আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মাতৃত্বের ছায়ায় নতুন নেতৃত্ব ?

I am great; tell it others রোডমার্চের পরের দিন সিলেটে চার দলের জনসভায় বিএনপি চেয়ারপার্সন নিজে প্রধানমন্ত্রী না হওয়ার ঘোষণা দেন। সিলেটের আলীয়া মাদ্রাসা মাঠে দেয়া খালেদা জিয়ার ভাষণটি ছিল- আগামী নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই হবে। নির্বাচনের পর দেশ পরিচালনার জন্য একটি সঠিক নীতিমালা তৈরি করে নতুনদের কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া হবে। তিনি আরও বলেছেন-‘আমি ও আমার দলে যারা সিনিয়র আছি, তারা সরকারকে (নতুনদের দ্বারা গঠিত) সহযোগিতা করবো, সাহায্য ও বুদ্ধি পরামর্শ দেব। নতুনরাই পারবে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে।

’ নতুনদের কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার প্রসঙ্গটি নিয়ে ইতোমধ্যে মানুষের মনে সন্দেহ দানা বেঁধে উঠেছে। কারণ সকলেই জানেন তিনি নতুন নেতৃত্ব বলতে তার ছেলে তারেক রহমান ও তার বিশ্বস্ত সহচর বাবর, গিয়াসুদ্দীন মামুন প্রমুখকে বুঝিয়েছেন। ‘নতুনদের নামে খালেদা জিয়া চোরতন্ত্র চান’- বলেছেন আওয়ামী লীগের মুখপাত্র মাহবুব-উল আলম হানিফ। (বিডিনিউজ২৪, ১৩-১০-১১) খালেদা জিয়া নতুন প্রজন্মের নাম করে তার দুর্নীতিবাজ দুই পুত্রকে ক্ষমতায় বসাতে চান। খালেদা জিয়া জরিমানা দিয়ে কালো টাকা সাদা করেছিলেন।

তার দুই ছেলে পিতার নামে অরফানেজ ট্রাস্ট করে এতিমদের জন্য বিদেশ থেকে পাওয়া টাকা আত্মসাৎ করেছেন। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এই দুর্নীতিবাজদের ক্ষমতায় বসানোর মাধ্যমে দেশে তিনি চোরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চান। মুদ্রাপাচার মামলায় খালেদার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোকে গত ২৩ জুন ছয় বছর কারাদণ্ড দেয় ঢাকার জজ আদালত। বড় ছেলে তারেক রহমানের বিরুদ্ধেও মুদ্রাপাচার মামলা বিচারাধীন। তারা দুজনই বর্তমানে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন।

আমরা জানি নতুন বলতে যাদের বোঝানো হয়েছে তারা আসলে গত জোট সরকারের আমলে নানান রকম অপকর্ম ও অপশাসনের মূল হোতা। এজন্য মাতৃত্বের কাছে নেতৃত্ব মার খাচ্ছে বলে আমাদের মনে হয়েছে। ২০০৮ সালে নির্বাচনে জয়ী হলে খালেদা জিয়া নিজে নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্রপতি হয়ে বড় ছেলেকে প্রধানমন্ত্রী পদে বসানোর কথা চিন্তা করেছিলেন। সেই সময় সিনিয়র নেতারা ভালো চোখে বিষয়টিকে দেখেন নি। কারণ তারেক জিয়া প্রধানমন্ত্রী হলে সিনিয়রদের কোনো অবস্থান থাকবে না এটা তারা ভালো করে বুঝেছিলেন।

উইকিলিকসের তথ্য মতে তারেক রহমানের অপকর্মে সিনিয়র নেতারা যে বিরক্ত ছিলেন তা প্রকাশ পেয়েছে। ১/১১-এর পরে কিছু নেতার সংস্কারপন্থী ভূমিকার পিছনে তারেকদের দুষ্কর্ম থেকে মুক্ত হওয়ার বাসনা সক্রিয় ছিল। এছাড়া বিএনপির শীর্ষ পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ কোন্দল তুঙ্গে। এ অবস্থায় নতুন নেতৃত্বের ঘোষণা সিনিয়র নেতাদের জন্য যেমন সুখবর নয় তেমনি আপামর দেশবাসীর জন্য অশনি সংকেত। কারণ প্রধানমন্ত্রী হলে তারেক জিয়া মূলত দেশ চালাবেন ছাত্রদল ও যুবদলের ক্যাডারদের দিয়ে।

দ্বিতীয় পর্বের রোড মার্চের বিভিন্ন ভাষণে খালেদা জিয়া দম্ভোক্তি করেছেন। স্বাধীনতা বিরোধী দলের সঙ্গে জোট বেঁধে বিএনপি আন্দোলন করে ক্ষমতায় যাবে এটাও হাস্যকর। কারণ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে এটা নিশ্চিত। এজন্য তত্ত্বাবধায়ক ইস্যু তাদের মূল নয় বরং স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিকে বাঁচানোর প্রচেষ্টা গোপনে লালন করে যাচ্ছে তারা। অন্যদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন হয়ে বিএনপি পরাজিত হলে পুনরায় দেশে যে তারা অরাজকতার সৃষ্টি করবে এটাও স্পষ্ট।

২. নেতৃত্বের ক্ষেত্রে ছাত্রদলেও শূন্যতা দেখা যাচ্ছে; সেই জায়গা দখল করেছে ছাত্রশিবির। আমানুল্লাহ আমান ও নাসিরউদ্দিন পিন্টুর মতো সাবেক ছাত্রদল নেতা দুর্নীতি এবং অন্যান্য অপরাধের দায়ে জেলে। অথচ ছাত্রদল পরিচালনা থেকে তারা নেতা হয়েছিলেন। পরবর্তীতে নির্বাচনে জয়ী হয়ে দুর্নীতিতে অভিষিক্ত হন আমান। আর পিন্টু বিডিআর বিদ্রোহে সম্পৃক্ত থেকে হত্যাকাণ্ডের আসামিতে পরিণত হয়েছেন।

তবে বিএনপির ঘাড়ে সওয়ার জামায়াত ইসলামীর সংগঠন ছাত্রশিবির আসল নেতৃত্ব কুক্ষিগত করে নিয়েছে। জিয়াউর রহমানের হাত ধরে যে মৌলবাদী সংগঠনের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ঘটেছিল তারই অনিবার্য কুফল পেলাম আমরা আশির দশক থেকে ছাত্রশিবিরের উত্থানে। স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াত শিবির মুক্তিযুদ্ধের আগে প্রচার করেছিল পাকিস্তান থাকলে ইসলাম থাকবে। আর ইসলামের নামে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট পরবর্তী মৌলবাদী সংগঠনগুলো ভর্তি পরীক্ষায় দুর্নীতির মাধ্যমে শিবির সমর্থিত অযোগ্য ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও পরবর্তী সময় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে তাদের মিশন কার্যকর করা শুরু করে। একাডেমিক কুকর্ম সম্পন্ন করার সঙ্গে সঙ্গে হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটায় জামায়াত-শিবির প্রতিক্রিয়াশীল শিক্ষক ও ছাত্র।

অনেক খুনী ছাত্র-শিবির কর্মী বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। অব্যাহত শিবিরের দখলদারিত্বে বিপর্যস্ত দেশের পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৮৬ সালে ছাত্র সমাজের সভাপতি হামিদের কব্জি কাটে শিবির ক্যাডাররা। ১৯৯৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুমন্ত ছাত্রদের ওপর আক্রমণ করে ছাত্রশিবির। ছাত্রনেতা জোবায়েদ নিহত হন।

একই বছর খুলনা বিএল কলেজের ছাত্রদলকর্মীকে জবাই করে হত্যা করে শিবির। সেসময় ২০ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদ অধিবেশনে বিএনপি সাংসদরা জামায়াত-শিবিরের কঠোর সমালোচনা করেন। মেজর হাফিজ, সাবেক আইন প্রতিমন্ত্রী ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, সাবেক হুইপ আশরাফ হোসেন প্রমুখ বলেন- পশ্চাদপদ, ঘৃণ্য, প্রগতিবিরোধী, আদর্শবিরোধী, গণতন্ত্রবিরোধী একটি সাম্প্রদায়িক রাজনীতি সভ্য দেশের আধুনিক সমাজে ও গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে চলতে পারে না। জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের দাবিও ওঠে। স্বাধীন দেশে রগ কাটার রাজনীতি চলতে পারে না বলেও বিএনপি নেতারা মন্তব্য করেন।

কিন্তু এর পরই আবার ১৯৯৪ সালে ২৯ অক্টোবরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদল নেতা মুছাকে হত্যা করে ছাত্র শিবির। ২২/৯/২০০৪ সালের একটি সংবাদ থেকে দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদল নেতাকর্মী ব্যাপকভাবে জামায়াতিকরণের অভিযোগে চবি উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি করছে। ২০/৯/০৪ তারিখে ‘যুক্তরাষ্ট্রের কালো তালিকায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়’ শীর্ষক একটি দৈনিকে ছাত্র শিবিরের সঙ্গে আল কায়দা বা হামাসের সম্পর্ক খতিয়ে দেখার বিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়। আজকের কাগজে’র এই সংবাদটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ও শিক্ষকমণ্ডলীর মধ্যে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করে। এক হিসেবে ২০০০ থেকে ২০১০ এর শুরুতে(৯বছরে) সারাদেশে ছাত্র শিবির ১০০ হিংসাত্মক ঘটনায় খুন করেছে ৫০জনকে।

(কালের কণ্ঠ, ১০/২/১০) এসব ছাত্র খুনের ঘটনায় কারো কোন শাস্তি হয় নি। তদন্ত কমিটির রিপোর্টগুলো হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটনে ব্যর্থ হয়েছে। অর্থাৎ ফ্যাসিস্ট চক্রের কাছে ছাত্রদল জিম্মি। ছাত্রশিবির যখন আওয়ামী লীগকে ভারতের দালাল বলে তখন ছাত্রদলও সুর মিলিয়ে সেসব কথা বলা শুরু করে। জামায়াতও তার সুর পাল্টেছে ক্ষমতায় বসেছে, সংসদে গিয়েছে।

যদিও মওদুদীরা মনে করেন ভোট দেওয়া, সংসদে যাওয়া হারাম। মওদুদী প্রচারিত ইসলামী আদর্শের পরিপন্থী কাজ করতে তাদের বাঁধেনি। দেখা যাচ্ছে ছাত্রদল যেমন শিবিরের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত তেমনি বিএনপি স্বাধীনতা বিরোধীদের কাছে জিম্মি। তাহলে বিএনপির নতুন নেতৃত্ব প্রসঙ্গটি একটি জটিল রাজনৈতিক প্রপঞ্চ। ৩. সম্প্রতি উইকিলিকস খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান এবং তাঁদের সঙ্গে সম্পর্কিত নানান বিষয়ে তথ্য প্রকাশ করেছে।

তারেক রহমান জিয়ার নটরিয়াস জ্যেষ্ঠপুত্র এবং রাজনৈতিক উত্তরাধিকার। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোটের বিজয়ী হওয়ার কৃতিত্ব তার বলে মনে করা হয়। তাকে অনেকে বলে থাকেন দুর্নীতিবাজ, রাজনীতি ও ব্যবসায়ী ক্ষেত্রে অনভিজ্ঞ, অর্ধ শিক্ষিত ও দুর্বিনীত। আবার কেউ কেউ তাকে ডায়নামিক, স্মার্ট ও নতুন প্রজন্মের নেতা হিসেবে বিবেচনা করেন। তিনি বিএনপির সিনিয়র পদে অভিষিক্ত হওয়ায় তার মা খালেদা জিয়া অধিকতর নিরাপদ অনুভব করেন।

যদিও তারেক হাওয়া ভবন খ্যাত ছায়া সরকারের কর্মকাণ্ডের মূল হোতা ছিলেন। উইকিলিকস রিপোর্টে মার্কিন তারাবার্তায় ভবিষ্যতে খালেদা জিয়া তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন কিনা তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করা হয়। পুত্রের গুণাবলি ও যোগ্যতা এবং মাতার প্রশ্রয় সম্পর্কে উইকিলিকস সূত্রে আমরা জানতে পেরেছি, খালেদা জিয়া কেবল নিজের সন্তান তারেক-কোকোকে নিয়ে ক্ষমতার কেন্দ্র গড়ে তোলেন। একজন মা হয়ে তার পুত্রের সুখকর ভবিষ্যৎ রচনার জন্য অন্যায়, অনিয়ম, দুর্নীতি করেছেন; রাষ্ট্রীয় প্রশাসন যন্ত্রকে ব্যবহার করেছেন নির্বিচারে। মা খালেদার পুত্রের অপকীর্তিকে প্রশ্রয় দেবার কারণে আজকে সংবাদ প্রকাশিত হয়- ‘কোকো মালয়েশিয়ায়, শ্রমিক বানিয়ে পার্সপোর্ট নবায়ন।

’ পৈতৃকসূত্রে প্রাপ্ত একটি স্যুটকেস ও ছেঁড়া গেঞ্জির চমক দেখাতে গিয়ে সন্তানরা দুর্নীতির চোরাগুপ্তাপথ বেছে নিলে তাদেরকে নিষেধ করেন নি তিনি? পুত্রের প্রতি অনায্য পক্ষপাত বর্তমানেও প্রকাশ পাচ্ছে বলে আমাদের ধারণা। মাত্রাতিরিক্ত মাতৃদরদে আরাফাত রহমান প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী আর তারেক রহমান প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের রাজনীতিতে। মার্কিন দূতাবাসের তারবার্তার বরাত দিয়ে উইকিলিকস আরো জানিয়েছে দুর্নীতি মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত তারেককে জামিনে মুক্তি দিয়ে চিকিৎসার জন্য ২০০৮-এর ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাজ্যে পাঠানো হয়েছে। তাকে বাংলাদেশের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিক ভাবা হয়। এই তারেকই এরশাদকে হুমকি দিয়েছিলেন।

এরশাদ আওয়ামী লীগের মহাজোটে গেলে তাকে আবারও কারাগারে পাঠানো হবে বলা হয়েছিল। ২০০৬ সালের ১৮ জুলাই এই তারবার্তাটি ঢাকা থেকে ওয়াশিংটন পাঠানো হয়। ২০০৮ সালের ২১ ডিসেম্বর ঢাকার মার্কিন দূতাবাস থেকে ওয়াশিংটনে পাঠানো তারবার্তায় আরো বলা হয় তারেক রহমান কুখ্যাত লোকদের পছন্দ করেন। ২০০৯ সালের ১৪ মে অন্য একটি তারবার্তায় বিএনপিতে খালেদা জিয়ার একচ্ছত্র আধিপত্য থাকায় জ্যেষ্ঠ পুত্র তার স্বাভাবিক উত্তরসূরিতে পরিণত হয়েছেন বলা হয়। এছাড়া উইকিলিকসে খালেদার আস্থাভাজন ও প্রভাবশালী যে ১৭ ব্যক্তির নাম প্রকাশ করা হয় তার মধ্যে ১২ জনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল বলে মন্তব্য পাওয়া যায়।

এর মধ্যে মতিউর রহমান নিজামী মার্কিন সরকারের প্রতি বৈরি মনোভাব প্রকাশ করেন। ২০০৫ সালের ১১ মে রাষ্ট্রদূত হ্যারি কে টমাস পাঠানো নথিতে দেখা যায় কাছের ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা হলেন- তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরী, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, সাঈদ এস্কান্দার, লুৎফুজ্জামান বাবর, কামালউদ্দিন সিদ্দিকী, এম সাইফুর রহমান, খন্দকার মোশাররফ হোসেন। অতীতের এসব ক্ষমতাধর কেউই নতুন প্রজন্মের নেতা হওয়ার যোগ্যতা রাখেন না। কারণ তাদের সকলের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ রয়েছে। এমনকি বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিএনপির বিরুদ্ধে দুর্নীতির ভূরি ভূরি অভিযোগের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছে শরিক দল জামায়াত ইসলামীর শীর্ষ নেতৃত্ব বিস্ময় প্রকাশ করেছিল।

অথচ উইকিলিকসের তথ্য মতে তারেক, জামায়াত ও জেএমবি একসূত্রে জঙ্গি কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত। অর্থাৎ জোট সরকারের আমলে বিএনপি রক্ষা করছিল জেএমবিকে এ সংবাদও উইকিলিকসের ২০০৫ সালের ১৪ ডিসেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. কামাল সিদ্দিকীর জবানিতে আমরা জানতে পেরেছি। ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের সাবেক শার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্সকে তিনি জানিয়েছিলেন, তারেক রহমান, জামায়াত ইসলামী, জেএমবি পরস্পর সম্পর্কে জড়িত। তারেক রহমান ভূমি প্রতিমন্ত্রী রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর অনুরোধে গ্রেফতারকৃত জেএমবি প্রধান বাংলা ভাইয়ের ডেপুটি কামরুলকে ছেড়ে দিতে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাবরকে বাধ্য করেছিলেন। হাওয়া ভবনে তারেকের কতিপয় বিকারগ্রস্ত বন্ধু রয়েছে তাদের কথা তারেক গুরুত্ব দিয়ে শোনে এবং সে মতো কাজ করে- এ অভিযোগ ছিল প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের।

৪. ১৯৯১ সালে নির্বাচনের পরে তারেক ও কোকো অবৈধ পন্থায় ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রতিষ্ঠিত হন। আর ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার গঠনের পর তারেক রহমানের হাতে বিএনপির নেতৃত্ব কুক্ষিগত হলে রাজনৈতিক বাণিজ্য তথা দুর্নীতির বদৌলতে নেতাকর্মীরা লাখ লাখ ছাড়িয়ে শত কোটি টাকার মালিক বনে যান। এসময় হাওয়া ভবন ধীরে ধীরে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, বাণিজ্য সবকিছু নিয়ন্ত্রণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে; সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতাধর হয়ে উঠতে থাকেন তারেক রহমানের সহযোগীরা। তার বন্ধু ও ব্যবসায়িক পার্টনার গিয়াসউদ্দিন মামুন ঢাকার এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী থেকে হয়ে ওঠেন দেশের নৌ-বাণিজ্য, গার্মেন্টস, মিডিয়াসহ নানা রকম ব্যবসার মালিক। আর দেশের প্রশাসন, পুলিশসহ সর্বত্র পোস্টিং, পদোন্নতির সব মন্ত্রণালয়ের টেন্ডার, প্রজেক্ট সবকিছুর নিয়ন্ত্রক বনে যায় হাওয়া ভবন।

তারেকের কর্মকাণ্ডের জন্য প্রবীণ নেতাদের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। খালেদা জিয়া পুত্রের কর্মকাণ্ড নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। পূর্বেই বলা হয়েছে মায়ের প্রশ্রয়ে তারেক রহমান চালাতে থাকেন বিকল্প সরকার। বিএনপির বিদ্রোহী নেতা কর্নেল অলি আহমদ বেগম জিয়ার বাসায় গিয়ে ২০০২ সালে তারেক রহমানকে নিয়ন্ত্রণের জন্য বললে খালেদা জিয়া তাঁর ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে বলেছিলেন- ‘জিয়া পরিবারকে বাদ দিয়ে এদেশে কোনো রাজনীতি হবে না। ’ এভাবে রাজনৈতিক উত্তরাধিকার বিবেচনা প্রাধান্য পাওয়ায় জোট আমলে তারেক-মামুনের হাওয়া ভবনের দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়ন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।

বিএনপির ক্ষমতাধর (প্রয়াত) মন্ত্রী সাইফুর রহমান, শাহজাহান সিরাজ, ইকবাল হাসান মাহমুদ, বাবর, বাংলা ভাই থেকে শুরু করে পাতি নেতাদের বংশধররা সদম্ভে এই রাজনৈতিক বাণিজ্যের অংশিদারিত্বে পরিণত হন। এমনকি জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতাদের একজন কর্নেল(অব.) আকবর হোসেন নৌপরিবহণ মন্ত্রী থাকাকালে নৌযান পরিচালনায় শৃঙ্খলা আনতে গিয়ে মামুনের বিরোধিতা করায় হাওয়া ভবনের ধমকে উপলব্ধি করেছিলেন এটা জিয়ার বিএনপি নয় তারেক জিয়ার বিএনপি। তিনি শেষ পর্যন্ত মামুন গংদের দুর্নীতির সাগরে নিমজ্জিত হন। দেখা যাচ্ছে তারেক রহমান প্রবীণ নেতাদেরও নিজের দাপটে কাবু করে দুর্নীতিগ্রস্ত করেছেন। তাহলে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের প্রসঙ্গ এলে তারেক কীভাবে গ্রহণযোগ্য হবেন? পৃথিবীর অনেকে দেশেই উত্তরাধিকারের রাজনীতি রয়েছে।

ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাতেও। ভারতে নেহেরু পরিবারের ইন্দিরা গান্ধী থেকে শুরু করে সঞ্চয় গান্ধী, রাজীব গান্ধী পেরিয়ে রাহুল-প্রিয়াঙ্কার উত্তরাধিকার চলছে। তবে কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী ক্ষমতার আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। নিজের ছেলে রাহুলকে রাজনীতির পথে ধীরে ধীরে তৈরি করে তুলছেন। পক্ষান্তরে অনভিজ্ঞ, অদূরদর্শী, অপরিপক্ব উইকিলিকসের ভাষায় অর্ধশিক্ষিত তারেক জিয়াকে এক লাফে ক্ষমতার শীর্ষে উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

ফলে বিএনপির নতুন নেতানেত্রী এখন দুর্নীতির মহানায়ক-নায়িকা। মৌলবাদী জামায়াতের সহায়তায় দলটি নির্বাচনে জয়ী হলেও প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি এবং দলের দ্বিতীয় জন হওয়ার মতো কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিত্ব নেই। খালেদা জিয়াকে মনে রাখতে হবে বর্তমান বিশ্ব পাল্টে গেছে। দেশের রাজনীতি সম্পর্কে আম জনতা সচেতন। প্রতিবেশী দেশসহ বিশ্বের অনেক দেশই বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরস্থিতি ও নেতৃত্ব নিয়ে চিন্তা ভাবনা করছে।

তারেক ও তার বন্ধু মামুন, সহচর বাবর, মিলন, মিল্লাত কিংবা হাওয়া ভবনের আশিক, অপুদের চাইতেও দেশের জনগণ যে শক্তিশালী তা কি খালেদা জিয়া গত নির্বাচনে টের পান নি? যদি সেখান থেকে শিক্ষা পেয়ে থাকেন তাহলে নতুন নেতৃত্বের ক্ষেত্রে সততাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না কেন? পরিশ্রমী, সৎ ও মেধাবীরাই হতে পারেন বিএনপির আগামী নেতৃত্ব। ১৯৮১ সালের ৩০ মে নিহত হবার পরে একজন রাষ্ট্রপতির উল্লেখযোগ্য সম্পদের মধ্যে জিয়ার পুরানো স্লিপিং স্যুট, ছেঁড়া গেঞ্জি, ভাঙা স্যুটকেস পাওয়া গেলে তাঁর সততা প্রশ্নবিদ্ধ হয় নি। যদিও জিয়া রাষ্ট্রপতি হবার পরে জামায়াত-শিবিরকে পৃষ্ঠপোষকতা করে, ঋণখেলাপির কালচারের প্রচলন ঘটিয়ে, দেশের মধ্যে স্বাধীনতা বিরোধীদের দিয়ে মাস্তানতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন তবে তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ছিল সহজ-সরল। সেই সততার মতো মূল্যবান সম্পদটি হাতছাড়া হয়ে গেছে বিএনপির নেতাদের ভেতর থেকে। এজন্য খালেদা জিয়াকে নতুন নেতৃত্ব নিয়ে আরো ভাবতে হবে।

আমরা জানি আগামী নির্বাচনে দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের মামলায় অপরাধী কেউ অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। ফলে অনেকের রাজনৈতিক নেতৃত্ব শেষ হয়ে যাবে। মানুষ বুঝতে পেরেছে খালেদা জিয়া পুরানো পদ্ধতিতে ফিরে তারেকের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন। কিন্তু আমরা কেউ সেই নতুন নেতৃত্ব মেনে নিতে চাই না। রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী হিসেবে নিজের পুত্রের দিকে ইঙ্গিত করে কথা বললে তা হবে আত্মঘাতী এটা মনে রাখতে হবে বিএনপির নেত্রীকে।

বরং উইকিলিকসে প্রকাশিত বিএনপির নেতৃত্ব সম্পর্কে তারেকের মন্তব্য গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা দরকার। তিনি বলেছিলেন- ‘কেউই অপরিহার্য নন। কোনো স্থান শূন্য হলে কেউ না কেউ এগিয়ে আসে। ’ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।