আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আঁধারের গায়ে পরশ তব...

চিত্ত যেথা ভয়শূন্য সকালের নরম রোদ্দুর গায়ে মেখে সন্ন্যাসী দরজায় এসে দাঁড়ালেন। দরজার কপাট খুললেন ধীরে ধীরে। তার শরীরের ফাঁক গলে চুইয়ে চুইয়ে পড়ল সকালের আলো। অভ্যস্ত ছন্দে পায়ে পায়ে তিনি এগিয়ে এলেন। কালো মেঝেতে বিছিয়ে থাকা ধুলোর মিহিদানায় তার নগ্ন পা অপরূপ আলপনা এঁকে এঁকে চলল।

তিনি দাঁড়ালেন ধীরে ধীরে, চোখ বুলালেন চারদিকে। দুপাশের সারি সারি বিছানায় শুয়ে মাঝে জরাক্লিষ্ট হাড্ডিসার অসহায় মানুষেরা। শুয়ে আছে শিশুর মতো কুঁকড়ে, শুয়ে আছে তীব্র যন্ত্রণাকে সঙ্গী করে। ওদের কেউ নেই, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব। কেউ কোথাও নেই।

সকলেই এক এক করে ত্যাগ করেছে তাদের। তিনি তাকালেন, যন্ত্রণায় কুঁকড়ে আসা, ভয়ানক দুর্বল এক অসহায় মানুষের দিকে। সন্ন্যাসীকে সম্ভাষণের শক্তিও লোকটির অবশেষ নেই। তিনি এলেন। স্পর্শ করলেন লোকটির শরীরে, হাত-মুখে, কপালে-গভীর মমতায়।

এরপর কয়টি দীর্ঘশ্বাস ফেলে লোকটি ঢলে পড়ল সন্ন্যাসীর দু হাতের ওপর। মুখে প্রশান্তির হাসি। হয়তো এই পুণ্য পরশের জন্যই এতক্ষণ প্রাণান্ত চেষ্টা করে বেঁচে ছিল লোকটি। অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি পাস করা ইঞ্জিনিয়ার ‘ফিরা অ্যালংকটের’ সামনের দিনগুলো ছিল সূর্যের মতো ঝলমলে। ব্যাংকে উঁচু বেতনের ঠিকঠাক চাকরি আর বাগদত্তার কাছে ফেরার জন্য সব প্রস্তুতি যখন শেষ করে এনেছে সে সময়ই সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেল।

খবর এলো তার বাগদত্তা অপেক্ষার পালা চুকিয়ে বিয়ে করে ফেলেছে আরেকজনকে। মানসিকভাবে বিধ্বস্ত আর বিপর্যস্ত ফিরার জীবন ডুবে যেতে থাকল বেহিসেবি মদ্যপানে। তখনই এক আত্মীয়ের হস্তক্ষেপে ফিরাকে ঢুকিয়ে দেয়া হয় এক বৌদ্ধ আশ্রমে। ফিরার প্রথম কয়েক সপ্তাহ কাটল প্রচণ্ড অস্থিরতায়। এরপর তিনি পড়তে শুরু করলেন বৌদ্ধধর্ম ও দর্শনের অপরূপ মর্মবাণী।

আত্মস্থ করলেন। ফিরা বেছে নিলেন নির্লোভ শান্তিময় তপস্বীর জীবন। তিন মাস পরে নির্বাণ। ফিরা ধারণ করলেন বৌদ্ধ তাপসের গাঢ় বাদামি পোশাক। প্রশান্ত ত্যাগের জীবন।

অনন্ত ভালোবাসার জীবন। বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি। ইন্ট্রাভেনাস ড্রাগের যথেচ্ছ ব্যবহার আর বর্ধিষ্ণু সেক্স ইন্ডাস্ট্রি একসঙ্গে মিলে থাইল্যান্ডের এইডস পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। এর কোনো চিকিৎসা নেই। পরিণামে যন্ত্রণাদায়ক অনিবার্য মৃত্যু।

যদিও স্বাভাবিক সংসপর্শে এইডস ছড়ায় না কিন্তু এইডস রোগীরা বাস্তবে হয়ে পড়ে অসপৃশ্য। নিছক আগ্রহ থেকেই ১৯৯১ সালের কোনো এক বিবর্ণ বিকেলে ফিরা ব্যাংককের এক হাসপাতালে এইডস রোগীদের দেখতে গেলেন। মন দিয়ে শুনলেন তাদের বেদনার কথা। কেউ তা শোনে না। এর পরদিন আরো বেশি সময় দিলেন ফিরা।

রোগীদের শীর্ণ হাতগুলো নিলেন নিজের মুঠোয়। গভীর মমতায় সপর্শ করলেন অসপৃশ্য শরীর। তখন থেকেই ফিরা হয়ে উঠলেন হাসপাতালের নিয়মিত ভিজিটর। এরপর ফিরা শুরু করলেন এক টুকরো কাপড় ভিজিয়ে ভিজিয়ে রোগীদের শরীর পরিষ্কার করে দেয়ার কাজ। অপার ভালো লাগায় ভরে যেত অসপৃশ্য মানুষগুলোর মন।

একদিন হঠাৎ ফিরা হাসপাতালে আসতে পারলেন না। অসহ্য-অস্থির প্রতীক্ষায় রইল একদল শীর্ণ-অসহায় মানুষ। দিন গড়িয়ে রাত্রি এলো, আবার সকাল। ভোরের প্রথম আলোর সঙ্গে ওয়ার্ডে ঢুকলেন ফিরা। আশা আর আনন্দের মিলিত উল্লাসে কেঁদে ফেলল সবাই।

কয়েকজন সমস্ত শক্তি এক করে বিছানা থেকে ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে নেমে ফিরার পা জড়িয়ে ধরল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল- ‘আমরা ভেবেছিলাম সবার মতো আপনিও বুঝি আমাদের ত্যাগ করেছেন। এর মধ্যে তিনজন মারা গেছে। সকলেই বারবার আপনার কথা বলছে। ’ ফিরার দু চোখ বেয়ে জল নেমে এলো।

অকস্মাৎ তিনি উপলব্ধি করলেন এই মানুষগুলোর কাছে তিনি কত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন। ফিরা এই মানুষগুলোকে সম্মানের সঙ্গে বাঁচানোর সংকল্প করলেন। যখন ফিরা প্রথম এইডস রোগীকে তার বৌদ্ধ আশ্রমে নিয়ে এলেন সেটা ছিল ১৯৯২-এর সেপ্টেম্বর মাস। ফিরার সতীর্থরা হইচই করে উঠল। এইডস রোগীদের সেবা করা আমাদের দায়িত্ব নয়।

সন্ন্যাসীরা নেতা, সমাজের কর্মী নন। ফিরা দমলেন না। এ তো সেই কুসংস্কারের প্রতিধ্বনি। তিনি বুঝলেন এখনই সময়, আশ্রমবাসীদের নেতৃত্ব দেয়ার, জনগণকে শিক্ষা দেয়ার। শান্তভাবে ফিরা সতীর্থদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলেন।

আকুলভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। আপনারা যদি সামান্য কিছু সতর্কতা নেন তবে এইডস আক্রান্ত হওয়ার বিন্দুমাত্র আশঙ্কা নেই। অনেকটা বেদনার সঙ্গে দেখলেন তার সব সতীর্থ রাতের আঁধারে পালিয়ে গেল। হঠাৎ বিরাট এক দায়িত্ব এসে পড়লে একা ফিরার কাঁধে। একাই সব কাজ করলেন ফিরা।

তিনি হয়ে উঠলেন একই সঙ্গে ডাক্তার, নার্স, বাবুর্চি, ঝাড়ুদার, দারোয়ান সবকিছু। ধীরে ধীরে মালিশ করে দিতেন রোগীদের অসাড় হাত-পা। দগদগে ঘায়ে মলম লাগিয়ে দিতেন পরম মমতায়। দিনের পর দিন চলত একই রুটিন। ধীরে ধীরে এসে জুটল আরো কয়েকজন সাহসী হৃদয়বান স্বেচ্ছাসেবী।

কিন্তু স্থানীয় লোকেরা বেঁকে বসল ভয়ানকভাবে। তারা ফিরার কাছে খাবার-দাবার বিক্রি করা বন্ধ করে দিল। ছয় মাইল দূর থেকে হেঁটে হেঁটে ফিরাকে খাবার কিনে আনতে হতো। এমনকি লোকাল বাসের ড্রাইভাররাও ফিরাকে বাসে উঠতে দিত না। বাধ্য হয়ে ফিরাকে হাঁটতে হতো দীর্ঘ পথ।

বড় কষ্ট এই পথচলা। মনে জোর আনতেন এই ভেবে যে, এ অবস্থা থাকবে না। হয়তো এক মাস-এক বছর-নয়তো এক যুগ পরে নিশ্চয়ই ঠিকঠাক হয়ে যাবে সবকিছু। আশ্রমের কথা ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগল না। চারদিক থেকে আসতে লাগল রোগীরা।

হয়তো আজকের উজ্জ্বল বিকেলে কোনো শীর্ণ যুবতী তার ঢিলেঢালা বেসবল ক্যাপ মাথায় আটকে আরেক মধ্যবয়সী রোগীর সাথে আশ্রমের সবুজ ভলিবল কোর্টে খেলার চেষ্টা করছে। পেছনে একটা পোর্টেবল স্টেরিওতে বাজছে সত্তর দশকের জনপ্রিয় গান। হোয়ারস ইয়োর মামা গান, হোয়ারস ইয়োর পাপপা গান, ফার ফার অ্যাওয়ে। বেদনার সঙ্গে মেলে বেদনার। আর্তনাদের সঙ্গে আর্তির।

ফিরার কথা বৃথা যায়নি। আশ্রমটি দাঁড়িয়ে গেছে। এইডস রোগীদের আশা আর ভরসার কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। তারা জানে সমাজ-সংসার ত্যাগ করলেও ফিরার আশ্রমে রয়েছে প্রশান্ত আবাস। অবসর পেলে ফিরা তার চৌকোনা টেবিলে নিয়ে বসেন তার সংগ্রহ।

আশ্রমের জীবিত এবং মৃত এইডস রোগীদের ছবি। পুণ্যসপর্শে প্রার্থনা করেন তাদের জন্য। ফিরাকে কিছু জিজ্ঞেস করলে স্মিত হেসে বলেন-‘আমার প্রত্যাশা একটাই; সমাজ এদের মমতার দৃষ্টিতে দেখুক। ’ আশ্রমে রোগীদের জন্মদিন পালন করা হয় কেক কেটে। সবার সঙ্গে ফিরা কণ্ঠ মেলান ‘হ্যাপি বার্থডে টু ইউ’।

সবাইকে নিজের হাতে কেক বিলিয়ে রাতের সব কাজ করে একটু বিশ্রামের জন্য রওনা হন ফিরা। পিচকালো অন্ধকারে পথ চলেন। হঠাৎ লজ্জা ভুলে মেঘের ঘোমটা সরিয়ে দেয় চাঁদ। ধবধবে জ্যোৎস্নায় ভেসে যায় চারদিক। ফিরা পথ চলেন।

ক্লান্ত-অবসন্ন। রোগীদের ওয়ার্ড থেকে ভেসে আসে পোর্টেবল স্টেরিওতে সত্তর দশকের জনপ্রিয় গান। হোয়ারস ইয়োর মামা গান, হোয়ারস ইয়োর পাপা গান, ফার ফার অ্যাওয়েঃ বেদনার করুণ আর্তি ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে। ক্লান্ত-অবসন্ন ফিরা একাকী পথ চলেন। তার পথ কিছুতেই শেষ হয় না...।

(৯০ এর দশকে আজকের কাগজে প্রকাশিত এই লেখাটি পরবর্তীতে "বালাই ষাট" বইয়ে সংকলিত হয়েছে) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।