আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রোকসানা- একটি অমর প্রেমের গল্প

একটি বানানভুলসর্বস্ব ব্লগ কথাটা ঠিক কখন উঠলো তা খুঁজে পাওয়া মুশকিল। আমাদেরা আর সব ক্ষণস্থায়ী পরিকল্পনার মতই ফানুসের মত জন্ম নেয়া এই পরিকল্পনার সফলতা সম্পর্কে আমার সন্দেহ ছিল সুনিশ্চিত। পথে চাকা গড়ানোর আগ পর্যন্ত আমি বিশ্বাস করতে রাজি ছিলাম না যে কোনোভাবে আমরা এই ক্ষণিকের খেয়ালকে বাস্তবে রূপ দিতে পারবো। পরিকল্পনাটা যে খুব বেশী রকমের আহামরি তা নয়, তবে আহামরি বটে। আর সব গাণিতিক সমস্যার মত এর বাস্তব রূপায়নে অনিয়ত উৎপাদকের সংখ্যা ছিল অনেক, তার একটি হল ঘুমকাতুরে উৎপাদকগুলোকে ঠিক সময়ে কাজে লাগানো- সোজা ভাষায় রিজওয়ান, মানিক, সাকিব আর হাসানকে ভোর দশটায় ঘুম থেকে তোলা।

রোজার মাসে শেষ রাতে সেহেরী খেয়ে দশটায় ঘুম থেকে উঠা রীতিমত একটি চ্যালেঞ্জ, বিশেষ করে আরেক মিল্কিওয়ের আরেক পৃথিবীর সময় অনুযায়ী বসবাসরত এই চার এলিয়েনের জন্য আমাদের পৃথিবীর বেলা দশটা তাদের গ্রহের শুকতারা দেখার সময়ই বটে। যথারীতি সাকিব তার সময়জ্ঞানের সন্মান রাখলো- শেষ যাত্রী হিসেবে আমাকে নেয়ার সময় ছিল সকাল সাড়ে দশটা, পৌণে এগারোটায় তার না আসা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে আমি বাসার ছোটখাটো কাজে মনোনিবেশ করলাম। এরপর শোয়া এগারোটায় আমাকে বার্তা পাঠালো তৈরী হবার জন্য, দশ মিনিটের মধ্যে তারা আমাকে নিতে আসবে। ছয়জন যুবককে নিয়ে ছয় চাকার দুই বাহন রাস্তায় গড়ায়, মাথা প্রতি একটি করে চাকা পড়লেও যোগ্যতা অনুযায়ী সাকিব আর আরিফ তা ভাগ করে নিয়ে বাকিদের মাথার উপর থাকে চাপগুলো নিজেদের মাথায় স্থানানতরিত করে- আরিফ তার নিজের দুই চাকা আর সাকিব তার পিতার চার চাকাতে আমাদের নিয়ে চাপাইনবাবগঞ্জ বিশ্বরোড অভিমুখে রওনা দেয়। দুইজনেরই তাদের স্বীয় বাহনে এই প্রথম লম্বা রাস্তা পাড়ি দেয়ার প্রচেষ্টা।

চার চাকা বেশী নিরাপদ বলে আমি সাকিবের পাশের আসনে অভীষ্ট হই। আমাদের পিছনের বাকি দুইটি আসনে হাসান ও রিজওয়ান। অপরপক্ষে আরিফের সঙ্গী হয় আমাদের সুপ্রিয় মানিক ভাই ( আশা করি মানিক ভাইকে আপনারা চিনতে পেরেছেন)। রাজশাহী-চাপাই নবাবগঞ্জ হাইওয়ে। মসৃণ সরু রাস্তা গাছের ছায়ায় একে-বেঁকে পশ্চিমে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত।

ভারবাহী ট্রাক আর যাত্রীবাহী বাসের পাশাপাশি ছোট ছোট আরো অসংখ্য বাহনের অবিচল আগাগোনা ছিল বিশেষভাবে লক্ষণীয়। হাতে অনেক সময় থাকায় আমরা খুবই পরিমিত গতিতে গন্তব্য অভিমুখে এগোতে থাকি। মাথার উপরের ছাদ আমাদের শুচিবায়ুগ্রস্ত ব্রাহ্মনের মত সূর্যের প্রখর ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলতে সাহায্য করছিল। বাকি দুই ব্রাহ্মণের সেই সুবিধা ছিলোনা, কিছুক্ষণ পরই মানিক সূর্যের তাপে অতিষ্ট হয়ে রাস্তার পাশের বিমোহিতকর বিল দেখে যাকাতের ফকিরের মত একটা লুঙ্গি আর গামছার জন্য রীতিমত হাহাকার শুরু করে দিল। যদিও মানিকের মতে বিলের টলটলে পানিই তাকে গোসলের জন্য আহ্বান জানাচ্ছিল, তার রোদে ঘর্মাক্ত বদন নয়, তবুও ৫-১ ভোটে পরাজিত মানিককে আমাদের বক্তব্যটাই মেনে নিতে হয়েছিল।

মানিকের দাবি যে একেবারে ফেলে দেয়া হয়েছিল তা কিন্তু নয়, বিভিন্ন ভঙ্গিতে গোটাকয়েক ছবি তুলে মনোমুগ্ধকর বিলকে আমরা আমাদের ভ্রমণের সাথী করে নিলাম। গোদাগাড়ির কামারপাড়ায় আমরা রিজওয়ানকে হারালাম। নানীর বাসায় যাওয়ার জন্য রিজওয়ান আমাদের ভ্রমণের বাকি অংশে আর শরীক হতে পারলোনা। মানিক দুই চাকা থেকে নেমে চার চাকার যাত্রী হলো আর তার স্থলাভিষিক্ত হল হাসান। নবাবগঞ্জ বিশ্বরোড আর বেশী দূরে ছিলোনা।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা আমাদের ব্যবসায়ী বন্ধু মুসলেহ-এর মার্কেটের সামনে উপস্থিত হলাম। জুমাতুল বিদা। কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে মুসলেহ, হাসান আর সাকিব চলে গেলো জুম্মার নামাজ পড়তে। নামাজ পড়ে এসে আমরা চার বেরোজদার গেলাম খাসির মাংস দিয়ে ভরপেট খানা খেতে (আশা করি কেউ রোজা রাখার সময় লেখাটা পড়ছেন না)। খেয়ে আমরা রওনা দিলাম চাপাই নবাবগঞ্জের সোনা মসজিদ অভিমুখে।

এ পর্বে দুই চাকার চালক হাসান ও তার সঙ্গী হল মুসলেহ। কিছুদূর যাওয়ার পর আমরা পৌছালাম মহানন্দা নদীর উপর। ব্রীজে উঠে আমি স্মৃতিকাতর না হয়ে পারলাম না। ব্রীজের কাছেই আমার নানুবাড়ি হওয়ায় শৈশবে এখানে আমার আনাগোনা ছিলো নিয়মিত। শৈশবে সন্ধ্যার আলোতে আলোকিত মনোরম ব্রীজ দুপুরের খাড়া রোদে দেখতে না পেলেও তৃপ্তির এক ফোঁটা কমতি হয়না।

ব্রীজের আড়াআড়িভাবে দুই দিকে বিস্তৃত নদীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে কতগুলো ছবি তুলে আমরা পুণরায় আমাদের যাত্রা শুরু করলাম। আমাদের মধ্যে দুই চাকার চালক ছিল তিনজন, তাদের মধ্যে দুইজন ভাগাভাগি করে চালানোতে ৬৫ কি.মি. রাস্তা চালাতে তাদের তেমন কোনো বেগ পেতে হয়নি। সমস্যা ছিল চার চাকা পরিচালনায়, কারণ তা একমাত্র সাকিবই চালাতে পারতো। আমাদের সাহায্য করার ইচ্ছা থাকলেও উপায় ছিলোনা। রাজশাহী থেকে একটানা চালাতে চালাতে এক সময় এসে সাকিবের ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটে।

আগুনে ঘি ঢালার মত করে সোনা মসজিদের কিছুদূর আগে এক বাজারে ভ্যানের জ্যাম সাকিবের মাথায় আগুন ধরিয়ে দেয়। লোহা দিয়ে লোহা কাঁটার মত করে ধোঁয়া দিয়ে সেই আগুন কোনোভাবে ঠান্ডা করে আমরা সোনা মসজিদ পৌছাই। কলিযুগে মানুষের সময় কম, তার সাথে দিন দিন কমে যাচ্ছে পড়ার ধৈর্য্য। ছোটবেলা থেকে কমন পড়ে পড়ে অভ্যস্ত মানুষ একাডেমিক পড়ার বাইরে কিছু পড়তে চায় না, নতুন কিছু জানতেও চায় না। সুতরাং সোনা মসজিদের ঐতিহাসিক ইতিবৃত্ত বলে পাঠকের চক্ষুশুল হতে চাই না।

শুধু একটি সাধারণ জ্ঞানের তথ্য দিয়ে যাই- মসজিদের পাশে আমাদের দেশের একজন বীরশ্রেষ্ঠের কবর আছে। সোনা মসজিদ থেকে আমরা যাই ৫০০ মিটার ভিতরে অবস্থিত তাহখানায় । জায়গাটার দ্বৈত তাৎপর্যপূর্ণ- আরাকান রাজ শাহ সুজার বাগানবাড়ি ও নিয়ামতউল্লাহ (রঃ) –এর মাজার। ভিতরে ঢুকেই ডানে শাহ সুজার ছোট একটি বাগানবাড়ি মধ্যযুগের এই স্থাপত্য লোকালয় থেকে দূরে হবার কারণে এখন টিকে আছে। বাড়ির ভিতরে তিনটি ঘর, একটি বারান্দা এবং যেটা সবচেয়ে আকর্ষনীয় সেটা হল হাম্মামখানায় মধ্যযূগীয় বাথ-টাব।

বাথ-টাবের পাশে বড় খোলা জানালা দিয়ে পাশের পুকুর দেখা যায়। হয়ত কোন এক সময় শাহ সুজার অন্দরমহলের রমণীরা সখীদের সাথে সেখানে স্নান করতে করতে পুকুর পাড়ের তাল গাছের নিচে বংশীবাদকের দিকে আনমনে তাকিয়ে থাকতেন। পুকুর থেকে অবাধে হাম্মামখানায় পানি প্রবাহের জন্য বাড়ির নিচে আন্ডারগ্রাউন্ড টানেল। আর বাড়ির সাথে পুকুরের দিকে মুখ করে বড় লম্বা বারান্দা। হাম্মামখানা ও আরিফকে নিয়ে নানাবিধ গল্প বানিয়ে আমরা মাজারের ভিতর যাই।

সেখানে একটি উল্লেখযোগ্য বস্তু হল জিন্দা পাথর । লোকমুখে প্রচলিত, রাতে নাকি সেই পাথর জীবিত হয়ে উঠে। এরপর জীবিত পাথর কি করে তা শোনার আগ্রহ আমাদের কারো হয়নি। পাঠকদের কারো আগ্রহ হলে যেয়ে শুনে আসতে পারেন, আমরা এতটুকু নিশ্চয়তা দিতে পারি যে পুরো জায়গাটা দেখে কেউ হতাশ হবেন না যদি আপনারা আরিফের মত সব ব্যাপারেই অনাগ্রহী না হন। তাহখানায় কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে, কিছু ছবি তুলে আময়া ফিরতি পথের যাত্রা শুরু করি।

প্রায় পড়ন্ত বিকাল, ইফতারের আগে পৌছাতে পারবোনা বুঝে আমরা বিশ্বরোড থেকে ইফতার কিনে রওনা দেই রিজওয়ানের নানীবাসার দিকে। ওখান থেকে রিজওয়ানকে নিয়ে রাজশাহী ফিরব এই ছিলো আমাদের পরিকল্পনা। কিন্তু পারিবারিক সমস্যার কারণে রিজওয়ান আমাদের সাথে ফিরতে অসম্মতি জানায়। রিজওয়ানের নানী রিজওয়ানের বিয়ের জন্য পাত্রী দেখছিলেন। আমরা ধারণা করলাম পাকাপাকি কথা হবে বলেই রিজওয়ান আমাদের সাথে ফিরতে অপারগতা জানায়।

এই লেখাটা শেষ করা পর্যন্ত রিজওয়ানের সাথে দেখা হয়নি। সুতরাং পাকা খবরটা পাঠককে জানানো গেলোনা। যাই হোক, মাঝরাস্তায় ভরপেট ইফতারি করে রাতের অন্ধকারে আমরা রাজশাহীর উদ্দেশ্যে রওনা দেই। রাতের পথে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়া কতটুকু সম্ভব জানিনা। এক দোকানের সামনে চার চাকা দাড় করিয়ে বাজার সদাই করার সময় অপর প্রান্ত থেকে ছুটে আসা একটি বাস আমাদেরকে দুই ইঞ্চি দূর থেকে পাশ কাটিয়ে নাটকীয়ভাবে আমাদের সামনে আমাদের জীবনের ফ্লাশব্যাক তুলে ধরে।

সত্যি কথা বলতে কি বাসটা যদি এর দুই ইঞ্চি ডান দিয়ে যেত তাহলে পাঠকদের মধ্যে কয়েকজন চারদিন পর আমাদের কুলখানিতে দাওয়াত পেতেন। ঈদ উদযাপনে ব্যস্ত কতজন আমাদের কুলখানিতে আসতেন তা দেখা থেকে আমরা বঞ্চিত হলাম। সত্যিই A friend in need is a friend indeed. দুই ইঞ্চি দূর থেকে আযরাঈলকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার আনন্দে আমরা আরিফের সাথে তার পছন্দের গানগুলো কোরাস করে গাওয়া শুরু করি- ‘আয় খুকু আয়’, ‘আমরা অমর সঙ্গী’ বিবিধ গানের তালে তালে কখন কাশিয়াডাঙ্গা পৌছে যাই তা টেরই পাইনা। এরপর কোর্ট ষ্টেশন মোড়ে পৌছে এক কাপ চা খেয়ে আমরা আমাদের ছোট্ট ভ্রমণের পরিসমাপ্তি টানি। পাঠকের হয়ত ভাবছেন এটা তো প্রেমের গল্প নয়, ভ্রমণ কাহিনী।

যদি তা ভেবে থাকেন তাহলে ঠিকই ভেবেছেন। এই ভ্রমণ কাহিনীর শিক্ষা হল- Everything is not what it seems. আর সব কিছুতে হিন্দি সিনেমার মত গদগদ প্রেম খুঁজতে হয়না। মনে রাখতে হবে যে প্রেম বাতাসে উড়ে বেড়ায় না যে সব কিছুতেই পরাগায়ন করে যাবে। প্রেম পীরিতির বাইরেও যে একটা বিশাল দুনিয়া আছে সেটা সবারই মনে রাখা উচিত। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।