আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

(মাসুদ রানা) দুর্গম দুর্গ কাজী আনোয়ার হোসেন \\\\এক////

ঢাকা থেকে করাচি। করাচি থেকে টু-সীটার সী-পে−নে করে চলেছে রানা কেটি বন্দর। আবোল তাবোল ভাবছে রানা। কী এমন ব্যাপার যেজন্যে এমন স্পেশাল ভাবে তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? এত তাড়াহুড়োই বা কিসের? ঢাকার পি. সি. আই. হেড অফিস জানিয়েছে পাকিস্তান ন্যাভাল ইন্টেলিজেন্সের বিশেষ অনুরোধে তাকে পাঠানো হচ্ছে করাচি। একটা অত্যন্ত জরুরী কাজে ছোট্ট একটা কম্যাণ্ডো গ্র“পকে লীড করতে হবে।

আর কিছুই জানা যায়নি। অত্যন্ত গোপনীয় ব্যাপার। ওখানে পৌঁছে জানা যাবে সব। করাচি পৌঁছে টি-থারটি থ্রী জেট থেকে নেমে সী-পে−নে ওঠা ছাড়া আর তেমন কিছুই ঘটল না। একজন মাঝ-বয়সী নেভী ক্যাপ্টেন এগিয়ে এসে হ্যাণ্ডশেক করলেন রানার সঙ্গে, বিনা বাক্যব্যয়ে নিয়ে গেলেন এঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে রাখা সী-পে−নের কাছে, কয়েকটা কাগজ ধরিয়ে দিলেন ওর হাতে।

আবার হ্যাণ্ডশেক করে উঠে গেল রানা সিঁড়ি বেয়ে। কয়েকটা ডোশিয়ে। বোধহয় ওর গ্র“পের আর সবার। দেখা হওয়ার আগেই তাদের সম্পর্কে রানার যাতে মোটামুটি একটা ধারণা হয় সেজন্যে ওকে এগুলো দেয়া। সাথে প্রত্যেকের ছবি আছে একটা করে।

প্রমেই আছে পেশোয়ারী এক ছোকরার ছবি। মাহবুব চানন্। নেভির লেফটেন্যান্ট। রেডিও এক্সপার্ট। উর্দু, পশতু, ইংরেজি এবং কচ্ছ ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারে।

হবি- মোটর এঞ্জিনিয়ারিং। গেরিলা ফাইটার হিসেবেও কৃতিত্ব আছে। দাড়ি গোঁফ কামানো পাতলা ছিমছাম চেহারা। চোয়ালের হাড় দুটো উঁচু। কিন্তু কম্যাণ্ডো মিশনে যাওয়ার জন্যে বয়সটা একটু কম বলে মনে হলো রানার।

বাইশ কি তেইশ। তারপর আছে পাঞ্জাবী মিশ্রী খান। প্রকাণ্ড একজোড়া কালো গোঁফ। . ২ মাসুদ রানা-৬ .দেখলেই বোঝা যায় বহু ঘাটের পানি খেয়েছে। হািিডসার মস্ত কাঠামো শরীরের।

ফিফ্্ ডিভিশনের আর্মি ক্যাপ্টেন। বয়স পঁয়তালি−শ। এক্সপে−াসিভের ব্যাপারে অদ্ভুত এক প্রতিভা। পোয়াটেক বারুদ হাতে ধরিয়ে দিলেই বোম বানিয়ে ফেলবে। কর্মঠ এবং ভয়ঙ্কর লোক।

আর তৃতীয় ছবিটা দেখে চমকে উঠল রানা। আলতাফ ব্রোহী! আর্মিতে থাকতেই পরিচয় ছিল রানার সঙ্গে। সিন্ধী। বয়স চলি−শ বছর। করাচি পি. সি. আই.-এ কাজ করছে এখন।

কয়েকটা অ্যাসাইনমেন্টে একসাথে কাজ করেছে ওরা। পরিচয়টা এখন বন্ধুত্বের পর্যায়ে চলে গেছে। প্রকাণ্ড চেহারা- যেমন লম্বা তেমনি চওড়া। তেমনি করিৎকর্মা। পাকিস্তানের শ্রেষ্ঠ গেরিলা ফাইটার।

‘রান অভ কাচে’র যুদ্ধে শত্র“ লাইনের পেছনে চলে গিয়ে ভারতীয় সৈন্যদের আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ভাল করেই চেনে ওকে রানা। ওকে দেখলে অসম্ভব শক্তিশালী একটা যুদ্ধের মেশিন ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না রানার। শেষ ছবিটা লেফটেন্যান্ট আরীফের। মেয়েলী চেহারা।

ন্যাভাল ইন্টেলিজেন্সের স্পাই। ওর সম্পর্কে ডোশিয়ে দেখে তেমন বিশেষ কিছু জানা গেল না। প্রত্যেকটি লোক যুদ্ধ সংμান্ত কাজ করেছে। এই সব এক্সপার্টদের এখান ওখান থেকে কুড়িয়ে নিয়ে এসে একটা কম্যাণ্ডো গ্র“প তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু কোথায়, কি কাজে, কিভাবে নেতৃত্ব দিতে হবে জানা নেই ওর।

কেটি বন্দরে পৌঁছলে হয়তো জানা যাবে। জানালা দিয়ে বাইরে চাইল মাসুদ রানা। সিন্ধু নদের মোহনায় কেটি বন্দর। সমুদ্রের কাছাকাছি নদীর বিশাল বিস্তার। কেটি বন্দর মাইল খানেক থাকতেই নেমে পড়েছে পে−ন নদীতে।

ডান ধারে তীরের ওপর কয়েকজন সামরিক পোশাক পরা লোক দাঁড়ানো। একটা তাঁবুও দেখা গেল মাঠের মধ্যে। ‘দিস ইজ কমোডোর জুলফিকার অভ ন্যাভাল ইন্টেলিজেন্স। ’ হাত বাড়িয়ে হ্যাণ্ডশেক করল রানা। শক্ত সমর্থ শক্তিশালী একটা হাত।

বয়সের ভাঁজ পড়েছে গালে। ক্লিন শেভ্ড্। ‘আপনার সহকারীদের সাথে দেখা হবে পরে, তার আগে আমরা দু’চারটে কথা সেরে নিতে চাই আপনার সঙ্গে। আসুন এদিকে। ’ রানার পেছন পেছন বাকি তিনজন অফিসারও এল তাঁবুর মধ্যে।

সী- পে−নটা ফেরত চলে গেল করাচি। ‘দ্বারোকা যেতে হচ্ছে আপনাকে,’ বললেন কমোডোর জুলফিকার একটা চেয়ারে বসে। রানাও বসল। তাঁবুর মধ্যে একটা টেবিল আর তার চারপাশে ক’টা চেয়ার ছাড়া আসবাব নেই আর। কমোডোরের টেম্পোরারী অফিস।

দুর্গম দুর্গ ৩ স্থির দৃষ্টিতে রানার দিকে চেয়ে আবার আরম্ভ করলেন কমোডোর, ‘করাচি থেকে দুশ দশ মাইল দূরের এই নৌ-ঘাঁটিটা বরাবর আমাদের মাথা-ব্যথার কারণ। অত্যন্ত শক্তিশালী রাডারে ওরা ওখানে বসে করাচিতে পাকিস্তান এয়ার ফোর্সের গতিবিধি লক্ষ করছে এবং চারদিকে ইনফরমেশন দিচ্ছে। ওদের এয়ার ফিল্ড থেকে উঠে ভারতীয় বিমান বাহিনী করাচিতে বম্বিং করবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তার ওপর ওখানে জমা হচ্ছে ওদের নৌবাহিনী- অতর্কিত আμমণে পাকিস্তান ন্যাভাল ফোর্সকে ছিনড়ব ভিনড়ব করে দেয়ার জন্যে। কাজেই স্ট্র্যাটেজিক পজিশনে অবস্থিত এই নৌ-ঘাঁটি ধ্বংস করে দেয়া ছাড়া আর কোনও উপায় দেখতে পাচ্ছি না আমরা।

দেরি হলেই হার হয়ে যাবে আমাদের। ’ ‘আমরা পাঁচজন গিয়ে...’ ‘আপনাদের কাজ কেবল ওদের দুর্গম দুর্গে প্রবেশ করে চারটে অব্যর্থ কামান ধ্বংস করে দেয়া। ওগুলোর জন্যে দ্বারোকার আধমাইলের মধ্যে যাওয়া যাচ্ছে না। ওগুলোকে স্তব্ধ করে দিতে পারলে বাকি কাজ নির্বিঘেড়ব সেরে আসতে পারবে পাকিস্তান নেভি। একাজের জন্যে শ্রেষ্ঠ যোগ্যতাসম্পনড়ব তিনজন সহকারী পাচ্ছেন আপনি, দ্বারোকা পৌঁছে লেফটেন্যান্ট আরীফের সাহায্য পাচ্ছেন, কাজেই আমরা আশা করতে পারি সফল হতে পারবেন আপনি।

গোটা দেশের নিরাপত্তা নির্ভর করছে এই কম্যাণ্ডো গ্র“পের নেতার ওপর, তাই আপনাকে বেছে নিয়েছি আমরা। আশা করি এই সম্মানের মর্যাদা রক্ষা করবেন। ’ ‘চেষ্টার ত্র“টি হবে না, স্যার,’ বলল রানা বিনীত ভাবে। এবার ম্যাপ বের করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রত্যেকটি ব্যাপার আলোচনা করলেন কমোডোর। রানা অবাক হলো ভদ্রলোকের নিপুণ প−্যানিং এবং পরিচ্ছনড়ব চিন্তা দেখে।

সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাপারও দৃষ্টি এড়ায়নি ওঁর। দুই ঘণ্টা কখন পার হয়ে গেল বুঝতেই পারল না সে। কমোডোর জুলফিকারের প্রতিটি কথা স্রেফ হাঁ করে গিলে নিল মাসুদ রানা। পুরো প−্যানটা ভালভাবে বসিয়ে নিল মাথার মধ্যে। ‘উইশ ইউ বেস্ট অভ লাক, ইয়ংম্যান।

’ রানার কাঁধের ওপর রাখলেন কমোডোর ডান হাত। ‘কাজটা ভয়ঙ্কর, দুঃসাধ্য এবং বিপদজনক। কিন্তু শুনেছি, কারও পক্ষে যদি সম্ভব হয় এ মিশন সফল করা, সে হচ্ছেন আপনি। আমার বিশ্বাস, আপনি পারবেন। ’ মাইল খানেক তফাতে একটা ডাক-বাংলো প্যাটার্নের কাঠের বাড়িতে নিয়ে আসা হলো রানাকে জীপে করে।

পাঁচ মাইল দূরে আরব সাগরের বুকে ঝিলিমিলি এঁকে ডুবে যাচ্ছে সূর্যটা। চারদিকে কুয়াশা-কুয়াশা ধোঁয়াটে ভাব। উনিশশো পঁয়ষট্টি সালের সেপ্টেম্বর মাস। চোখ ফিরিয়ে নিয়ে ঢুকে পড়ল . ৪ মাসুদ রানা-৬ রানা বাড়ির ভেতর কমোডোর জুলফিকারের পেছন পেছন। সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে চলে গেলেন কমোডোর।

এখন সব কিছুর ভার রানার ওপর। লেফটেন্যান্ট আরীফের সঙ্গে তার নিজেকেই পরিচয় করে নিতে হবে দ্বারোকায়। টেবিলে খাবার সাজানো রয়েছে। খাওয়া শেষ করে ওদের যেটুকু বলা দরকার বলবে রানা। তারপর নৌকোয় উঠে বাকি কথা হবে।

আধঘণ্টার মধ্যে রওনা হতে হবে ওদেরকে। কিছুক্ষণ চুপচাপ একমনে খেল রানা। বুঝতে পারল আলতাফ ছাড়া আর সবাই লক্ষ করছে তাদের নতুন দলপতিকে। বুঝবার চেষ্টা করছে, মূল্যায়নের চেষ্টা করছে চোখে দেখে যতটুকু সম্ভব। এমন সময় ঘরে এসে ঢুকল একজন অপরিচিত সামরিক অফিসার।

কাঁধের ওপর তিনটে স্টার দেখে বোঝা গেল আর্মি ক্যাপ্টেন, সদ্য প্রমোশন পেয়েছে। ফর্সা চেহারা, চাল চলনে একটা উদ্ধত ভাব। দেখেই আন্দাজ করা যায়, সেপাইদের যম। ‘কি ব্যাপার? এখনও খাওয়াই হয়নি আপনাদের? অথচ আপনাদের এই কোয়ার্টার ভ্যাকেট করবার কথা ছিল ছ’টার সময়। আমাকে আমার কোয়ার্টার থেকে বের করে দিয়ে যদি এ রকম অত্যাচার...’ ‘আপনাকে চিনলাম না,’ গম্ভীর কণ্ঠে বলল রানা।

লোকটার গলাটা খোনা, আর ব্যবহারে এমন একটা বিরক্ত বেপরোয়া তাচ্ছিল্যের ভাব রয়েছে যে দেখেই পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বলে গেল রানার। ঝট্ করে ফিরল অফিসার রানার দিকে। ‘ও, আপনি বুঝি নতুন এসেছেন? তা আপনি কে শুনি?’ ‘গেট আউট!’ আঙুল দিয়ে দরজা দেখিয়ে দিল রানা। ‘আমরা যতক্ষণ আছি কোন পঞ্চম ব্যক্তি চাই না। বেয়ারাকে পর্যন্ত ওই গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হুকুম দিয়েছি।

আপনি এখন যেতে পারেন। ’ ‘কি? আমার বাড়িতে বসে আমাকে গেট আউট?’ কট্মট্ করে চেয়ে রইল ক্যাপ্টেন রানার দিকে। রাগে লাল হয়ে গেছে সারা মুখ। আবার হাতের ইশারায় দূর হয়ে যেতে বলল ওকে রানা। ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল সে ঘর ছেড়ে।

‘আজ আমরা কেন সমবেত হয়েছি জানার জন্যে নিশ্চয়ই আপনারা সবাই উৎসুক হয়ে আছেন। আমরা কেউ কাউকে চিনি না, পাকিস্তানের বিভিনড়ব জায়গা থেকে আমাদের টেনে আনা হয়েছে একটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্যে। শত প্রশড়ব উঁকি দিচ্ছে সবার মনে। আমি আপনাদের সমস্ত প্রশেড়বর উত্তর দিচ্ছি একে একে। সম্মিলিত চেষ্টায় আমাদেরকে একটা অসাধ্য সাধন করতে হবে।

খুলে বলছি, শুনুন...’ ‘গেছি রে গেছি, বাবা, নির্ঘাত মারা পড়েছি!’ ককিয়ে উঠল মিশ্রী খান। ‘এই দুর্গম দুর্গ ৫ সেপ্টেম্বরের তুফানের দিনে সামুন্দার? নৌকায়? উহ্!’ ফস্ করে দেশলাই জ্বেলে কিংস্টর্ক সিগারেট ধরাল সে একটা। ‘ক্যাপ্টেন খান ঠিকই বলেছেন,’ বলল মাহবুব চানন্। ‘মস্ত বড় ঝুঁকি নিচ্ছেন আপনি, মেজর রানা। হুকুম করলে আমি নেভিগেট করব, কিন্তু পৌঁছতে পারব কিনা তাতে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

’ ‘ঝুঁকিটা আমাদের নিতেই হবে। অন্য কোনও পথে আমাদের বিপদ আরও বেশি। আলতাফ, তুমি কোথায় চললে?’ কথাটা শেষ হবার আগেই ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল আলতাফ ব্রোহী। দেখা দেখি তড়াক করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল মিশ্রী খান। হাতে একটা পিস্তল।

‘মাহবুব, পাশের ঘর থেকে টর্চটা নিয়ে এসো। কুইক!’ বলে রানাও এক লাফে বেরিয়ে এল বাইরে। কিন্তু তখন দেরি হয়ে গেছে। আগেই টের পেয়ে গিয়েছিল, টর্চ আনতে আনতে বেড়া টপকে একশো গজ দৌড়ে চলে গেছে সে। দুটো গুলি ছুঁড়ল মিশ্রী খান- লাগল না একটাও।

বেয়ারা দৌড়ে এগিয়ে এল। আলতাফকে দেখা গেল না কোথাও। ‘লোকটাকে চেনো?’ জিজ্ঞেস করল রানা। ‘চিনি, হুজুর! ক্যাপ্টেন সাহেবের খানসামা, করিম। বোবা আর কালা।

’ ‘বোবা-কালা যদি হবে তো লুকিয়ে লুকিয়ে কি শুনছিল সে কান পেতে?’ কোনও জবাব দিল না বেয়ারা। ফ্যাল-ফ্যাল করে চেয়ে রইল ওদের দিকে। ‘কোথায় গেছে তোমার ক্যাপ্টেন সাহেব?’ ‘অফিসারস্ ক্লাবে। ’ ‘ডেকে আনো। পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসতে বলবে।

’ বেয়ারা চলে যেতেই ফিরে এল ওরা ডাইনিং রূমে। একটা ইজি চেয়ারে শুয়ে পড়ল মিশ্রী খান। বলল, ‘ওকে ধরা না গেলে আমাদের রওনা হওয়ার কোনও মানে হয় না, ওস্তাদ। ব্যাটা স্পাই। আমার কোনও সন্দেহ নাই।

’ গম্ভীর মুখে পায়চারি করল রানা কিছুক্ষণ। আবার চেয়ারে এসে বসে অপেক্ষা করছে আলতাফের। এমনি সময় হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকল একটা মিশমিশে কালো লোক। গেঞ্জি আর হাফ প্যান্ট পরনে। পেছনে ওর একটা হাত মুচড়ে ধরে ঢুকল আলতাফ ব্রোহী।

অপর হাতে একটা ছোরা। ‘ব্যাটা ছোরা তুলেছিল! ওর কব্জিটা ভেঙেই ফেলেছি কিনা জানি না,’ বলল আলতাফ। ‘কি নাম তোমার?’ জিজ্ঞেস করল রানা লোকটাকে। ‘কি করছিলে তুমি এখানে?’ কোনও জবাব দিল না লোকটা। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে।

খটাং করে মাথার পেছনে আলতাফের হাতের এক গাঁট্টা পড়তেই ককিয়ে উঠল। . ৬ মাসুদ রানা-৬ তারপর ‘আঁউ-আঁউ’ করে বোবার মত বিকট শব্দ বের করল মুখ থেকে। ‘তোমাকে একটা প্রশড়ব করা হয়েছে, তার উত্তর দাও। তোমার অভিনয় দেখতে চাওয়া হয়নি। ’ উঠে বসল মিশ্রী খান।

ধীরে সুস্থে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে সে একটা সাইলেন্সার লাগাচ্ছে ওর পিস্তলের মুখে। আবার খানিকক্ষণ বিকট আওয়াজ বের করল সে মুখ দিয়ে। ওর পেছন দিকে কানের কাছে একটা শব্দ করল আলতাফ তুড়ি দিয়ে, কিন্তু যেন শুনতেই পায়নি এমন ভাবে সামনের দিকে চেয়ে রইল লোকটা। মাহবুবের মনে হলো নিশ্চয়ই লোকটা বোবা এবং কালা। বলেই ফেলল, ‘লোকটা সত্যি বোবা-কালা।

’ ‘হতে পারে, না-ও হতে পারে,’ বলল রানা। ‘কিন্তু ও যে আড়ি পেতেছিল তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তাছাড়া নিরপরাধ লোক এমন হঠাৎ ছোরাই বা বের করবে কেন? কাজেই আমরা যে বিরাট কাজে হাত দিয়েছি তাতে ঝুঁকি নেয়া চলবে না। ’ হঠাৎ নিষ্ঠুর নির্দয় হয়ে উঠল রানার কণ্ঠস্বর, ‘আলতাফ!’ ‘বলো, মেজর। ’ ‘ছুরি তো আছেই।

ঝটপট কাজ সেরে ফেল। ঠিক হƒৎপিণ্ড আন্দাজ করে চালাবে। ’ একটা আতঙ্কিত চিৎকার বেরিয়ে এল মাহবুবের মুখ থেকে। লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল সে। দড়াম করে উল্টে গেল চেয়ারটা।

‘কি করছেন, মেজর...’ মুখের কথা বেধে গেল মাহবুবের। অবাক হয়ে দেখল ছুটে গিয়ে ধাক্কা খেল লোকটা কাঠের দেয়ালে। প্রাণভয়ে একটা হাত তুলে রেখেছে সে ওপরে। ঘরের কোণের দিকে সরে যাচ্ছে সে গুটিসুটি মেরে। সারা মুখে আতঙ্কের স্পষ্ট ছাপ।

চোখ ফিরিয়ে দেখল বিজয়ীর হাসি আলতাফের মুখে, মিশ্রী খানও বুঝতে পেরেছে ব্যাপারটা। হঠাৎ নিজেকে আস্ত গর্দভ মনে হলো ওর। স্বভাবতই বেশি কথা বলে মিশ্রী খান। হা-হা করে হেসে উঠে বলল, ‘বোবা কালারও জানের ভয় আছে, বাবা। ভাল কায়দা করেছেন, ওস্তাদ।

’ এমনি সময় ঘরে ঢুকল ক্যাপ্টেন বেয়ারার সাথে। ভুরু জোড়া কুঁচকে আছে। আμমণাওক ভঙ্গি। ঢুকেই তীক্ষè কণ্ঠে বলল, ‘কি পেয়েছেন আমাকে, মি. মাসুদ রানা? যখন-তখন ডেকে পাঠাবার আপনি কে? ঘরটা আবর্জনামুক্ত হলো কিনা দেখতে এসেছি। আপনার কথা শুনতে আসিনি।

’ ‘এই লোকটা কে?’ কোণের দিকে ইঙ্গিত করল রানা। কোণের দিকে চেয়েই মুখের ভাব পাল্টে গেল ক্যাপ্টেনের। ‘আরে! করিম! আমার খানসামা। ও ওখানে কেন?’ ‘দেয়ালে কান ঠেকিয়ে বাইরে থেকে আমাদের কথাবার্তা শুনছিল। ’ ‘আমি বিশ্বাস করি না।

’ ‘খবরদার, ক্যাপ্টেন!’ মিশ্রী খানের পিস্তলটা ক্যাপ্টেনের দিকে ধরা। দুর্গম দুর্গ ৭ ‘আমরা সবাই দেখেছি। ও কি আপনার স্পাই না ভারতের, কেবল তাই জানতে চাই আমরা। ’ অবাক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল ক্যাপ্টেন মিশ্রী খানের পিস্তলের দিকে। জোর করে হাসবার চেষ্টা করল সে।

লাল হয়ে উঠল ওর ফর্সা মুখ। বলল, ‘বিশ্বাস করি না, তার কারণ লোকটা বোবা ও কালা। ’ ‘বোবা কিনা জানি না,’ বলল রানা। ‘কিন্তু কালা যে নয় তার প্রমাণ আছে আমাদের কাছে। ’ একটা হাত তুলে ক্যাপ্টেনকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘আপনার সাথে এ ব্যাপারে তর্কাতর্কি করবার সময় আমাদের নেই।

লোকটাকে এক্ষুণি অ্যারেস্ট করুন এবং অন্ততপক্ষে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে যেন সে কারও সঙ্গে কথা বলতে বা দেখা করতে না পারে সেজন্যে নির্জন সেলে আটকে রাখুন। কথা বলতে পারুক আর না পারুক, লোকটা ভয়ঙ্কর। ’ ‘চমৎকার, চমৎকার!’ তিক্ত হাসি হাসল ক্যাপ্টেন। ‘একজন সিভিলিয়ানের হুকুম তামিল করতে হবে আমাকে। কোথাকার মাতব্বর এসেছেন আপনি...’ রানাকে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দেখে থেমে গেল সে।

টেবিলটা ঘুরে হেঁটে এসে ক্যাপ্টেনের এক ফুট দূরে থামল রানা। কঠোর দৃষ্টি ওর চোখে। ‘আপনার এই ব্যবহারের জন্যে ইচ্ছে করলেই কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারতাম- কিন্তু তা করব না। সময় নেই আমাদের হাতে। যা বলছি তাই করবেন আপনি, নইলে ডিমোশন তো হবেই, কোর্ট মার্শালও হতে পারে।

কি? কর্নেলের সাথে দেখা করতে হবে, না আমার হুকুম তামিল করবেন?’ বেত্রাহত কুকুরের মত কুঁকড়ে গেল ক্যাপ্টেন। বুঝল, মুখে যা বলছে কাজেও সেটা করে দেখাবার ক্ষমতা আছে এই লোকের। সবার সামনে এই চরম অপমান আর পরাজয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকল সে বাঁশপাতার মত। কিন্তু অল্পক্ষণেই সামলে নিল নিজেকে। ‘ঠিক আছে।

ঠিক আছে। অত সব ভয় না দেখালেও চলত। যা বলছেন তাই হবে। জানি, বেহুদা আপনার সন্দেহ, তবু...। বেয়ারা, দু’জন গার্ড ডেকে নিয়ে এসো।

’ ‘আপনার অপমানিত বোধ করবার কিছুই নেই, ক্যাপ্টেন,’ চট করে বলল মিশ্রী খান। ‘যাঁর হুকুম পালন করতে যাচ্ছেন তিনি বর্তমানে সিভিলিয়ান হলেও আর্মিতে আপনার চেয়ে এক র‌্যাঙ্ক ওপরে ছিলেন। ’ . ৮ মাসুদ রানা-৬ দুই আধঘণ্টার মধ্যে জিনিসপত্র সব নৌকোয় তুলে তৈরি হয়ে নিল ওরা। কমোডোরের পার্সোনাল পিক্-আপে মালপত্রসহ ওদের সমুদ্রের ধারে নামিয়ে দেয়া হয়েছে। নৌকার চার্জে যে গার্ডটা ছিল তাকে তুলে নিয়ে ফিরে গেছে পিক্-আপ।

গয়না-নৌকোর সমান বহুদিনের পুরানো একটা জেলে নৌকা। এখানে- ওখানে কাঠ দিয়ে তালি মারা। পাটাতনের নিচেই এঞ্জিনরূম। এঞ্জিনের অবস্থাও নৌকার মতই। নৌকার মধ্যে ওদের জন্যে পুরানো নোংরা কাপড়, খাবার, একটা স্টোভ, রশি, রিসিভারসহ একখানা রেডিয়ো ট্র্যান্সমিটার, দুটো বেরেটা সাব- মেশিনগান, দুটো মাউজার ব্রেনগান, তাছাড়া আয়না, টর্চ ইত্যাদি টুকিটাকি জিনিস আগে থেকেই রাখা আছে।

পিক্-আপ থেকে নামানো হয়েছে দুটো বাক্স। একটায় টিএনটি, অ্যামাটোল, ডিনামাইট স্টিক, গান কটন প্রাইমার, এমারি ডাস্ট, গ্রাউণ্ড গ−াস আর একটা জারে করে পটাশিয়াম আছে। অন্যটার মধ্যে আছে ডিটোনেটার। পারকাশন আর ইলেকট্রিক দু’রকমই। এঞ্জিন রূমের মধ্যে থেকে বাইরে মাথা বের করল মাহবুব।

মাস্তুলটার দিকে চেয়ে বলল, স্পাল আছে না, স্যার, সঙ্গে?’ ‘আছে বোধহয়, কেন?’ ‘কারণ আমি হলপ করে বলতে পারি, দরকার হবে। ’ ‘কেন, এঞ্জিন?’ ‘ওটা ‘‘এন’’-ও নয় ‘‘জিন’’-ও নয়। ঠাকুরদার আমলের একটা টু সিলিণ্ডার ভট্ভটি। প্রপেলার শ্যাফটের সাথে যে জায়গাটা মিশেছে ওখানে দুই মণ রাস্ট পড়ে আছে। এ জিনিসের ওপর নির্ভর করলে আর পৌঁছতে হবে না আমাদের।

’ রানা বুঝল এই এঞ্জিন পেয়ে ভেতর ভেতর যার-পর-নাই খুশি হয়ে উঠেছে মাহবুব। ওর কারিগরী মাথা খেলাবার সুযোগ পেয়েছে সে এইবার। কিন্তু এ ধরনের একটা নৌকায় ওদের এত গুরুত্বপূর্ণ কাজে পাঠানো হচ্ছে বলে মনে মনে একটু অসন্তুষ্ট না হয়ে পারল না সে। ছেড়ে দিল নৌকা। সোজা এগোল ওরা দক্ষিণে।

দ্বারোকা আর ওখা-র মাঝামাঝি পাহাড়ী জায়গায় উঠবে। আধঘণ্টার মধ্যেই সামরিক পোশাক খুলে জেলে পোশাক পরে নিল ওরা। সাগরে ডুবিয়ে দেয়া হলো পাকিস্তানী পোশাকগুলো পাথর বেঁধে। প্রকাণ্ড গোঁফে বার কয়েক তা দিয়ে পাটাতনের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল মিশ্রী খান। পালা করে রাত জাগতে হবে।

প্রমে জাগবে আলতাফ আর মাহবুব। দুর্গম দুর্গ ৯ রানা শুয়ে পড়ল মিশ্রী খানের পাশে। এঞ্জিনের শব্দ আর সাগরের কুলুকুলু। বাতাস নেই। নিস্তরঙ্গ আরব সাগরে ভেসে চলেছে ওরা অজানার উদ্দেশে।

‘ওস্তাদ!’ কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে নিচু গলায় ডাকল মিশ্রী খান। ‘কি?’ ‘আমার অবশ্য মাথা ঘামানো উচিত না, তবু জিজ্ঞেস করছি, যদি ওই ছোকরা ক্যাপ্টেন আপনার হুকুম না শুনত, তাহলে কি করতেন আপনি?’ ‘কর্নেলকে বলতাম। কর্নেল না শুনলে গুলি করে মেরে ফেলতাম করিমকে। ’ ‘আমিও ঠিক তাই ভেবেছিলাম। আচ্ছা, ক্যাপ্টেন যদি আপনার কথা না শুনত তাহলে কি ওর কোর্ট মার্শাল হত সত্যি করে?’ ‘না।

আমাদের হাতে অত ক্ষমতা নেই। এমনি ভয় দেখিয়েছিলাম। ধমকেই কাজ হয়ে গেল- কাজেই ওসব কথা ভাবার কোনও দরকার নেই। ’ ঘুমে জড়িয়ে এল রানার কথাগুলো। ‘আমিও তাই ভেবেছিলাম।

আসলে আমাদের হাতে অত ক্ষমতা নেই। কিন্তু কেন জানি আমার মনে হচ্ছে করিমকে মেরে রেখে আসাই উচিত ছিল। ওই ক্যাপ্টেনটার মুখের চেহারা দেখেছিলেন? আপনি দেখতে পাননি, আমি দেখেছি। আপনি যখন ওর দিকে পেছন ফিরলেন তখন কেউ উপস্থিত না থাকলে আপনার পিঠে ছুরি বসিয়ে দিতেও দ্বিধা করত না ও। ওর অহঙ্কার গুঁড়ো হয়ে গেছে, ওস্তাদ।

আÍম্ভরী লোকের কাছে এর চাইতে বড় অপমান আর কিছুই নেই। ’ রানার তরফ থেকে জবাব এল না কোনও। গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়েছে সে। পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ল মিশ্রী খানও। কিন্তু মন থেকে অস্বস্তি গেল না ওর।

ঠিক ভোর ছ’টার সময় বন্ধ হয়ে গেল এঞ্জিন। ছুটে গেল রানা এঞ্জিন রূমের দিকে। ঘুম ভেঙে উঠে বসল আলতাফ আর মিশ্রী খান। মাহবুব ঘুমাতে অস্বীকার করায় মিশ্রী খানকে আর ওঠানো হয়নি। ‘কি হলো, ওস্তাদ? পৌঁছে গেছি?’ জবাব দিল মাহবুব।

মাথা বের করল সে এঞ্জিন রূমের ভেতর থেকে। ‘প্রায়। তিনভাগের দুই ভাগ চলে এসেছি। বাকিটা পাল টাঙিয়ে যেতে হবে। এক্জস্ট লিক।

’ ‘মেরামত হবে না?’ জিজ্ঞেস করল রানা। ‘অসম্ভব। ওয়েলডিং দরকার। হাবিজাবির মধ্যে একটা স্পেয়ার এঞ্জিন খুঁজে পাওয়া গেছে, দেখি চেষ্টা করে লাগানো যায় কিনা। ’ ‘কতক্ষণ লাগবে, মাহবুব?’ . ১০ মাসুদ রানা-৬ ‘ঠিক বলতে পারছি না, স্যার।

আদৌ হবে কিনা তা-ও বলা যায় না। একদম রাস্ট পড়ে আছে। আপনি পালটা ওঠাবার ব্যবস্থা করুন, আমি চার্ট দেখে হাল অ্যাডজাস্ট করে দিয়ে লাগব এঞ্জিনের পেছনে। ’ মাথার ওপর দিয়ে দুটো মিগজেট উড়ে চলে গেল। কিছুদূর গিয়ে কি মনে করে ঘুরে এল আবার।

ডাইভ দিয়ে অনেক নিচে নেমে দেখল ওদের- তারপর সন্তুষ্ট চিত্তে চলে গেল যেদিকে যাচ্ছিল সেদিকেই। পাল তুলে দেয়া হলো নৌকায়। বেশ ফর্সা হয়ে গেছে চারপাশ। মিশ্রী খান নেমে গেল মাহবুবের সাথে এঞ্জিনরূমে, সাহায্য করবে বলে। বড় সাইজের একটা মশুরির ডালের মত সূর্য উঠল পুব সমুদ্র থেকে।

দুই ঘণ্টা পার হয়ে গেল। মন্থর গতিতে চলেছে নৌকা গন্তব্যস্থলের দিকে। হঠাৎ পেছন দিকে চেয়েই চিৎকার করে উঠল রানা। ‘দেখেছ, আলতাফ?’ ‘দেখেছি, মেজর। এখনও তিন মাইল আছে।

ঘণ্টাখানেক আগে যেটা পাশ কাটিয়ে চলে গেল, খুব সম্ভব সেটাই। ওদের টহলদারী লঞ্চ। ’ ‘সোজা আসছে আমাদের দিকে! মিশ্রী আর মাহবুবকে শিগগির ডাকো। ’ জরুরী বৈঠক বসল। ‘আমাদের থামিয়ে সার্চ করবে ওরা।

কিছু একটা সন্দেহ করেছে নিশ্চয়ই। কিংবা কোন সংবাদ জানতে পেরেছে, তাই ফিরে আসছে। বিপদ আশা করবে ওরা, এবং সাবধান থাকবে। কাজেই মাঝামাঝি কোনও ব্যবস্থা চলবে না। হয় ওরা ডুববে, নয় আমরা- এছাড়া আর কোনও উপায় নেই।

আমাদের অস্ত্রশস্ত্র আমরা কিছুতেই পানিতে ফেলব না। কাজেই, সার্চ করলে সব বেরিয়ে পড়বে। ’ খুব দ্রুত প−্যান ঠিক করে সবাইকে বুঝিয়ে দিল রানা। সব চাইতে অনভিজ্ঞ মাহবুব। জীবনে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়ায়নি সে কখনও আগে।

যুদ্ধক্ষেত্রের অভিজ্ঞতা হয়নি ওর। হঠাৎ বলে উঠল, ‘অসম্ভব! আপনি যা করতে যাচ্ছেন সেটা মানুষ খুন। এভাবে হত্যা করবার কোনও অধিকার...’ ‘খবরদার!’ চিৎকার করে উঠল মিশ্রী খান। ‘তুমি দুধের বাচ্চা, তুমি কি বোঝ? চুপ করে থাকো। ’ ‘হয়েছে, মিশ্রী খান!’ তীক্ষè কণ্ঠে বলল রানা।

কয়েক সেকেণ্ড তীব্র দৃষ্টিতে ওর দিকে বিরক্তি বর্ষণ করে ফিরল মাহবুবের দিকে। ‘লেফটেন্যান্ট, এটা যুদ্ধ। আর যুদ্ধের নিয়মই হচ্ছে শত্র“পক্ষকে সমান সুযোগ না দিয়ে কোনও না কোনও অসুবিধার মধ্যে রাখা। কারণ আমরা যদি ওদের মারতে না পারি, ওরা আমাদের মারবে। এটা অত্যন্ত সহজ যুক্তি- হয় ওরা তলিয়ে যাবে, নয় আমরা।

আমাদের মিশনের উদ্দেশ্য হাজার হাজার পাকিস্তানী সৈনিকের প্রাণ রক্ষা করা, বিশ্বের চোখে আমাদের যোগ্যতা তুলে ধরা। দুর্গম দুর্গ ১১ এখন এই মুহূর্তে বিবেকের প্রশড়বই ওঠে না। ’ মাথা নিচু করে রইল মাহবুব। রানার যুক্তির অকাট্যতা হƒদয়ঙ্গম করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই যে হত্যাকাণ্ড ওর নিজ চোখে দেখতে হবে সেটা কল্পনা করে শিউরে উঠল একবার।

বুঝল, রানাকে বিচার করবার ক্ষমতা এখনও হয়নি ওর। বলল, ‘আমাকে মাফ করবেন, মেজর। ক্যাপ্টেন খান ঠিকই বলেছেন, আপনাদের তুলনায় আমি দুধের বাচ্চা ছাড়া কিছুই নই। আমার চুপ করে থাকাই উচিত। ’ একবার ফিরে চাইল সে মোটর লঞ্চটার দিকে।

‘আমার ওপর নির্ভর করতে পারেন, স্যার। ’ ‘বেশ, বেশ,’ মৃদু হাসল রানা মাহবুবের দিকে চেয়ে। ‘তোমার ওপর নির্ভর করতে আমার বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই। এছাড়া অবশ্য উপায়ও নেইআলতাফ আর তুমি ছাড়া কচ্ছ ভাষা আর কেউ জানে না। কিন্তু সেজন্যে নয়।

আমাদের এই ছোট্ট গ্র“পের প্রত্যেকের ওপর প্রত্যেকে নিশ্চিন্তে নির্ভর করতে না পারলে সাফল্য আসবে না। মিশ্রী খান, জিনিসটা রেডি করো। স্বাভাবিক, সহজভাবে চলাফেরা করবে। ওদের দূরবীন এখন পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে আমাদের। ’ সামনের দিকে হেঁটে চলে এল রানা।

আলতাফ এল পিছু পিছু। এঞ্জিন সারতে বসল মাহবুব। মিশ্রী খান ব্যস্ত হয়ে পড়ল একটা বিশ্রী কাজে। লঞ্চটা যখন ছয়ফুট দূরে এসে পড়ল তখন পাটাতনে বসে একটা ছেঁড়া চাদর কোলের ওপর বিছিয়ে সেলাই করছে রানা। জনা ছয়েক ভারতীয় ন্যাভাল অফিসার দেখা গেল রেলিং-এর ধারে।

তিনজনের হাতে অটোমেটিক কারবাইন, দু’জনের হাতে রিভলভার। একধারে ট্রাইপডের ওপর বসানো একটা মেশিনগান চেয়ে আছে ওদের দিকে স্থির দৃষ্টিতে। হুইল-হাউস থেকে মাথা বের করল অল্প বয়সী এক লেফটেন্যান্ট। দুই হাত মুখের কাছে তুলে চিৎকার করে বলল, স্পাল নামাও। ’ মনেমনে চম্কে উঠল রানা।

হিম হয়ে গেল বুকের ভেতরটা। কথাটা পশতু ভাষায় বলেছে লেফটেন্যান্ট। মাহবুব একে ছেলেমানুষ, তার ওপর অনভিজ্ঞ। ঠিক ধরা পড়ে যাবে। রানা পরিষ্কার বুঝল, এই প্রম কথাতেই ধরা পড়ে যাবে ওরা।

কিন্তু মাহবুব এই ফাঁদে পা দিল না। মাথাটা কাত করে কানের কাছে হাত তুলে হাঁ করে কিছু শুনবার চেষ্টা করল। ঠিক মাথা মোটা জেলেদের চমৎকার অনুকরণ। কথাটা যেন বুঝতেই পারেনি এমন ভাবে কচ্ছ ভাষায় জিজ্ঞেস করল, ‘কি বলছেন গো?’ স্পাল নামাও। তোমাদের নৌকা সার্চ করব।

’ রানা লক্ষ করল এবারেও পশতু ব্যবহার করছে লেফটেন্যান্ট। বোকার মত চেয়ে রইল মাহবুব ওর মুখের দিকে কিছুক্ষণ, তারপর রানা এবং আলতাফের দিকে চাইল অসহায় দৃষ্টিতে। ওদের চেহারা দেখেও বোঝা . ১২ মাসুদ রানা-৬ গেল একটি বর্ণও বুঝতে পারেনি ওরা। হতাশ ভাবে দুই হাতের তালু চিৎ করল সে। ‘মাদ্রাজী ভাষা আমরা বুঝি না,’ চিৎকার করে বলল সে।

‘কচ্ছের ভাষা বলতে পারেন না?’ এক বিশেষ ধরনের মুখভঙ্গি করল লেফটেন্যান্ট। ভাঙা-ভাঙা কচ্ছ ভাষায় বলল, ‘এক্ষুণি নৌকা থামাও, আমরা সার্চ করব। ’ ‘কি? নৌকা থামাব? কেন নৌকা থামাব, কিসের সার্চ? আমরা চোর, না ডাকাত? লাইসেন্স আছে আমাদের...’ খেপে উঠল যেন মাহবুব। হাত-পা ছুঁড়ে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল তীক্ষè কণ্ঠে বাধা দিল লেফটেন্যান্ট। ‘দশ সেকেণ্ড সময় দিলাম।

তারপর গুলি করব। ’ আহত-পরাজিত মাহবুবের মুখের চেহারা। তিক্ত কণ্ঠে বলল, ‘নামাও পাল। ’ পাল নামিয়ে ফেলল আলতাফ। নামিয়ে বোকার মত হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইল।

খালি দুই হাত ঝুলছে দেহের দুই পাশে। রানাও সেলাই বন্ধ করে বিরক্ত মুখে চেয়ে রইল লঞ্চের অফিসারদের দিকে। ডিজেল এঞ্জিনের শব্দটা একটু গভীর হলো। কাছে সরে এসে নৌকার গায়ে গা ঠেকাল লঞ্চটা। রিভলভার আর অটোমেটিক কারবাইন হাতে নেমে এল তিনজন অফিসার মেশিনগানের লাইন অফ ফায়ার থেকে গা বাঁচিয়ে।

ঝট করে প্রম জন সরে এল মাস্তুলের কাছে। ঘুরে দাঁড়িয়েই রানা ছাড়া বাকি সবাইকে কন্ট্রোলে রাখার জন্যে রিভলভারের মুখটা বুলিয়ে নিল ওদের ওপর। রানাকে লঞ্চের স্প্যানডাও মেশিনগানটার হাতেই ছেড়ে দিল সে। মাথা ঘুরিয়ে নির্বোধ দৃষ্টিতে চারদিকে চাইল রানা। মাহবুব ডেকের ওপর সাইলেন্সার মেরামতের কাজে লেগেছে।

মিশ্রী খান ওর থেকে দেড় গজ দূরে কাতানি দিয়ে একটা টিন কাটছে মনোযোগের সঙ্গে- মেরামতের কাজে লাগবে। রানা লক্ষ করল কাতানিটা বাম হাতে ধরেছে মিশ্রী খান। অর্থাৎ, ডান হাতটা মুক্ত আছে রানার আদেশের অপেক্ষায়। আলতাফ তেমনি দাঁড়িয়ে আছে বোকার মত। মাস্তুলের কাছে দাঁড়ানো লোকটা নি®পলক চোখে চেয়ে রয়েছে সবার দিকে।

বাকি দুজন ধীর পায়ে হেঁটে আলতাফের পাশ দিয়ে যাচ্ছে, কারবাইন দুটো ঢিল করে ধরা। সমস্ত নৌকাটা যে ওদের আয়ত্তে এসে গেছে, তাতে ওদের কোন সন্দেহ নেই। গোলমালের কথা ভাবাও এখন হাস্যকর। ঠিক এই সময় চাদরের তলা থেকে ঠাণ্ডা মাথায় সযতেড়ব প্রম গুলিটা করল রানা। সোজা গুলি গিয়ে লাগল স্প্যানডাও মেশিনগানারের হƒৎপিণ্ডে।

পর মুহূর্তে ঢলে পড়ল মাস্তুলের পাশে দাঁড়ানো অফিসারটা রানার দ্বিতীয় গুলিতে। অফিসারটা ডেকের ওপর গড়িয়ে পড়বার আগেই তিনটে জিনিস ঘটল একই সঙ্গে। ঝট্ করে বল-সাইলেন্সারের পাশে লুকানো মিশ্রী খানের দুর্গম দুর্গ ১৩ পিস্তলটা তুলেই পরপর চারটে গুলি করল মাহবুব। কাতানি দিয়ে থ্রী-সেকেণ্ড কেমিক্যাল ফিউজটা একটু কুঁকড়ে দিয়ে ছুঁড়ে ফেলল সেটা মিশ্রী খান পাশে দাঁড়ানো লঞ্চের এঞ্জিনরূমের ভেতর। আর সঙ্গে সঙ্গে আলতাফের দুটো গরিলা সদৃশ প্রকাণ্ড হাত ওর পাশের দু’জন অফিসারের মাথা দুটো ভয়ঙ্কর জোরে ঠুকে দিল।

ঠাস্ করে দুটো খোসা ছাড়ানো নারকেলে বাড়ি লাগল যেন। পরমুহূর্তে চারজনেই ওরা শুয়ে পড়ল পাটাতনের ওপর। প্রচণ্ড বিস্ফোরণের সাথে সাথে ধোঁয়া আর আগুনের হল্কা উঠল আকাশের দিকে। ভারতীয় টহলদারী লঞ্চের একটা রেলিং মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গিয়ে পড়ল দশগজ তফাতে। জোর ঝাঁকুনি খেল নৌকাটা।

ধাক্কা খেয়ে কিছুটা সরে এল জ্বলন্ত লঞ্চ থেকে। তারপর সব চুপ। কানে তালা লেগে গেছে রানার। টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল সে পাটাতনের ওপর। ডুবে যাচ্ছে লঞ্চটা।

মিশ্রী খানের বোমায় এঞ্জিনরূমের তলা নিশ্চয়ই খসে গেছে। দাউ দাউ করে জ্বলছে লঞ্চ। শুকনো কাঠ জ্বলছে, তাই ধোঁয়াও নেই, আর ধোঁয়া দেখে অনুসন্ধিৎসু পে−নের আশঙ্কাও নেই। আধ মিনিটেই চলে যাবে লঞ্চটা পানির তলায়। হঠাৎ দৃষ্টি পড়ল রানার একজন লোকের ওপর।

ছুরির মত কোনও লোহার পাত লেগে চিরে গেছে পেটটা। নাড়ি-ভুঁড়ি বেরিয়ে পড়েছে ডেকের ওপর। বেঁচে আছে এখনও। এক হাতে পেট চেপে ধরে হামাগুড়ি দিয়ে আগুন থেকে সরে আসতে চাইছে সে। বীভৎস সে দৃশ্য।

চোখে-মুখে তার মৃত্যুর আতঙ্ক। ভাঙা-চোরা ডেকের ওপর উঠে এল পানি। দপ্ করে নিভে গেল আগুন। ধীরে ধীরে ডুবে গেল লঞ্চটা। খানিকটা সাদা ফেনা আর তৈলাক্ত বুদ্বুদ ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট রইল না।

শান্ত আরব সাগরে মৃদু হাওয়া- চারদিক নিস্তব্ধ। একটা উল্টানো হেলমেট ভেসে যাচ্ছিল, ডুবিয়ে দিল রানা সেটাকে। চিহ্নমাত্র রইল না আর এতবড় লঞ্চটার। নিজেদের নৌকার দিকে ফিরল এবার রানা। প্রকাণ্ড দেহী আলতাফ আর বাচাল মিশ্রী খান উঠে দাঁড়িয়েছে।

মাহবুবও উঠে বসবার চেষ্টা করছে। ওর জুলফির কাছে একটা ক্ষত থেকে রক্ত ঝরছে। মিশ্রী খান এগিয়ে গেল সবচেয়ে আগে। ক্ষতটা পরীক্ষা করে ডাক্তারী চালে বলল, ‘কিচ্ছু হয়নি। সামান্য বাড়ি লেগেছে কাঠের টুকরোর।

’ ইমার্জেন্সী মেডিকেল কিট খুলে ডেটল দিয়ে ধুয়ে জায়গাটায় সার্জিক্যাল টেপ লাগিয়ে দিল সে। আলতাফ ব্রোহী বিষণড়ব মুখে দাঁড়িয়ে ছিল চুপচাপ। ওর পায়ের কাছে পড়ে আছে কারবাইন-ধারী অফিসার দুজন। ওর দিকে চেয়ে রানা বুঝল ওর মানসিক অবস্থাটা। ‘শেষ?’ জিজ্ঞেস করল সে মৃদুকণ্ঠে।

মাথা নাড়ল আলতাফ ব্রোহী। ‘হ্যাঁ! অতিরিক্ত জোরে মেরেছিলাম। ’ ভারি শোনায় ওর কণ্ঠস্বর। ১৪ মাসুদ রানা-৬ রানা জানে বহু লোক প্রাণ দিয়েছে আলতাফ ব্রোহীর হাতে। যখনই সে মেরেছে; দক্ষ হাতে নির্দয়ভাবে মেরেছে।

কিন্তু প্রতিবারই অনুশোচনায় নিজেকেও সেই সাথে দগ্ধে মেরেছে। ওর ধারণা কারও প্রাণ নেবার তার কোনও অধিকার নেই। খোদা এভাবে অপঘাতে মরবার জন্যে প্রাণ সৃষ্টি করেননি। কিন্তু বেশি লোকের বেশির ভাগ ভাল-র জন্যে অসংখ্য প্রাণ শিখা নিজ হাতে নিভিয়ে দিতে হয়েছে ওকে। প্রতিবারই বিবেক দংশন করেছে ওকে- প্রতিবারই ওর মনে হয়েছে, হয়তো অন্য কোনও উপায় ছিল, হয়তো এদের মৃত্যুর সত্যিই কোনও প্রয়োজন ছিল না।

প্রতিবারই ওকে অনেক যুক্তি-তর্ক দিয়ে নিজের মনকে বোঝাতে হয়েছে যে সে হত্যা করেছে প্রতিশোধের জন্যে নয়, ঘৃণার জন্যে নয়, জাতীয়তাবাদ কিংবা ‘ইজম্’ তো নয়ই- অন্যায়কে দমন করে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার জন্যে। ‘আর কারও কিছু লাগেনি তো? মিশ্রী?’ ‘না, ওস্তাদ। ’ ‘বেশ। আলতাফ, পাল তুলে দাও। নয়টা বাজতে যাচ্ছে।

সিগন্যালের সময় হয়ে গেছে। মাহবুব হাল অ্যাডজাস্ট করে করাচি টিউন করবার চেষ্টা করে দেখো। ’ আকাশের দিকে একবার চেয়ে বলল, ‘ওদের ফোরকাস্টটাও শোনা দরকার। এখন আপাতত যত তাড়াতাড়ি এখান থেকে ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.