আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার দেখা ভালোমানুষেরাঃ অবলা নারী পর্ব-২

আমিও বাধ ভাংতে চাই... এই পর্বটা আসতে একটু দেরী হল। এইবার চেষ্টা করব দিদুর জীবনের কয়েকটা ঘটনা শেয়ার করতে। ১। আমার দাদার পোস্টিং ছিলো দর্শনা, আগেই বলেছি। সুতরাং ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার স্বার্থে দিদুকে একলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আমাদের বাড়িতে থাকতে হোত আর বাড়তি জায়গায় একটা ঘর উঠিয়ে ভাড়া দিতেন।

একবার সে ঘর ভাড়া নিলেন এক টিএনও। তখনও কোয়ার্টার পাননি মনে হয়। কিন্তু বাড়িটার লোকেশন আর একলা মালকিনকে দেখে বেচারা আস্তে আস্তে চেষ্টা করছিলেন বাড়িটা দখলের। কিছু শুভাকাঙ্খীর কাছ থেকে আমার দিদু জেনেও গেলেন সেকথা। কিন্তু আগে থেকে কি করবেন? চুপ করে অপেক্ষা করতে থাকলেন।

একদিন সকালে উঠে খুব চিৎকার শুরু করে দিল লোকটা। দিদুর ছেলেরা উনাকে বিরক্ত করে, উনার জায়গায় (!) খেলাধুলা করে নোংরা করে রাখে… ইত্যাদি। কানের কাছে এসে অনেকক্ষণ ঘ্যানঘ্যান করেও জবাব না পেয়ে আর একটু আগে বেড়ে আব্বুদের কাকে যেন ধরে ফেলল মারবে বলে! আর তো সহ্য করা যায় না। দিদু সামনে এগিয়ে বসিয়ে দিলেন এক চড়। আঘাতের চেয়ে অপমানটাই বড়।

লোকটা সাথে সাথে অফিস থেকে আরো কিছু সরকারী কর্মকর্তা ডেকে নিয়ে আসল শালিসের জন্য। এনে আসামীকে সামনে রেখে অভিযোগও পেশ করলো। এইবার দিদু কান্নাভেজা কন্ঠে বললেনঃ আমি মহিলা মানুষ, একলা থাকি। কিছু ঘটলে যে আমার স্বামীকে জানাবো তারও কোন উপায় নাই। আমার ছেলেমেয়েরা নাবালক।

আপনারা শুধু একটা কথার বিচার করেন। এই লোক আমার কত কাছে আসলে আমি তাকে থাপ্পড় দিতে পারলাম? আমার সম্মান বাঁচানোর এইটুক অধিকারও কি আমার নাই? সবাই তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ়! আর কথা না বাড়িয়ে সবাই টিএনও সাহেবকে পরামর্শ দিলেন মানসম্মান থাকতে এলাকা ছেড়ে দিতে। তিনি পরের দিনই বাসা ছেড়ে দিয়েছিলেন। ২। ৫ ছেলেকে নিয়ে দিদু গিয়েছেন দাদার কাজের জায়গায়।

ছুটিতে দাদা আসতে পারবেন না এজন্য। ফেরার সময় দুরন্ত বাচ্চাদের সামলাতে গিয়ে একটা দূর্ঘটনা ঘটে গেল। মালপত্র সব আর বাচ্চাদের উঠানোর পর ট্রেন ছেড়ে দিল, দিদু উঠতে পারেননি তখনও। বুদ্ধি করে চেপে ধরলেন মাত্রই উঠেছেন এমন এক যাত্রীর ছাতা! সে বেচারা তো মহা খাপ্পা। ছাতা চোরের হাত থেকে ছাতা বাঁচাতে আরেক প্রান্ত আরো কষে চেপে টান দিলেন।

ব্যস, ছাতার সঙ্গে উঠে গেলেন দিদু। উঠেই লোকটাকে অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে বাচ্চাদের সাথে গিয়ে বসলেন। ৩। ১৯৭১ এর ঘটনা এটা। ব্রাহ্মণবাড়িয়া হিন্দুপ্রধান এলাকা আর সীমান্তের কাছাকাছি হওয়াতে যুদ্ধের সময় একরকম খালিই হয়ে গিয়েছিলো।

আর সে সুযোগে সুযোগসন্ধানীরাও লুটপাট করেছিল ইচ্ছামত। নিজের জায়গা থেকে যতটুকু সম্ভব প্রতিবাদ করতেন দিদু। যুদ্ধের পর যখন সবাই ফিরে আসলো, তখন শুরু হল আরেক প্রহসন। সম্ভ্রান্ত হিন্দু মহিলারাও নেমে পড়লেন ট্রেজার হান্টে। দলবেঁধে এক এক বাড়ি গিয়ে যা-ই পছন্দ হত আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতেন আর সাথে আসা কাজের লোকেরা সেসব উঠিয়ে নিয়ে যেত।

এমনকি অনেক নিম্ন বর্ণের হিন্দুকেও এই অত্যাচার সহ্য করতে হচ্ছিল। একদিন আমাদের বাড়িতেও আসলেন বিখ্যাত পাল বাড়ির বউয়ের নেতৃত্বে আরো কয়েকজন। দিদুকে ডেকে বললেন, আমরা বাড়ি সার্চ করবো। দিদু প্রথমে ঠান্ডা মাথায় বুঝাতে চেষ্টা করেছিলেন যে আমি লুটপাট করিনি। কিন্তু উনারা নাছোড়বান্দা।

তারপর দিদু দিয়ে বসলেন এক শর্ত। যদি উনাদের কিছু এই বাড়িতে পাওয়া যায়, তবে উনারা দিদুকে বেঁধে বিচার করবেন আর যদি কিছু না পাওয়া যায় তাহলে এর উল্টাটা হবে! উনারা হাসতে হাসতেই রাজি হলেন। এরপর সারা বাড়ি ঘুরেও যখন কিছু পাওয়া গেল না উনারা তাড়াতাড়ি চলে যেতে উদ্যত হলেন। তখন দিদু পাল বাড়ির বউকে ধরে হাত বেঁধে ফেললেন, আর মনে করিয়ে দিলেন শর্তের কথা। পরে ওই বাড়ির পুরুষরা এসে মাফ চেয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল আর কথা দিয়েছিল আর কোন বাড়িতে গিয়ে এরকম হানা দেয়া হবে না।

আগের পর্ব এখানে আমার দেখা ভালোমানুষেরাঃ অবলা নারী পর্ব-১ দাদুবাড়ি নেয়ে একটা লেখাঃ আমি একটা জানালা চেয়েছিলাম ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.