আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রলয়ের হাতছানি

মাথায় ভুত চাপলে মানুষ অনেক কিছুই করে। আমার মাথায় একটা গল্পের প্লট চলছিল অনেক দিন থেকেই। ভাবলাম গল্পটা এইবার লিখে ফেলবো। তবে পুরোটা একবারে নয়। একটু করে।

১লা জুন,২০১৪ করিয়াক মাউন্টেইন রেঞ্জ, সাইবেরিয়া, রাশিয়া বরফের নিচে,কঠিন পাথরের শুরু যেখান থেকে,তারো প্রায় ৫০ মিটার নিচে দিয়ে চলে গেছে দীর্ঘ এক গোপন প্যাসেজ। প্যাসেজের দু পাশের দেয়ালে প্রায় বোঝা যায় না এমন অসংখ্য দরজা ছড়িয়ে আছে। স্নায়ুযুদ্ধের শুরুর দিকে এই প্যাসেজ,দু পাশের দেয়ালের দরজা আর দরজাগুলোর ওপাশের অসংখ্য ছোটবড় ঘর,প্যাসেজ আর ল্যাবরেটরি নিয়ে তৈরি এই বিশাল অতি গোপন মিলিটারি রিসার্চ ফ্যাসিলিটিটার নির্মাণকাজ শেষ হয়। মূলত হাই পাওয়ার লেজার, ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ওয়ারফেয়ার,ডাইরেক্টেড এনার্জি ওয়েপন আর নিউক্লিয়ার ডিভাইস নিয়ে গবেষণা হয় এখানে। এর গোপনীয়তা নিয়ে এখানকার কর্মীরা গর্ব করে।

এটা রাশিয়ার সবচেয়ে বড় মিলিটারি রিসার্চ ফ্যাসিলিটিগুলোর একটা এবং এটার হদিস এমনকি সি আই এ পর্যন্ত জানে না। এমনকি রাশিয়ান সামরিক বাহিনীরও খুব বেশি লোক এটার অস্তিত্ব সম্পর্কে জ্ঞাত নয়। প্যাসেজটার প্রায় আধ কিলোমিটার নিচে নিউক্লিয়ার রিসার্চ ডিভিশন। তার ভেতরে অনেকগুলো ল্যাব। নিউক্লিয়ার রিসার্চ ডিভিশনের প্রধান গেট থেকে শুরু হওয়া করিডোরটা প্রায় ৫০ মিটার সোজাসুজি গিয়ে "টি" আকারে দুদিকে চলে গেছে।

ডানদিকে ২০ মিটার যাওয়ার পর হাতের বামদিকে বড়সড় একটা ভারি দরজা,তার ওপর বড় আকারে লেখা Лаборатория-17 СОВЕРШЕННО СЕКРЕТНО Уровень 10 оформление только অর্থাৎ ল্যাব-১৭ অতি গোপনীয় শুধুমাত্র দশম লেভেল প্রবেশাধিকার অবশ্য দশম লেভেল প্রবেশাধিকার বা অতি গোপনীয় সাইন দেয়া ল্যাব এটাই একমাত্র না। দরজার ওপাশে দেড়শো ফুট বাই আশি ফুট ঘরটার ভিতরে চল্লিশ জন লোক মহাব্যস্ত ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তাদের কেউ কেউ বিজ্ঞানী,কেউ কেউ প্রকৌশলী,কেউ টেকনিশিয়ান আর বাকিরা সামরিক কর্মকর্তা। সামরিক কর্মকর্তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে, বাকিরা কেউ মনিটরের সামনে,কেউ ট্যাব বা ক্লিপবোর্ড হাতে দৌড়াদৌড়ি করছে আর যন্ত্রপাতি চেক করছে আর কেউ ঘরের প্রায় দুই তৃতীয়াংশের বেশি জায়গা দখল করে থাকা বিশাল এক্সপেরিমেন্টাল রিঅ্যাক্টরটার সামনে কাজ করছে। আজ একটা অনেক বড় দিন এই রিসার্চ টিমটার জন্য।

তাদের অনেকেই এই প্রজেক্টে প্রায় দশ বছর ধরে কাজ করছে। গত পাঁচদিন প্রায় কেউ ই ঘুমোয়নি। খাওয়া দাওয়া ও অনেকে করেছে ল্যাবেই,মনিটরের সামনে বসে। আজকে ফাইনাল টেস্টিং এর দিন। পরমাণু বোমার জন্য ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ প্রক্রিয়ার প্রযুক্তিতে এক মাইলফলক যুক্ত হতে যাচ্ছে আজ।

যে কাজ করতে দিনের পর দিন বিশাল কারখানাতে দানবাকৃতির সব যন্ত্র চলত,সেই কাজ এখন কয়েক ঘন্টার মধ্যে ছোট জায়গাতেই করে ফেলা সম্ভব হবে। ত্রিশ বছরের এক তরুণ প্রকৌশলী সামরিক অফিসারদের সাথে আলাপরত ল্যাবকোট পরা এক বৃদ্ধের দিকে এগিয়ে গেলো। বৃদ্ধের বয়স ষাটের কিছু বেশি,পাকা উশকোখুষ্কো চুল,মোটা গোঁফ আর অল্প একটু দাড়ি। তিনি এই প্রজেক্টের জনক এবং প্রধান ডঃ মিখাইল দব্রোভলস্কি। লম্বায় ছয়ফুট ২ ইঞ্চি, হাল্কা পাতলা দেহ এবং অসাধারণ এক ব্যক্তিত্ব।

এককালে মস্কো ইউনিভার্সিটির প্রোফেসর ছিলেন, বারো বছর আগে তার কিছু কাজ সামরিক বাহিনীর নজরে আসে। তারপর আর কি, প্রোফেসর জীবনের সমাপ্তি, দু বছর চেলিয়াবিন্সকে ছিলেন, এরপর এই ল্যাবে আসা। বিয়ে থা করেননি,তাই পিছুটান বলতে গেলে নেই। এই দশ বছরে দু তিন বারের বেশি বের হননি এই জায়গা থেকে। নিজেকে ঠাট্টা করে মোল র‍্যাট বলেন তিনি।

তরুণ প্রকৌশলী গিয়ে তাকে বলল,"সব চেকিং শেষ স্যার" তিনি ঘুরে দাঁড়ালেন। চোখে চাপা উত্তেজনা। একটু হেঁটে গিয়ে একটা মনিটরের সামনে রাখা একটা মাইক্রোফোন তুলে নিলেন। তারপর একটু কেশে সবার মনযোগ আকর্ষণ করে বললেন,"এক্সকিউজ মি,জেন্টলমেন, আজকে রাশিয়ার সামরিক শক্তির জন্য অনেক বড় একটা দিন। আজ অনেক ছোটবড় বাধা পেরিয়ে অবশেষে আমাদের ফাইনাল টেস্ট।

আগে যে পরিমাণ ইউরেনিয়াম এনরিচ করতে বহুদিন লেগে যেতো,বহু অর্থ লেগে যেতো,তা মাত্র একদিন বা তারো কম সময়ে করা সম্ভব হবে। এবং খরচ হবে আগের সবচেয়ে সাশ্রয়ী প্রযুক্তিরও অর্ধেক। যাহোক এসব আপনাদের জানা যেহেতু প্রজেক্টটার বয়স দশ বছর। এর মধ্যে এর উন্নয়ন আপনারা দেখেছেন,সমস্যা দেখেছেন,তার সমাধান ও দেখেছেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে আমার টিমের কাছে ঋণী,আমার চিন্তাটাকে বাস্তবে রূপ দিতে আমার সাথে এতোদিন থাকার জন্য।

" এরপর একটু থেকে তিনি বললেন,"আপনারা দেখেছেন কিছুক্ষণ আগে রিঅ্যাক্টরে অসমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম প্রবেশ করানো হয়েছে সেফটি চেম্বার দিয়ে। এখন সিস্টেম সম্পুর্ণ প্রস্তুত। তাহলে আমরা প্রক্রিয়া শুরু করতে পারি। " বলে তিনি সামনের প্যানেলের একটা নাম্বার প্যাডে গোপন একটা নাম্বার প্রবেশ করালেন। প্যানেলের একটা ছোট অংশ খুলে একটা স্বচ্ছ ঢাকনা আবৃত বড় লাল সুইচ উঠে এলো।

সুইচের পাশে একটা চাবির ফুটো। তিনি ঢাকনাটা খুলে মাইক্রোফোনটা তুলে বললেন,"জেনারেল ইগর,দয়া করে আসুন এবং চাবিটা প্রবেশ করান"। পঞ্চাশোর্ধ্ব সম্পুর্ণ ইউনিফর্ম পরিহিত একজন জেনারেল এগিয়ে এলেন। তিনি জেনারেল ইগর,এই প্রজেক্টের সামরিক উপদেষ্টা। পকেট থেকে একটা চাবি বের করে চাবির ফুটোয় ঢুকিয়ে দিলেন।

সাথে সাথে একটা বড় লাল আলো জ্বলে উঠলো। তারপর তিনি একবার সবার দিকে তাকালেন এবং লাল সুইচটা টিপে দিলেন। সাথে সাথে একটা বিশাল দরজা নেমে এলো রিঅ্যাক্টর আর ঘরের বাকি অংশের মধ্যে। একটা বড় মনিটরে কাউন্টডাউন শুরু হলো। সংখ্যাটা শূন্যতে নেমে আসতেই একটা গুঞ্জন শুরু হলো।

নিয়ন্ত্রক কম্পিউটার যান্ত্রিক নারীকন্ঠ্যে ঘোষণা দিলো, "রিঅ্যাক্টর চালু হয়েছে। " তিনঘন্টা পরের কথা। যে পরিমাণ ফুয়েল ঢুকানো হয়েছিলো তার সমৃদ্ধকরণ প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। আগে এর একশো ভাগের এক ভাগ সমৃদ্ধ করতে সারাদিন লেগে যেতো। এখন একটা রোবটিক হাত ফুয়েল নিয়ে এনরিচমেন্ট টেস্টিং চেম্বারে প্রবেশ করাচ্ছে।

এর আগের বার পিউরিটিতে কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছিলো। সেই সমস্যাটা ঠিক করতে একমাস লেগে গিয়েছিলো। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে এনরিচমেন্ট টেস্টিং সিস্টেমের ফলাফল জানতে। অবশেষে আধা ঘন্টা পর বড় মনিটরটায় ফুটে উঠলো, Анализ отчета Топливо образец был протестирован тест показывает 99.99999999% U-235 обогащения по всей выборке топлива অর্থাৎঃ Analysis report Fuel sample has been tested test indicates 99.99999999% U-235 enrichment for the entire fuel sample এরপর আরো কিছু টেকনিক্যাল ডাটা। পুরো ঘরে একটা আনন্দের জোয়ার বয়ে গেলো।

সবাই একে অপরকে অভিনন্দন জানানো শুরু করলো। অনেকে এসে ডঃ মিখাইল দব্রোভলস্কি এবং জেনারেল ইগররের সাথে হ্যান্ডশেক করলো,তাদের অভিনন্দন জানালো। পুরো ঘরে একটা স্বস্তির ছোঁয়া। দশ বছরের নিরলস পরিশ্রম সফল হয়েছে আজ। দব্রোভলস্কি মনে মনে খুশিতে লাফাচ্ছেন,অনেকগুলো কারণেই।

আজ তার জন্য অনেক,অ-নেক বড় একটা দিন। তবে তিনি তার কাজ ভুলে যাননি। তিনি একটু পর মাইক্রোফোন তুলে নিয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,"জেন্টলমেন, সবাইকে অনেক অভিনন্দন। তবে আমাদের কাজ ভুললে হবে না। রিঅ্যাক্টর ক্লিনআপ প্রসেস শুরু করা হোক।

" যারা ক্লিনআপ প্রসেস নিয়ন্ত্রণ করবে তার আবার চেয়ারে বসে মনিটরের দিকে তাকিয়ে কাজ শুরু করলো। সামরিক অফিসাররা বেরিয়ে গেলেন,সাথে আরো অনেকেই। জেনারেল ইগর চাবিটা নিয়ে দব্রোভলস্কির কাঁধে একটা চাপড় মেরে বেরিয়ে গেলেন। দব্রোভলস্কি ক্লিনআপ প্রসেস সুপারভাইজিং এ মন দিলেন। রাত এগারোটা।

দব্রোভলস্কি তার ঘরে ইজিচেয়ারে শুয়ে আছেন। সন্ধ্যা ছয়টায় কাজ শেষ করে তিনি ঘরে ফিরেই ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিলেন । দশমিনিট আগে ঘুম থেকে উঠে এখন ইজিচেয়ারে আরাম করে শুয়ে একটা বই পড়ছেন। তার ঘরটা একরকম একটা ছোটখাটো লাইব্রেরি। অনেক নামী লেখকের বই আছে তার কাছে।

কিশোর বয়সের ড্যানিয়েল ডিফো, রবার্ট লুই স্টিভেনসন থেকে শুরু করে যৌবন বার্ধক্যে পড়া ভিক্টর হুগো, আসিমভ,হিচকক সহ বহু লেখকের বই তিনি সংগ্রহে রেখেছেন। তার জামা কাপড় হারিয়ে গেলেও বই একটাও হারায়নি। গত কয়দিন কাজের চাপে বই পড়ার সময় পাননি। এখন দান্তের "ইনফার্নো" মহাকাব্য নিয়ে বসে আছেন। পড়ছেন আর ভাবুক হয়ে যাচ্ছেন।

হেলের সেভেন্থ সার্কেল এর মিডল রিং এর অংশটায় এসে আনমনা হয়ে গেলেন,ওই অংশটায় তারা থাকে যারা আত্নহত্যা করে। একটু পর বইটা বন্ধ করে রেখে দিয়ে টেবিলে গিয়ে বসলেন। তার লেখালেখির শখ আছে বহু দিন ধরেই। একসময় তার কিছু লেখা রাশিয়ান লাইফ ম্যাগাজিনে ছাপা হয়েছিলো। ছোটদের জন্য লিখতেন ছাত্রজীবনে।

লেখালেখি করার জন্য ডায়রি আছে তার। সেখানে কিছু পাতায় গল্প,কোথাও অর্থহীন আঁকিবুকি,কোথাও একটুখানি কবিতা,কোথাও ব্যক্তিগত কথা লেখা। আজ লিখতে ভালো লাগছে না। তিনি একটু ডায়রীটা নাড়াচাড়া করে বন্ধ করে রাখলেন। একটু পর তার ঘরের ফোনটা বেজে উঠলো।

তিনি মনে মনে এই ফোনটা বাজার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ফোনটা ধরতেই জেনারেল ইগরের কন্ঠ্য ভেসে এলো,"কিহে!!! চলে এসো রিফ্রেশমেন্ট রুমে। আজ তোমার সাথে কঠিন দাবা খেলা আছে আমার। গত দুবার আমাকে হারিয়েছ,আজ আমার পালা। " দব্রোভলস্কি হেসে বললেন,"দুবার না ইগরসোনা, গত দশ বছরে একবার ড্র করেছিলে,আর বাকি বার গুলোতে হেরেছ।

" ওপাশ থেকে ইগরের হাসি শোনা গেল,"এবার আর না দব্রোভায়া। চলে এসো। " বলে ফোনটা রেখে দিলেন। দব্রোভলস্কি উঠে দাঁড়ালেন। তার পরণে স্লিপিং স্যুট।

সেটা বদলাতে হবে। তার প্যান্ট শার্ট বিছানাতেই পড়ে আছে। ইচ্ছে করেই চেঞ্জরুম থেকে নিয়ে এসেছিলেন। মনে মনে বললেন,"আমার কাজ শেষ। দ্যুঁপের কাজটা তোমার কাজকেও এগিয়ে রেখেছে আশা করি গাত্তি।

আমার কাজ তুমি পেয়ে যাবে। আমার সময় এসে গেছে। " তিনি আড়চোখে তার ঘরের সিকিউরিটি ক্যামেরার দিকে তাকালেন। এরপর তার টেবিলের চোখা মাথাওয়ালা পেপারওয়েটটা বেখেয়াল হবার ভান করে মাটিতে ফেলে দিলেন। ব্যাপারটা আগেও করেছেন তিনি,তাই সেটা ঠিক জায়গামতোই পড়লো।

ত্রিভূজাকৃতির বস্তুটার একটা চোখা মাথা উপরের দিকে। তিনি সেটা না দেখার ভান করে প্যান্ট উঠিয়ে চেঞ্জরুমের দিকে হাঁটা দিতে গেলেন। প্যান্টটার একটা পা তার পায়ের নিচে পড়লো। তিনি আনমনে হাটার ভান করে ওটা টান দিতে গিয়ে হোঁচট খেলেন,এটাও অনুশীলন করা। মেঝেতে পড়তে গিয়ে বুকে চোখা পেপারওয়েটটা পুরোটাই প্রায় ঢুকে গেলো।

তীব্র ব্যথা সত্ত্বেও তার মুখে এক মুহূর্তের জন্য হাসি ফুটে উঠলো। তারপর সব অন্ধকার। ক্যামেরা রুমের ডিউটিরত সৈনিক স্ক্রিনে তাকিয়ে প্রথমে বুঝতেই পারলো না কি দেখছে সে। এরপর সে সম্বিৎ ফিরে পেয়েই অ্যালার্ম বাজিয়ে দিলো। পরবর্তী অংশ পড়তে ক্লিক করুন ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।