আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নয়া ফাঁদ! সাবধান!

বাংলাদেশ ঢাকা: “স্যার, এই কাগজটা ‘কী’, একটু দেইখ্যা দিবেন? ভাড়া চুকিয়ে রিক্সা থেকে নামতে যাবো এমন সময় রিক্সাওয়ালা সবুজ রঙের একটি কাগজ এগিয়ে দিয়ে প্রশ্নটি করে। ২০ ডলারের একটি নোট। না, কোনো ভেজাল নেই, আসল-ই মনে হচ্ছে। হেসে বললাম, এটা তো ডলার, ২০ ডলারের নোট। তুমি পেলে কোত্থেকে? স্যার, ডলার কি? ডলার হচ্ছে আমেরিকান টাকা।

২০ ডলারে অনেক টাকা। তুমি পেলে কোত্থেকে? এক স্যারে খুশি হইয়া দিছে। স্যার এইটা দিয়া অনেক টাকা ক্যামনে পামু? মে মাসের শেষের দিনের ঘটনা এটি। ভাবলাম, যে লোকই টাকাটা ওকে দিয়ে থাকুক, তার মনটা অনেক বড়। হয় তো কিছুক্ষণ আগেই বড় কোনো দান মেরেছেন তিনি, তাই খুশী হয়ে রিক্সাওয়ালাকে এত টাকা বকশিস দিয়েছেন।

রিক্সাচালককে বললাম, মানি এক্সচেঞ্জে যেতে হবে তোমাকে। বসুন্ধরা সিটির নিচের তলায় মানি এক্সচেঞ্জ আছে। ওখানে গেলেই তারা এটা ভাঙ্গিয়ে তোমাকে টাকা দেবে। এখন ডলারের রেট ৮১ টাকার মত। ২০ ডলার ভাঙ্গিয়ে ১৬২০ টাকা পাবে।

স্যার, আমি রিক্সাওয়ালা মানুষ। আমি গেলে ভেজাল করতে পারে। আপনিই এইটা রাইখা আমারে কিছু টাকা দেন। আমি সতর্ক হয়ে উঠি। এসব তো পুরনো খেল।

পিতলের টুকরোকে স্বর্ণের টুকরো বলে প্যাসেঞ্জারকে লোভের জালে ফেলে রিক্সাওয়ালাবেশি প্রতারকদের বাটপারির অনেক ঘটনা জানা আছে। ভালো করে তাকাই চালকের মুখের দিকে। নাহ্‌, একেবারে সিধাসাদা আদমি। তারপরও সতর্ক হই। বলি, না।

এ মুহূর্তে আমার কাছে এক টাকাও নেই। তুমি অন্য কোথাও চেষ্টা কর। স্যার, এক কাম করলে কিমুন অয়— আমি আপনারে রিক্সায় কইরা বসুন্ধরায় লইয়া যাই। হেইহানে আপনি এই টাকাটা আমারে ভাঙ্গাইয়া দেন। তারপর আমি আমার রিক্সায়ই আপনেরে এইহানে নামায়া দিয়া যামু।

নিজেকে আমি বোকা মনে করি না কখনোই। এছাড়া ডেয়ার-ডেভিল মাসুদ রানা না হলেও একেবারে ভীতু নই। সাত-পাঁচ চিন্তা করে সাহসেরই জয় হয়। বলি, চল। ধানমন্ডি ৯/এ সড়কে আমার বাসার সামনে থেকে ফের রিক্সায় উঠি।

বসুন্ধরা সিটিতে সহজেই টাকা ভাঙানো গেল। ডলারটায় কোনো ভেজাল নেই দেখে নিজের বিবেচনার ওপর ভক্তিটা আরও জোরালো হলো। এরপর ফেরার পথে গ্রাম থেকে আসা সহজ সরল রিক্সাওয়ালার সঙ্গে টুকটাক কথাবার্তা হয়। সে বারবার কৃতজ্ঞতা জানাতে থাকে। আমিও একজন রিক্সাওয়ালার উপকার করতে পেরে আনন্দিত মনে বাড়ি ফিরি।

তার নাম সুলতান। বিদায় জানানোর আগে সে আমার সেল নাম্বার চেয়ে নেয়। এরপর রাতেই রিক্সাওয়ালা সুলতান ফোন দিয়ে কুশল জিজ্ঞাসা করে। আমি খুশি হই। এরপর তার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ জারি থাকে।

একদিন ফোন করে বলে, স্যার আমার কাছে ওই রকম টাকা আরও আছে। মানে ডলার? হ্যাঁ। কোত্থেকে পেয়েছে? আবার সেই ভদ্রলোক দিয়েছে নাকি। না স্যার। এইটা আসলে অন্য কাহিনী।

আমি আপনারে টাকাগুলান দেহাইবার চাই। চলে আস। আমার কর্মস্থলের ঠিকানা বলি তাকে। না স্যার। আমি রিক্সাওয়ালা মানুষ হেই হানে এই লেবাস-সুরতে যাইবার পারুম না।

ঠিকই বলেছে। রিক্সাওয়ালা তো কি। সুলতান ব্যাটার কমন সেন্স আছে! আমি আবারও খুশি হই। পরে সাব্যস্ত হয়, ইটিভি ভবনের পাশের গলিতে দেখা করবো। জায়গাটা আমার অফিস থেকে কাছে।

সুলতানের সঙ্গে আরও দু’জন আসেন। একজন তার সমবয়সী, নাম কামাল। সুলতান জানায় পেশায় ফেরিওয়ালা কামাল তার বস্তির পাশেই থাকে। আর অপরজন বয়সে তরুণ। কথাবার্তায় বিহারি টান।

সুলতান বললো, সে থাকে চট্টগ্রাম। তবে নাম জানায়নি। তারা একটি কাপড়ের ভেতরে মোড়ানো অনেকগুলো ডলার দেখায়। পুরনো নতুন মিলিয়ে ডলারগুলো এবারও আসলই মনে হলো। জিজ্ঞেস করলাম, এগুলো কোত্থেকে পেয়েছো? স্যার, টেকাগুলান এক মাউরা (মারোয়ারি) ব্যবসায়ীর।

সে চিটাগাংয়ে রেল স্টেশন এলাকায় এক বাড়িতে থাকতো। একদিন ঘুমের মইধ্যে মারা যায়। তার মাথার বালিশের মধ্যে এই টেকাগুলান ছিল। তার বাড়িতে ঝি’র কাম করতো এক মাতারি। একদিন ঘর পরিষ্কার করার সময় বালিশটা ছিড়া যাওয়ায় ভিতর থেইকা একটা টেকা বাইর অইয়া আহে।

মাতারি টেকাটারে পুরানা লটারির কাগজ মনে কইরা তার অল্প বয়েসি এই ভাইগনারে দেয় (বলে তরুণ ছেলেটাকে ইঙ্গিত করে)। পরে জানা যায় এইটা ডলার। তারপর মাউরা মারা যাওয়ার পর একদিন ওই বালিশটা নিয়ে চইলা আসে ওই মাতারি। ওই বাড়ির কেউ জানতো না এর ভেতরে যে ডলার ভর্তি। ওই পোলাটা হইলো কামালের আত্মীয়।

সেই এইগুলা আমগোর কাছে আনছে। আমার কেমন কেমন অবিশ্বাস হতে থাকে। কিন্তু সুলতান যে সহজ সরল প্রকৃতির, আর আমাকে যে সম্মান করে, তাতে তাকে অবিশ্বাস করা যায় না। জিজ্ঞেস করি, কতগুলি আছে নোট? শ পাঁচেক। মনে মনে হিসেব করি, তার মানে ৮ লাখ টাকার ওপরে! জিজ্ঞেস করি, কি করবে? স্যার হেই লেইগাই তো আপনের কাছে আইছি।

আমরা গরিব-ধরিব মানুষ। ভদ্রলোকগো লগে কথা কইবার পারি না। কুনু জাগায় কথা কইতে গেলেই ধমকি-ধামকি দিয়া খেদায়া দিব। আপনি অহন আমগো মা-বাপ। আপনেই এইগুলান রাইখা দেন।

আমার কাছে তো এগুলো নেওয়ার মত অত টাকা নাই। স্যার, আপনে ভালা মানুষ। আপনে আমগো ঠকাইবেন না হেইটা জানি। আপনে অর্ধেক দাম দিয়েন স্যার। তারপরও আমি সর্বোচ্চ শ’দুয়েক নোট কিনতে পারবো এখান থেকে।

স্যার, আপনের লগে কুনু দরদাম নাই। আপনের যা দিবেন তাতেই আমরা খুশি। আমার কাছে এখন টাকা নেই। কয়েকদিন সময় লাগবে টাকা বন্দোনস্ত করতে। তাদের কাছে কয়েকদিন সময় চেয়ে নেই।

বলি আমার অফিসে আসতে। সুলতান ফের আমাকে মনে করিয়ে দেয় তার লেবাস-সুরতের কথা। আমি লজ্জা পাই। তাই তো! তারা ওখানে কি করে আসবে? সেখানে তো সমাজের উচ্চস্তরের এলিটদের আনাগোনা। পরে তারা প্রস্তাব দেয় টিএসসি’র সামনে হবে লেনদেন।

অন্য যেখানেই বলি, তারা সমস্যা দেখায়। তবে সুলতান যেহেতু নির্ভেজাল সরল মানুষ, আমি তাদের কথায় সায় দিই। হোটেল রেস্টুরেন্ট বা অন্য যে কোনো জায়গায় ডলার বিনিময় ঝামেলার ব্যাপার। টিএসসি হচ্ছে নিরাপদ জায়গা। এরপর কয়েকবার যোগাযোগ শেষে ঠিক হয় ৬ আগস্ট বেলা সাড়ে এগারোটায় টিএসসির সামনে সুলতান আসবে ডলার নিয়ে।

আমি ৯৫ হাজার টাকা নিয়ে যাবো। সুলতান-কামাল এল সময় মতই। সঙ্গে বিহারী ছেলেটাও। আমিও ছিলাম আগে থেকেই। কামাল আর বিহারী ছেলেটা আমার সঙ্গে রিক্সায় উঠলো।

সুলতান দাঁড়িয়ে রইলো একটু দূরে। ‌আমি ৯৫ হাজার টাকার বান্ডিল তাদের হাতে দিলাম। তারা কাগজের একটি প্যাকেট দিল। আমি খুলে ডলারগুলো দেখতে চাইলাম। ওরা বললো, স্যার এইখানে রাস্তায় খুইলেন না।

ছিনতাইকারীর নজরে পইড়া যাইবেন। পুলিশও ঝামেলা পাকাইবার পারে। আমি কম সাবধানী লোক না। এতদিন সুলতান পার্টির সব কথায়ই সায় দিয়ে আসলেও এবার কাগজের প্যাকেট খুলে দেখতে চাইলাম। প্যাকেটটি খুলতে শুরু করতেই হঠাৎ দু’জন একসঙ্গে রিক্সা থেকে লাফ দিয়ে নেমে দৌড় দিল।

আমি চি‍ৎকার করে তাদের ডাকতে থাকলাম। তারা শুনলো না এবং কাছেই দাঁড় করানো একটি সিএনজিতে উঠে মিলিয়ে গেল চোখের সামনে থেকে। তাদের আকস্মিক এ আচরণে বিস্মিত হই। পাগলের মত তাড়াহুড়ায় প্যাকেটটা ছিড়ে ফেলি। দেখি, প্যাকেট ভর্তি বাজে কাগজের টুকরা শুধু।

” কথা শেষ করলেন ঢাকার একটি পাঁচতারা হোটেলের কর্মকর্তা জামাল সাহেব (ছদ্মনাম)। একটু বিরতি নিয়ে বললেন, বিষয়টি বাংলানিউজকে শেয়ার করলাম, যাতে আমার মত আর কেউ প্রতারকদের এরকম ধোঁকায় না পড়ে। রমজান মাস। ঈদকে সামনে রেখে এরকম ঘটনা নিশ্চয়ই আরও ঘটানোর চেষ্টা করছে প্রতারকরা। অনুরোধ করলেন, তার নাম পরিচয় যেন না প্রকাশ না করা হয়।

জিজ্ঞেস করলাম পুলিশ র্যাবকে জানিয়েছেন? থানায় যাবো জিডি করতে। আর র্যাব-৩ কে ঘটনা জানিয়েছি। র্যাব কর্মকর্তা মেজর সাদিক জানিয়েছেন, এসব বিষয় তারা সেভাবে ডিল করেন না। তবে জিডি করে তার একটা কপি তাদের দিয়ে রাখতে বলেছেন। তারা চেষ্টা করবেন।

জামাল আরও বললেন, সুলতানের মোবাইলটা (০১৮৩৯-৭৬০২৬৫) এখনও মাঝেমধ্যে খোলা পাচ্ছি (সোমবার রাত সাড়ে ৯টা)। ফোন রিসিভ করলেও তারা উল্টাপাল্টা কথা বলছে। বলছে তারা কামরাঙ্গির চরে থাকে। সুলতান বা কামাল নামে কাউকে চেনে না। আবার মাঝেমধ্যে সুলতান পরিচয় দিয়ে জিজ্ঞেস করছে- আমি কত টাকা দিয়েছিলাম? তারপরই ফোন কেটে দিচ্ছে।

অর্থা‍ৎ এই চক্রটি খুবই শক্তিশালী আর বেপরোয়া। এসব ক্ষেত্রে সাধারণত সেলফোন বন্ধ করে দেয় দুর্বৃত্তরা। কিন্তু এক্ষেত্রে তারা ফোন বন্ধ করছে না। জামাল আবারও বললেন, ভাই আমার নাম পরিচয় প্রকাশ করবেন না। বাড়িতে, বন্ধুমহলে আর অফিসে বেকায়দায় পড়তে পারি।

সুত্র===== বাংলা নিউয২৪ ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।