আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কোন সেমাই খাবেন এবারের ঈদে? আসল নাকি ভেজাল ওরফে নকল সেমাই?

মনের আনন্দে অথবা মনন যন্ত্রনায় মনন কথা লিখি নিশিদিন.......... কামরাঙ্গীরচরে ভেজাল সেমাই তৈরির মহোৎসব শিপন হাবিব রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে ভেজাল সেমাই তৈরির মহোৎসব চলছে। ময়লা-আবর্জনা ভরা পরিবেশেই তা শুকানো হচ্ছে। রাতের অন্ধকারে ও তালাবদ্ধ স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে ভিন্ন ভিন্ন নামে প্যাকেটজাত করা হচ্ছে ভেজাল ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি সেমাই। আর ব্যবহার করা হচ্ছে দেশী-বিদেশী সুপরিচিত সেমাইয়ের নাম। ছোট-বড় নির্দিষ্ট কারখানা ছাড়াও এলাকার বিভিন্ন ভাড়াটিয়া বাসায় গোপনে এসব সেমাই শুকানো ও প্যাকেট হচ্ছে।

কোনটা পাকিস্তানি আবার কোনটা বাংলাদেশী নামে হচ্ছে প্যাকেট। নামকরণ করা হচ্ছে বোম্বে, পিওর, এসিআই, কর্ণফুলী, সোয়ানসহ নানান নামে। এ সেমাই স্বাস্থ্যসম্মত কিনা, তা কিনে ক্রেতারা প্রতারিত হচ্ছে কিনা তা দেখার যেন কেউ নেই। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা এসব কারখানা থেকে মাসোহারা পাচ্ছে প্রশাসনিক কর্মকর্তাসহ রাজনৈতিক নেতারা। শনিবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, কামরাঙ্গীরচর থানার সুলতানগঞ্জ ইউনিয়নের আশ্রাফাবাদ, বড় গ্রাম রোড, রসুলপুর পূর্ব, রসুলপূর পশ্চিম, হুজুরপাড়া, মাদ্রাসাপাড়া, পাকাপুল, বরিসুল ঘাট, বেড়িবাঁধ এলাকাসহ ৫, ৬, ৭, ৮ ও ৯নং ওয়ার্ড এলাকায় প্রায় শতাধিক সেমাই তৈরির কারখানা।

কারখানায় কোন নাম লেখা নেই। দরজা জানালা বন্ধ করে ভেতরে শ্রমিকরা কাজ করছে। কারখানাগুলোর মেইন গেটে ‘নদীর পানি দূষণ করবে না’, ‘মাদক থেকে দূরে থাকুন’, ‘নামাজ কায়েম করুন’, ‘মাশাআল¬াহ’সহ বিভিন্ন রংয়ে লেখা সাইনবোর্ড রয়েছে। প্রায় কারখানা ঘেঁষেই রয়েছে শত শত ভাঙাড়ি দোকান। চারদিক ময়লা-আবর্জনা আর উৎকট গন্ধ।

ভেড়িবাঁধ এলাকায় পাকাপুলের একটি ভাঙাড়ি দোকানে কাজ করছেন হনুফা বেগম। জানালেন, তিনি এক সময় সেমাই কারখানায় কাজ করতেন। বয়স হয়েছে বলে এখন আর কাজে নিচ্ছে না মিল মালিকরা। সেমাই কারখানায় ২০-২৫ বছর বয়সী ছেলেমেয়েদের চাহিদা বেশি। রাত জেগে কাজ করতে হয় এসব কারখানায়।

শুরুতে প্রকাশ্যেই নদীর পাড়সহ খোলা আকাশের নিচে সেমাই শুকানো হতো, এখন কিছুটা সতর্ক হয়েছেন মালিকরা। কারখানার ভেতর খোলা আকাশ ও ময়লা আবর্জনার ভেতর শুকালেও কারও চোখে পড়ছে না। রাত-দিন চব্বিশ ঘণ্টাই কারখানাগুলোর দরজায় তালা লাগানো থাকে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এলাকার বেশ কয়েকজন সচেতন নাগরিক জানান, কারখানার ভেতর-বাইরের পরিবেশ অনেক নোংরা। অধিকাংশ শ্রমিক মহিলা ও শিশু।

অনেক শ্রমিক পরিবার নিয়ে কারখানার ভেতরেই থাকছেন। তারা প্রায়ই বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হন। আইন-শৃংখলা বাহিনীর সদস্য ও ক্ষমতাসীন দলের কতিপয় নেতা এসব কারখানা থেকে মাসোহারা পেয়ে থাকেন। এ এলাকায় অধিকাংশ বাসিন্দা দরিদ্র হলেও এসব কারখানার সেমাই ক্রয় করেন না। কারণ, জেনেশুনে বিষ পান করা যায় না।

দিনের পর দিন সেমাই তৈরির ময়দাসহ নানান উপকরণ ময়লা আবর্জনায় ফেলে রাখা হচ্ছে। এলাকার কয়েকজন মুসলি¬ জানান, এখানকার কারখানার মালিক ও শ্রমিকরা অনেক উচ্ছৃংখল। তাদের ভয়ে সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ করতে পারে না। প্রত্যেকটি কারখানায় তালা লাগানো থাকে। এসব কারখানার ভেতরে অসামাজিক কর্মকাণ্ডও চলছে বলে অভিযোগ করেছেন অনেকে।

দুপুরের দিকে হুজুরপাড়া এলাকায় অবস্থিত ২টি সেমাই কারখানায় প্রবেশ করতে চাইলে কারখানার দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দু’জন মধ্য বয়সী লোক বাধা দেন। রেগে বললেন, মালিক কিংবা মালিকের নির্দেশ ছাড়া ভেতরে কাউকেই ঢুকতে দেয়া হয় না। পরে জানা যায়, কারখানাটি প্রভাবশালী জনৈক আবদুল রাজ্জাকের। কলেজ পড়-য়া শিক্ষার্থী জান্নাত আক্তার, পারভীন সুলতানা ও সুহেল আহম্মেদ জানান, এলাকার তরুণ সমাজ সচেতন হলেও এসব নোংরা পরিবেশে তৈরি সেমাইয়ের কারখানা বন্ধ করা যেত। তারা এলাকার মানুষকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, যেসব বাসা বাড়িতে গোপনে ভিন্ন ভিন্ন নামে সেমাইয়ের প্যাকেট করা হয় সেসব বাসা বাড়ির মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাবীবা ফুট প্রোডাক্টের একজন শ্রমিক জানান, এলাকার সব কারখানা অবৈধ নয়। তবে কারখানাগুলো কেন তালা দিয়ে রাখা হয় কিংবা কারখানার নাম লেখা হয় না, তা তাদের জানা নেই। তিনি আরও জানান, তারা অর্ডার অনুযায়ী কাজ করেন। দেশের অনেক নামিদামি কোম্পানির সেমাই এখান থেকে প্যাকেট করা হয়। এ কারখানা থেকে এসিআই’র সেমাইও তৈরি করা হতো।

তবে এখন করা হচ্ছে না। বড়গ্রাম রোডের বাসিন্দা সিদ্দিকুর রহমান জানান, তিনি প্রায় ২০ বছর ধরে এ এলাকায় বসবাস করছেন। ধীরে ধীরে বেড়েছে বাড়িঘর, বেড়েছে লোকসংখ্যা। এ এলাকায় শুধু সেমাইয়ের কারখানাই নয়, প¬াস্টিকসহ শত রকমের অবৈধ কারখানা রয়েছে। এসবের পেছনে বড় ধরনের একটি চক্র রয়েছে।

বুড়িগঙ্গা নদী সবচেয়ে বেশি দূষিত হচ্ছে এ এলাকায় থাকা শত শত কারখানার ময়লা-আবর্জনায়। জানা যায়, ঘন বসতি এলাকার বিভিন্ন খালি জায়গায় টিন ও ইটের দেয়াল করে ভেতরে সেমাই তৈরির কারখানা নির্মাণ করা হয়েছে। ময়লা আর্বজনার মধ্যে সেমাই তৈরি ও প্রক্রিয়াজাত করা হলেও সাধারণ মানুষের চোখে পড়ছে না তা। ভেড়িবাঁধ ঘেঁষে গড়ে ওঠা কারখানাগুলো দেখে মনে হয় বাসাবাড়ি কিংবা ভাঙাড়ি দোকান। ময়লা-আর্বজনার স্তূপ পড়ে আছে চারপাশে।

বেশি টাকা ভাড়া পাওয়ায় অনেক বাড়ির মালিক নিচ তলা ভাড়া দিচ্ছেন বিভিন্ন লোকের কাছে। ওইসব ভাড়াটিয়া বাসায় দিন-রাত দরজা-জানালা বন্ধ করে খোলা সেমাই ভরে বিভিন্ন নামে প্যাকেট করা হচ্ছে। চৈতালী সেমাই কারখানার ম্যানেজার সেলিম জানান, আমরা নাম লিখি কি না লিখি তা একান্তই আমাদের ব্যাপার। প্রশাসন, এলাকার প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করেই এখানে ব্যবসা করতে হয়। বিকালের দিকে ভেড়িবাঁধ এলাকায় দেখা যায়, বেশ কয়েকটি ভ্যানে সেমাই বোঝাই করা হচ্ছে।

ভ্যান চালকের সঙ্গে কথা বলতেই পাশে থাকা একটি টিনশেড কারখানা থেকে বেরিয়ে এলেন দু’জন শ্রমিক। এ প্রতিবেদকের শরীরে ধাক্কা দিয়ে বললেন, ভ্যান ড্রাইভারের সঙ্গে কিসের কথা। পরে জানা যায়, এ কারখানাটির নামও হাবীবা ফুট প্রোডাক্ট। এ এলাকায় হাবীবা নামক ৩টি সেমাইয়ের কারখানা রয়েছে বলে জানা গেছে। কারখানার ফরহাদ মিয়া নিজেকে শ্রমিক পরিচয় দিয়ে জানান, তিনি এখানে শ্রমিকদের হিসাব-নিকাশ দেখেন।

কর্ণফুলী, বোম্বে, পিংক সিটি, হেলদিসহ নানান নামে তারা সেমাই তৈরি করেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিউটিফুল সেমাইয়ের এক শ্রমিক জানান, তার ম্যানেজার নাজির সাহেব ভেতরেই আছেন কিন্তু আপনাকে (প্রতিবেদক) ভেতরে ঢুকালে আমার চাকরি চলে যাবে। তাছাড়া কারখানার ভেতর অনেক নারী ও শিশু রয়েছে। একই কারখানায় ভিন্ন নামে সেমাই তৈরি করায় তাদের কোন অসুবিধা হয় কিনা এমন প্রশ্নে তিনি জানান, এখানকার সব কারখানায় বিভিন্ন নামে সেমাই তৈরি হচ্ছে। মূলত এখানকার কারখানাগুলো অর্ডারে কাজ করে বেশি।

অনেক কোম্পানি রয়েছে যারা ময়দাসহ প্রয়োজনীয় সেমাই তৈরির কাঁচামাল দিয়ে নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে এখান থেকে সেমাই তৈরি করে প্যাকেটজাত করে। ক্ষোভ প্রকাশ করে ক্ষমতাসীন দলের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি সোহেল (ছন্দনাম) বলেন, নামবিহীন ওইসব কারখানার ভেতরে কি হচ্ছে তা সাধারণ মানুষ কিছুতেই জানতে পারে না। একটি কারখানা একই সেমাই দিয়ে ১০-১২টি কোম্পানির নামে সেমাই প্যাকেট করছে। এটা সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতি হচ্ছে।

আইন-শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরাই পারে এর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে। কারণ, এখানকার জনপ্রতিনিধিরা ভোটের জন্য সব অপকর্মই সহ্য করে নিচ্ছেন। ভেজাল সেমাই, অবৈধ কারখানা গড়ে উঠলে তাদের কিছুই যায় আসে না। জনপ্রতিনিধিদের চাপ না থাকায় এলাকার আইন-শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরাও বেজায় খুশি।  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.