আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হিন্দু মেয়েদের বাবার সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারের বিষয়টি নিয়ে ভাববার অবসর রাষ্ট্রের কবে হবে?

সবকিছুই চুকিয়ে গেছে গালিব! বাকি আছে শুধু মৃত্যু!! আমার লেখাগুলোতে তেমন একটা তথ্য, উপাত্ত, উদ্ধৃতি থাকেনা। আমি বিশ্বাস করি যে সত্য বা বাস্তবতার মুখোমুখি আমি বা আমরা প্রতিদিন হই তা উপস্থাপনের জন্য কোন তথ্য, উপাত্ত, উদ্ধৃতির প্রয়োজন নেই। বাস্তব সত্যকে তথ্য, উপাত্ত, উদ্ধৃতির মোড়কে আবৃত করাটা আদতে নিরেট সত্যকে একটি পোশাকিরূপ দেয়ার প্রয়াস বা প্রচেষ্টা মাত্র। এতে সত্যের জৌলুস এতটুকুন পরিমান বাড়ে বলে আমি মনে করিনা। আমাদের দেশে হিন্দু মেয়েদের তার বাবার সম্পত্তিতে অনধিকারও তেমন একটি চরম সত্য।

এটাকে বোঝানোর জন্য কোন তথ্য, উপাত্ত, উদ্ধৃতির প্রয়োজন নেই। তবে যে বিষয়টা চরম হতাশার তাহলো এ চরম বঞ্চনার বিষয়ে রাষ্ট্র বা ঐ সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয়দের কোন হাহাকার নেই। কোন এক অজানা কারণে সংশ্লিষ্ট সম্প্রদায় বা রাষ্ট্র এ অবিচারকে বিনা প্রচেষ্টায় মেনে নিচ্ছে। দেশে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদ নামে একটি সংঘ আছে। তবে সংঘটির কার্যক্রম পূজা বা অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি নির্বিঘ্নে পালনের জন্য সরকারকে অনুরোধ এবং অনুষ্ঠানাদি শেষ হলে সরকারকে ধন্যবাদ জানানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

সংঘটি নিজেদের মেয়েদের অধিকার, স্বার্থ বা ধর্মীয় উত্তরাধিকার আইনে সংস্কার আনার জন্য কখনও সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে এমন কার্যক্রম কখনও দেখিনি। দেশে একজন শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদ আছেন যিনি সনাতন হিন্দু সমাজ থেকে ওঠে এসছেন। ভদ্রলোক জায়গা, অজায়গায় একটু কথা বলার সুযোগ পেলেই মুখ চালাতে শুরু করেন। অতিকথনে অভ্যস্ত এই ব্যক্তি অর্পিত সম্পত্তি বা দেশের নানা সম-সাময়িক বিষয়ে সুযোগ পেলেই জোরালো বা মুখরোচক বক্তব্য পেশ করেছেন বা করেন। প্রয়োজনে বা অপ্রয়োজনে বিভিন্ন বিষয়ে জাতিকে নানা রকমের ছবক দেন।

পুরো জাতিকে ছবক দিলেও তিনি কখনও হিন্দু সম্প্রদায়ের মেয়েদের তাদের পিতার সম্পত্তিতে অধিকার নিয়ে কখনও কিছু বলেননা বা এ বিষয়ে আইন প্রণয়নের জন্য সরকারকে উপদেশ দেন না। অবশ্য আমি এখানে আমি এটা বলছি না যে, অর্পিত সম্পত্তি আইনে সংস্কারে ভূমিকা রেখে বা এ বিষয়ে সরকারকে চাপ প্রয়োগ করে তিনি নেতিবাচক কোন কিছু করেছেন। যা আমি বলার চেষ্টা করেছি তাহলো অর্পিত সম্পত্তির মতো অমানবিক আইনের সংস্কারে ভূমিকা রাখার পাশপাশি তিনি যদি ধর্মীয় উত্তরাধিকার আইন সংস্কারেও সরকারকে প্রণোদিত করতেন তবে সেটা শোভনীয় এবং সার্বজনীন হত। এনিয়ে আমি হিন্দু সম্প্রদায়ের পরিচিত কয়েকজনের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছি। বেশিরভাগই বিষয়টা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন।

তবে শেষ পর্যন্ত তাদেরই একজন আমাকে যা জানাল তার সারমর্ম দাঁড় করালে বিষয়টা এমনভাবে ব্যাখ্যা করা যায় যে, হিন্দু সম্প্রদায়ের মেয়েদের মাঝে ভিন্ন ধর্মের ছেলেদের বিয়ে করার একটা প্রবণতা আছে। ফলে মেয়েদের সম্পত্তির অধিকার দিলে সেটা ভিন্ন ধর্মের লোকদের অধিকারে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। আমার কাছে তার এ বক্তব্যটি পুরোপুরি পুরুষতন্ত্রকে বহাল রাখার একটি মনোভাব বলেই মনে হয়েছে। আমি দৃঢ় ভাবেই বিশ্বাস করতে চাই যে, বিবাহ বিষয়টি দু’জন প্রাপ্ত বয়স্ক নারী-পুরুষের পারস্পরিক ইচ্ছা বা সম্মতির উপর নির্ভরশীল। এখানে ধর্মীয় পরিচয় কোন প্রকারের নির্ণায়ক হওয়ার সুযোগ নেই।

কিন্তু আমাদের সমাজ যেহেতু এ ধরণের মানসিকতার কাছাকাছি নেই তাই ভদ্রলোকের বিবেচনা অনুসারে আন্ত:ধর্মীয় বিয়েটাকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে নিলেও একজন মেয়েকে তার পৈতৃক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার কোন সুযোগ নেই। কারণ এখানে সম্পত্তিটা মেয়ের নামে যাচ্ছে, তার স্বামীর নামে নিশ্চয়ই নয়। উপরন্তু আন্ত:ধর্মীয় বিয়েটা শুধু মেয়েরাই করছেনা, ছেলেরাও করছে। এদের মধ্যে অনেকে আবার বিবাহ সূত্রে কনভার্টও হচ্ছেন। কিন্তু এক্ষেত্রে কিন্তু ভিন্ন ধর্মের মেয়েকে বিয়ে করার কারণে কেউ বলছেন না যে ছেলেদেরও পিতার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা উচিত।

আর সত্য হচ্ছে এই যে, আমাদের দেশে এই ধরণের বিয়ের সংখ্যা নিতান্তই কম। হয়তো হাজারে দু’একটা হতে পারে। এমন দু’একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনায় ভয় পেয়ে নিজেদের মেয়েদের সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করা শুধু অযৌক্তিকই নয়, অমানবিকও বটে। বিষয়টা নিয়ে আমি দলিতদের স্বার্থ নিয়ে কাজ করেন এমন একজন সমাজকর্মীর সাথেও কথা বলেছি। ভদ্রলোক যুগ-বিবেচনায় একধাপ অগ্রবর্তী।

তিনি কোন বিশেষ সমপ্রদায়ের জন্য নয় বরং একটি সার্বজনীন উত্তরাধিকার আইন চান। আমি নিজেও মানবতা এবং আইনকে সম্প্রদায়ের মাঝে আবদ্ধ রাখিনা। আমি অধিকারের কোন নারী-পুরুষ বিভেদ করিনা। কিন্তু কখনও কখনও বাস্তবতা আমাকে স্তব্ধ করে। আমি আপোষ করি।

যেখানে মানবতার কোন চর্চা নেই, কোন ভিত্তি নেই, আইনের প্রতি কোন শ্রদ্ধাবোধ নেই সেখানে আপোষের মাধ্যমে আগানোটাই আমি শ্রেয় মনে করি। কাজেই যারা সার্বজনীন উত্তরাধিকার আইন প্রণয়নের চেষ্টা করছেন তাদের প্রতি সর্বোচ্চ সন্মান রেখে বিনয়ের সাথে বলব দয়া করে সার্বজনীন উত্তরাধিকার আইনের প্রচেষ্টার আড়ালে হিন্দু সম্প্রদায়ের মেয়েদের-কে তাদের পিতার সম্পত্তির অধিকার থেকে আর বঞ্চিত রাখবেন না। বাস্তবতা বিবেচনায় আমাদের দেশে সার্বজনীন উত্তরাধিকার আইন অন্তত নিকট ভবিষ্যতে প্রণয়ন/প্রয়োগ করা সম্ভব নয়। এখানে মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে সামান্য হেরফের এনে সাম্য আনয়নের প্রচেষ্টা নিলে আমিনীরা লাঠি হাতে রাজপথে নামে। আর সেই লাঠির ভয়ে আমাদের সদাশয় সরকার বাহাদুর নিরাপদ দুরত্বে পিছিয়ে আসেন।

আমি সংস্কারের ক্ষেত্রে বাঙালি হিন্দুসমাজকে মুসলিম সমাজের চেয়ে অনেক বেশি উদার মনে করি। আমি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করি কন্যাসন্তানদের-কে তাদের পিতার সম্পত্তিতে পুত্রদের সমান অধিকার দিয়ে কোন আইন প্রণয়ন করলে সনাতন হিন্দু সমাজের কেউ আমিনীর মতো লাঠি নিয়ে রাজপথে নেমে আসবেনা। আর সনাতন হিন্দু সমাজে যদি সাম্যের ভিত্তিতে প্রণীত কোন উত্তরাধিকার আইন প্রতিষ্ঠিত হয় তবে এতে উৎসাহিত হয়ে মুসলিম সম্প্রদায়ও নিজেদের মেয়েদের সমান অধিকার প্রদানের নিমিত্ত আইন প্রণয়নে উদ্বুদ্ধ হবে। তবে একটা বিষয় আমাকে এখানে স্বীকার করতেই হবে যে, অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকলেও পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারে মুসলিম মেয়েরা হিন্দু মেয়েদের তুলনায় অনেকটাই এগিয়ে আছে। পুত্রসন্তানের সমান ভাগ না পেলেও মুসলিম মেয়েরা তার পিতার সম্পত্তিতে একটি নির্ধারিত অংশ পেয়ে থাকে।

এক্ষেত্রে হিন্দু সম্প্রদায়ের মেয়েরা তার পিতার সম্পত্তি থেকে পুরোপুরিই বঞ্চিত। লেখাটার সমাপ্তি টানব ভারতীয় পার্লামেন্টে ১৯৫৬ সালে পাসকৃত Hindu succession Act, 1956 (Click This Link) এর উপর একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনার মধ্য দিয়ে। আলোচ্য আইনটির মাধ্যমে সনাতন হিন্দু ভারতের Mitaksara এবং Dayabagha আইনগুলো রহিত করে সাম্যের ভিত্তিতে একটি সার্বজনীন উত্তরাধিকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করা হয়। এটি বলবৎ হওয়ার ফলে ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার সম্পত্তিতে স্ত্রী, পুত্র, কন্যারা সমান অধিকার লাভ করে। নারীর ক্ষেত্রে মুত্যুর পর তার সম্পত্তিতে স্বামী, পুত্র, কন্যারা সমান অধিকার লাভ করে।

আইনটির মাধ্যমে কন্যাকে অবিবাহিত, ডিভোর্সী, বিধবা অবস্থায় তার বাবার বাড়িতে অবস্থানের অধিকার দেয়া হয়। শুধু তাই নয়, এ আইন অনুসারে কেউ ধর্ম ত্যাগ করলেও উত্তরাধিকার সম্পত্তির উপর তার অধিকার থাকবে। তবে সেক্ষেত্রে ধর্মত্যাগকারীর বংশধরেরা তার অন্যান্য হিন্দু আত্মীয়দের সম্পত্তির উত্তরাধিকার (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে) হিসেবে বিবেচিত হবেনা। তবে মৃত্যুর পূর্বে যদি সে স্বধর্মে ফিরে তবে উত্তরাধিকার হিসেবে তার অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে। এতকিছুর পরেও Hindu succession Act, 1956-এ একটি সীমাবদ্ধতা ছিল।

এ আইনে পুরুষ ভাগীদাররা তার হিস্যা বুঝে না নেয়া পর্যন্ত মেয়ে ভাগীদাররা তাদের হিস্যা বুঝে নিতে পারত না। এ সীমাবদ্ধতা উত্তরণের নিমিত্ত ২০০৫ সালে আইনটি সংশোধন করা হয়। সংশোধিত আইন অনুসারে একজন নারী ভাগীদার উত্তরাধিকার সম্পত্তি পাবার যোগ্যতা অর্জন করার পরে যেকোন সময়ে তার ইচ্ছানুযায়ী তার ভাগ বুঝে নিতে পারবে। পুরুষ ভাগীদাররা সম্পত্তি বুঝে নেয়ার সময়কাল পর্যন্ত এখন আর তাদের অপেক্ষায় থাকতে হয়না। এদেশে হিন্দু উত্তরাধিকার আইনে সংস্কার আনয়নের সময়ে সংশ্লিষ্টরা Hindu succession Act, 1956-কে একটি আদর্শ নমুনা হিসেবে গ্রহণ করতে পারেন।

রাখ-ঢাক না রেখেই বলি, এটিকে সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করতে পারেন। এ কথাটা এ কারণে বলা যে, যেকোন আইন প্রণয়নের সময়েই কমিটি গঠন, মতামত গ্রহণ, যাচাই, বাছাইয়ের মাধ্যমে এখানে ইচ্ছাকৃতভাবে দীর্ঘসূত্রিতা অবলম্বন করা হয়। সবশেষে, সাহস করেই বলি যে যেকোন সার্বজনীন উত্তরাধিকার আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রেও উল্লেখিত আইনটি একটি উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.