আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ডায়েরির পাতা থেকে একটি খসড়া

মাজহার সরকার অনেক অনেক দিন আগের কথা। প্রমিথিউয়াস মানুষ সৃষ্টি করে তাদের প্রত্যেকের গলায় দুটি করে মালা ঝুলিয়ে রাখলেন- একটি সামনে আর অপরটি পেছনে। সামনের মালাতে রাখলেন অপর লোকের দোষ ত্রুটি আর পেছনেরটায় রাখলেন নিজের দোষ ত্রুটি। তাই এখনও পর্যন্ত মানুষ নিজের দোষ দেখতে পায় না। শুধু দোষ দেখে অপরের।

আর অপরের দোষ অনেক দূর থেকেও মানুষ দেখে ফেলে। অথচ তার নিজের দোষটি চেখেও পড়ে না। গনতন্ত্রে অবাধ মতামত প্রকাশের স্বাধীনতাকে আমরা আমাদের নোংরা হাতে নিয়ে লুফালুফি করে আমরা এটাই করছি। রাজনীতি, সামাজিক জীবনে কিংবা সভা সেমিনারে। তবে জীবনের এই সব কঠিন সত্য ও বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এ কথাটা বুঝেছি যে, সত্য কখনো বঞ্চনা করে না।

তবে আমরা সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে ভয় পাই। এই কারনেই সমাজে দুর্দিন চলে আসে। সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার নামে মিথ্যার আশ্রয় নিলে সত্যেকেই নির্বাসিত করা হয়। প্লেটো তার আদর্শ রাষ্ট্র থেকে কবিদের নির্বাসিত করতে চেয়েছিল। সে কি এই কারনে যে, কবিরা সত্য বলে? কম তো হোঁচট খেলাম না, তবু পথ ছাড়িনি।

আছি, পথে আছি, রাজপথে আছি, এও জানি যে, পথ আমাকে সেই দেখাবে যে আমাকে চায়। মাওলানা আবুল কালাম আজাদ তার 'India Wins Freedom' শুরু করতে গিয়ে বলেছিলেন, "আমাদের এই পৃথিবী নামক গ্রহটির শুরুর ও শেষের পৃষ্ঠাগুলো কবেই হারিয়ে গেছে"। এর রেশ ধরে বলি আদর্শ এমনই যে চেতনার উম্মেষ যার জীবনে আসে সে তার শুরু ও শেষ খুঁজে পায় না। আমার আপনার ঠিকানা তাই এই রাজপথ। আমরা সত্যকে পরিত্যাগ করে লুকিয়ে যেতে পারি না।

রঁমা রঁল্যা বলেছিলেন,'Silence Is Crime'. আমরা মিথ্যার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিরব থাকতে পারি না। দেবতা জিউসের আদেশে প্রমিথিউয়াস পৃথিবীতে পশু ও মানুষ সৃষ্টি করলেন। কিন্তু পশুর সংখ্যা বেড়ে গেল। দেবতা জিউস তখন প্রমিথিউয়াসকে বললেন পশুর সংখ্যা বেশি হয়ে গেছে। এদের কিছু সংখ্যককে তুমি মানুষে পরিণত করো।

দেবতা জিউসের কথা মতো প্রমিথিউয়াস কিছু পশুকে মানুষ করে দিলেন। ফলে পশু থেকে মানুষ হলো। আর তাদের চেহারা মানুষের মতো হলেও প্রকৃতি ও আচরন পশুর মতোই রয়ে গেলো। এই সব পশু স্বভাবের মানুষ পৃথিবীতে এখনও সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। গ্রীক এই গল্পটির প্রভাব আছে আমাদের মহাভারতের শকুনী চরিত্রটির মধ্যে।

সমগ্র বিশ্ব সাহিত্যেই এমন চরিত্র দ্বিতীয়টি আছে কিনা সন্দেহ। কুপরামর্শদানে এমন পারদর্শী ব্যক্তি দুলর্ভ। আমাদের রাজনৈতিক ভাবমূর্তি নষ্ট ও ক্ষতি সাধনের নানা প্রচেষ্টা চালিয়ে যায় এসব পশু ও শুকুনীরা। ওরা পেরে ওঠে না আমাদের সাথে। কেননা সুবিধাবাদের সঙ্গে আমাদের আপোস নেই।

দলাদলি ও উপদলীয় কোন্দল থেকেও আমরা মুক্ত। বাংলাদেশের ছাত্র-রাজনীতিতে আমরাই সবচেয়ে অগ্রসর তত্ত্ব দিয়ে পরিচালিত, আর সেটাই সংগ্রামীর ভূমিকা পালন করে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক মানস আমাদের বিশেষায়িত করে। আমাদের বিকাশের পথে ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট ও তার সামনে আমাদের বৈপ্লবিক কর্তব্য উত্থাপিত করে। আমাদের প্রাণের সংগঠন ছাত্রলীগ এমন এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের উপর প্রতিষ্ঠা করা, জনগণের সঙ্গে যার বজায় থাকবে নিরবিচ্ছিন্ন যোগাযোগ এবং যা সাধারন ছাত্র-ছাত্রীদের বৈপ্লবিক সংগ্রামে নেতৃত্বদানে সক্ষম থেকেছে।

ছাত্রলীগকে চলতে হবে স্বত:স্ফূর্ত ছাত্র আন্দোলনের আগে আগে। তাকে পথ দেখাতে হবে। প্রলেতারিয়েত, শ্রমিক বা পেশাজীবিরা স্বত:স্ফূর্তভাবে যে-সমস্ত তাত্তি্বক, রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক প্রশ্নের সম্মুখীন হয়, তার উত্তর দিতে হবে। ১৮৫২ সালের ২৪ জুনে জার্মান পেটি-বুর্জোয়া প্রবন্ধকর ফের্ডিনান্ড লাসাল একটি চিঠিতে কার্ল মার্কসকে লিখেছিলেন, "....পার্টি সংগ্রাম দেয় পার্টির বল আর প্রাণশক্তি, কোন পার্টির দুর্বলতার সবচেয়ে বড় প্রমান হলে সেটার বিক্ষিপ্ততা এবং স্পষ্ট সীমারেখাগুলির লেপে-পুছে যাওয়া। কোন পার্টি আরও শক্তিশালী হয় নিজেকে বিশোধিত করে..." এ থেকে আমরা বুঝতে পারি যে আমদের স্লোগান হওয়া উচিত আমাদের পক্ষে সত্য-সত্যই একটা রণধ্বনি।

রাজনৈতিক আলোড়নের প্রকৃতি ও প্রধান মর্মবস্তু আমরা জানি, জানি আমাদের সাংবিধানিক কর্তব্যগুলো, বিভিন্ন দিক থেকে একটা সংগ্রামী পরিকল্পনা আমরা নিয়েছি। বিভিন্ন জেলা, থানা, ওয়ার্ড মহকুমা, গ্রাম, প্রত্যন্ত অঞ্চলে আমাদের কেন্দ্রীয় কেবিনেটের নেতৃবৃন্দ কয়েকদিন পর পরই যাচ্ছেন, সভা-সমিতিতে যোগ দিচ্ছেন, কথা বলছেন, ছাত্রলীগের বৃহৎ ভূগোলের পুরোভূমিতে হালচাষ করে বুনে আসছেন শেখ মুজিবের সোনার বাংলার আদর্শের উৎকৃষ্ট বীজ। এটা কারও গোপন কথা নয় যে, আমাদের নিজেদের মধ্যকার মতবিরোধগুলো নিছক সাংগঠনিক কাঠামোর ভিতরে সীমাবদ্ধ থাকত, সেগুলো প্রতিফলিত হত বিভিন্ন নিছক ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যে। আমি দেখিছি বাস্তবতার চাইতে পত্রিকার রঙিন পৃষ্ঠায় বা টেলিভিশনের লাইভ ফুটেজে সে বিরোধ কখনও অধিক অধিক মাত্রায় দাউদাউ করে জ্বলেছে, কখনও স্তিমিত হয়ে ধিকিধিকি হয়ে জ্বলেছে-পুঁজিবাদী, সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তির রাজনৈতিক বাণিজ্যের ছাইয়ের তলে। ছাত্রলীগ নিয়ে খেলার কেউ কম চেষ্টা করেননি, আমাদের বিরুদ্ধে সমালোচনা দীর্ঘ কাল যাবৎ চালিত হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী ঘরকুনো রাজনৈতিক গোপন বৈঠক থেকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের 'চেয়ার' থেকে, বহু বই পুস্তকে এবং এক প্রস্ত ফাউ গবেষণা-নিবন্ধে।

তবু আমরা এক বিন্দু কি টলেছি? জুপিটারের মস্তক থেকে মির্নাভার যেমন জন্ম হয়েছিল, মেডুসার রক্তপাত থেকে টগবগে সাদা ডানাওয়াল ঘোড়া পেগাসাসের যেমন জন্ম হয়েছিল তেমনি আমাদের বিশ্বাস, আমাদের নিঃছিদ্র চেতনা থেকে জাগ্রত হয়েছে বিপ্লবের ভাষা। যে কেউ ইচ্ছে করে কাকের মতো চোখ বুঝে থাকতে পারে না। সবাই দেখেছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কতদূর এগিয়েছে। প্রকৃতিবিজ্ঞানের যাবতীয় অবিস্কার সত্ত্বেও মানুষের জন্ম প্রক্রিয়া বা প্রসব পক্রিয়া সে-ই পুরনো ধারার কায়দায় আছে। তেমনি সমাজবিজ্ঞান বা রাজনীতি বিজ্ঞানের যাবতীয় সাফল্য এবং সচেতন ছাত্র/ছাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধি সত্ত্বেও ভবিষ্যতে নতুন রাজনৈতিক সমাজব্যবস্থার জন্ম হবে প্রধানত স্বত:সফূর্ত ছাত্র আন্দোলন উদ্ভেদের ফলে।

বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে সেভাবেই প্রস্তুত থাকতে হবে। আবার মনে রাখতে হবে জগতে সন্তান আনতে পারে যে কেউ, কিন্তু সেই সদ্যোজাত আন্দোলনকে সুষ্ঠ পরিচর্যা ও সেবা দিতে হবে। ভাল বিবাদের চেয়ে খারাপ শান্তি ভাল কিনা সেই প্রশ্নে আমরা যাবো না। আমরা চাই টেকসই ঐক্য। প্রচলিত ছিল যে, ফরাসীরা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করে, তার কারণ তারা পরম-অসহিষ্ণু, জার্মানরা ঐক্যবদ্ধ, কেননা তারা ভাল ছেলে! পৃথিবীতেও টঃড়ঢ়রধ বা স্বপ্নরাষ্ট্র অর্থাৎ নিঁখুত সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার দেশ কোথাও নেই।

বল্লাল সেনের কোলীণ্য প্রথার মতো কতগুলো বংশকে সৎকুল বলে অন্যদের ঝেড়ে ফেলা বর্তমানে সম্ভব নয়। এই সংকট যুগে যুগে সব দেশেই ছিল। কবি জসীমউদ্দীন তাই হয়তো বলেছিলেন, "উইড়া যাওয়ার সাধ ছিল, পাঙ্খা দেয় নাই বিধি"। আমাদের কি নেই ভাবলে আমরা আরও হারাবো, ভাবতে হবে কি আছে আর তা নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। আমাদের Savoir-vivre বা সভ্যাচার এবং Savoir-faire বা সামাজিক কর্মকুশলতা অত্মস্থ করতে হবে।

আমরাতো একটা যুগসন্ধির (Transition) প্রজন্ম, আমরা এক যুগ থেকে আরেক যুগে প্রবেশ করেছি। আমাদের সামান্য দুঃখ ব্যর্থতায় দমে গেলে চলবে না। পরিবর্তিত বিশ্ববাস্তবতায় দাঁড়িয়ে মুষ্ঠিবদ্ধ হাতে আমাদের মুক্তির মিছিলে যেতে হবে। যেমন অংসান সুচি বলেছিলেন “Freedom from fear”। মানুষের এই অভয় পথে যাত্রা কখনো ব্যর্থ হয় না।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন "জাগো জাগো থেকো না রে অচেতন"। লেখক ঃ মাজহার সরকার, কবি ও ছাত্র রাজনীতিবিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.