আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শেষ দিনে বাবার সাথে............ (''নুহাশ'' তুমিও কি আমার মত, নাকি আমি তোমার মত!!!)

আমি তোমার পায়ের কাছে কুকুরের মত বসে থাকি তোমার ভেতরের কুকুরটা দেখবো বলে!!! ১৯৯৮ সাল, ২৮ ডিসম্বর। ক্লাস নাইনে ফাইনাল পরীক্ষা শেষ, রেজাল্টও হয়ে গেছে। তারপরও পড়াশুনা করতে হবে, মা'র হুকুম। কারণ নাইন-টেনে একই বই পড়ে এস এস সি পরীক্ষা দিতে হবে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই কতগুলো ইলেকটিভ ম্যাথ কষে দৌড়ে চলে গেলাম বাড়ির সামনে মাঠে খেলতে।

দুপুর বারোটা/সাড়ে বারোটা হবে, এমন সময় মা ডাকাকাকি শুরু করলো। মা বলল- এখুনি আশা কে (আমার মেজো বোন) একটা ফোন ...করে আয়, তোর আব্বা যেন কেমন করছে। আমাদের বাসার টি এন্ড টি তে সমস্যা থাকায় আমি চলে গেলাম মোড়ের ফোনের দোকানে। মেজআপুকে ফোন করে বললাম- তুমি তাড়াতাড়ি বাসায় আসো, আব্বা যেন কেমন করছে। মেজআপু শোনা মাত্র হাউমাউ করে কেঁদে দিল।

আমি বাসায় ফিরছি পথে দেখা হলো বড় দুলাভাইয়ের সাথে, জিজ্ঞাসা করলাম- ভাইয়া, আব্বা কেমন আছে? ভাইয়া বলল- ভাল, তুমি বাসায় যাও। বড় বোনের দু'দিন আগে একটা বাচ্চা হয়েছে, তাকে হাসপাতাল থেকে এনে বাসায় রেখে দুলাভাই বেরিয়েছে কেবল। গেট দিয়ে ঢুকতেই দেখি পাশের বাসার বাবুল আঙ্কেল, আমি একটু ভয় পেয়ে গেলাম। কারণ দু'দিন আগে বল লাগিয়ে বাবুল আঙ্কেলের জানালার কাঁচ ভেঙ্গে ফেলেছিলাম। ভেবেছি আঙ্কেল মনে হয় মা'র কাছে নালিশ করতে এসেছে।

না, উনি নালিশ করতে আসেনি, ঘরে ঢুকে দেখলাম পাড়ার অনেক মানুষ আমাদের বাড়ীতে। সবাইকে সরিয়ে আমি ভেতরে ঢুকে দেখি আমার বাবাকে ঠান্ডার মধ্যে মেঝেতে শুইয়ে রেখেছে একটা পাতলা সাদা চাদর দিয়ে ঢেকে। ক্লাস টেনে পড়ুয়া আমার কিশোর মন কোন কিছু বুঝতে বাকী রইল না। আমার বুকের সমস্ত রক্ত চোখের পানি হয়ে দু'গাল বেয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে। বাবুল আঙ্কেল এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।

তখন শুধু একটা কথাই চিন্তা হচ্ছিল- মা যখন আমাকে শাষণ করবে তখন কে আমাকে বুকের মধ্যে আগলে রাখবে! কে আমার মাথায় ছায়া হয়ে থাকবে! একটু পর মা এসে বলল- বাসার মধ্যে যেন কোন কান্নার আওয়াজ না হয়, আলো কে( আমার বড় বোন) একটু আগে হাসপাতাল থেকে আনা হয়েছে। আমরা সবাই চুপ করে থাকলাম। কিছুক্ষন পর ছোট আপা আসলো ভার্সিটি থেকে, এসেই ওর শরীর থেকে চাদরটা খুলে দলা করে বাবার মাথার নিচে দিতে দিতে বলছে- আমার আব্বা তো বালিশ ছাড়া শুয়ে থাকতে পারেনা, কেন আমার আব্বা বালিশ ছাড়া শুয়ে আছে! এরপর বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা, সবাই ইফতারী করল যে যেখানে পেরেছে। আমিও একটু পানি খেয়ে রোজা ভাঙ্গলাম। বাড়িতে অনেক মানুষ এসেছে।

এইবার বাবাকে নিয়ে যাওয়ার পালা। আমার মায়ের তার পঁয়ত্রিশ বছরের জীবনসঙ্গী আজ তাকে ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলে যাচ্ছে, পাগলের মত হয়ে গেছে আমার মা। নির্জন রাত, একটু আগেই আমার বাবাকে আমার নিজ হাতে কবরে শুইয়ে দিয়ে আসলাম। একা একা বাসায় ফিরলাম। আমার ঘরে ঢুকে ইলেকটিভ ম্যাথের বইটা আর খাতা নিয়ে বসলাম মায়ের বকুনির ভয়তে।

চশমার কাঁচে বারবার পানি জমে যাচ্ছে, ঘোলা হয়ে যাচ্ছিল অংক গুলো। চৌদ্দ বছর হয়ে গেছে, আজও পারিনা বুকের রক্ত চোখের পানি হয়ে গড়িয়ে যাবার বাঁধা দিতে যখন চিন্তা করি আমার মাথার উপর কোন ছাঁয়া নাই, যখন চিন্তা করি আমার মা প্ঁয়ত্রিশ বছর সংসার করে আজ নিঃসঙ্গ!!! ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।