আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্যার, আপনাকে আমি কোনদিনও ক্ষমা করব না

ব্লগার না পাঠক হওয়ার চেষ্টায় আছি ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর। জন্ম হয়েছিল বাংলা সাহিত্যের একজন জীবন্ত কিংবদন্তীর। অথবা কতিপয় “উচ্চ শিক্ষিত সাহিত্যবোধ্যা” লোকের ভাষায় একজন সস্তা, ফালতু বাজারী লেখকের। তাঁর নাম রাখা হয়েছিল শামসুর রহমান যা তিনি নিজেই পরিবর্তন করে রাখেন হুমায়ুন আহমেদ। জ্যোৎস্না প্রিয় এই লোকটি লেখালেখি শুরু করেন ছাত্রাবস্থায় এবং তাঁর আত্মজীবনী পড়ে জানতে পারি তাঁর প্রথম লেখা শুরু হয়েছিল একটি প্রেমপত্র লিখার মাধ্যমে।

তাঁর এক বন্ধুর অনুরোধে লিখে ফেলেন সেই প্রেমপত্র! সেই শুরু এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত বিরামহীন ভাবে লিখে যাওয়া। দুইশটিরও বেশি উপন্যাস! অবিশ্বাস্য!! সত্যিই অবিশ্বাস্য!! তাঁর এত এত লেখার সাহিত্যমান নিয়ে যারা প্রশ্নের পর প্রশ্ন তুলে যান তাদের কাছে একটাই অনুরোধ আগে “শঙ্খনীল কারাগার”, “জ্যোৎস্না ও জননীর গল্প”, “নন্দিত নরকে”, “বহুব্রীহি”, “অপেক্ষা” কিংবা হালের “মাতাল হাওয়া”র মত একটা বই লিখে দেখান এবং তারপর ইচ্ছেমত তাঁর মত সস্তা লেখককে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করবেন। এবার আসি আমার বই পড়া শুরুর প্রসঙ্গে। বই পড়াটা যে একটা নেশা সেটা আমি বুঝতে পারি যখন আমি ক্লাস এইটের শেষ দিকে। পাশের বাসার ভাইয়া তখন ডিইউতে পড়ত।

উনার বাসার শেলফ ভর্তি গল্পের বই। সমরেশ, সুনীল থেকে শুরু করে শরৎচন্দ্র, মানিকদা সকলের বইই ছিল। হঠাত করেই আমার একদিন মনে হল যে একটা গল্পের বই পড়ব। শেলফ থেকে নিয়ে নিলাম একটা বই! আমার স্পষ্ট মনে আছে সেটা ছিল বহুব্রীহি। হাসতে হাসতে শেষ।

একটা লাইন এখনও মাথায় ঘুরছে- “ডাক্তার সাহবে বলের মত গড়িয়ে পড়তে লাগলেন। ” সেই থেকে শুরু। বিরামহীন বই পড়া। নেশার মত বই পড়া। নাহ, অন্য লেখকের বই না! শুধুই হুমায়ুনীয় বলয়।

আর কিচ্ছু না। হুমায়ুন আহমেদ সমগ্র, মিসির আলী সমগ্র, হিমু সমগ্র কি না পড়েছি! সেই সময়কাল পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত সব বইই পড়ে ফেলেছিলাম। দুপুর থেকে তাঁর বই পড়া শুরু করে রাত দুটা, তিনটা বেজে যাচ্ছে তাও অবিরাম পড়তে থাকা! অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, সেই সময়ে আমি বই পড়ছিলাম আর আম্মু আমাকে রাতে খাইয়ে দিচ্ছিল তা প্রায় প্রতিদিনের ব্যাপার হয়ে গিয়েছিল!! উল্লেখ্য, ওই ভাইয়া হুমায়ুন আহমেদের লেখা তেমন বেশি একটা পছন্দ করতেন না এবং জীবনে হুমায়ুনের বই পড়ার জন্য সামান্য খোঁচাটা ওই ভাইয়ার কাছ থেকেই শোনা!! পাঠক হিসেবে আমি মোটামোটি নিম্ন-শ্রেণীর। তবে সমরেশ, সুনীল, অদ্বৈত মল্লবর্মণ, শরৎচন্দ্র, তসলিমা নাসরীন, হুমায়ুন আজাদ সহ অনেক লেখকের অনেক বই পড়েছি। কিন্তু হুমায়ুন আহমেদের মত অন্য কোন লেখকের বই কোনদিনও গোগ্রাসে গিলেছি বলে মনে হয় না! অনেকেই বলেন যারা অন্য লেখকদের বই বেশি পড়েন তাদের কাছে হুমায়ুন আহমদের কোন “বেইল” নাই।

কথাটা অন্য সকলের জন্য সত্য হলেও আমার জন্য সত্য নয়! “পুতুল নাচের ইতিকথা” আমার পড়া ক্লাসিক বইগুলোর একটা। যেভাবে মানিকদা শশীর চরিত্র রুপায়ন করেছিলেন কিংবা শুরুতেই হারুর মৃত্যুর দৃশ্য চিত্রায়ন করেছিলেন তা পৃথিবীর অন্য কোন লেখক পারবেন কিনা আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কিন্তু না, বইটি আমি তো গোগ্রাসে গিলতে পারি নি! আস্তে আস্তে পড়েছি! চার মাস না পাঁচ মাসে শেষ করেছি। মজার ব্যাপার হল ওই সময়ের ভেতরেই হুমায়ুনের কত্ত বই পড়ে ফেলেছি তারও ইয়ত্তা নেই!! আরও একটি মজার ব্যাপার হল জীবনে কোন লেখকের বই আমি দ্বিতীয় বার পড়ি নি, কিন্তু হুমায়ুন স্যারের একটা বই যে কত্তবার পড়েছি তারও ইয়ত্তা নেই! সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল এসএসসি পরীক্ষার কিছু আগে একদিন ওই ভাইয়া আমাকে জিজ্ঞাস করেছিলেন, “বল তো বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে সাহসী চরিত্র কোনটি?” আমি উত্তর দিয়েছিলাম “ইন্দ্র”। পরক্ষণেই তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার প্রিয় চরিত্র কোনটি?” আমি উত্তর দিলাম “হিমু”।

উত্তর শুনে ভাইয়া এমনি টাশকি খেলেন যে সেই সময়ের ভাইয়ার মুখভঙ্গী আজও আমার চোখের সামনে ভাসছে! আচ্ছা হুমায়ুন স্যার, আপনি কি জানেন আমার বই পড়া শুরু হয়েছিল আপনার হাত ধরে! আপনি কি জানেন আমি আপনার কত্ত বড় একজন ভক্ত? টিভিতে যখন আপনার কোন নাটক দেখায় দৌড়ে ছুটে যাই তা দেখার জন্য। একটা মজার কথা বলি, এসএসসি পরীক্ষার আগে বইমেলা থেকে আপনার দুটি বই কিনেছিলাম। বাসায় আসার পর আব্বু অন্য বইগুলো আমার ডেস্কের উপর রেখে আপনার দুটো বই আলমারিতে রেখে দিয়েছিল যাতে আমি পরীক্ষা দিয়ে বই পড়ি। কারণ, আব্বু জানত অন্য বইগুলো আমি ছুঁয়েও দেখব না। ঠিক সেই রাত্রেই আব্বু-আম্মু ঘুমিয়ে পড়লে আমি চুপি চুপি বই আলমারি খুলে আপনার বই পড়া শুরু করি এবং সেই রাত্রেই পড়ে শেষ করি।

ও ভাল কথা, বাকি বইগুলো কিন্তু আমি পরীক্ষা দিয়েই পড়েছিলাম!!! স্যার আপনি জানেন, আমি না মোটামোটি গর্তজীবি অসামাজিক মানুষ। একজন অসামাজিক মানুষের বন্ধু-বান্ধব অনেক কম থাকবে এটাই নিয়ম। আমারও বন্ধু-বান্ধব তেমন কেউ নাই! মজার ব্যাপার হল, আপনার সৃষ্ট চরিত্রগুলোই আমার বন্ধু!! বিশ্বাস করুন আর নাই করুন চুপিসারে ওদের সাথে আমার অনেক কথা হয়! প্রচণ্ড নিঃসঙ্গতার মাঝেও ওরা আমাকে সঙ্গ দেয়। এতদিন তো এই নিঃসঙ্গতাকে আমাকে বিন্দুমাত্র গ্রাস করে নি। কিন্তু আজ!!! স্যার, আপনি ওদেরকে আমার কাছে মৃত করে দিলেন!! আমি দুঃখিত, আমি আপনাকে ক্ষমা করতে পারব না।

কখনই না। আমি তো গত ছয় বছর ধরে বই মেলায় গিয়ে অন্যপ্রকাশ স্টলে গিয়ে আপনার বই বিশেষত হিমুর বই কিনতাম গোগ্রাসে! বইমেলার বই কিনা শুরু হত হিমুর বই কেনা দিয়ে। আচ্ছা স্যার, হিমুর বই কি আর আসবে না??? তাহলে আমি কিভাবে বই কিনব!! জানেন স্যার, আপনাকে নিয়ে না আজকে পত্রিকা আর টিভিতে অনুষ্ঠান হচ্ছে! আগে আপনার কোন অনুষ্ঠান হলে আমি দেখব না, সেটা ভাবাও ছিল কল্পনাতীত! আজ কেন যেন আপনাকে নিয়ে কোন অনুষ্ঠান দেখার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা আমার নেই! দেখিও নি! আমার টেবিলে এখনও পড়ে রয়েছে “শুভ্র গেছে বনে” বইটি। আপনার বই ধরার ইচ্ছেও নাই!! আপনি অনেক খারাপ মানুষ স্যার!! “ওরা” আপনাকে সস্তা বলে। আপনি সস্তা না, আপনি অনেক “ফালতু”।

আমাকে নিঃসঙ্গ করে দেওয়ার জন্য আপনাকে আমি ক্ষমা করতে পারব না। ও ভাল কথা, পরের বইমেলায় যাব কিনা তাও জানি না! কার বই কিনব সেটাও জানি না! ও আরেকটা কথা, এত্তদিন ধরে আপনার লেখাকে যারা “অসার” প্রমাণ করে “জাতে” উঠার প্রাণান্তকর চেষ্টা করত তারা আজকে নিজেদের প্রোফাইলে আপনার ছবি লাগিয়েছে! আপনাকে নিয়ে অনেক সুন্দর সুন্দর কথা লিখছে!! স্যার এগুলো দেখে আপনি কি হাসছেন??!! আমার না অনেক হাসি পাচ্ছে। আমার মনেও হচ্ছে দূর থেকে এগুলো দেখে হাসি থামাতেও পারছেন না। আচ্ছা, স্যার আপনি কি আসলেই নেই?? আমার মনে হচ্ছে “কেউ কোথাও নেই”!! যদিও আমি জানি আপনি বেঁচে আছেন এবং বেঁচে থাকবেন। রোববারে নাকি আপনি দেশে আসবেন! শহীদ মিনারের ওখানে হয়ত সোমবারে আপনাকে রাখা হবে!! সবাই আপনাকে দেখতে যাবে!!! যাকে আমি কোনদিন ক্ষমা করব না তাঁকে শেষবারের মত দেখতে যাওয়ার প্রশ্নই উঠে না! তাও আমি মনে হয় যাব! যদি বেঁচে থাকি তাহলে পৃথিবীর সব কিছু ঠেলেও যাব! ক্যান যাব তা জানি না...... ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.