আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রহমত, মাগফিরাত আর নাজাতের পয়গাম নিয়ে আবার এলো মাহে রমযান

নয়া যামানার নয়া পথিক,পথ হারিয়ে ছুটনা দিক্বিদিক আল্লাহু আকবার...... দূর মিনারে অনুরণিত হলো মাগরিবের আযান। ছোট ছোট বাচ্চারা হৈ-হুল্লোড় করে দৌড়ানো শুরু করল খালি মাঠের দিকে,কেউ উঠল গাছের মগডালে, আবার কেউবা উঠল বাড়ির ছাদে; ছোট ছোট এই বাচ্চাদের সাথে বড়রাও আছে। সবার দৃষ্টি ঐ পশ্চিম আকাশে। সবাই হন্যে হয়ে যেন খুঁজছে কিছু...। অবশেষে দেখা দিল সুতার মত চিকন রমযানের নতুন চাঁদ।

সবার মন খুশিতে ভরে উঠল। বাচ্চারা খুশির অতিশয্যে নাচানাচি শুরু করেছে, আর বড়রা শুকরিয়া সরূপ বলল আল-হামদুলিল্লাহ; সবাই নতুন চাঁদ দেখার দোআ পড়ল। কারো মুখে হাসি,কারো চোখে আনন্দের অশ্রু...। কেনইবা খুশি হবে না সবাই, এ নতুন চাঁদ তো তাদের কাছে তাদের প্রতিপালকের রহমত, মাগফিরাত আর নাজাতের পয়গাম নিয়ে শুভাগমন করেছে। তাই তো কেউ বলছে স্বাগতম মাহে রমযান,কেউবা বলছে আহলান সাহলান মাহে রমযান, আর কেউবা বলছে খোশ আমদেদ মাহে রমযান... রামাযানের অর্থ --------------------------- 'রামাযান'(رمضان )শব্দটির অর্থ অনেকে অনেকভাবে করেছেন।

মূলতঃ আরবি ভাষায় শব্দটির অর্থ- 'দগ্ধকারী', 'দহনকারী', 'জ্বালানী' ইত্যাদি। মাসটি এই নামে নামকরণের কারণ হচ্ছে- সর্বপ্রথম যখন এই মাসের নামকরণ করা হচ্ছিল সে বছর এ মাসে প্রচণ্ড গরমের মৌসুম ছিল,তাই মানুষ এ মাসের নাম 'রামাজান' রেখে দিয়েছিল। তবে ওলামায়ে কেরাম বলেন, মাসটিকে 'রামাযান' নামে বলার কারণ হচ্ছে, এ মাসে আল্লাহ তা'আলা স্বীয় রহমত ও ফজলে বান্দার সকল গুনাহ জ্বালিয়ে দগ্ধ করে দেন। এ উদ্দেশ্যেই আল্লাহ তা'আলা মাসটি নির্ধারণ করেছেন। অন্যান্য ধর্মে সিয়াম ---------------------------------- হিন্দু ধর্মেঃ পৃথিবীর যে সকল ধর্মে আমরা সিয়ামের সন্ধান পাই তার মধ্যে ভারতের হিন্দু ধর্ম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য ।

মত, পথ ও বিশ্বাসের আকাশ-পাতাল পার্থক্য সত্ত্বেও ভারতীয় জনগণের একটা বিরাট অংশ হিন্দু ধর্মের সাথে সম্পৃক্ত। হিন্দু ধর্মে সিয়াম সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে T.M.P Mahadevan লিখেছেনঃ "ফি বছর অনুষ্ঠিত ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও পর্বের মধ্যে কয়েকটি পর্ব রোযার (উপবাসব্রত) জন্য নির্দিষ্ট করে রাখা হয়েছে। এসব উপবাসব্রতের উদ্দেশ্য হচ্ছে আত্মশুদ্ধি লাভ। প্রতিটি হিন্দু উপদলের উপাসনা ও উপবাসব্রতের জন্য পৃথক দিন-সময় নির্ধারিত রয়েছে। তখন তারা সারাদিন উপবাস ব্রত পালন করে।

............কয়েকটি পর্ব শুধু হিন্দু নারীদের পালনীয়। এ পর্বগুলোকে বিশেষ গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট্যের কারণে 'ব্রত' নামে আখ্যায়িত করা হয়। ......( Outlines of Hinduism, chapter 4, section 6) প্রাচীন কিছু ধর্মেঃ মাওলানা সাইয়েদ সুলাইমান নদভী(রহ) তাঁর সুবিখ্যাত সীরাত গ্রন্থে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটেনিকার বরাত দিয়ে লিখেছেনঃ"প্রাচীন মিসরীয়দের ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিতেও সিয়ামের প্রচলন পাওয়া যায়। তবে তা সাধারণ অনুসারীদের জন্য ফরয নয়। পারসিকদের ধর্মগ্রন্থের কোন কোন শ্লোক থকে প্রতীয়মান হয়, ধর্ম প্রধানদের জন্য পাঁচশালা উপবাসব্রত অবশ্য পালনীয় ছিল।

"( সীরাতুন্নবী- খ- ৫,পৃঃ ২১২) ইয়াহুদী ধর্মেঃ তাদের ধর্মে বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন সিয়ামের দিন নির্ধারিত হয়েছে এবং বিভিন্ন কারণে আরো সংযোজিত হত, যেমন- দুর্ভিক্ষ, মহামারী, ইত্যাদি । আর বিভিন্ন উপলক্ষে ইয়াহুদী ধর্মনেতাগণও মাঝে মাঝে জনসাধারণের উপর সিয়াম ফরয করে থাকেন এবং তাদের এ অধিকার তাদের ধর্মমতে স্বীকৃত। সাধারণত ইয়াহুদীদের সিয়াম শুরু হয় সকালে সূর্য বেশ কিছু ওপরে ওঠার পর থেকে এবং তা শেষ হয় রাতের তারা উদয়ের পর। তবে কাফফারা বা প্রায়শ্চিত্ত সিয়ামের(যা মে মাসের নবম তারিখে রাখা হয়) সময়সীমা হচ্ছে এক সন্ধ্যা থেকে আরেক সন্ধ্যা। সিয়ামের জন্য সুনির্দিষ্ট বিধি-বিধান ইহাহুদী ধর্মে পাওয়া যায় না।

......'আব' মাসের প্রথম নয় দিন এবং তামুজের সতের তারিখে আংশিক সিয়ামের বিধান রয়েছে। এ ক'দিন শুধু মদ ও গোশত নিষিদ্ধ, অন্য কিছু নয়। (Jewish Encyclopedia) খ্রিস্ট ধর্মঃ খ্রিস্ট ধর্মের সকল প্রামাণ্য গ্রন্থ থেকে সিয়ামের সঠিক রূপ ও প্রকৃতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোন ধারণা অর্জন করা বেশ দুরূহ ব্যাপার। কেননা যুগ বিবর্তনের সাথে সাথে সামাজিক ও নৈতিক প্রভাবে সিয়ামের আহকাম ও বিধি-বিধানের মধ্যেও বারবার বড় ধরণের রদবদল সাধিত হয়েছে। সেন্ট পলের মৃত্যুর প্রায় দেড় শ' বছর পর খ্রিস্ট জগতে সিয়ামের বিধি-বিধান প্রণয়ন ও সুবিন্যস্তকরণের প্রয়োজনীয়তা সুতীব্রভাবে অনুভূত হয়।

সিয়াম কখনো একদিন। কখনও দু'দিন, আবার কখনও চল্লিশ ঘন্টাব্যাপী হতো। সিয়ামের বিধি-বিধান প্রণয়ন ও সুবিন্যস্তকরণের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্ন হয় খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় ও পঞ্চম শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে। ...... আরো পরে ঈসা(আ) এর জীবনের বিভিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে খ্রিস্ট জগতে বেশ কিছু সিয়ামের প্রচলন হয়,কালের বিবর্তনের সাথে পাল্লা দিয়ে সেগুলোর আকৃতি-প্রকৃতিও বদলাতে থাকে। সংস্কার যুগ শেষ হওয়ার পর ইংল্যান্ডের চার্চ সিয়ামের দিন সমূহ নির্ধারণ করে দেয় কিন্তু সিয়ামের বিধানাবলী সম্পর্কে কোন নির্দেশ জারি করেনি , বরং তা মানুষের বিবেক ও ধর্মীয় দায়িত্ববোধের উপর ছেড়ে দেওয়া হয়।

তবে ষষ্ঠ এডওয়ার্ড, প্রথম জেমস ও এলিজাবেথের সময় ইংল্যান্ডের পার্লামেন্ট আইন পাশ করে যে, সিয়ামের দিনগুলোতে গোশত খাওয়া যাবে না...। ( Encyclopedia of religion and ethics) তবে যাই হোক ইসলাম আগমনের পূর্বে পূর্ববর্তী জাতিদের উপরেও যে সিয়ামের বিধান ছিল তা সহজেই অনুমেয়। তাইতো আল্লাহ তা'আলা বলেছেনঃ "হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হলো যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরয করা হয়েছিল। " (সূরা আল বাকারাঃ১৮৩) ইসলাম ও অন্যান্য ধর্মের সিয়ামের মাঝে কিছু মৌলিক পার্থক্য ও হিকমত --------------------------------------------------------------------------------------------------- ইসলাম-পূর্ব ধর্মসমূহে সিয়ামের দিন, সংখ্যা, সময় ও প্রকৃতি নির্ধারণের বিস্তারিত ও সুস্পষ্ট কোন বিধি-বিধানের সন্ধান পাওয়া যায় না। ফলে মানুষ নিজেদের সুবিধা মত সিয়াম পালন করত।

এই অবাধ স্বাধীনতা প্রকৃতপক্ষে সিয়ামের ভাবমূর্তি ও তার প্রাণশক্তি সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট করে দিয়েছিল। আরো সোজা কথায়, সিয়ামের প্রকৃত মর্ম ও হাকিকতই তাদের হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল। সিয়ামের যাবতীয় বিধি-বিধান শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত করে দেয়ার সবচেয়ে বড় হিকমত ও তাৎপর্য মূলত এটাই। তাই শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী(রহ) তাঁর অমর গ্রন্থ 'হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা'য় লিখেছেনঃ "সিয়ামের ব্যাপারে এখতিয়ার দেয়া হলে ব্যাখ্যা ও পলায়নের দরজা উন্মুক্ত হয়ে যাবে। সৎ কাজের নির্দেশ ও অসৎ কাজের নিষেধের পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে।

আর ইসলামের এই সর্বাপেক্ষা বড় আনুগত্য অলসতার শিকার হয়ে যাবে। " (হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা, খঃ২, পৃঃ ৩৭) আর প্রাচীন ধর্মসমূহে সিয়ামে অনেক সময় আংশিক সিয়াম পালন করার সুযোগ ছিল আবার মাঝে মাঝে সিয়ামের সময় এতটা দীর্ঘ ছিল যা পালন করা ছিল সাধারণ মানুষের সাধ্যের বাইরে। যেমন বিরতিহীনভাবে একটানা তিনদিন তিনরাত সিয়াম পালন করা। প্রাচীন ধর্মসমূহে ধারাবাহিক সিয়ামের কোন বিধান ছিল না, বরং বছরের বিভিন্ন দিন বিক্ষিপ্তভাবে সিয়াম পালন পালনের প্রথাই প্রচলন ছিল। উপরন্তু দুই সিয়ামের মধ্যবর্তী সময়ের ব্যবধান এতো দীর্ঘ হতো যে, মানুষ্যজীবনে সিয়ামের কোন প্রভাবই তখন আর অনুভূত হতে পারত না।

সিয়ামের ধারাবাহিকতার হিকমত ও তাৎপর্য সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেশলভী(রহ) লিখেছেনঃ " আত্মিক উৎকর্ষ তথা নিরুংকুশ আনুগত্যের ফলপ্রসূ অনুশীলনের জন্য বিক্ষিপ্ত পানাহার বর্জনের পরিবর্তে ধারাবাহিক সিয়ামের বিধানই ছিল অপরিহার্য। কেননা দু'একবার অনশনব্রত যত কঠোর ও দীর্ঘই হোক, মানুষের জন্য কাঙ্ক্ষিত সুফল বয়ে আনতে সক্ষম নয়। "( হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহঃ খ-২, পৃঃ ৩৭) রমজানের ইতিহাস ------------------------------ রমযানুল মুবারকের সিয়াম ফরয হওয়ার পূর্বে আশুরার সিয়াম পালনের নির্দেশ ছিল মুসলমানদের উপর। হিজাযের গুটি কয়েক আরবগোত্র ও আরব ইয়াহুদীদের মধ্যেও আশুরার সিয়ামের প্রচলন ছিল। তবে রমজানের সিয়ামের বিধান ঠিক তখনই নাজিল করা হয়েছে,যখন সারা দুনিয়ার শিরক ও তাগুতী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামরত মুষ্টিমেয় সহায়-সম্বলহীন মুসলমানদের মাথার ওপর থেকে বিপদের মেঘ কেটে গিয়ে অর্থনৈতিক নিপীড়ন ও চরম দারিদ্র্যের অমানিশার পর সুখের দিনের প্রভাত কিরণ মদিনার পূর্ব আকাশে দেখা দিয়েছে এবং মদিনায় এসে মুসলমানগণ একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার সুযোগ লাভ করেছেন।

হ্যাঁ, ঠিক তখনই নাযিল হল সিয়াম সাধনার বৈপ্লবিক বিধান। সিয়ামের বিধান নাযিল হওয়ার সূক্ষ্ম বিষয়গুলোর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে গিয়ে আল্লামা ইবনুল কায়্যিম(রহ) লিখেছেনঃ "যেহেতু মানুষকে চিরাচরিত স্বভাব ও প্রকৃতি থেকে ফিরিয়ে রাখাই হচ্ছে সবচেয়ে কষ্টসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার, সেহেতু সিয়ামের বিধান নাযিল করার ব্যাপারে মোটেও তাড়াহুড়ো করা হয়নি, এমনকি হিজরতের পরেও সাথে সাথে সিয়ামের নির্দেশ দেয়া হয়নি, বরং মদিনার মুক্ত বাতাসে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার পরও মুসলমানদেরকে(মানসিক প্রস্তুতির জন্য) পর্যাপ্ত সময় দেয়া হয়েছে। যখন একথা সুপ্রমাণিত হয়ে গেলো, মুসলমানদের অন্তরে ঈমানের শিকড় অত্যন্ত মজবুত হয়ে বসে গেছে, রগ-রেশায় মিশে গেছে তাওহীদের আবেদন ও সালাতের মর্মবাণী, আল-কুরআনের নতুন যে কোন নির্দেশর জন্যই এখন তাঁরা সদা উদগ্রীব, ঠিক তখনই হিজরতের দ্বিতীয় বছরে নাযিল হলো সিয়ামের বিধান এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম নয়টি রমযান সিয়াম পালন করে দুনিয়া থেকে চিরবিদায় নিলেন। (যাদুল মা'আদ) সিয়ামের বিধানবাহী আল-কুরআনের আয়াতটি হচ্ছে এইঃ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ-أَيَّامًا مَعْدُودَاتٍ ۚ فَمَنْ كَانَ مِنْكُمْ مَرِيضًا أَوْ عَلَىٰ سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِنْ أَيَّامٍ أُخَرَ ۚ وَعَلَى الَّذِينَ يُطِيقُونَهُ فِدْيَةٌ طَعَامُ مِسْكِينٍ ۖ فَمَنْ تَطَوَّعَ خَيْرًا فَهُوَ خَيْرٌ لَهُ ۚ وَأَنْ تَصُومُوا خَيْرٌ لَكُمْ ۖ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ-شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِنَ الْهُدَىٰ وَالْفُرْقَانِ ۚ فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ ۖ وَمَنْ كَانَ مَرِيضًا أَوْ عَلَىٰ سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِنْ أَيَّامٍ أُخَرَ ۗ يُرِيدُ اللَّهُ بِكُمُ الْيُسْرَ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ الْعُسْرَ وَلِتُكْمِلُوا الْعِدَّةَ وَلِتُكَبِّرُوا اللَّهَ عَلَىٰ مَا هَدَاكُمْ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ -"হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেমন ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যেন তোমরা 'তাকওয়া' অর্জন করতে পার।

গণনার কয়েকটি দিনের জন্য অতঃপর তোমাদের মধ্যে যে, অসুখ থাকবে অথবা সফরে থাকবে, তার পক্ষে অন্য সময়ে সে রোজা পূরণ করে নিতে হবে। আর এটি যাদের জন্য অত্যন্ত কষ্ট দায়ক হয়, তারা এর পরিবর্তে একজন মিসকীনকে খাদ্যদান করবে। যে ব্যক্তি খুশীর সাথে সৎকর্ম করে, তা তার জন্য কল্যাণ কর হয়। আর যদি রোজা রাখ, তবে তোমাদের জন্যে বিশেষ কল্যাণকর, যদি তোমরা তা বুঝতে পার। রমযান মাসই হল সে মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে কোরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্যপথ যাত্রীদের জন্য সুষ্পষ্ট পথ নির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী।

কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে, সে এ মাসের রোযা রাখবে। আর যে লোক অসুস্থ কিংবা মুসাফির অবস্থায় থাকবে সে অন্য দিনে গণনা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান; তোমাদের জন্য জটিলতা কামনা করেন না যাতে তোমরা গণনা পূরণ কর এবং তোমাদের হেদায়েত দান করার দরুন আল্লাহ তা’আলার মহত্ত্ব বর্ণনা কর, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর। "(সুরা আল বাকারা:১৮৩-১৮৫) রমজানের সাথে সিয়ামের সম্পর্ক ---------------------------------------------------- এখানে এ প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, সিয়ামকে রমযানুল মুবারকে কেন ফরয করা হলো? কি এর হিকমত ও তাৎপর্য? বস্তুত মহাপ্রজ্ঞাবান আল্লাহ পাক কেন সিয়ামকে রমজান মাসে ফরয করেছেন এবং কি এর হিকমত ও রহস্য তা এই মানবীয় ক্ষুদ্রতা ও স্থূলতার মধ্যে অবস্থান করে অনুবাধন করা সম্ভব নয়। তবে এতটুকু বলা যায়, রমজান মাসেই আল-কুরআন নাযিল হয়েছে।

গোমরাহীর ঘন অন্ধকারে নিমজ্জিত মানবতার পূর্ব আকাশে উদ্ভাসিত হয়েছে সুবহে সাদিকের সোনালী আলো। তাই এটা খুবই যুক্তিযুক্ত ছিল, সিয়ামের প্রারম্ভকে যেরূপ সুবহে সাদিকের সাথে সম্পৃক্ত করে দেয়া হয়েছে, তদ্রূপ ত্রিশটি সিয়ামের জন্যও মানবতার সুবহে সাদিকের মাস মাহে রমজানকে নির্দিষ্ট করে দেয়া হবে। তদুপরি আল্লাহর রহমত ও বরকত এবং রূহানিয়াত ও আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রেও মাহে রমযান অন্যান্য মাসের তুলনায় অধিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। তাই একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, সিয়াম সাধনার জন্য এ মুবারাক মাসটিই সর্বাধিক উপযুক্ত। এদিকে ইঙ্গিত করেই আল্লাহ তা'আলা বলেছেনঃ شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِّنَ الْهُدَىٰ وَالْفُرْقَانِ ۚ فَمَن شَهِدَ مِنكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ ۖ -"রমজান মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে কুরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্যপথ যাত্রীদের জন্য সুস্পষ্ট পথনির্দেশ ।

আর হক ও বাতিলের পার্থক্যকারী। সুতরাং তোমাদের মাঝে যে এ মাস পাবে, তাকে অবশ্যই সিয়াম পালন করতে হবে। " কুরআনের সাথে সিয়ামের রয়েছে এক সুগভীর আত্মিক ও প্রেমময় সম্পর্ক। এজন্যই রাসূলুল্লাহ(সাঃ ) রমযানুল মোবারকে কুরআন তিলাওয়াতে অত্যাধিক মনযোগী হয়ে পড়তেন। ইবাদাত ও পুণ্যের বিশ্বমৌসুম ------------------------------------------- বস্তুত রমযানুল মুবারাক হচ্ছে ইবাদাত,তিলাওয়াত, যিকির, পবিত্রতা ও নৈকট্য লাভের এক বিশ্বমৌসুম।

আত্মিক উৎকর্ষ ও পরকালীন কল্যাণ লাভের এক ঐশী উৎসব । পূর্ব-পশ্চিম তথা দুনিয়ার সকল অঞ্চলের সকল শ্রেণীর সকল মুসলমান সমভাবে এ উৎসবে শরীক। শিক্ষিত-অশিক্ষিত, পণ্ডিত-মূর্খ, শাসক-প্রজা ও ধনী-গরীব সকলেই ইহ ও পরকালীন কল্যাণ অর্জনের এই প্রতিযোগিতায় সমান উৎসাহী। ইসলামী দুনিয়ার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত একই সময়ে অভিন্ন নিয়মে পালিত হচ্ছে রমযানুল মুবারক। ধনীর প্রসাদ ও গরীবের পর্ণ কুটির সর্বত্রই তার অফুরন্ত কল্যাণ ও বরকতের অবাধ গতি।

এখানে কেউ নিজস্ব মত খাটাতে ব্যস্ত নয়। ফলে সিয়ামের দিন, সময়, রূপ ও প্রকৃতি নির্ধারণে নেই কোন আরজকতা ও বিশৃঙ্খলা। প্রত্যেক চক্ষুষ্মান ব্যক্তি ইসলামী জাহানের যে কোন অঞ্চলেই রমযানুল মুবারাকের কল্যাণবর্ষী ও জ্যোতির্ময় সে দৃশ্য অবলোকন করতে পারে। মনে হয় গোটা ইসলামী উম্মাহ শান্তি ও কল্যাণের, নূরানিয়াত ও স্নিগ্ধ জ্যোতির্ময়তার এক বিস্তৃত শামিয়ানার নিচে ঠাঁই নিয়েছে, এমন কি ঈমানী দুর্বলতার কারণে সিয়ামের ব্যাপারে যারা অনীহ ও অলস, তারাও মুসলিম উম্মাহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার ভয়ে রোযা রাখতে বাধ্য হয় কিংবা রোযা না রাখলেও প্রকাশ্যে পানাহার চালিয়ে যেতে ইতস্তত ও লজ্জিত বোধ করে। পর্দা টানিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে পানাহার করে এবং রোযা না রাখার কথা প্রকাশ করতে কুণ্ঠাবোধ করে।

অবশ্য সেই সব ধর্মদ্রোহী,মৃতাত্মা ফাসিকদের কথা ভিন্ন, লজ্জার অনুভূতিটুকুও যাদের বিলুপ্ত হয়ে গেছে। রমযানের ফযীলত ও আযমত ----------------------------------------- রমজানের সিয়াম হচ্ছে একটি সার্বজনীন ইবাদাত। মুসলিম উম্মাহর প্রতিটি সক্ষম ও প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির ওপরই সিয়াম ফরয। প্রচণ্ড গরমের দীর্ঘতম দিনেও স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুসলমানেরা সিয়াম পালন করে থাকে। আর রাতে মশগুল থাকে সালাত,তিলাওয়াত ও অন্যান্য ইবাদতে।

এর কারণ, ঈমানদারদের কাছে নবী-রাসূলদের মাধ্যমে প্রাপ্ত আখিরাতের লাভ ও মুনাফার মূল্য স্বাস্থ্য বিজ্ঞানী ও অর্থনীতিবিদদের বর্ণিত স্থূল ও ক্ষণস্থায়ী মুনাফার চেয়ে অনেক বেশী। সিয়াম সম্পর্কে এমন সব সুসংবাদ ও মহাপুরস্কারের কথা তারা জানে যার সামনে একটি মাসের ক্ষুৎ-পিপাসার কষ্ট একেবারেই তুচ্ছ, উল্লেখের অযোগ্য। হযরত আবু হুরাইরা(রা) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ ) হাদিসে কুদসিতে ইরশাদ করেছেনঃ "আদম সন্তানের প্রতিটি আমলই কয়েকগুণ বৃদ্ধি করে দেয়া হয় এবং সওয়াব দশগুণ থেকে সাত শত গুণ বৃদ্ধি করা হয় সিয়াম ব্যতীত। কেননা সিয়াম শুধু আমারই জন্য এবং আমিই তার বিনিময় দেব। আমার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যই শুধু সে পানাহার বর্জন করেছে, নফসের চাহিদা বিসর্জন দিয়েছে।

{সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১১৫১ (১৬৪); মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ৯৭১৪; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস : ৮৯৮৭; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস : ১৬৩৮} হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,সিয়াম পালনকারীদের জন্য দু'টি খুশির সময় আছে। একটি খুশি হচ্ছে ইফতারের সময়, আরেকটি খুশি হচ্ছে আপন প্রতিপালকের সাথে মিলিত হওয়ার সময়। নিশ্চয় সিয়াম পালনকারীর মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে মিশকের চেয়েও প্রিয় ও পবিত্র। "{-সহীহ বুখারী, হাদীস : ১৯০৪, ১৮৯৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১১৫১ (১৬৩, ১৬৪, ১৬৫); মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ৯৪২৯, ৭১৭৪; সুনানে তিরমিযী, হাদীস : ৭৬৬} আরেক হাদিসে ইরশাদ হয়েছেঃ " যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতিসাব(ছওয়াব প্রাপ্তি) তথা আল্লাহকে নিবেদন করে সিয়াম পালন করে তার পূর্ব জীবনের সকল পাপরাশি ক্ষমা করে দেয়া হয়। " {সহীহ বুখারী ,হাদীস : ১৯০১; জামে তিরমিযী' হাদীস : ৬৮৩; ইবনে মাজাহ ,হাদীস : ১৩২৬} এরকম অনেক হাদিস আছে রোযার প্রতিদান এবং তার ফজিলত সম্পর্কে।

এ মাস কিভাবে কাটানো উচিৎ ------------------------------------------- রমযান মাসে যতটা সম্ভব নফল ইবাদাত বেশি করা উচিৎ। কুরআন তিলাওয়াত, তারাবীর নামাজ, যিকির-আযকার, নফল নামাজ যত বেশি সম্ভব করা ভাল। কিন্তু এসব ইবাদাত থেকে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে। যার প্রতি সাধারণতঃ দৃষ্টি দেয়া হয় না। আর তা হচ্ছে - গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা ।

এ মাসে গুনাহ যেন আমাদের মাথায় চেপে না বসে, এ মাসটিতে যেন চোখের বিচ্যুতি না ঘটে, ভুল স্থানে যেন দৃষ্টি না যায়, কান যেন কোন অশ্লীল কোনো কিছু না শুনে, জবান থেকে যেন কোনো গলদ কথা নিঃসৃত না হয়, যেন আল্লাহর নাফরমানী থেকে পুরোপুরি বেঁচে থাকা যায়। পবিত্র মাসটি যদি এভাবে অতিবাহিত করা যায়, তাহলে যদি এক রাকাত নফল নামাজও না পড়া হয়, তিলাওয়াত-যিকির-আযকারও যদি খুব একটা না করা হয়, শুধুমাত্র গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা হয়, তবেই তো আল্লাহর নাফরমানি থেকে বেঁচে থাকা হল। এতেই আপনি মুবারাকবাদ পাওয়ার যোগ্য। এ মাসও হবে আপনার জন্য মুবারাক মাস। দীর্ঘ এগার মাস ব্যাপী তো নানা ধরণের কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়।

তাই অন্তত এ মাসটিকে গুনাহ থেকে পবিত্র করে নিন। আল্লাহর নাফরমানি থেকে বিরত থাকুন। পবিত্র মাসটিতে কানকে গলদ স্থানে ব্যবহার করবেন না। ঘুষ খাবেন না, সুদ খাবেন না। কমপক্ষে এ একটি মাস এভাবে চলুন।

রোযা তো আমরা মাশাআল্লাহ বড় আগ্রহের সাথেই রেখে থাকি। কিন্তু রোযা অর্থ কি? রোজার অর্থ হচ্ছে, খানা-পিনা এবং প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণ থেকে মুক্ত থাকা। রোযার সময় এ তিনটি বিষয় অবশ্যই পরিত্যাগ করতে হয়। এবার লক্ষ্য করুন! এ তিনিটি বিষয় এমন যা মূলতঃ হালাল। খাবার খাওয়া, পান করা এবং বৈধ পদ্ধতিতে স্বামী-স্ত্রী তাদের প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণ করা হালাল।

রোযার সময় আপনি এসব হালাল বিষয় হতে নিজেকে মুক্ত রাখলেন। কিন্তু যেগুলো পূর্ব থকেই হারাম ছিল, যথা- মিথ্যা বলা, গীবত করা, কু-দৃষ্টি দেয়া এগুলো পূর্ব থকেই হারাম ছিল। অথচ এখন রোযা রাখা হচ্ছে- মিথ্যা কথাও বলা হচ্ছে, রোযাও রাখা হচ্ছে, গীবতও করা হচ্ছে, কু-দৃষ্টি দেয়া হচ্ছে, রোযাদার অথচ সময় কাটানোর নাম করে নোংরা ফ্লিম দেখা হচ্ছে। তাহলে প্রশ্ন হলো, পূর্ব থকে হালাল বিষয়সমূহও রোযার ভিতর ত্যাগ করা হলো অথচ হারামসমূহ ত্যাগ করা হলো না, তাহলে এটা রোযা হলো কি? তাই তো হাদিসে শরীফে আল্লাহর পেয়ারা হাবীব ইরশাদ করেছেন,"যে রোযা রেখেছে, অথচ মিথ্যাচার পরিহার করেনি, তার এই কৃত্রিম পানাহার বর্জনের কোন প্রয়োজন আল্লাহর নেই। "{সহীহ বুখারী' হাদীস : ১৯০৩; সুনানে আবু দাউদ ,হাদীস : ৩৩৬২} হযরত আবু উবায়দা(রা) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেছেন," সিয়াম হচ্ছে ঢাল সরূপ যদি না সে নিজেই তা ফুটো করে দেয়।

"(মুসনাদে আহমদ হাদীস : ১৬৯০) 'আওসাত' গ্রন্থে উপরিউক্ত হাদিসের সাথে একথাও যুক্ত আছে,"সাহাবাগণ আরয করলেন, কোন জিনিস দ্বারা তা ফুটো হয়ে যায়?" ইরশাদ হলো, "মিথ্যা কথা ও গীবত দ্বারা। " হাদিসে আরো ইরশাদ হয়েছেঃ " অনেক সিয়াম পালনকারী এমন যাদের ক্ষুধার্ত ও পিপাসার্ত থাকাই সার হয়েছে। তদ্রূপ অনেক ইবাদাতগুযার এমন যাদের বিনিদ্র রাত কাটানোই সার হয়েছে। " রোযার সময় অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা ও ঝগড়াঝাঁটি থেকেও দূরে থাকা উচিৎ। তাই হাদিসে ইরশাদ হয়েছেঃ "সিয়ামরত অবস্থায় তোমাদের কেউ অশালীন ও অর্থহীন কথাবার্তায় লিপ্ত না হয়।

কেউ যদি তাকে অশালীন কথা বলে কিংবা তার সাথে অকারণে বাদানুবাদে লিপ্ত হতে চায় তবে সে যেন একথা বলে দেয়, আমি রোযাদার। " {সহীহ বুখারী হাদীস : ১৯০৪; সহীহ মুসলিম হাদীস : ১১৫১} রোযার উদ্দেশ্যঃ তাকওয়ার আলো প্রজ্বলিত করা -------------------------------------------------------------------- রোযার উদ্দেশ্য আল্লাহ তা'আলা নিজেই বলে দিয়েছেন, আর তা হলো - তাকওয়া অর্জন করা। অর্থাৎ রোযা মূলতঃ অন্তরের মাঝে তাকওয়া বা আল্লাহভীতির আলোক প্রজ্বলিত করার লক্ষ্যে ফরয করা হয়েছে। ইমাম গাযালী (রহ) তাঁর স্বভাবসুলব দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সিয়ামের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে লিখেছেনঃ " আখলাকে ইলাহী তথা আল্লাহর গুণে মানুষকে গুণান্বিত করে তোলাই হচ্ছে সিয়ামের উদ্দেশ্য। সিয়াম মানুষকে ফিরিশতাদের অনুকরণের মাধ্যমে যতদূর সম্ভব নিজেকে প্রবৃত্তির গোলামী থেকে মুক্ত হওয়ার শিক্ষা দেয়।

কেননা ফিরিশতাগণ সকল চাহিদা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত এবং মানুষের মর্যাদাও হচ্ছে পশুর চেয়ে বহু উর্ধ্বে। জৈবিক চাহিদা মুকাবিলা করার জন্য তাকে দান করা হয়েছে বিবেক ও বুদ্ধির আলো। অবশ্য এক দিক দিয়ে তার স্থান ফিরিশতাদের নীচে। জৈবিক চাহিদা ও পাশবিক কামনা অনেক সময় তার উপর প্রাধান্য বিস্তার করতে সক্ষম হয় এবং তার ভেতরের এ পশুত্ব দমন করতে তাকে কঠোর সাধনা ও মুজাহাদ করতে হয়। তাই মানুষ যখন পাশবিক ইচ্ছার সুতীব্র স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয়, তখন সে নেমে আসে অধঃপতনের নিম্নতম স্থানে।

অরণ্যের পশু আর লোকালয়ের মানুষে কোন প্রভেদ থাকে না তখন। আর যখন সে তার পাশবিকতা দমন করতে সক্ষম হয়, তখন তার স্থান হয় নূরের ফিরিশতাদেরও ওপরে। " (এহয়াউল উলুম,খঃ১,পৃঃ২১৬) রোজা হচ্ছে 'তাকওয়া' অর্জনের সর্বোত্তম ট্রেনিংকোর্স। একজন মানুষ যতবড় পাপিষ্ঠ কিংবা যেমনই হোক না কেন রোযা রাখার পর তার অবস্থা এমন হয় যে, প্রচণ্ড গরমের দিনে পিপাসায় কাতর সে, একাকী কক্ষে, অন্য কেউ সাথে নেই, দরজা-জানালা বন্ধ, কক্ষে রয়েছে ফ্রিজ, ফ্রিজে রয়েছে শীতল পানি-এমনি মুহূর্তে তার তীব্র চাহিদা হচ্ছে, এ প্রচণ্ড গরমে এক ঢোক ঠাণ্ডা পানি পান করার। কিন্তু ,তবুও কি এ রোযাদার লোকটি ফ্রিজ হতে শীতল পানি বের করে পান করে নিবে? না, কখনোই না।

অথচ লোকটি যদি পান করে, জগতের কেউই জানবে না। তাকে কেউ অভিশাপ কিংবা গাল-মন্দও করবে না। জগতবাসীর নিকট সে রোজাদার হিসেবেই গণ্য হবে। সন্ধ্যায় বের হয়ে সে লোকজনের সাথে ইফতারও করতে পারবে। কেউই জানবে না তার রোজা ভঙ্গের কথা।

এতদস্ত্বেও সে পান করবে না। কেন? কারণ, সে ভাবে যে, অন্য কেউ না দেখলেও আমার মালিক যার জন্য রোজা রেখেছি তিনি তো আমায় দেখছেন। তাছাড়া আর কোন কারণ নেই। তাইতো আল্লাহ বলেন-" রোযা আমার জন্যই,সুতরাং আমিই এর প্রতিদান দেবো। " এই যে হৃদয়ে আল্লাহর সামনে দণ্ডায়মান হবার এবং জবাবদিহিতার ভয়ের অনুভূতি জাগ্রত হওয়াকেই বলে 'তাকওয়া'।

এজন্যই শাহ আশরাফ আলী থানভী(রহ) বলেছেন," রোজা দ্বারা শুধুমাত্র পশুসুলভ চরিত্রের মৃত্যু ঘটবে এমন নয়, বরং বিশুদ্ধ রোজা মানেই তাকওয়ার উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন সিঁড়ি। " আল্লাহ যেন আমাদের বলছেন, রোজার মাধ্যমে তাকওয়ার এ ব্যবহারিক ট্রেনিং কোর্স সম্পন্ন করার পর তাকে আরো উচ্চ শিখরে নিয়ে যাও। সুতরাং যেমনিভাবে রোজার দিনে প্রচণ্ড পিপাসা সত্ত্বেও পানি পান করনি, আল্লাহর ভয়ে আহার করনি, তেমনিভাবে জীবনের অন্যান্য কাজকর্মে যদিও গুনাহ করার ইচ্ছা জাগে, যদি গুনাহ করার উপলক্ষ তোমার সামনে আসে, তখন সে ক্ষেত্রে আল্লাহ তা'আলার ভয়ে নিজেকে গুনাহ হতে বাঁচিয়ে রেখো। এ লক্ষেই তোমাকে এক মাসের ট্রেনিং করানো হচ্ছে। ট্রেনিং কোর্সটি পরিপূর্ণ হবে তখন, যখন জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে এর ভিত্তিতে আমল করবে।

রমজানের দিনের বেলায় পানি ইত্যাদি পান করনি আল্লাহর ভয়ে- অথচ জীবনের অন্যান্য কাজকর্মের আল্লাহকে ভুলে গিয়ে চোখ দ্বারা কু-দৃষ্টি করছ, কান দ্বারা অশ্লীল কথা শুনছ- তাহলে কিন্তু ট্রেনিং কোর্সটি আর পূর্ণতা লাভ করবে না। রোযার আরেকটি মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে- আল্লাহ তা'আলার হুকুম পালন। এমনকি পুরো দীনের মূল কথাই হচ্ছে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের হুকুম পালন করা। যখন বলবেন খাও তখন খাওয়াটাই 'দীন"। যখন বলবেন খেও না- তখন না খাওয়াটাই 'দীন'।

আল্লাহ তা'আলার দাসত্ব স্বীকার আর আনুগত্যের এক বিস্ময়কর পদ্ধতি তিনি রোযার মাধ্যমে বান্দাকে দিয়েছেন। তিনি দিন ব্যাপী রোযা রাখার হুকুম দিলেন, তার জন্য বহু সওয়াব বা প্রতিদান রাখলেন। অন্যদিকে সূর্যাস্তের সাথে সাথে তাঁর নির্দেশ- 'তাড়াতাড়ি ইফতার করে নাও। " ইফতারে তাড়াতাড়ি করাটা আবার মুস্তাহাব হিসেবে আখ্যায়িত করলেন। বিনা কারণে ইফতারে বিলম্ব করাকে মাকরুহ হিসেবে আখ্যায়িত করলেন।

কেন মাকরুহ?! যেহেতু সূর্যাস্তের সাথে সাথে আল্লাহ তা'আলার হুকুম হচ্ছে ইফতার করে নেয়ার। যেহেতু এখন যদি না খাওয়া হয়, যদি ক্ষুধার্ত থাকা হয়, তবে এ ক্ষুধার্ত অবস্থা আল্লাহর নিকট পছন্দনীয় নয়। কারণ, সকল কিছুর মৌলিক উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর আনুগত্য-দাসত্ব প্রকাশ করা, নিজ আকাঙ্ক্ষা পূরণ করা নয়। আবার সাহরীর সময় বিলম্ব করে খাওয়া উত্তম। তাড়াতাড়ি খাওয়া সুন্নত পরিপন্থী।

অনেকে বারটা বাজেই সাহরী খেয়ে শুয়ে পড়ে, এটা সুন্নতের পরিপন্থী। সাহাবায়ে কেরামের এ অভ্যাস ছিল যে, তাঁরা সাহরী শেষ সময় পর্যন্ত খেতেন। কারণ, সাহরী শেষ সময়ে খাওয়া শুধুমাত্র অনুমতিই নয়; বরং হুকুমও। আল্লাহ তা'আলার আনুগত্য তো এরই মাঝে নিহিত। তাই হাকীমুল উম্মত হযরত আশরাফ আলী থানভী (রহ) বলেছেন," যখনই আল্লাহ তা'আলা খাওয়ার নির্দেশ দেন, তখন বান্দা যদি বলে- খাবো না কিংবা বলে -আমি কম খাই, তাহলে এটা তো আনুগত্যের প্রকাশ হলো না।

আরে ভাই! খাওয়ার আর না খাওয়ার মাঝে কিছু নেই। সকল কিছুই হচ্ছে তাঁর আনুগত্যের মাঝে। অতএব, যখন তিনি বলেন -খাও, তখন খাওয়াটাই ইবাদাত। তখন না খেয়ে নিজের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত আনুগত্য প্রকাশ করার প্রয়োজন নেই। " ই'তিকাফ ও শবে কদর -------------------------------------- শাহ ওয়ালীউল্লাহ(রহ) ই'তিকাফের হাকিকত সম্পর্কে বলেছেনঃ "মসজিদে ই'তিকাফ হচ্ছে আত্মিক প্রশান্তি, হৃদয়ের পবিত্রতা,চিন্তার বিশুদ্ধতা,ফিরিশতাকুলের গুণাবলী অর্জন, শবে কদরের সৌভাগ্য ও কল্যাণ লাভের এক সর্বোত্তম উপায়।

তাই আল্লাহর রাসূল রমযানুল মুবারাকের শেষ দশ দিনে ই'তিকাফ করেছেন এবং উম্মতের সৎ ও ভাগ্যবান লোকদের জন্য তা সুন্নতরূপে ঘোষণা করেছেন। " (হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহঃ খঃ২, পৃঃ ৪২) এজন্যই রাসূলুল্লাহ (সা) প্রতি রমজানে অত্যন্ত আগ্রহ ও গভীর আত্মনিমগ্নতার সাথে ই'তিকাফ পালন করেছেন এবং যুগে যুগে মুসলিম উম্মাহও যথার্থ নিষ্ঠার সাথে এই নবী সুন্নতের উপর আমল করে এসেছেন। ফলে ইতিকাফ রমযানুল মুবারাকের এক অবিচ্ছেদ্য অংশরূপে স্বীকৃতি লাভ করেছে। হযরত আবু হুরাইরা (রা) রিওয়ায়েত করেছেনঃ "প্রতি রমযানেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শেষ দশ দিন ই'তিকাফ করেছেন। কিন্তু ওফাত-পূর্ব রমযানে ই'তিকাফ করেছেন বিশ দিন।

" (বুখারী) লাইলাতুল কদরের ফযীলত ও মর্যাদার কথা কুরআন ও হাদিসে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বর্ণিত হয়েছে। আর কুরআন মাজীদে তো এ মুবারক রাতের নামে একটি সূরাই নাজিল করা হয়েছে। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেনঃ "নিঃসন্দেহে আমি তা লাইলাতুল কদরে অবতীর্ণ করেছি। আর আপনি কি জানেন লাইলাতুল কদর কি? লাইলাতুল কদর হাযার মাসের চেয়ে উত্তম। " (সূরাতুল কদরঃ১-৩) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন,"লাইলাতুল কদরে ঈমান ও ইহতিসাব সহকারে যে ব্যক্তি ইবাদাত করবে তার পূর্ব জীবনের সকল পাপ ক্ষমা করে দেয়া হবে।

" {সহীহ মুসলিম ,হাদীস : ৭৬০; সহীহ বুখারী, হাদীস : ২০১৪ } মহাপ্রজ্ঞাময় ও করুণার অধিকারী আল্লাহ পাক লাইলাতুল কদরকে রমযানের শেষ দশ দিনের মধ্যে গোপন রেখেছেন যেন মুসলমানগণই তার সন্ধানে ব্যাপৃত হয় এবং লাইলাতুল কদরের সৌভাগ্য লাভের প্রত্যাশায় উদ্যম ও চঞ্চলতা নিয়ে সব কটি রাতই জাটিয়ে দেয় ইবাদাতের নিমগ্নতায়। কেননা এতেই মানুষের কল্যাণ। রমযানের শেষ দশ দিন মুসলমানদের কিভাবে কাটাতে হবে , নিজেকে দিয়েই আল্লাহর রাসূল তা দেখিয়ে গেছেন। হযরত আয়েশা (রা) রিওয়ায়েত করেছেনঃ "রমযানের শেষ দশদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সারা রাত জেগে ইবাদাত করতেন এবং ঘরের অন্যদের জাগিয়ে দিতেন। তখন তাঁর ইবাদাত নিমগ্নতা ছিল দেখার মত।

" [ বুখারী ও মুসলিম] অধিকাংশ হাদিস দ্বারা এ কথাই প্রমাণিত হয়, লায়লাতুল কদরের রমযানের শেষ দশ দিনে এবং আরো সুনির্দিষ্টভাবে শেষ সাত দিনের যে কোন বেজোড় রাতে নিহিত রয়েছে। আল্লাহর রাসূল ইরশাদ করেনঃ "যে ব্যক্তি লায়লাতুল কদরের সন্ধান পেতে চায় সে রমযানের শেষ সাত দিনের মধ্যেই সন্ধান করুক। " [ বুখারী ও মুসলিম] হযরত আয়েশা (রা) রিওয়ায়েত করেন,"রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানের শেষ দশ দিন নির্জন ই'তিকাফে বসে যেতেন এবং বলতেন, শেষ দশ দিনে লায়লাতুল কদরের সন্ধান করো। " [সহীহ বুখারী, হাদীস : ২০২৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১১৬৭ ] হযরত আয়েশা (রা) থেকে আরো বর্ণিত আছে,রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন," শেষ দশ দিনের বেজোড় রাতে লায়লাতুল কদরের অনুসন্ধান কর। " [সহীহ বুখারী হাদীস : ২০১৭; ২০২০] বুযুর্গানে দীনদের রমযান পালন -------------------------------------------------------- রমযানে আল্লাহর নেককার বান্দাদের অবস্থা পুরোপুরি বদলে যেত।

যেন মনে হতো তারা দুনিয়া থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন। তারা রমযানকে রমযানের মত পালনের জন্য তাদের সাধ্যমত চেষ্টা করতেন। তাঁরা রমযানে এত সময় ইবাদাতে মগ্ন থাকতেন যা এযুগে অনেকটা অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। তবে সবাই একটি ইবাদাত বেশি বেশি করতেন,আর তা হল- কুরআন তিলাওয়াত। ইমামে আ'যম হযরত আবু হানিফা(রহ) প্রতিদিন এক খতম কুরআন তিলাওয়াত করতেন আর রাতের শেষে দিতেন আরেক খতম।

এভাবে পুরা রমযানে একষট্টি খতম কুরআন তিলাওয়াত করতেন। আল্লামা।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১০ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.