আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

টুপ করে ডুবে গেল শমী

আমরা শুধু আপন মানুষ খুঁজি, আপন মানুষদের খুঁজতে হয় না, তারা পাশেই থাকে !! বন্ধুরা ওকে মুটকো বলে ডাকতো, আমরা ডাকতাম এন্ড্রয়েড রোবট বলে। আটশাট জামা পরে, পেছনে একটা স্পোর্টস ব্যাগ লাগিয়ে ডানে বামে না তাকিয়ে হাটতো। বলতে গেলে একলা একলাই চলতো আমাদের শমী। গত বৃহস্পতিবার এভাবেই শরীফ মাহমুদ শমী সমগ্র সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়কে কাঁদিয়ে একলা একলাই চলে গেল না-ফেরার দেশে। হলে আমি যে রুমটাতে থাকি সেখানে জুনিয়র ছেলেদের আনাগোনা অনেকটাই বেশী।

আমার টেবিলের পাশে একটা স্টোর খাট আছে। দুনিয়ার আবর্জনা দিয়ে ভর্তী। সবাই এসে ঐ খাটেই বসে। শমী কয়েকদিন আগে এসে আমার কছে বলল-“ভাইয়া এখানে একটু বসি?” আমি বললাম-“না, এখন ব্যাস্ত পরে কথা বলব”। সত্যি কথা বলতে শমীর প্রতি রাগ ছিল আমার।

আমাদের ভাঙ্গা-চোরা সাংবাদিক সমিতিটাকে দাঁড় করাতে আমাকে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়। অতি উৎসাহী নতুন কিছু শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে এসেই বিভিন্ন সংগঠনে যোগ দেয়। সময়ের সাথে সাথে তাদের উৎসাহ কমে আসে। তখন বিপদে পরে সংগঠনগুলো। সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি এমনি ভাবে বিপদে পড়েছিল শমীসহ আরো কিছু অতি উৎসাহিতদের জন্য।

আমি কাউকে কিছু বলিনি। শমী সেদিন এসে বলল-“ভাইয়া প্লিজ আমাকে আরেকবার সুযোগ দিন, এবার আর ভুল হবে না। ” আমি বললাম-“ঠিক আছে, দিব। তবে তার আগে আমার কাছে তোমাকে পাঁচটা নতুন রিপোর্ট জমা দিতে হবে। ” সন্ধ্যাবেলা একটি রিপোর্ট নিয়ে শমী হাজির।

মাৎস্য-বিজ্ঞান অনুষদের ক্লাসরুম সংকট। সবকিছুই ঠিকঠাক ছিল, ডিন স্যারের বক্তব্য ছিল না। আমাকে অনুরোধ করল-বক্তব্যটা এনে দিতে হবে। সেদিন আরো বলল-কোন বন্ধুর সাথে নাকি ওর ঝগড়া হয়েছে। কিছু টাকাও চাইল।

আমার মানিব্যাগও প্রায় শূন্য, তাই দিতে পরি নাই। পরদিন শমীর আর দেখা নেই। শমীকে সাথে নিয়ে অডিটরিয়ামের দূরাবস্থা নিয়ে রিপোর্ট করবো -পাত্তা নেই তার। পরদিন শমী সকালে এসে বলল-“ভাই আজ আমাদের অনুষদের প্রোগ্রামের কাভারেজের সময় আমাকে সাথে নিতে হবে। ” আমি ওর বোকা বোকা হাসি দেখে আগের দিনের রাগ ভুলে গেলাম- “ঠিক আছে, চলো।

” গত বুধবার একটি জাতীয় দৈনিকে শমীর প্রথম রিপোর্ট প্রকাশ পেল। ছবি সহ ছোট্ট রিপোর্টটি শমীর গাল ভরা হাসি এনে দিল। পেছনে স্পোর্টস ব্যাগ ঝুলিয়ে হাতে করে তার রিপোর্টটি রাস্তায় যাকে পায় তাকেই দেখায়। আমি সেদিন আমার ফেইসবুক এ্যাকাউন্ট থেকে রিপোর্টটি প্রকাশ করায় সে কয়েকবার আমাকে ফোন করে ধন্যবাদ দিল। বৃহ্স্পতিবার।

কৃষি অনুষদ প্রথম ব্যাচ তাদের শিক্ষা সমাপনী উৎসব পালন করবে। সকাল থেকেই সাজ সাজ রব। আমিও প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী। উৎসব আয়োজন করতে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। শমী সকাল থেকেই স্যারদেরও চেম্বারে চেম্বারে গিয়ে গিয়ে তার প্রথম প্রকাশিত রিপোর্টটি দেখাল।

বেলা সারে বারটায় শমী আসল আমাদের অনুষদ ভবনের সামনে। চোখগুলো ছোট ছোট করে আমার কাছে আবদার করলো-“ভাইয়া আপনাদের র‌্যাগ উৎসবের কাভারেজ আমি করবো। প্লিজ ক্যামমেরাটা আমাকে দেন। ” সাত পাঁচ না ভেবেই ক্যামেরাটা দিয়ে দিলাম। “তোমার প্রথম রিপোর্ট ছাপা উপলক্ষ্যে আমাকে খাওয়াবা না?” শমী একগাল হাসি দিয়ে বলে-“কি খাবেন, মিষ্টি না বিরিয়ানী? আজ বিকালে তাহলে আমরা বাইরে গিয়ে দুজন খেয়ে আসব।

” উপাচার্য মহোদয় আনন্দ শোভাযাত্রায় অংশ নিয়ে র‌্যাগ উৎসবের উদ্বোধন ঘোষনা দিলেন। ব্যান্ড পার্টির বাজনার তালে তালে শুরু হলো রং খেলা। আবিরের রঙে একে অপরকে রাঙ্গিয়ে আমরা ক্যাম্পাস প্রদক্ষিন করছিলাম। শমী আমাদের সব আনন্দ ক্যামেরায় ধারন করছিল। এ ডাকে, ও ডাকে- শমী এদিকে আসো, শমী আমার ছবি তোল।

ক্লিক ক্লিক করে শমী আমাদের ছবি তোলে। দুপুর তিনটার দিকে স্টাফ কোয়ার্টার সংলগ্ন পুকুরে আমরা সবাই গোসল করতে যাই। শমীকে পেয়ে আমাদের ব্যাচের মেয়েরা পাথরের স্তুপের উপর উঠে গেল-আমাদের একটা ছবি তুলে দাওনা শমী!! আমি শমীকে দূর থেকে ডেকে বললাম-আমার ক্যামেরাটা রুমে পৌছে দিও কিন্তু। আমি ভাল সাতার পারি না। আমার মতো যারা সাতার জানে না তারা পুকুর পারে সিড়িতে বসে থাকল।

কয়েকজন জুনিয়রের সহযোগীতায় একটু একটু সাতার দিলাম। তারপর কয়েকটা ডুব দিয়ে কোন মতে উঠে আসলাম। হলে আসার পর একজন এসে ক্যামেরাটা দিয়ে গেল-ঐ মোটা ভাইটা আপনাকে দিতে বলল। ক্লান্ত শরীরে হলে এসে আবার গোসল করলাম। কাপড় ছেড়ে কম্পিউটারটা ছাড়লাম আজকের তোলা ছবি দেখব বলে।

একটা ফোন-“পুকুরে ডুবে আছে শমী। মাত্র তোলা হল। জ্ঞান নেই। ” মনে হল কে জানি মাথায় আঘাত করল। দৌড়ে পুকুর পারে গেলাম।

গিয়ে দেখি শমী নাই, হাসপাতালে নিয়ে গেছে। একলা একলা নাকি প্যান্ট শার্ট পরেই পুকুরে নেমেছিল। এতো বড় শরীরটার প্রাণ কি করে অভিশপ্ত পুকুরটা গ্রাস করে নিতে চাইল-বুঝলাম না। নিথর দেহটাতে প্রাণ আসুক মনে প্রানে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করলাম। সে প্রার্থনা কবুল হয়নি।

সন্ধ্যায় আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি আসল। শমীর মৃত্যুর খবর শুনে সবাই ভিড় জমাচ্ছে। আমার শুধু মনে পরছে, আজ সন্ধ্যায় আমাদের বিরিয়ানি খেতে যাওয়ার কথা ছিল। শমীর প্রথম রিপোর্ট প্রকাশের উদযাপন করার কথা ছিল। অর্ধেক রাত শমী হাসপাতালের মর্গের হিমঘরে শুয়ে ছিল।

চিৎকার করে বলতে মন চাইছিল-উঠো শমী উঠো !!  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।