আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একত্রিশ বছরের বিধবা এক নারীর জীবনের গল্প--

জানার আগ্রহ মানুষের চিরন্তন, বই হলো তার বাহন, আইনের মৃত্যু আছে কিন্তু বইয়ের মৃত্যু নেই। শূন্যতা কি পুরানো সম্পর্ককে কাছে টেনে আনে। স্মৃতি টেনে রাখে মনকে। লাঞ্চ আওয়ারে টিফিন বক্সটি যেন আবারো মনে করিয়ে দেয় নিজের মূল্যহীন জীবনকে। যে যার মত খাওয়ায় ব্যস্ত।

তারই সুবাস ভেসে আসে বাতাসে। নিজের বক্সটি খুলতে অনেকটা লজ্জা বোধই হয়। প্রায় নষ্ট হয়ে যাওয়া বাসি তরকারি আর ফ্রিজে রাখা ঠাণ্ডা ভাত। পেটের তাগিদে দু’এক গ্রাস মুখে দিলেও অনেকটাই ফেলে দিতে হয়। আজও তার ব্যতিক্রম নয়।

খিদে পেটে উঠে দাঁড়ায় শেলী আহমদ। আজ আর মুখে রুচবেনা। ফেলে দেওয়ারও প্রয়োজন বোধ করে না। ও কি আপা না খেয়ে উঠে পড়লেন। বসেন তো।

খিদে পেটে থাকতে নেই। আমাইরা প্রায় দিন লাঞ্চ শেয়ার করে। আজও বক্সটি এগিয়ে দিতেই বাঁধ সাঁধে শেলী আহমদ। আমার খিদে নেই আমাইরা। তুমি খেয়ে নাও।

জীবন কি? জীবন কেন? জীবন মানে কি সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। নাকি জীবন মানে নিজেকে নিঃশেষ করে আগামীর জন্য অপেক্ষা করা। অফিস কক্ষে নিজের বরাদ্দ চেয়ারে বসে এমনি হাজারো প্রশ্নে নিজের ভিতর যেন রক্তক্ষরণ হতে থাকে। বিধবার শরীরে উঠা সাদা কাপড় কি মনে করিয়ে দেয়। তুমি আজ অর্ধেকটাই দাফন হয়ে গিয়েছো।

সাহস, মনোবল। এই সবের ওপর কি তখনই আস্তরণ পরে। ভরা মজলিশেও নিজেকে অসহায় লাগে। একসাথে বসবাসরত উনিশ বছর কি কিছুই নয়। স্মৃতিতে সাঁতার কেটেই তো এতগুলো বছর পার করা।

ভালোবাসার মানুষটাই তো তাকে সাহসী করে তুলেছিল। তারই প্রেরণায় শখের বশে চাকরিটা যেন আরো মূল্যবান হয়ে উঠে প্রয়োজনের তাগিদে। আজ কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি শেলী আহমদ। ছেলেকে শিক্ষিত করে আজ স্বস্থানে নিজেই প্রতিষ্ঠিত। নিজেই পছন্দ করে বৌ করে আনে সুতপাকে।

আহ্‌ সুখ যেন উড়ে এসে জুড়ে বসে। কতবার অবসর নেওয়ার কথা মনে এলেও ভাববার সময় নেয়। সুতপার পরিবর্তন নিজেকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। বাধা বুয়া শেফালী। প্রতিদিনের টিফিন ছিল গরম ভাত আর রান্না করা তরকারি।

নিয়মে অনেক দিন ধরে এটাই ছিল। আজ বাসি তরকারি ঠাণ্ডা ভাত কেন রে। সকালে দু’মুঠো ভাত রান্না করতেও তোর সময় হয় না। দুপুর পর্যন্ত এইসব খাবার কি খাওয়ার যোগ্য থাকে। কেন মা।

ফ্রিজে রাখা ভাত তরকারি তো নষ্ট হবার কথা নয়। আর প্রতিদিন রান্না করাও তো কম ঝামেলা নয়। শুধু শুধু বাসিগুলো থেকে যায়। একমাত্র ছেলের বৌ সুতপার জবাব আসে এই ভাবেই। তার ছেলের বৌ যার হাতে মাস শেষে সব টাকা তুলে দেয়।

প্রতিবাদ করার ভাষা হারায় শেলী আহমদ। অপমানটুকু গায়ে মেখেই প্রতিদিন অফিস করা। এত বছর ধরে নিজের বাসস্থানের জায়গাটাকি ঘুনে ধরে এলো। শেষ বয়সে কি বৃদ্ধ আশ্রমেই তার ঠাঁই নিতে হবে। কই মনে তো পড়ে না।

অসুস্থ অবস্থায় মাথায় হাত রেখে বলেছে, মা আপনার কিছু লাগবে? মাথায় কি একটু পানি ঢেলে দিব, আরাম পাবেন। আজ গরম ভাতে শিং মাছের ঝোল খাবেন। এই সবই থাকে কল্পনায়। কখনো শাড়ি এনে বলেছে, আপনার শাড়ি সব পুরানো। এই শাড়িটা পড়ে কাল অফিসে যাবেন।

নিজেকে নিজেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। এত বছর ধরে কার জন্য এত সব। ছেলে। সে তো আরো দূরের। কই নিজের ভরণ পোষণের দায়িত্ব তো কারো উপর চাপায় নি সে।

নিজেকে এত অক্ষম ভাবার দরকার কি। বিধবা বলেই কি? শেষ বয়সে একটু শান্তির আশায় এত সব সয়ে যাওয়া। সংসারের এই নড়বড়ে খুঁটিটায় জোর দেওয়া দরকার বোধ হয় এখনই। সুতপার বিয়ের পর এই প্রথম। নিজের পরিশ্রমের অর্থ বেশ খানিকটা ব্যয় করে শেলি আহমদ।

শপিং মল ঘুরে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসের সঙ্গে যোগ হয় বারতি দু’একটি শাড়ি। আরো টুকটাক কিছু। ভাল বিস্কিট তার সাথে চানাচুরও বাদ যায় না। এই সাহসী মনটি এতদিন কোথায় ছিল। এই প্রতিবাদের মাঝেই কি কোথাও লুকিয়ে আছে সুতপার প্রশ্নের জবাব।

ডোর বেল বাজতেই দরজা খোলে শেফালি। খালা আম্মা আপনার এত দেরি। কোন কথা ছাড়াই নিজের ঘরে আসে। ভারি প্যাকেট ছুঁড়ে ফেলে বিছানায়। রাজ্যের ক্লান্তি শরীর জুড়ে।

এই সময় এক কাপ চা মন্দ নয়। শেফালী। ডাকটা একটু জোরেই হয়ে যায়। আমার জন্য এক কাপ গরম চা নিয়ে আয়। আর শোন টিফিন বক্সটি নিয়ে যা।

কাল থেকে আর টিফিন দিতে হবে না। মা কি ফিরলেন। এত দেরি তো আপনার হয় না। হ্যাঁ আজ একটু দেরি হলো। নিজের কিছু দরকারি জিনিস কেনার ছিল।

আপনি এত সব করতে গেলেন কেন। আমাকে বললেই তো আমি এনে দিতাম। সুতপা। এই দুই বছরে আমার প্রয়োজন কি তুমি বুঝেছ কখনো। মা কি কোন কারণে রেগে আছেন।

আপনি তো এভাবে কথা বলেন না কখনো। বলিনি। আজ বলছি। তোমাদের ব্যবহারই আমাকে বাধ্য করেছে। শোন বৌমা।

তোমাকে আজ আমি বলতে দ্বিধা করছি না। আমার কোন বিষয়েই তোমার চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। আমারটা আমিই বুঝে নেব। অনেকগুলো টাকাই তো খরচ করে এলেন। বাকি দিনের কথা কি একবারও মনে হয়েছে? একত্রিশ বছর বিধবা জীবনে ছেলেকে প্রতিষ্ঠিত করার পিছনে কি কারো কোন সাহায্য ছিল।

না ছিল না। আজ তোমাকে বলতে বাধ্য হচ্ছি, একমাত্র ছেলের বৌ হিসেবে তোমাকে আমি আমার মেয়ের মতই মনে স্থান দিয়েছিলাম। বিনিময় সে তুমিও জান। মানুষ আশা নিয়ে স্বপ্ন বুনে। যে ছাদের নিচে তুমি রাত যাপন করছ, এটা তো এমনি হয় নি।

আমার ত্যাগ আর পরিশ্রম মিশে আছে প্রতিটি কোণায় কোণায়। সন্তানের কাছে একজন মায়ের খুব বেশি চাওয়া থাকে না। চায় একটু সম্মান। আর মূল্যবোধ। তোমরা কি তার খানিকটাও আমাকে দিয়েছো।

একজন মানুষ হয়ে আমারও ক্লান্তি আসে। একটু সহানুভূতি পেতে ইচ্ছে করে। তোমাদের দেওয়ার মাঝে আমার যে আদর আর অনুভূতি মিশে আছে তার কতখানি মূল্যায়ন তোমরা করেছো। অনেকগুলো বছর পার করা মানুষটারও একটা মন থাকে। সেই মনে দুঃখকষ্টগুলোও একসাথে বসবাস করে।

সম্মানে সেই সুখের দেয়ালটা মজবুত হয়। এক সাথে এতগুলো কথা বলে হাঁপিয়ে উঠে শেলী আহমদ। সুতপা এতদিন যাকে চিনেছে সে অন্য জন। এই শেলী আহমদ তার কাছে অজানা। অচেনা।

নির্বাক সুতপা দাঁড়িয়ে থাকে মূর্তি হয়ে। নিজের অবস্থানের কথাও যেন ভুলে যায়। শোন বৌমা। আমাকে যদি তোমাদের অপছন্দ হয়। তোমরা আলাদা হয়ে থাকতে পার।

আমার আপত্তি থাকবে না। অবহেলায় একসাথে থাকাটাও আমার জন্য অপমানজনক। তুমি রিয়াদের সাথে কথা বলে বুঝে নিও। খালাআম্মা আপনার চা। কাপ হাতে দাঁড়িয়ে শেফালী।

শেফালী তুই যা। শেফালীর হাত থেকে চা নিয়ে নিজেই শাশুড়ির হাতে ধরিয়ে দেয়। প্যাকেট খুলে বিস্কিট দেয়। মা চা খেয়ে গোসল সেরে আসুন তো। আজ এক সাথে খাবো।

ভুনা খিচুড়ির সাথে আচার মাংস, সালাদ। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায় শেলী আহমদ। এ কথা তুমি বলছ। হ্যাঁ, আমি বলছি। ডাক্তারের রিপোর্টে আপনি যে দাদি হতে যাচ্ছেন।

এবার আপনার অফিস আদালত বাদ দিন তো। অনেক হয়েছে। সব পাওয়া কি ভাগ্যে এমনি ভাবেই লেখা হয়ে থাকে। ঠিক এই মুহূর্তে সুতপাকেও তো পর মনে হচ্ছে না। সম্পর্ক কি এভাবেই ভেঙ্গে ভেঙ্গে জোড়া লাগে।

লিখেছেনঃ নুর আঙ্গেজ বেগম নূরী দৈনিক আজাদী পত্রিকা ) চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১০ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।