আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঐতিহ্যবাহী ছাত্রাবাস পোড়াল কারা?

সিলেট এমসি কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী গোলাম কিবরিয়া গতকাল মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সন্ত্রস্ত হয়ে ছাত্রাবাসে ছুটে আসেন। প্রায় ২০ বছর আগে ছাত্রাবাসের বাসিন্দা ছিলেন তিনি। আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া কক্ষগুলো ঘুরে ঘুরে দেখে একটি কক্ষে স্থির হন। কাঁদছিলেন অস্ফুট স্বরে। কান্নার মধ্যেই কিবরিয়া বলেন, ‘তারা (ছাত্রলীগ-ছাত্রশিবির) মারামারি-কাটাকাটি করবে করুক।

ছাত্রাবাস পোড়াবে কেন? এই ছাত্রাবাস তো শুধু স্থাপনা নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রাচীন একটি ঐতিহ্য। শিক্ষা-দীক্ষার ঐতিহ্য কি এতই স্থূল?’ শুধু কিবরিয়াই নন, সিলেটের প্রাচীনতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমসি কলেজের ঐতিহ্যবাহী ছাত্রাবাসের ৪২টি কক্ষ পোড়ানোর ঘটনায় ক্ষুব্ধ সাবেক শিক্ষার্থীসহ সাধারণ লোকজন। গত সোমবার থেকে কলেজ ও ছাত্রাবাস অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করার পরও গতকাল ভস্মীভূত ছাত্রাবাস দেখতে ভিড় করেন সাবেক শিক্ষার্থীসহ অসংখ্য মানুষ। রোববার রাতের এ ঘটনার দুই দিন পরও অগ্নিসংযোগকারীদের চিহ্নিত করতে পারেনি কলেজ কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ।

পোড়া ছাত্রাবাস দেখে দর্শনার্থী সবার একই প্রশ্ন—এভাবে ছাত্রাবাস পোড়াল কারা। তারা কি চিহ্নিত হবে? কোনো ব্যবস্থা কি নেওয়া হবে। এ ব্যাপারে শাহপরান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এনামুল মনোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, ‘কারা অগ্নিসংযোগ করেছে—সেটি এমসি কলেজ কর্তৃপক্ষের তদন্ত কমিটি বের করবে। তাদের তদন্ত প্রতিবেদন পেলে পুলিশ ব্যবস্থা নেবে। ’ জানা গেছে, ছাত্রাবাস পোড়ানোর ঘটনা তদন্তে কলেজের উপাধ্যক্ষকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি করার পর গতকাল সিলেট জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মো. শহীদুল আলমের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি সকাল ১০টা থেকে বেলা পৌনে তিনটা পর্যন্ত ছাত্রাবাস এলাকায় অবস্থান করে ছাত্রাবাসের তত্ত্বাবধায়কসহ প্রত্যক্ষদর্শী ২০ জনের সাক্ষ্য নেয়। কলেজ সূত্রে জানা যায়, শিক্ষানুরাগী রাজা গিরিশ চন্দ্র রায়ের পিতামহ মুরারীচাঁদের নামে ১৮৯২ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় সিলেট এমসি কলেজ। ১৯২১ সালে কলেজের পাশে প্রায় ২০ কেদার জায়গাজুড়ে নির্মিত হয় ছাত্রাবাস। ব্রিটিশ আমলের স্থাপত্যশৈলীর ‘সেমিপাকা আসাম টাইপ’ ছাত্রাবাস ভবনগুলো ছিল দর্শনীয়। এ ব্যাপারে কলেজের অধ্যক্ষ ধীরেশ চন্দ্র সরকার প্রথম আলোকে বলেন, দর্শনীয় ছিল বলে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৩৩৬ বাংলা বর্ষের ২১ কার্তিক সিলেট সফরে এসে এই ছাত্রাবাসে দীর্ঘ সময় কাটান।

এ জন্য ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছিল ছাত্রাবাস। ছাত্রাবাসের সি-ব্লকের তত্ত্বাবধায়ক জামাল উদ্দিন বলেন, ছাত্রাবাসের ছয়টি ব্লকে আসনসংখ্যা ২৬২। মেধার ভিত্তিতে এ আসন বরাদ্দ দেওয়া হয়। ঐতিহ্য অনুযায়ী এ ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেওয়া হয় না বলে আসন পাওয়া নিয়ে এক ধরনের মেধার লড়াই ছিল। এমসি কলেজের ছাত্রসংগঠন সূত্রগুলো জানায়, মেধার ভিত্তিতে ছাত্রাবাসের বাসিন্দা হওয়ার পর ছাত্রদের দলভুক্ত করতে তৎপরতা চালায় ছাত্রসংগঠনগুলো।

এ ক্ষেত্রে প্রতিবছর এগিয়ে থাকে ইসলামী ছাত্রশিবির। রোববার রাতে ভস্মীভূত হওয়া ৪২টি কক্ষের মধ্যে ২৭টি কক্ষে ছাত্রশিবিরের এমসি কলেজ সভাপতি এস এম মনোয়ারসহ শিবিরের ‘সাথি’ (দলীয় পদ) ৪০ জন শিক্ষার্থী থাকতেন। ঘটনা সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শীসহ পুলিশ সূত্র জানায়, রোববার বিকেলে ছাত্রাবাসের সামনে খেলার মাঠে ছাত্রশিবিরের কর্মীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের হাতাহাতি ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এর জের ধরে ছাত্রলীগের কর্মী মোহাম্মদ উজ্জ্বলকে মারধর করে ছাত্রশিবির। এর প্রতিবাদে ছাত্রলীগের দুটি পক্ষ ছাত্রাবাসে ঢোকে।

এক পক্ষ বিক্ষোভ করতে থাকে। অপর পক্ষ ছাত্রাবাসের তিনটি ব্লকে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুন নেভানোর কাজ করা একাধিক দমকলকর্মীর ভাষ্যমতে, সারিবদ্ধ কক্ষগুলোতে পেট্রল ঢেলে আগুন লাগানো হয়। এ জন্য মুহূর্তেই আগুন নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে। নেভাতে গিয়ে প্রায় চার ঘণ্টা সময় লেগে যাওয়ায় কক্ষগুলো ভস্মীভূত হয়।

আগুন কারা লাগাল, এমন প্রশ্নে ছাত্রাবাসে অবস্থান করা শাহপরান থানার এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ‘রোববার রাতে আমরা যখন ছাত্রাবাসে যাই, তখন আগুন পাইছি আর ছাত্রলীগ পাইছি। শিবিরের কাউকে পাইনি। এখন আপনারাই বুঝে নেন—কারা আগুন লাগাল। ’ প্রশাসনের তদন্ত কমিটির কাছে সাক্ষ্যদানকারী সূত্র ও প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা গেছে, ছাত্রলীগের কর্মী উজ্জ্বলকে শিবির মারধর করছে—এ খবরে সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি পংকজ পুরকায়স্থ, সহসভাপতি সেলিম চৌধুরী ও সারওয়ার আহমদ, মহানগর ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক এস আর রুমেল, এমসি কলেজের পাশের সিলেট সরকারি কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি দেবাংশু দাস ওরফে মিঠুর নেতৃত্বে ছাত্রলীগের শতাধিক কর্মী লাঠিসোঁটা নিয়ে ছাত্রাবাসে প্রবেশ করেন। ছাত্রাবাসের বাসিন্দা একাধিক ছাত্র জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সিলেট সরকারি কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতির নাম উল্লেখ করে বলেন, ‘ধর ধর শিবির ধর...স্লোগান দিয়ে তাঁরা ছাত্রাবাস এলাকায় প্রবেশ করেন।

এঁদের মধ্যে সাত থেকে আটজনকে ব্যাগসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম বহন করতে দেখা গেছে। তাঁরা ছাত্রাবাসের পেছন দিকে যাওয়ার পর পরই আগুন আগুন বলে আর্তনাদ শুরু হয়। ’ এ ব্যাপারে ছাত্রলীগের নেতা পংকজ পুরকায়স্থ ও দেবাংশু দাস দাবি করেন, ‘আগুন শিবিরের নেতা-কর্মীরাই লাগিয়েছে। ’ নিজেদের কক্ষে নিজেরা আগুন লাগাবে কেন, এমন প্রশ্নে দেবাংশু দাস বলেন, ‘আমাদের এক ছেলেকে শিবির কুপিয়েছিল। এর প্রতিবাদ জানাতে আমরা ছাত্রাবাসে গিয়েছিলাম।

কিন্তু আগুন দেখে আমরা ফিরে এসেছি। এটা শিবির করে আমাদের ওপর দায় চাপাচ্ছে। ’ সূত্র জানায়, ছাত্রলীগের কর্মীকে মারধরের পর পরই ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরা ছাত্রাবাস থেকে চলে যান। ওই সময় ছাত্রাবাসে ছিলেন সাধারণ কয়েকজন ছাত্র ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। এঁদের মধ্যে ছাত্রলীগের কেউ আগুন লাগাতে পারেন বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা তদন্ত কমিটিকে জানিয়েছে।

এ ব্যাপারে তদন্ত চলার সময় কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. শহীদুল আলম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ২০ জনের সঙ্গে কথা বলেছি। আরও তথ্য-উপাত্ত এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য সংগ্রহ করে আগামী ১০ দিনের মধ্যে তদন্ত সম্পন্ন করব। ’ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.