আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাঁকখালীর বাঁকে বাঁকে ত্রাণ অথবা পরিত্রাণের গল্প

যারা উত্তম কে উচ্চকন্ঠে উত্তম বলতে পারে না তারা প্রয়োজনীয় মুহূর্তে শুকরকেও শুকর বলতে পারে না। এবং প্রায়শই আর একটি শুকরে রুপান্তরিত হয়। রাত এগারোটা ছুঁই ছুঁই, আরামবাগের শেষ স্টপেজ থেকেও বাসটা আরো কিছুদূর এগিয়ে গেল। কিন্তু তখনো টিমের শেষ সদস্য এসে পৌছায়নি, টিমের বাকী সদস্যরা তার জন্য অপেক্ষা করছি। আর পাঁচ মিনিট আর পাঁচ মিনিট এমনটা শুনছি গত পঁচিশ মিনিট ধরে, বেশ খানিকটা দূর থেকেই তিনি আসছেন ফলে দেরী হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।

অবশেষে তিনি যখন এসে পৌছলেন, ততক্ষণে আমাদের একটা শর্ট বিড়ি ব্রেক হয়ে গেছে। আমরা পরস্পরকে চিনতেও শুরু করেছি। টিমে একজন ডাক্তার, একজন ফটোগ্রাফার, একজন মডু, একজন পুরান ব্লগার, তিনজন তুলনামূলক নতুন ব্লগার আর দুই পয়সার আমি । আটজনের টিমের তিনজনের সাথে আমি সম্পৃক্ত অনেক আগে থেকেই, বিশেষত তিতাস বাঁচানোসহ নানা উদ্যোগের সময়ে। বাকীরা নতুন, অন্তত আমার কাছে।

ব্লগেোস্ফিয়ারে চট্টগ্রামের সাম্প্রতিক পাহাড় ধস আর বন্যা নিয়ে ব্লগারদের নানান উদ্যোগ শুরু হয়ে গিয়েছিল একদম শুরু থেকেই, চট্টগ্রামের জন্য আমরাঃ পাহাড়ে পাহাড়ে মৃত্যু, দূর্গত মানুষের জন্য এগিয়ে আসার আহবান! । তৈরি হয়েছে নানাবিধ সোশ্যাল নেটওয়ার্ক ভিত্তিক কর্মকান্ডও যেমন ফেইসবুক গ্রুপ চট্টগ্রামের জন্য আমরা । এই উদ্যোগ কেবল একটি অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ থাকেনি । ব্লগাররা ছড়িয়ে গেছেন নানান দিকে। , আশার কথা হল গর্বের কথা হল ব্লগার রা ছুটে গেছেন দেশের নানান প্রান্তে, মানবতার জন্য আমরাঃ চট্টগ্রামের পর এবার কুড়িগ্রাম ।

আমি নিজেও একটা গোপন অপরাধবোধে ভুগছিলাম পুরোটা সময়। মানুষগুলোর জন্য কিছুই করতে পারলাম না আটকে থাকলাম নানান ব্যক্তিগত ব্যস্ততায়। আবার খুশিও হচ্ছিলাম ব্লগারদের নানান উদ্যোগ ব্লগে দেখতে পেয়ে; ত্রাণের খবর পেয়ে। তারা একভাবে আমাকে ভারমুক্ত করছিলেন বলে। মধ্যবিত্তের শহরে থাকা মানবতাবোধ হাহ! নিজেকে নিয়ে খুব সম্মানিত বোধ করছিলাম না।

আবার পরিবর্তনের যে খুব চেষ্টা করছিলাম তাও না। এমন সময় কৌশিক আমন্ত্রণ জানালো ব্লগ বিডিনিউজ ২৪ এর ব্লগারদের উদ্যোগে সংগৃহীত তহবীলের ত্রাণ কর্মসূচীতে অংশ নিতে। স্থান কক্সবাজার। বৃহস্পতিবার রাতে রওনা দিয়ে সোজা কক্সবাজার আবার শুক্রবার রাতে রওনা দিয়ে শনিবার সকালে ঢাকায় ফিরে আসা। উদ্দেশ্য অন্তত ১০০ পরিবারের দূর্গত মানুষকে পরিবার প্রতি ১০০০ করে টাকা আর প্রয়োজনীয় ঔষুধ ও হালকা খাবার দেয়া।

এই টাকা দিয়েছেন ব্লগাররাই। তারা এই উদ্যোগটা বেশ চমৎকার ভাবেই শুরু করেছেন। বিডি নিউজ ২৪ ব্লগের ব্লগারদের উদ্যোগের বিস্তারিত দেখে নিন এখান থেকে। লিংক ১ লিংক ২ লিংক ৩ প্রতিটা টিমেই যা হয় নানান রকমের মানুষ থাকে। অন লাইনে এবং অফ লাইনে তাদের আচরণও ভিন্ন থাকে।

ব্লগারদের প্রথম সাক্ষাৎ তাই সবসময়ই নানান ঘটনাপূর্ণ। সেই অভিজ্ঞতা সঙ্গে নিয়েই বৃষ্টিভেজা মুহূর্তে কক্সবাজার পৌছলাম। তবে বেশ দেরীতে। বৃষ্টি ভেজা কক্সবাজারের পথ ইতোমধ্যে ব্লগারদের মধ্যকার যোগাযোগ বেশ চমৎকার গড়ে উঠেছিল। হোটেলে পৌছে নাস্তা খেয়ে মালপত্র গোছানো শুরু হল ।

শুরু হল ওয়ার্ক প্ল্যান এবং ওয়ার্ক ডিস্ট্রিবিউশন। তরুণ ব্লগার দুজন তো মহা উত্তেজিত। ব্লগাররা মালপত্র গোছানোতে ব্যাস্ত ব্লগারদের অনেকেরই মাঠে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে অনেকে আবার একেবারেই নবীন। বারবার ক্রস চেক করে একটা গাড়ী আর একটা সিএনজি নিয়ে আমরা চলে গেলাম ঝিলংজা ইউনিয়ন পরিষদের কার্যালয়ে। স্থানীয় প্রশাসনের সাথে আগেই কথা বলে রাখার ফলশ্রুতিতে সবকিছু বেশ গোছানোই ছিল।

আমরা যখন সেখানে পৌছলাম তখন ত্রাণের জন্য অনেক মানুষ সেখানে আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলেন। সেই চিরাচরিত দৃশ্য, অপেক্ষমান দূর্গত মানুষের দল তারা দাঁড়িয়ে আছেন এই বৃদ্ধা জানেন না অপেক্ষার পালা কখন শেষ হবে এই বৃদ্ধের চোখে কেবলই শুণ্য দৃষ্টি এই অপেক্ষমান ক্লান্ত বৃদ্ধা জানেন না কখনো শুরু হবে ত্রাণ আমরা পৌছেছি বিপর্যয়ের দ্বিতীয় পর্যায়ে অর্থাৎ প্রাথমিক ভয়াবহতার পরবর্তী পুনর্বাসন পর্যায়ে। এই ধরণের গোছানো পদ্ধতির কিছু সুবিধা আর অসুবিধা দুটোই চোখে পড়ল। বেশ সাজানো গোছানো সাঁরিবদ্ধ মানুষের দল। যদিও ত্রাণকার্য শুরু করার পর বোঝা গেল যে অন্তত ৬ জন পুন:বার ত্রাণ নিয়েছেন।

স্থানীয় চেয়ারম্যান সাহেব দূর্গতের জানিয়েছেন যে তিনি নিজেই ত্রাণ দিচ্ছেন। এর মধ্য দিয়ে ব্লগারদের ত্রাণ দেবার বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। স্থানীয় শক্তি ও ব্যবস্থাপনাকে ব্যবহার করার কিছু কৌশলগত স্থানিক সমঝোতা করে নিতে হয়। এটা মাঠে যারা কাজ করেন তারা সবাই জানেন। দূর্গত মানুষের সংখ্যা যখন ষাটের কাছাকাছি পৌছালো তখন ত্রাণ দেয়া শুরু হল।

ব্লগাররা স্থানীয় মানুষজনের সহায়তায় সুশৃঙ্খলভাবে ত্রাণ দেয়া শুরু করলেন। শুরু হল ত্রাণ কার্যক্রম তুলে দেয়া হচ্ছে ত্রাণের টাকা ঔষূধ আর শুকনো খাবার ব্লগার মোর্শেদ বুঝিয়ে দিচ্ছেন ঔষধ ব্যবহারের পদ্ধতি এরই মধ্যে আমি স্থানীয় মানুষজনের কাছে জানতে চাইছি প্রকৃত অবস্থা কি? মূলত পাহাড়ী ঢলের কারণেই এই বন্যা। অন্তত ৪০০০ গৃহস্থালী ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে এবং ১০০০ গৃহস্থালী হয়েছেন সরাসরি শিকার। কথা বলছি চেয়ারম্যান সাহেবের সাথে। তিনি জানালেন পলি জমে নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ার ফলেই এই বন্যা।

ড্রেজিং এর ব্যবস্থা করা গেলেই বিনা পয়সায় এই সমস্যা মোকাবিলা করা সম্ভব। স্থানীয় মানুষজনের সাথে কথা বলে জানা গেল তাদের অনেকেই বিশুদ্ধ পানির জন্য নলকুপকে পলিথিন দিয়ে মুড়ে দিয়েছিলেন তাই পানি বাহিত রোগের প্রকোপ কম হয়েছে। তবে শিশু ও বৃদ্ধদের জ্বরাজরি বেশ হয়েছে। অনেকে এখনো আশ্রয় নিয়ে আছেন সাইক্লোন শেল্টারে। গবাদী পশু হারিয়ে গেছে চুরিও হয়েছে অনেকের।

দূর্গতদের সাথে কথা বলছেন ব্লগার সাইদ এক পর্যায়ে স্থানীয় প্রশাসিনক কর্মকর্তা ত্রাণের কর্মকান্ডে যোগ দেন। যদিও এর মধ্যে ত্রাণে, তালিকা তৈরিতে, ছবি তুলতে, খবর নিতে, ভিডিও করতে ব্যস্ত ছিলেন ব্লগার ইমন, সবাক, সুলতান মির্জা, কৌশিক, হাসান বিপুল। আবার সবাই নানানভাবে পুরো পরিস্থিতিটা যাচাইও করছিলেন। এমনি এক পর্যায়ে হাসান বিপুল প্রস্তাব করলেন আশেপাশের জায়গা নিজেরা ঘুরে দেখার, মোর্শেদ আমি আরো কয়েকজন ব্লগার যেয়ে দেখে আসলাম করুণ পরিস্থিতি। ত্রাণ কেন্দ্র একটি রাজনৈতিক পরিস্থিতিও বটে।

উত্তরবঙ্গ থেকে মাইগ্রেট করে আসা কয়েক ঘর মানুষ খুব কাছে থেকেও ত্রাণের দেখা পাননি। আমরা অনুমান করি স্থানীয় ভোটের রাজনীতিতে তারা বাদ পড়ে গেছেন। যদিও ত্রাণের দাবীর ন্যায্যতা কারোরই কম নয় ক্রমাগতভাবে বন্যার ক্ষতি আমাদের চোখে স্পস্ট হতে লাগলো। উপস্থিত দূর্গতের সাহায্য করে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম একদম সরাসরি নদী ভাঙ্গনের কাছাকাছি চলে যাবার। এই সেই বাঁকখালীর ভাঙ্গন এখনো জল জমে আছে ঘরের ভেতর এভাবে ঠেকানোর চেষ্টা করা হয়েছে বন্যাকে যদিও প্রকৃতি রেখে গেছে তার ভাঙ্গনের দাগ, মানুষ হয়েছে বাস্তুহারা ব্লগার মির্জা দেখাচ্ছেন কতদূর পর্যন্ত পানি উঠেছিল ব্লগাররা ও স্থানীয় প্রশাসন আলাপ করছেন সম্ভাব্য প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনা নিয়ে বাঁকখালির বাঁকে দাঁড়িয়ে এই পুরোটা সময় জুড়ে ত্রাণ বঞ্চিত মানুষজন আমাদের পিছু ছাড়েনি।

তারা রয়ে গেছেন ছায়ার মত। কেউ বোধ করছেন বঞ্চনা কেউ বা মিনতি। কিন্তু তখনো আমরা কল্পনা করতে পারিনি ত্রাণের পরবর্তীতে পরিত্রাণের গল্পটি। স্থানীয় প্রশাসন, ব্লগারদের উদ্যোগ এবং স্থানীয় ত্রাণ রাজনীতি। কতজন মানুষকেই বা সাহায্য করা সম্ভব কিভাবেই বা সম্ভব।

প্রকৃতির বঞ্চনা মানুষের বঞ্চনা ভূক্তভুগী মানুষগুলোকে খেপিয়ে দিয়েছিল। পরিস্থিত আঁচ করে একটি গাড়ীতে করে চারজনের প্রথম দলটিকে আমরা পাঠিয়ে দেই। আর আমরা ক্রমাগত সরে আসতে থাকি মূল কেন্ত্র থেকে। দূর্গতর হাতের সংখ্যা বাড়তেই থাকে। এক পর্যায়ে তারা সিএনজির চাকার নিচে পা দিয়ে ত্রাণ দেয়া মানুষগুলোকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে।

অমানবিক এবং দূর্ধর্ষ এক টানা হেচড়ার পর আরো তিন পরিবারের জন্য তিন হাজার টাকা দিয়ে আমরা ছুটে বেরিয়ে আসি। কেননা ততক্ষণে আমাদের নিরাপত্তা ক্রমশই কমতে শুরু করেছিল। টানাহেচড়া ও ব্লগারদের কাছ থেকে টাকা ছিনিয়ে নেয়ার এক পর্যায়ে পরিত্রাণের সময় দুর্গত মানুষগুলো বঞ্চনার এমন এক সীমায় পৌছে গিয়েছিল যে এক পর্যায়ে তাদের একটা অংশ ডেসপারেট হতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেনি। আর এইভাবেই শেষ হয়েছিল সেদিনের ত্রাণ ও পরিত্রাণের গল্প। দুর্যোগ আক্রান্ত বিপুল লোকসংখ্যা, পরিস্থিতির গুরুত্ব, স্থানীয় রাজনীতি, ত্রাণের রাজনীতি এই সবকিছুর মধ্য দিয়েই ব্লগাররা নানান প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে তাদের কর্মকান্ড চালিয়ে গেছেন এবং ভবিষ্যতে যাবেনও।

আর তাই আমার বারবারই মনে হয়েছে মাঠে যেয়ে কাজ করার জন্য ব্লগারদেরও অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা প্রয়োজন। প্রয়োজন মাঠের সাথে দৃঢ় যোগাযোগ স্থাপন করা। আর এর মধ্য দিয়েই কিবোর্ডের ভার্চুয়াল দূরত্ব অতিক্রম করে বাস্তবতায় হেঁটে দেশের সেবা করা সম্ভব। সম্ভব সত্যিকার পরিবর্তন সাধন। আমি ব্লগারদের এ্‌ই মহৎ উদ্যোগকে স্বাগত জানাই এবং আরো বেশি মাটি ও মাঠ ঘনিষ্ট হতে অনুরোধ করি।

শেষ করছি একটা মজার ছবি দিয়ে...এটা ভার্চুয়াল আর রিয়েল এর একটা মজার রূপককে প্রকাশ করে। শুভেচ্ছা সবাইকে। আসল নিবাস মাটিতে মাঠে, পরির্বতন এই দেশে মাটিতে মাঠেই শুরু হবে ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.