আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কুহেলিকা

~ ভাষা হোক উন্মুক্ত ~ ১) নবনীর সামনে রাখা লম্বা টি টেবিলের উপর এক গোছা লাল টিউলিপ। সাদা দেয়ালটায় অদ্ভুত সুন্দর একটা ওয়াল পেইন্টিং, একটি আদিবাসী ছেলে ছোট খালের পানিতে ছিপ ফেলে বসে আছে। আশেপাশের গাছপালা, বুনো প্রকৃতির স্বাভাবিক সৌন্দর্য নিখুঁত ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন চিত্রকর। হটাত করে দেখলে ফটোগ্রাফ বলে ভুল হয়। ঘরের কোণে বড় একটা গাছ,লম্বা লম্বা সবুজ সতেজ পাতা।

কাউন্টারের পেছনে দুপাশে দুটি দরজা। একটিতে লেখা ডাঃ মেলিসা উইলিয়ামস, আরেকটি দরজায় মানুষের মস্তিষ্কের জটিল ত্রিমাত্রিক মডেলের ছবি। সবুজ রঙের চার সেট সোফা, যেন এই মাত্র সেলোফেন খুলে ফেলা হয়েছে,এতটাই পরিষ্কার। সামনে রাখা টেবিলগুলো পুরু কাঁচের তৈরি, একটি গোলাকার লোহার স্ট্যান্ডের ওপর বসানো। এক পাশে কিছু ম্যাগাজিন রাখা।

সব মিলিয়ে খুব শান্তি শান্তি একটা পরিবেশ। নবনী খুব আস্বস্তি নিয়ে বসে আসছে সাইকিয়াট্রিস্ট ডাঃ মেলিসা উইলিয়ামসের চেম্বারে। তার এত স্বাভাবিক গতীতে চলা জীবনটা হটাত করেই থমকে গেছে একেবারে। বছরে দু’একবার ভয়ঙ্কর টাইপের দুঃস্বপ্ন দেখা ছাড়া সে কোন কালেই অধিভৌতিক কিছু দেখেনি সে। আর এখন সে জাগ্রত অবস্থায় এমন কিছু দেখতে পায়, যার কোন ব্যাক্ষা তার জানা নেই।

সে কারণেই আজকে তার ডাঃ মেলিসার চেম্বারে আসা। কাউন্টারে বসে থাকা মেয়েটি এক মনে কাজ করে যাচ্ছে। কখনও কি বোর্ড চাপার মৃদু শব্দ, কখনও কাগজে কিছু লেখার খসখস আওয়াজ আসছে। এক সময় মেয়েটি কম্পিউটার মনিটর থেকে চোখ সরিয়ে নবনীর দিকে তাকালো। মানুষের সিক্সথ সেন্স নিয়ে জটিল জটিল আর্টিকেল নবনীর পড়া।

কত অদ্ভুত সব ক্ষমতা থাকে মানুষের। অলৌকিক ক্ষমতা যার মাঝে থাকে,তাকে সাইকিক বলে। অথচ কেউ কারও দিকে তাকিয়ে থাকলে আমরা কেমন করে যেন টের পেয়ে যায় – এই সাধারণ ব্যাপারটাও প্রমাণ করে যে প্রতিটি মানুষের মাঝেই কি অসীম অলৌকিকতা লুকিয়ে আছে,তা আমরা অনুভব করিনা। কাউন্টারে থেকে মেয়েটি মিষ্টি করে হাসলো নবনীর দিকে চেয়ে। বললো – - তোমার কি দেরী হয়ে যাচ্ছে? কাজ আছে তেমন কিছু? স্যরি,তোমাকে দেরী করিয়ে দেবার জন্য।

একজন পেশেন্ট একটু বেশী সময় নিয়ে ফেলছেন। আর একটু অপেক্ষা করো,ডাক্তার এখনই তোমাকে ডাকবেন। তুমি কি চা কফি কিছু খাবে? মৃদু হেসে মাথা ঝাঁকায় নবনী। এক কাপ কফি পেলে মন্দ হতো না,কিন্তু মেয়েটিকে সেটা বলতে ইচ্ছে করছে না। মানুষের মন খুব বিচিত্র একটা জিনিস।

প্রায় সব সময়ই ইচ্ছের পেছনে একটা প্রচ্ছন্ন অনিচ্ছা কাজ করে। প্রবল ইচ্ছের মুখেও মানুষ মুখ ফুটে অনেক সময়েই সেটা বলতে চায় না বা বলতে পারে না। খুব চাওয়া কোন কিছু,অনেক সাধ্য সাধনার পর হাতের কাছে পেলেও অনেক সময় অদ্ভুত এক প্রশান্তি, বিষণ্ণতা বা নির্লিপ্ততা গ্রাস করে। কি হবে এটা নিয়ে,থাক না। বেশ তো চলছিল এটা ছাড়াই।

কাগজের টেক এওয়ে কাপে করে দুই কাপ কফি নিয়ে নবনীর সামনে রাখে কাউন্টারের মেয়েটি,তারপর বসে পরে তার সামনের সোফাটায়। তারপর একটু হেসে একটা কাপ এগিয়ে দেয় নবনীর দিকে। - ফ্ল্যাট হোয়াইট কফি,এক চামচ চিনি দিয়েছি,আমার মনে হয় তোমার ভাল লাগবে। ২) ডাঃ মেলিসার ঘর। আর দশটা ডাক্তারের ঘর থেকে এই ঘরটা অনেক আলাদা।

ঘরের এক কোণে একটা ইজি চেয়ার,তার পাশে ছোট কালো একটা চৌকোনা বাক্স আর কিছু যন্ত্রপাতি না থাকলে এটাকে ডাক্তারের চেম্বার বলে বোঝার কোন উপায় নেই। সমস্ত ঘরে ছড়ানো নানা আকারের ইনডোর প্লান্ট। গতানুগতিক চেয়ার টেবিলের বদলে ডাক্তার বসে আছেন লাল টুকটুকে একটা মখমল মোড়ানো মোড়া জাতীয় জিনিসে। তার সামনে ছোট্ট কাঁচের টি টেবিলে একটি ছোট কম্পিউটার রাখা আর একটা নোট প্যাড। নবনী নিজেও বেসেছে খুব নরম নীল মখমলের মোড়াটায়।

হেলান দেবার ব্যবস্থা নাই, তার মানে ডাক্তার না চাইলে রোগীর আনমনা হবার কোন সুযোগ নেই এখানে। - কেমন লাগছে আমার চেম্বার? ভাল লাগছে তোমার? অনেকেই জিজ্ঞেস করে আমার ইন্টেরিয়র ডিজাইনার কে। তাই আমি আগে ভাগেই বলে দেই, আমি নিজেই এর ডিজাইনার। ডাক্তারদের তো ডিজাইনার হতে বাঁধা নেই, তাই না? সামান্য হেসে বলতে থাকেন মেলিসা – - আমার ঘরে সাউন্ড রেকর্ডার লাগানো আছে, তোমাকে আগেই বলে নেই। তুমি যা কিছু বলবে এখানে,সব রেকর্ড করা থাকবে।

তোমার ট্রিটমেন্টের জন্য এই কথাগুলো আমাকে শুনতে হবে পরেও। তবে তুমি আর আমি ছাড়া এই কথা তৃতীয় কোন ব্যক্তির কাছে যাবে না কোন ভাবেই। কাজেই তোমার যা ইচ্ছে বলতে পারো আমাকে। ভিডিও ক্যামেরাও আছে,রেকর্ড করছে সব কিছু। তোমার কথার মাঝে মাঝে আমি কিছু নোট নেবো হয়তো।

তোমার সেল ফোনেও কোন কল আসবেনা এই সময়ে,কারণ ফোনের নেটওয়ার্ক কাজ করে না এই ঘরে। আমরা কথা বলার সময় পৃথিবীর আর সব কিছু থেকে আলাদা হয়ে কথা বলবো, ঠিক আছে? এমন একটা ঘরে বসে কথা বলতে কিছুটা অস্বস্তি হচ্ছে নবনীর, কিন্তু কিছু করার নেই। ঘাড় কাত করে সম্মতি দেয় সে। - তারপর, বলো তো তোমার কি হয়েছে। এত সুন্দর একটা মেয়েকে কোন সে দানব কষ্ট দিচ্ছে,যার কারণে আজ তাকে আমার কাছে আসতে হলো।

মেলিসার কথার ধরনে হেসে ফেলে নবনী। ঘটনার শুরু গত এপ্রিল মাসের শেষ দিকে; বলে চলে নবনী। স্টুডেন্টস ডরমেটরীতে আমার রুমে শুয়ে ছিলাম আমি। ভোর বেলা,মাত্র ঘুম ভেঙ্গেছে তখন। কোন দুঃস্বপ্নও দেখিনি সে রাতে।

স্বাভাবিক ভাবেই ঘুম ভেঙ্গেছে আমার। আরামদায়ক একটা আলস্য ঘিরে আছে,তাই উঠি উঠি করেও উঠছিনা বিছানা থেকে। জানালা দিয়ে দিনের প্রথম আলোটা এসে পড়েছে ঘরে। সে আলোয় ঘরের সব কিছুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এমন সময় হটাত করেই জানালা দিয়ে মেঘের মত, কিংবা কুয়াশার মত একটা কিছু ঢুকে পরলো আমার ঘরে।

হটাত আলোটাও কমে গেল ঘরের। ভাবলাম শীতের সকালে কুয়াশা এসে পড়েছে,জানালাটা বন্ধ করতে ভুলে গেছিলাম বোধ হয়। উঠতে যাব বিছানা থেকে, দেখি ঠিক দরজাটার সামনে কুয়াশাটা গাড় হচ্ছে ধীরে ধীরে। আস্তে আস্তে একটা মানুষের মত আকৃতি পাচ্ছে সেটা। বিছানার মাঝে যেন জমে গেলাম আমি।

নড়াচড়া করবার শক্তিটাও নেই তখন, শুধু তাকিয়ে দেখছিলাম ওটার দিকে। ক্রমে ক্রমে কুয়াশার ভেতর স্পষ্ট হলো একটা মানুষের আবয়ব,সাদা একজন মানুষ। আমার পরিচিত কেউ নয়। চেহারাটা কারও সাথেই মেলেনা। এক সময় কুয়াশা মানব আমার দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বললো – হেল্প মি,আমাকে সাহায্য করো,আমাকে সাহায্য করো,আমাকে সাহায্য করো।

তারপর যেমন এসেছিল, তেমনই মিলিয়ে গেল বাতাসে। কিছুক্ষণ পর বিছানা থেকে উঠে জানালার সামনে গেলাম,সেটা বন্ধ,বাইরে ঝকঝকে রোদ, কুয়াশার লেশ মাত্র নেই। প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম ব্যাপারটা,ঘুম ঘুম চোখের ভ্রম বলে মেনে নিয়েছিলাম। পরের সপ্তাহে ঠিক সেই সময় আবার আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। আবারও দেখি সেই একই জিনিস।

তার পরের সপ্তাহে আবারও। তৃতীয় সপ্তাহে আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম – কে তুমি? কেন আমার কাছে আসছো বারবার? আমি কিভাবে সাহায্য করতে পারি তোমাকে? সে কোন জবাব দিলো না, শুধু হেল্প মি, হেল্প মি – বলে মিলিয়ে গেল। পরের সপ্তাহে আমি ঠিক সেই সময়ে জেগে রইলাম ঘরে। সে এলো না। তারপর একটা মাস কেটে গেছে, সে আর আসেনা।

আমার মধ্যে একটা অজানা অপরাধ বোধ, একটা ভয়, একটা আশঙ্কা কাজ করছে, যেন আমি পারতাম তাকে সাহায্য করতে, কিছু হয়তো করতে পারতাম, কিন্তু করিনি, বা করতে পারিনি। ইজি চেয়ারটায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে নবনী। খুব ঘুম পাচ্ছে তার, এই ঘরেই ঘুমিয়ে পড়তে পারলে ভাল হতো। নীরবতা ভাঙ্গে মেলিসা – ভালই তো হয়েছে, চলে গেছে সে, তোমাকে আর জ্বালাচ্ছে না, আর জ্বালাবেও না মনে হয়। চোখ মেলে তাকায় নবনী।

মেলিসার চোখের দিকে চেয়ে বলে – - আমি তাকে দেখেছি দুদিন আগে। সকালে ট্রেনে করে ক্লাসে যাবার সময়। সে দাঁড়িয়ে ছিল কম্পার্টমেন্টের ভেতর। আমি ওর দিকে তাকাতেই যেন চমকে উঠলো সে। তার চোখ বলছে আমার মত সে নিজেও শক্‌ড।

তারপর যেন একটু তাড়াহুড়া করেই পালিয়ে যেতে চাইলো, চলে গেল কম্পার্টমেন্টের ভেতর। আমারও কি হলো, আমি চুপ করে বসে রইলাম সেখানেই। আমার স্টেশনেও নামলাম না। ট্রেন যখন ডাউন টাউন স্টেশনে পৌঁছালো, দেখি সে অন্য দরজা দিয়ে নেমে গেছে। আমিও পিছু পিছু নেমে গেলাম।

একটু দূরত্ব রেখে হেঁটে গিয়ে দেখলাম ১২৮ নম্বর এপার্টমেন্টে ঢুকছে সে। যাবার সময় লেটারবক্স খুলে কি যেন করলো, আমি ভাবলাম ওর ইউনিট নম্বরটা দেখে যাই। কাছে গিয়ে দেখি ইউনিট দুই এর লেটার বক্সের ডালাতে একটা ভিজিটিং কার্ডের পেছনে লেখা “স্বাগতম নবনী”। ৩) কয়েকদিন পর মেলিসা কয়েকবার ফোন করে নবনীকে, কিছু তথ্য জেনে নেয় আর পরের সপ্তাহে আবার ফোন করে দেখা করতে বলে তার চেম্বারে। - দেখো ইয়াং লেডী,তুমি নিজেও জানো,যা কিছু ঘটেছে তোমার সাথে বলে তুমি বিশ্বাস করছো,সবই আসলে ঘটছে তোমার মাথার ভেতর।

তোমার অবাস্তব কল্পনা তোমাকে এসব দেখতে বাধ্য করছে। আমি এখন তোমাকে কিছু প্রশ্ন করবো,কিছু ঘটনার কথা বলবো আর তোমার উত্তরের ওপর ভিত্তি করে এই সমস্যার শেকড় খোঁজার চেষ্টা করবো। ঠিক আছে? নবনী শুনে যায় – - নবনী, গত কয়েক মাসের মধ্যে এমন কিছু হয়েছিল, কোন এক্সিডেন্ট বা কিছু, যা দেখে তুমি খুব বেশী ভয় পেয়েছিলে, বা খুব কষ্ট পেয়েছিলে? - না, তেমন কিছু না। একদিন শুধু আমার সেল ফোনটা কেড়ে নিয়েছিল কয়েকটা ছেলে। আমি এমনিতে বেশী ভিতু মানুষ না।

না হলে একা একা এই বিদেশ বিভূঁইয়ে আসতামনা। - সময় নাও নবনী, চিন্তা করো। তোমার জন্য আমি অনেক সময় রেখেছি আজকে। আমার তাড়া নেই। মনে করার চেষ্টা করো, এমন কিছু ঘটনা নিশ্চই ঘটেছে,যার কারণে তুমি ফেব্রুয়ারির ১৬ তারিখে ক্লাসে যাওনি।

১৭ তারিখেও না,সেদিনের সিডিউল্ড পরীক্ষাটাও দাওনি তুমি। তখন তোমার কোর্স টিচার তোমাকে কল দিয়েছিলেন। তুমি বলেছিলে তোমার শরীর বেশী ভাল নাই। অথচ তুমি কোন ডাক্তারের কাছেও যাওনি। কি হয়েছিল সে সময়ে? - ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখ রাতে আমার ব্যাগ আর সেল ফোনটা কেড়ে নিয়েছিল কয়েকটা সাদা ছেলে, ট্রেনের ভেতরে।

এমন কিছু এই দেশে আমার সাথে হবে, এটা ভাবিনি কখনও। ব্যাগে আমার আইডি, ট্রেনের মান্থলী টিকেট, ব্যাঙ্ক কার্ড সব ছিল। ১৬ তারিখে ক্লাসে না গিয়ে আমি সে সব নতুন করে বের করবার জন্য ছুটোছুটি করেছি। আর ১৭ তারিখে আমার পরীক্ষা দেবার মত প্রিপারেশন ছিলনা, তাই যাইনি। - তার পর থেকে অবশ্যই তোমার ট্রেনে চড়তে ভয় লাগতো? - হ্যাঁ, তা লাগতো।

কিন্তু আমি আর একা বা কম মানুষ আছে, এমন কম্পার্টমেন্টে উঠিনা এর পর থেকে। - তারপর থেকে তুমি মাঝে মাঝেই ভাবতে সে দিনের ঘটনা, রাইট? - হুম ... মাঝে মাঝে ভাবতাম। - এরপর থেকে তুমি সাদা ছেলেদের গ্রুপ দেখলেই ভয় পেতে, ঠিক? - হ্যাঁ, তা একটু পেতাম। - তখন থেকেই তুমি সাদা মানুষদের ঘৃণা করতে শুরু করো, এম আই রাইট? - না, ঠিক তা না, তবে আমি ... আমি ওদের, বিশেষ করে সাদা ছেলেগুলোকে এড়িয়ে যেতাম। - নবনী, এবার আমার কথা শোনো।

তুমি তখন থেকেই সাদা ছেলেদের মনে মনে ঘৃণা করতে শুরু করেছিলে। এই চমৎকার একটা দেশেও যে কেউ তোমার সাথে এমন বাজে ব্যাবহার করতে পারে, এত বাজে কথা বলতে পারে, সেটা তোমার কাছে অবিশ্বাস্য ছিল। তুমি বাজে কথা বলার ব্যাপারটা আমার কাছেও এড়িয়ে গেছো নবনী। আমি জানি এদেশের মাগাররা কি করে। ওরা অবশ্যই তোমাকে অনেক বাজে কথা বলেছে।

সে কারণে তুমি পরের দুদিন ক্লাসে যাওনি। মাথা নেড়ে সায় দেয় নবনী। সাদা ছেলেগুলো এমন বাজে কিছু কথা বলেছিল ওকে, সে নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারেনি যে কেউ তাকে এত খারাপ কথা বলতে পারে। - নবনী, প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিলে তুমি সেই সময়ে। প্রচণ্ড ভয়ের প্রথম ধাক্কাটা কেটে গেলে মানুষ রেগে যায়।

ঘৃণা জন্মে সেই ভয়ের কারণটার ওপর। তুমিও ঘৃণা করতে শুরু করলে সাদা ছেলেদের। আর সেই ঘৃণাটা তোমাকে বাধ্য করলো ওদের এড়িয়ে চলতে। কিন্তু সাদা মানুষের দেশে ওদের তুমি এড়াতে চাইলেও পারছিলে না। কাজেই তোমার মনে জন্ম নেয় ক্ষোভ।

তুমি কল্পনা করতে ওদের মেরে ফেলবার। তুমি এশিয়ান দেশের লোক। তোমাদের ওখানে মানুষ খুব সহজেই একজন আরেকজনের ওপর প্রতিশোধ নেয়, মারামারি করে, ভাংচুর করে। এখানে আইনের ভয়ে অতটা করেনা কেউ। কাজেই আমি ধরে নিচ্ছি, তুমি চাইতে ওদের আঘাত করতে।

কল্পনা করতে যে তুমি আরেকবার সামনে পেলে, তোমার হাতে একটা অস্ত্র থাকলে তুমি ওদের মেরে ফেলবে। একটা সময় তোমার ইচ্ছে করতো তুমি সব সাদা ছেলেকেই মেরে ফেলবে। এর কিছুদিন পর তোমার মনে নতুন একটা চিন্তা আসলো। একজন স্বাভাবিক মানুষের মত তুমি চিন্তা করতে থাকলে যে সব সাদা মানুষ তো আর খারাপ নয়। তুমি কেন সবাইকে এড়িয়ে যেতে চাইছো? তোমার মনে দুটো চিন্তাই প্রবল হয়ে উঠলো।

কিন্তু তখন তুমি চেষ্টা করলে সাদা ছেলেদের সাথে মিশতে। নবনী শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ডাঃ মেলিসার দিকে। মেলিসা বলতে থাকেন - - আমি তোমার কোর্স কো-অর্ডিনেটর ডঃ ফরেস্টের সাথে কথা বলেছি। মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহে যখন তিনি মার্ক নামের ছেলেটার সাথে তোমাকে একটা জয়েন্ট এসাইনমেন্টের কাজ করতে বলল,তুমি একবার পার্টনার চেঞ্জ করার কথা বলেও পরে রাজী হয়ে গিয়েছিলে মার্কের সাথে কাজ করতে। এরপর তোমরা দুই সপ্তাহ এক সাথে কাজ করলে।

মার্ককে বেশ খানিকটা সময় নিয়ে জানলে তুমি, দেখলে ছেলেটি আসলেও অনেক ভাল আর হেল্পফুল। কিন্তু তোমার মনের ভেতর প্রচ্ছন্ন ঘৃণাটা রয়েই গেল। তাই, খুব সম্ভবত, তুমি মাঝে মাঝে চিন্তা করতে কি করে মার্ককে খুন করা যায়, আবার পরক্ষনেই সেই চিন্তাটা মাথা থেকে দূর করে দিতে। তোমার সাদাসিধে জীবনটা একটা দোটানায় পড়ে গেল। তুমি একটা অপরাধ বোধে আক্রান্ত হলে তখন।

তোমার তেমন কোন বন্ধুবান্ধব নেই এখানে, যে তুমি তার সাথে এই ব্যাপারে আলাপ করতে পারো। কাজেই ব্যাপারটা থেকে গেলো তোমার মাথায়। আমি কি ঠিক বলছি নবনী? ভুল কিছু বললে আমাকে জানিও। নবনী নিরুত্তর, মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় শুধু। - এসাইনমেন্ট জমা দেবার পর মার্ক তোমাকে একদিন ডিনারে ইনভাইট করলো,আর তুমি গেলে সেই ডিনারে।

আর এখানে যা হয়, মার্ক সেদিনের ডিনারটাকে তোমার সাথে তার প্রথম ডেট হিসেবে ধরে নিয়ে অনেক খরচ করে তোমাকে খাওয়ালো। খাবার পর মার্ক তোমাকে ড্রিঙ্ক করতে বললেও তুমি করোনি। আমি মার্কের সাথেও কথা বলেছি কয়েকদিন আগে। সে বলেছে যে সে তখন একটু ড্রাঙ্ক ছিল। প্রথম ডেটে ছেলেরা স্বাভাবিক ভাবেই নার্ভাস থাকে খুব।

যেহেতু তোমার দিক থেকে ব্যাপারটা ডেট ছিল না,তুমি স্বাভাবিকই রইলে। ডিনার শেষ করে তোমরা বেড়িয়ে এলে। তখন বেশ রাত। তোমরা হেটে হেটে চলে এলে তোমার ডরমেটরীর সামনে। বিদায় নেবার সময় মার্ক তোমাকে চুমু খেতে এগিয়ে এলো।

ঠিক সে সময়েই তোমার মাঝে সেই পুরনো ঘৃণাটা জেগে উঠলো। আমি জানিনা তোমাদের দেশে চুমু ব্যাপারটা ঠিক কিভাবে দেখা হয়, আমার ধারণা এই ব্যাপারে তোমারা খুব কনজারভেটিভ। কিন্তু আমি মার্কের সাথে কথা বলে জেনেছি যে সে তোমার কপালে চুমু খেতে চেয়েছিল। কপালে চুমু খাওয়াটা শুধুই ভালবাসার প্রকাশ। এটা যে কেউ খেতে পারে।

বাবা মেয়েকে, ভাই বোনকে, বন্ধু বন্ধুকে কপালে চুমু খেয়ে ভালবাসা আর আবেগটা প্রকাশ করে। এটাই আমাদের এখানকার রীতি। কিন্তু তুমি সে সময় মার্ককে জোরে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিলে, আর দৌড়ে চলে এলে তোমার ঘরে। তাই না? - হ্যাঁ, আমাদের দেশে এমনটা করেনা কেউ – কোন রকমে জবাব দিলো নবনী। - নবনী, মেয়েরা চিরকালই ভালবাসা, কেয়ার আর এটেনশন পেতে ভালবাসে।

এই দেশে তোমার এই নিঃসঙ্গ জীবনে সম্ভবত তুমি এই প্রথম একটা ছেলের সাথে অনেকটা সময় নিয়ে মিশেছো। প্রতিদিন তোমরা বারো থেকে চোদ্দ ঘণ্টা সময় এক সঙ্গে থাকতে। মার্ক তোমাকে যেভাবে সময় দিয়েছে, এসাইনমেন্টের খুটিনাটি বুঝিয়ে দিয়েছে, নিজে থেকেই অনেক জটিল ক্যালকুলেশন করে এনেছে, তুমি ইম্প্রেসড হয়ে গেছিলে ওর প্রতি। তখন তোমার মাঝেও মার্কের জন্য একটা অবচেতন পর্যায়ের ভালবাসা জন্ম নিয়েছে। তোমাদের দেশ ও সমাজ সম্পর্কে স্টাডি করে আমি যতটা জেনেছি, তোমাদের দেশ একটা ইসলামিক দেশ।

তুমি সে দেশের কনজারভেটিভ মাইন্ডেড একটা মেয়ে,যার পরিবার তাকে শিখিয়েছে প্রেম করা অন্যায়,ভালবাসা খারাপ জিনিস,যে দেশে সেক্স নিয়ে কেউ কোন কথা উচ্চারণ পর্যন্ত করতে চায় না। তাই হয়তো তুমি এই ভালবাসার অস্তিত্ব জেনেও স্বীকার করতে ভয় পেয়েছিলে। তোমার সাথে কথা বলে আমার মনে হয়েছে, দেশে তোমার হাজবেন্ড বা বয়ফ্রেন্ড নেই, তবুও তুমি মার্কের ব্যাপারে তোমার এই অনুভূতিটা একেবারেই প্রশ্রয় দাওনি। কিন্তু মার্ককে মন থেকে সরাতেও পারছিলেনা তুমি। মার্ক আমাকে জানিয়েছে, সেদিনের পর মার্কের কোন কল তুমি রিসিভ করোনি,কোন ম্যাসেজ বা ইমেইলের রিপ্লাই দাওনি।

ক্লাসেও ওর সাথে কোন কথা হয়নি তোমার। ছেলেটা তার ব্যাবহারের জন্য বার বার ক্ষমা চেয়েছে তোমার কাছে। কিন্তু তোমার মনে মার্কের ওপর,সাদা সব ছেলের ওপর ঘৃণাটা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে শুধু। পরের দুটি সপ্তাহ তোমার ইউনিভার্সিটি বন্ধ ছিল। তখন তুমি অনেক সময় পেলে চিন্তা করবার।

একদিকে তীব্র ঘৃণা আর ভয়,আরেক দিকে তোমার স্বাভাবিক বোধ,দুটি ভিন্ন ধরনের চেতনা তোমার মনে কনফ্লিক্ট করতে লাগলো। ব্যাপারটা এতই প্রকট হয়ে উঠলো যে,তুমি তোমার ডোরমেটরীর পাশের সুপার শপে গিয়ে শপিং করে টাকা দিয়েও কিছু না নিয়েই খালি হাতে চলে এলে ঘরে। তোমার শপিং লিস্টে একটা কিছু ছিল,খুব সম্ভবত একটা নতুন মোবাইল ফোন,যার কারণে ওরা তোমার আইডি কপি করে রাখে এবং পরের দিন তোমার ডরমেটরীতে এসে ওরা সেগুলো দিয়ে যায়। অনেকক্ষণ কথা বলে থামলো মেলিসা। নবনীর চোখ টলমল করছে জলে।

কিন্তু সে কাঁদছে না। মেলিসা উঠে গিয়ে এক গ্লাস হালকা সবুজ রঙের পানীয় নিয়ে এসে নবনীর হাতে দিলো। তারপর আবার কথা শুরু করলো – - নবনী, কুয়াশার ভেতর তুমি যাকে দেখেছিলে, সে ছিল মার্ক। চিন্তা করে দেখো,তুমি মার্ককে ধাক্কাটা দেবার পর মার্ক যখন মাটিতে পড়ে যাচ্ছিল, ওর হাত বাড়িয়ে দেয়া ছিল তোমার দিকে, ও হয়তো কোন কথা বলেনি তখন,ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তুমি জানো সেই অবস্থায় একটা মানুষ সাহায্য ছাড়া আর কিছুই চাইবে না। যখন তুমি কুয়াশা মানবটিকে দেখেছিলে, প্রতিবারই সময়টা ছিল বেশ সকাল।

আমার ধারণা তোমার ঘুম হচ্ছিল না ভাল মত,কাজেই শপ থেকে তুমি হালকা ঘুমের ওষুধ কিনে এনেছিলে,রোজা রাতে সেটা খেতে ঘুমুতে যাবার আগে। ঘুমের ওষুধ খেয়ে যে ঘুমটা হয়,সেটা খুব স্বাভাবিক ঘুম না। জোর করে ওষুধটা তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়,কাজেই সকালে মাথা কিছুটা এলোমেলো থাকে। সে সময় মার্কের জন্য তোমার যে ভালবাসা আর অপরাধবোধটা ছিল, তা থেকে তোমার চেতনা তোমাকে ওই অবাস্তব জিনিসটা দেখতে বাধ্য করে। তিন সপ্তাহ পর তুমি আর ঘুমের ওষুধ খাওনি,তুমি হয়তো ভেবেছিলে যে এই ওষুধে অভ্যস্ত হয়ে গেলে সারা জীবন ওষুধ খেয়েই ঘুমাতে হবে তোমাকে,কাজেই তুমি আর কুয়াশা মানবকেও দেখনি।

নবনী এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মেলিসার দিকে। মেলিসা বলে চলে - - এবার আসো ট্রেনে দেখা লোকটির কথায়। নবনী,ট্রেনে দেখা লোকটিকে তুমি হয়তো আগেও দেখেছো। তুমি যে সময়ে ট্রেন ধরো,ঠিক সেই সময়ে সেও একই ট্রেন ধরতো সপ্তাহে তিন দিন। এমনটাই হয়,রেগুলার যারা পাবলিক ট্রান্সপোর্টে যাতায়াত করে,তারা একে অন্যকে চেনে।

সেই লোকটি তোমাকে সব সময়েই দেখতো। এই শহরে ইন্ডিয়ান পিপল খুব কম,সেই ট্রেনে তাই সহজেই তোমাকে চোখে পড়তো। আর তোমার ড্রেসটাও খুবই আনকমন। তুমি অবশ্য এতগুলো সাদা ছেলের মাঝে ওকে সেভাবে আলাদা করে আগে কখনও খেয়াল করনি। তোমার হাতে যে ফোল্ডারটা আজ নিয়ে এসেছো,ওর ওপর পরিষ্কার করে লেখা আছে নবনী রহমান।

আমার ধারণা এই ফোল্ডার নিয়েই তুমি ক্লাসে যাও। কাজেই ছেলেটা তোমার নাম জানতো। সেদিন ট্রেনে তোমাকে ওর দিকে ভয় আর ঘৃণা মিশ্রিত একটা দৃষ্টিতে তাকাতে দেখে ছেলেটা ভড়কে গিয়েছিল। কাজেই সে কম্পার্টমেটের ভেতরে চলে গিয়েছিল,তোমার দৃষ্টিসীমার বাইরে। কিন্তু তুমি যখন ওকে ফলো করে ট্রেন থেকে নেমে গেলে,সে ভয় পেয়ে যায়।

তাই সে অনেকটা দ্রুত হেটেই চলে যায় তার এপার্টমেন্টে। কোন একটা কারণে সেদিন সে নিজেও কাজে যায়নি। অনেক দূর থেকেও সে তোমাকে ওর এপার্টমেন্টের দিকে আসতেও দেখেছিল,তখন সে কি করবে ভেবে না পেয়ে ওর ভিজিটিং কার্ডে “ওয়েলকাম নবনী” লিখে চলে গিয়েছিল ভেতরে। হয়তো দেখতে চাইছিল যে তুমি সত্যি ওকে ফলো করছো না কি,বা ওর সাথে দেখা করতে চাও কি না, এমন কিছুই হবে। আমার কথাগুলোর সাথে কি তুমি একমত নবনী? নবনী সামান্য মাথা নেড়ে সায় দেয়।

- কিন্তু কি জানো,আমরা যদি খুঁজি,প্রতিটা কার্টুন চরিত্রের সাথে প্রায় হুবহু মিল আছে,এমন লোকও খুঁজে পাবো। হয়তো কার্টুনিস্ট থাকেন লন্ডনে,সেই লোকটিকে খুঁজে পাওয়া যাবে আফ্রিকায়, যাদের কোন দিনই দেখা হয়নি। কিন্তু পাওয়া যাবেই। তেমনি ভাবে তোমার কুয়াশা মানবের চেহারাটাও ট্রেনে দেখা সেই লোকটির সাথে মিলে গিয়েছিল। তাই তাকে দেখে তুমি দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলে।

নবনী, তোমার সমস্যার সমাধান কিন্তু তুমি নিজেই প্রায় করে ফেলেছিলে। কুয়াশা মানব আর কখনই তোমার কাছে আসতো না,সাহায্য চাইতো না। আর এখন তুমি তোমার সমস্যার ব্যাক্ষাটা জেনে গেছো। এখন বাকিটা তোমার হাতে। ইচ্ছে করলে তুমি মার্কের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারো,অথবা নাও পারো।

কিন্তু তোমার মন থেকে ঘৃণার অংশটুকুকে আর প্রশ্রয় দিও না। সব মানুষই খারাপ হয়না,এটা তুমিও জানো। বি পজিটিভ। হেলদি একটা লাইফ লিড করো, বন্ধুদের সাথে মেশো, ঘুরে বেড়াও, মজা করো, সিনেমা দেখো। সব ঠিক হয়ে যাবে।

ডাঃ মেলিসা উঠে এসে নবনীর পাশে দাঁড়িয়ে পরম মমতায় একটা হাত রাখলেন নবনীর মাথায়। মেলিসার চেম্বার থেকে বেড়িয়ে নবনী সোজা চলে আসে তার ঘরে। ঘরে ঢূকেই সবার আগে জানালা দুটো খুলে দেয় যতটা সম্ভব। পর্দাটাও সরিয়ে দেয়। বিকেলের নরম রোদ ছড়িয়ে পড়ে নবনীর ছোট্ট ঘরে।

তারপর অনেকদিন না শোনা কিছু গান খুঁজে বের করে সে। কম্পিউটারের ছোট্ট স্পিকারে বেজে ওঠে - যদি ডেকে বলি, এসো হাত ধরো.. চলো ভিজি আজ বৃষ্টিতে এসো গান করি মেঘো মল্লারে.. করুনাধারা দৃষ্টিতে আসবে না তুমি জানি আমি জানি... অকারণে তবু কেন কাছে ডাকি.. কেন মরে যাই তৃষ্ণা তে এইই এসো.. চলো জলে ভিজি শ্রাবণ রাতের বৃষ্টিতে ... নবনী অদম্য আবেগে ফুলে ফুলে কাঁদতে থাকে বিছানায় উপুর হয়ে। তার এতদিনের জমে থাকা ব্যাক্ষার অতীত তীব্র মানুষিক টানাপোড়েনের সমাপ্তি ঘটেছে আজ। নবনী আজ অনেকক্ষন কাঁদবে। ~সমাপ্ত~ [ সংশোধিত / রিপোস্ট / এক্সপেরিমেন্টাল লেখা ]  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।