আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমাদের বিউটি বোর্ডিং......

কবি-সাহিত্যিকদের কাছে পুরনো ঢাকার বিউটি বোর্ডিং এক আড্ডার কেন্দ্রস্থল। যারা শিল্প-সাহিত্যের খোজঁ রাখেন -তাদের কাছে এই নাম রক্তে নাচন ধরায়। বর্তমান শিল্পী সাহিত্যিকরা হয়তো এখনো যাননি বিউটি বোডিংয়ে। পুরনো ঢাকার নর্থ ব্রুক হল রোড, বাংলাবাজার, লালকুঠি আর প্যারিদাস রোড থেকে একটু সামনে এগিয়ে গেলে হাতের বাঁয়ে পড়বে ছোট্ট একটা গলি, যার নাম শ্রী দাশ লেন। এই লেনে ঢুকলেই চোখে পরবে ছোট্ট একটি সাইনবোর্ড।

খুব বেশী ঝিকিমিকি নয়, অতি সাধারন। তবে সেটাই ইতিহাস বিখ্যাত "বিউটি বোর্ডিং '। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর এই বোর্ডিং'র যাত্রা শুরু হয়েছিল খুব সাধারন ভাবে। দেশ ভাগের পরথেকেই বাংলাবাজার এলাকাটি মুদ্রণ এবং প্রকাশনার প্রধান কেন্দ্রস্থল হিসেবেই সবাই চেনে। স্বাভাবিক ভাবেই এখানে শিল্পী-সাহিত্যিকদের আড্ডার জায়গা হয়ে দাঁড়ায় এই বিউটি বোর্ডিং।

এই বিল্ডিং'এ বিউটি বোর্ডিং চালু হবার পুর্বে সুনীল কুমার মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত সাপ্তাহিক "সোনার বাংলা" পত্রিকা অফিস হিসেবে পরিচিত ছিল। এই পত্রিকা অফিসের সুত্র ধরেই এখানে জমে ওঠে শিল্পী সাহিত্যিকদের জম্পেশ আড্ডাস্থল। আর এখান থেকেই শুরু হয়-বাংলাবাজারকেন্দ্রিক সাহিত্যচর্চা। আড্ডাপ্রিয় বিভিন্ন শ্রেনী পেশার মানুষগুলোর প্রিয় গন্তব্যস্থল ছিল এই ঘুপচি গলির ছোট্ট দালানের বিউটি বোর্ডিং। ১৯৪৯ সনে কবি শামসুর রাহমানের প্রথম কবিতা ছাপা হয় সোনার বাংলা পত্রিকায় ।

পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যাবার পর দালানের দোতলায় গড়ে ওঠে স্বল্প দামের আবাসিক হোটেল। প্রথমে এই হোটেলে শুধু চা-নাশতা পাওয়া যেত। কবি শামসুর রাহমান থাকতেন আশেক লেনে, এবং কবি শামসুল হক থাকতেন লক্ষ্মীবাজারে। আর বিউটী বোর্ডিং'র সাথেই অন্য আর একটা পুরনো দালানের দোতলায় থাকতেন কবি শহীদ কাদরী। এখানে আড্ডা দিতে আসতেন আব্দুল গাফফার চৌধুরী, হাসান হাফিজুর রহমান সহ অনেকেই।

বিকেলে বোর্ডিং'র সবুজ চত্তরে এক কাপ চা কয়েকজনে ভাগ করে খেতে খেতে তখনকার শিল্পী সাহিত্যিকেরা মেতে উঠতেন জমজমাট আড্ডায়। এখানে যে শুধু আড্ডা হতো তাই নয়-পাশাপাশি চলত মতবিনিময়, বিতর্ক, সাহিত্যচর্চা। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর আজ পর্যন্ত যে সাংস্কৃতিক ব্যাক্তিত্ব আছেন তাঁদের বেশীর ভাগেরই পদধূলি পরেছে এই বিউটি বোর্ডিং'এ। দেশ ভাগের কিছুদিন পর সোনার বাংলা প্রেসটি নিয়ে যাওয়া হয় কলকাতায়। কয়েক বছর খালি থাকার পর প্রেসের মালিক জমিদার সুধীর চন্দ্র দাসের কাছথেকে যায়গাটি বুঝে নেন প্রলহাদ চন্দ্র সাহা।

পঞ্চাশ দশকের প্রথম দিকে প্রলহাদ চন্দ্রের মেয়ের নামে চালু করেন বিউটি বোর্ডিং। বোর্ডিং'এ প্রথম থেকেই দু'একটি রুম ভাড়া দেয়া হতো আবাসিক হোটেল রুম হিসেবে। ব্যাবসা সম্প্রসারনের সাথে সাথে তথা কাস্টমার সংখ্যা বৃদ্ধিপাবার সাথে সাথে আবাসিক রুমের সংখ্যাও বাড়ানো হয়। এখানে আড্ডা জমজমাট হবার অন্যতম কারন ছিল হোটেলে সুলভমুল্যে চা-কফি, চপ-কাটলেট পাওয়া যেত। আহম্মদ ছফার স্মপাদনায় প্রকাশিত হয় "স্বদেশ" এবং আরো বেশ কয়েকটি সাহিত্য সাময়িকী।

বিউটি বোর্ডিং'এ বসেই ততকালীন পুর্ব পাকিস্তানের প্রথম পুর্ণদৈর্ঘ্য সবাক চলচিত্র "মুখ ও মুখোশ"এর পরিকল্পনা করেছিলেন পরিচালক আব্দুল জব্বার খান। ১৯৭১ সনে পাক হানাদার বাহিনী বিউটি বোর্ডিং'র মালিক প্রলহাদ চন্দ্র সাহা সহ আরো ১৬ জনকে ধরে নিয়ে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে। প্রহলাদ বাবুর মৃত্যুর পর তাঁর পরিবার চলে যায় কলকাতায়। দেশ স্বাধীন হবার পর কয়েকজন পারিবারিক বন্ধুর ডাকে প্রহলাদ বাবুর পরিবার দেশে ফিরে এসে আবার হাল ধরেন বিউটি বোর্ডিং এর। পরিবারের কতিপয় সুহৃদের সহায়তায় পাকিস্তানী হানাদারদের ধংশস্তুপের ভিতর থেকে প্রহলাদ সাহার পুত্র তারাক চন্দ্র সাহা আবার পুনর্জীবিত করে গড়ে তোলে সেই ঐতিয্যবাহী বিউটি বোর্ডিং।

১৯৯৫ সনের আগস্ট মাসের ৪ তারিখ আয়োজন করা হয় "আড্ডা পুনর্মিলনীর"। ২০০৩ সনে গঠন করা হয় "বিউটি বোর্ডিং সুধী সংঘ ট্রাস্ট"। নতুন নতুন কবি সাহিত্যিকদের আড্ডা চলে বিউটি বোর্ডিং'র সবুজ চত্তরে। পুরনোরা তাদের স্মৃতি শেয়ার করেন নতুনদের সঙ্গে। তবে রাতেই আড্ডাটা আরো জম্পেশ হয়।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।