আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রাজনীতিবিদদের দৌড়-সংস্কৃতি

খোন্দকার তাজউদ্দিন কবিয়াল রমেশ শীল তার গানে লিখেছেন- ‘জনতা ছিনাইয়া আনে জয় নেতারা সেই জয় করে শুধু ক্ষয়। ’ রাজনীতিতে রাজনৈতিক দলের কর্মীরা প্রতিপক্ষকে পরাজিত করে জয় ছিনিয়ে আনে। আর নেতারা ÿমতায় এসে নিজেদের ভুল, স্বজনপ্রীতি, অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ, ভোগবিলাসে লিপ্ত হয়ে ও অযোগ্যতার পরিচয় দিয়ে সেই জয়কে পরাজয়ে পরিণত করে নিজেরা তো ডোবেনই, সেই সঙ্গে দলকেও ডোবান। অনেক সময় দেশকে বিপর্যয়ের মুখেও ঠেলে দেন। স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশের রাজনীতিতে নেতাদের ভুলের খেসারত দিতে হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোকে।

‘৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের পরে গণতান্ত্রিক শাসন শুরম্ন হলেও রাজনীতিবিদদের ভুলের খেসারত দিয়েছে একাধিক রাজনৈতিক দল। বর্তমানেও রাজনীতিবিদদের অপকর্মের শিকার জনগণ ক্ষুব্ধ হয়ে হরহামেশাই তাদের বিরম্নদ্ধে ফুঁসে উঠছে। যেসব নেতা নিজেদের স্বার্থ, জেদ, সঙ্কীর্ণ চিন্তা-চেতনা, ক্ষমতার মোহে জনতার আন্দোলন ও আত্মত্যাগকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করছেন তাদের বিরম্নদ্ধেই জনগণ ফুঁসে উঠছে। নিজ দলের নেতাকর্মীদের হাতেই তারা লাঞ্ছিত হচ্ছেন। অনেকেই জীবন বাঁচাতে দৌড়ে পালাচ্ছেন।

আর এর মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে নতুন সংস্কৃতি চালু হয়েছে। যার নাম ‘দৌড়-সংস্কৃতি’। ইদানীং হরহামেশা সরকারি দলের নেতা ও সংসদ সদস্যরা এই দৌড়ের শিকার হচ্ছেন। এতদিন রাজনীতিতে বিরোধী দলের নেতাদের দৌড়ে পালানোর রেকর্ড থাকলেও এখন সরকারি দলের নেতারা সেই রেকর্ড গড়ছেন। ‘দৌড়-সংস্কৃতিতে’ এতদিন আলোচনায় ছিলেন গত জোট সরকারের প্রভাবশালী সংসদ সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ।

জনগণের ধাওয়া খেয়ে তিনি পালানোর কারণে তাকে বলা হয় ‘দৌড় সালাহউদ্দিন’। বিদ্যুৎ ও পানির দাবিতে আন্দোলনে যাত্রাবাড়ী, ডেমরার জনগণের রোষানলে পড়ে তিনি শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হন। এক সময় দৌড়ে পালিয়ে জীবন রক্ষা করেন। দৌড় সালাহউদ্দিনের রেকর্ড ভঙ্গ করলেন মহাজোট সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের হুইপ শেখ আবদুল ওহাব। যশোরের ঝিকড়গাছা-চৌগাছার ভবদহ বিল কপালিয়ায় টিআরএম প্রকল্প উদ্বোধন করতে গিয়ে গত ২ জুন তিনি জনরোষের শিকার হয়ে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হন।

তার ও বহরের ১২টি গাড়ি ভাঙচুর ও ৬টিতে অগ্নিসংযোগ করে জ্বালিয়ে দেয়া হয়। এ সময় জনতার হাতে হুইপ, উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও, থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি, যশোর জেলা সহকারী পুলিশ সুপারসহ আওয়ামী লীগের ৫০ নেতাকর্মী পিটুনির শিকার হন। ১৬ জনকে গুরম্নতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চৌগাছার ভবদহ বিল কপালিয়ার ২ কিলোমিটার জুড়ে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় যশোরের অপর সংসদ সদস্য খান টিপু সুলতান জনরোষের ভয়ে অনুষ্ঠানস্থলে না গিয়ে যশোরে ফিরে আসেন ও পরে বিমানযোগে ঢাকায় চলে আসেন।

অবশ্য এর আগে গত এপ্রিলে এই দুই সংসদ সদস্যই ঝাড়ু ও জুতা মিছিলের কবলে পড়েন। সেদিন অবশ্য পুলিশের তৎপরতায় তারা প্রাণে রক্ষা পান। সরকারের মেয়াদপূর্তির এখনো দেড় বছর বাকি। অথচ এখনই অনেক সংসদ সদস্যপ্রাণ ভয়ে নির্বাচনী এলাকায় যেতে পারছেন না। দলীয় নেতাকর্মীরা তাদের অপকর্মের জবাব দিতে গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা করছেন না।

এÿেত্রে তারা পুলিশ প্রটেকশনকেও থোড়াই কেয়ার করছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, সরকারি দলের কর্মী হিসেবে সংসদ সদস্যদের কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা না পাওয়ার বেদনা, সংসদ সদস্যদের পরিবারের ও আত্মীয় স্বজনের দাপট, বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে আঁতাতের কারণে এমনটি ঘটছে। ৯ জুন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় দৌড় পরিস্থিতির শিকার ১২ এমপি ও সম্ভাব্য আরো ৫০ সংসদ সদস্যদের বিষয়ে আলোচনা হয়। ৬ বিভাগের ৬ জন সাংগঠনিক সম্পাদক তাদের রিপোর্টে বিতর্কিত সংসদ সদস্যদের তালিকা তুলে ধরেন। সভায় নিজ কর্মীদের হাতে দলীয় সংসদ সদস্যদের একের পর এক লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।

গণভবনের সূত্র মতে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলীয় এমপিদের অপকর্মে হতাশা ব্যক্ত করেছেন। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বিতর্কিত এমপিদের তালিকা অনুযায়ী তাদের অপকর্মের সারসংক্ষেপ তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন। গণভবন ও দলীয় কার্যালয়ে এসব এমপির বিরম্নদ্ধে শত শত অভিযোগ জমা পড়েছে। অভিযুক্ত এমপিরাই নিজ নির্বাচনী এলাকায় ‘দৌড়ের’ শিকার হচ্ছেন। আরো সেসব এমপি দলীয় নেতাকর্মীদের রোষানলে পড়ে লাঞ্ছিত হতে পারেন বলে প্রতিবেদনে উলেস্নখ করা হয়েছে তারা হলেন পটুয়াখালীর এমপি গোলাম মওলা রনি, পাবনার শামসুল হক টুকু, গাইবান্ধার অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বী মিয়া, মাহবুব আরা গিনি, বরগুনার ধীরেন্দ্র চন্দ্র দেবনাথ শম্ভু, নরসিংদীর জহিরম্নল হক মোহন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের এনামুল হক, নাটোরের আহাদ আলী সরকার, যশোরের খান টিপু সুলতান, মোস্ত্মফা মোহাম্মদ ফারম্নক, শেখ আবদুল ওহাব, মাগুরার ডা. এমএস আকবর, ময়মনসিংহের অধ্যক্ষ মতিউর রহমান, জামালপুরের ফরিদুল হক খান দুলাল, কুড়িগ্রামের জাকির হোসেন, রংপুরের আবুল কালাম আজাদ, ফরিদপুরের আবদুর রহমান প্রমুখ।

আওয়ামী লীগ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, গত ১৯ মে ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের এমপি ক্যাপ্টেন (অব.) গিয়াসউদ্দিনের ওপর হামলা চালায় তার নির্বাচনী এলাকার লোকজন। এর আগেও তিনি একাধিকবার এলাকায় লাঞ্ছিত হয়েছেন। অবস্থা বেগতিক দেখে পিস্ত্মল উঁচিয়ে গুলি ছুড়ে নিজেকে রক্ষা করেন। ২০১০ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর দলীয় নেতাকর্মীদের হামলার শিকার হন বরিশাল-২ (উজিরপুর-বানারীপাড়া) আসনের সংসদ সদস্য মনিরম্নল ইসলাম মনি। তিনি শ্বশুরবাড়ির সামনে হামলার শিকার হয়ে আহত হন।

একই বছর দলীয় কর্মীর বোমা হামলার শিকার হন কুষ্টিয়া-১ আসনের সংসদ সদস্য আফাজউদ্দিন আহম্মেদ। ওই বোমা হামলায় তিনজন নিহত হয়। দলীয় কোন্দলের কারণে এই বোমা হামলা চালানো হয়। নারায়ণগঞ্জের দুই সংসদ সদস্য সারাহ বেগম কবরী ও গোলাম দস্ত্মগীর গাজী একাধিকবার দলীয় কর্মীদের রোষানলে পড়েছেন। কবরীর সঙ্গে শামীম ওসমানের কোন্দল আর দস্ত্মগীর গাজীর সঙ্গে উপজেলা চেয়ারম্যান ও থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোঃ শাহজাহানের সাপে-নেউলে সম্পর্ক বিদ্যমান।

উভয় গ্রম্নপ একাধিকবার সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। গত ২৮ জানুয়ারি রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়োগ নিয়ে সংঘর্ষ হয়। ওই সংঘর্ষে গণপিটুনির শিকার হন সরকারের শরিক জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ও সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের ভাতিজা হোসেন মকবুল শাহরিয়ার আসিফ। তার মাথা ফেটে যায়। ৪ এপ্রিল লালমনিরহাটে লাঞ্ছিত হন এমপি মজিবর রহমান।

১৪ এপ্রিল খুলনায় চড়ক পুজোয় লাঞ্ছিত হন খুলনা-১ আসনের এমপি ননী গোপাল ম-ল। ১৬ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের এমপি নজরম্নল ইসলাম বাবুর গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। ৩১ মার্চ ঢাকায় এমপি সানজিদা খানমের ওপর হামলা চালায় দলীয় নেতাকর্মীরা। তার সভামঞ্চ ভেঙ্গে চুরমার করা হয়। জামালপুরের ফরিদুল হক খানের বিরম্নদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছেন নিজ উপজেলা সভাপতি জিয়াউল হক জিয়া ও উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান শফিকুল আলম।

তাদের মধ্যে সাপে-নেউলে সম্পর্ক বিদ্যমান। উভয় গ্রম্নপের মধ্যে একাধিকবার সংঘর্ষও হয়েছে। জানা গেছে একের পর এক দলীয় এমপি লাঞ্ছিত হওয়ার উদ্বিগ্ন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। এ বিষয়ে তিনি খোঁজ-খবর নেয়ার নির্দেশ দেয়ার পর লাঞ্ছিত এমপিদের তালিকা করে এ সক্রান্ত্ম প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নির্বাচনী এলাকা থেকে বিচ্ছিন্ন, নেতাকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক না রাখা, সংসদ সদস্যদের পরিবারের ও আত্মীয়দের দাপটের কারণেই এ ঘটনা ঘটছে।

পাশাপাশি অধিকাংশ এমপি নিয়োগ-বদলি, পদোন্নতি, টিআর, কাবিখা, কাবিটা বণ্টনে স্বচ্ছতা রাখেন না যে কারণে দলীয় নেতাকর্মীরা ÿুব্ধ বলে উলেস্নখ করা হয়েছে। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, রাজনীতিতে দৌড়-সংস্কৃতি চালু হয়নি। একটা ভুল বোঝাবুঝির কারণে যশোরে হুইপের গাড়ি বহরে হামলা হয়েছে। এর পেছনে বিলের মুনাফাভোগীরা জড়িত। এটাকে রং লাগিয়ে সরকারি দলের এমপিরা লাঞ্ছিত হচ্ছেন বলা ঠিক হবে না।

রাজনীতিতে গ্রম্নপিং নতুন বিষয় নয়। এটা আছে, থাকবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান বলেন, অন্যকে অসম্মান করে নিজে সম্মানিত হওয়া যায় না। আমাদের রাজনীতিতে এখন অন্যকে অসম্মান করে নিজে সম্মানিত হওয়ার প্রবণতা শুরম্ন হয়েছে। এমপিরা জনগণের সঙ্গে প্রত্যাশিত আচরণ করছেন না।

ফলে একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে যাচ্ছে। এখান থেকেই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটছে। . ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.