আমার কিন্তু স্বপ্ন দেখতে আজও ভাল লাগে । 'অমিট রয়' কে 'লুল' কহিবো সেই স্পর্ধা আমার নাই । 'অমিত-লাবণ্য' বাঙালী প্রেম পিয়াসী সকলের চির আরাধ্য জুটি । তাই এখানে 'লুল' মানে শুধুই প্রেম । কলকল রবে বয়ে যাওয়া ঝর্নার স্বচ্ছ জলে উদ্ভাসিত প্রেম ।
হৃদয় হতে উৎসরিত উৎস জলের উচ্ছলতার প্রেম । তৎকালীন অনেক লেখকই ইংগীত করিতেন 'রবিকবি' তেমন আধুনিক নন । সারাজীবন কাঠগড়ায় যুয্যমান অভিযোগের একটাই মোক্ষম জবাব দিয়েছিলেন 'কবিগুরু', তার শেষ বয়সে । আর সেটাই 'শেষের কবিতা' । আর সেদিন থেকেই বুঝি বাঙালী প্রেমিক-প্রেমিকার সাথে কবিতা বেঁধে নিলো এক অন্তহীন বন্ধনহীন পথচলা ।
ঘটনার শুরু কিন্তু পুরাই সিনেমাটিক !! শিলংয়ের পাহাড়ে আঁকাবাঁকা রাস্তায় মোটরে মোটরে ধাক্কা । গাড়ি দুটো গড়িয়ে পড়তে পড়তে পাহাড়ের কিনারায় হঠাৎ থেমে যাওয়া । আকস্মিক ধাক্কা সামলিয়ে দুজনেই নামলেন গাড়ি থেকে, অমিত আর লাবণ্য । কোথায় কি পরস্পরকে ধোলাই দিবে, তা নয় ! দুজনে জপছে 'মেরে লিয়ে, মেরে লিয়ে' না না না, আমারই দোষ !! আর অমিত তো পুরাই কেষ্ট ঠাকুর, লাবণ্য কে দেখেই তার কবিতার রস চুয়ে চুয়ে পড়তে থাকে, "এ যেন অম্বুরি তামাকের হালকা ধোঁয়া, জলের ভিতর দিয়ে পাক খেয়ে আসছে- নিকোটিনের ঝাঁজ নেই, আছে গোলাপ জলের স্নিগ্ধ গন্ধ" ।
আহা হা হা, তারপরেই শুরু হলো দুজনের রোমান্টিক পথ চলা,
"পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি
আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থী
রঙিন নিমেষ ধুলার দুলাল
পরাণে ছড়ায় আবীর গুলাল,
ওড়না ওড়ায় বর্ষার মেঘে
দিগঙ্গনার নৃত্য ;
হঠাৎ আলোর ঝলকানি লেগে
ঝলমল করে চিত্ত" ।
শুরু হলো শিলং মালভূমির পাহাড়ি বাঁকে ঝর্নার ফাঁকে দুজনের কাটুস কুটুস আলাপন । অমিত ইংরেজ কবি ডন'র সুবিখ্যাত দুই লাইনকে নিজের বলেই চালিয়ে দিলে,
"For God sake, hold your tongue
and let me love"
"দোহাই তোদের, একটুকু চুপ কর ।
ভালোবাসিবারে দে আমারে অবসর । "
অবিরত জল ঝরে চপল ঝর্নায় । অবিরত কথা ঝরে অমিত-লাবণ্য দুজনায় ।
লাবণ্য হয় 'বন্যা' আর অমিত হয় 'মিতা' । ঝরনার মতো জীবন স্রোতে শুধু চলা নয়, চলার সাথেই কলকল রবে কথা বলা । শুধু কথা বলা নয়, সামনে বসে দুজন দুজনকে 'পত্র' লেখা । অমিত লিখলে,
"Blow gently over my garden
Wind of the southern sea
In the hour my love cometh
And calleth me.."
"চুমিয়া যেও তুমি
আমার বনভূমি
দখিন সাগরের সমীরন,
যে শুভখনে মম
আসিবে প্রিয়তম
ডাকিবে নাম ধরে অকারন" ।
আর লাবণ্য লিখে দিলে,
"মিতা, ত্বমসি মম জীবনং, ত্বমসি মম ভূষনং,
ত্বমসি মম ভবজলধিরত্নম" ।
দুজনার পত্র দুজনে পড়ে দুজনেই বিষম আশ্চর্য হলে । অমিত লিখেছে মেয়ের মুখের কথা আর লাবণ্য লিখেছে পুরুষের । তবু যেন কিছুই অসংগত হয়নি । শিমুল কাঠই হোক আর বকুল কাঠই হোক, যখন জ্বলে তখন আগুনের চেহারাটা একই ।
অত:পর ঠিক হয়ে গেল, আসছে অঘ্রানে তাহাদের বিয়ে ।
শীঘ্র মিলনের কল্পনায় তারা হারিয়ে যায় । মধু মিলনের বর্ণে-ছন্দে-গন্ধে তারা রঙ ছড়ায় । লাবণ্য হবু বরের কাছে চুপিচুপি জানতে চায়, " 'মিলনের আর্ট' তোমার মনে কি রকম আছে বুঝিয়ে দাও, আজই আমার প্রথম পাঠ শুরু হোক" । অমিত তার 'মিলনের আর্ট' শিষ্যাকে বুঝিয়ে বলে, "ইচ্ছাকৃত বাধা দিয়েই কবি ছন্দের সৃষ্টি করে । 'মিলন' কেও সুন্দর করতে হয় ইচ্ছেকৃত বাধায়"।
(লুল পাঠক-পাঠিকা, শিখে নাও শিখে নাও )
ইতিমধ্যে শিলং মালভূমে 'ভিলেনী'দের আবির্ভাব, অমিতের ন্যাকা বোন 'সিসি' আর তার ততোধিক ন্যাকা বন্ধু 'কেটি' (কেতকি) । প্যারাডাইস লস্ট, স্বর্গ হতে বিদায়ের শুরু । এই দুটি মেয়ে পুরো নাড়িয়ে দিলো অমিত-লাবণ্যের প্রেম-বন্ধন । সিসি তার দাদার জন্য আগেই কেতকী কে পছন্দ করে রেখেছিলো, যদিও অমিত নিমরাজি ছিলো । সিসি-কেটি দড়ি ধরে দিলো টান, অমিত-লাবণ্য প্রেম হলো খান খান ।
অবস্থা বেগতিক দেখে মহান প্রেমিক অমিত বাবু পল্টি খাইলেন । সিচুয়েশন সুবিধের নয় দেখে লাবণ্যেরও পুরানো প্রেমিক 'শোভনলাল' এর কথা মনে পড়িতে সময় লাগিলোনা ।
অমিত-লাবণ্য দুজনেই স্বেচ্ছায় এ্যারেন্জড ব্রেক-আপে সম্মত হইলো । কিন্তু শেষ হয়েও যেন তার হয়না শেষ, কারন 'শেষের কবিতা' খানি এখনো লেখা বাকী আছে যে ! তাই লাবণ্য অবশেষে অমিত কে লিখলে,
"কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও ?
তারি রথ নিত্যই উধাও... ।
...........
ফিরিবার পথ নাহি
দুর হতে যদি দেখ চাহি
পারিবেনা চিনিতে আমায়
হে বন্ধু, বিদায় ।
............
মোর স্মৃতিটুকু দিয়ে স্বপ্নাবিষ্ট তোমার বচন
ভার তার না রহিবে, না রহিবে দায়
হে বন্ধু, বিদায় ।
.............।
হে ঐশ্বর্যবান
তোমারে যা দিয়াছিনু সে তোমারি দান
গ্রহন করেছ যত ঋনি তত করেছ আমায়
হে বন্ধু, বিদায় । "
একটা মহৎ প্রেমের মিউচুয়াল ব্রেক-আপ এইভাবেই হইলো । অত:পর মহান ত্যাগী প্রেমিক 'অমিত' কেতকীকে বিয়ের পর আত্মপোলব্ধি করিলেন, "একদিন আমার সমস্ত ডানা মেলে পেয়েছিলুম আমার ওড়ার আকাশ ।
আজ আমি পেয়েছি আমার ছোট্ট বাসা, ডানা গুটিয়ে বসেছি । কিন্তু আমার আকাশও রইলো" ।
প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, 'লুল' পোড়ার গন্ধ পাওয়া যায় ?? আপনাদের নাসিকারন্ধ্রে এখনো উহা না পৌছালে অমিত বাবুর স্বগতোক্তি পাঠ করিয়া দেখুন,
"কেতু হলো ঘড়ায় তোলা জল- প্রতিদিন তুলব, প্রতিদিন ব্যবহার করব । আর লাবণ্যের সংগে আমার যে ভালোবাসা, সে হইলো দিঘী । সে ঘরে আনবার নয়, আমার মন তাতে নিত্য সাঁতার দেবে" ।
অতএব, হে বাঙালী লুল প্রেমিক প্রবর, যার কাছে যা কিছু আছে তা নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ো প্রেমের ময়দানে । বীরবিক্রমে জয় করো জিএফের হৃদয় । তার পর গুডি বয়ের মতো এ্যারেন্জড ম্যারেজে আবদ্ধ হও । তাহলে চুকচুক করে খাবার জন্য ঘড়ার জলও পাইবে, আবার জিএফের দিঘীতে আজীবন 'ডুবসাঁতার'ও কাটিতে পারিবে ।
**********************************
আরো কিছু "লুলমর্টেম",
বাংলা সাহিত্যের চিরায়ত 'লুল' নায়কেরা : 'কুবের মাঝি' পর্ব ।
বাংলা সাহিত্যের চিরায়ত লুল নায়কেরা : শ্রীকান্ত-দেবদাস পর্ব ।
************************************
উৎসর্গ : ঘুম কাড়ানিয়া স্বপ্ন দেখা আর স্বপ্নের কারিগর 'ব্লগার' দম্পতি 'একটু স্বপ্ন ' ভাই আর 'মেঘরোদ্দুর ' আপু ।
আমার কিন্তু স্বপ্ন দেখতে আজও ভালো লাগে ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।