আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বন্ধুদের আমলনামা-২:: বালুচরের ডুবুরী জীবন কৃষ্ণ ঘরামী।। রেজা ঘটক

বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা... ছোটবেলায় আমরা যখন স্কুলে যেতাম, তখন প্রায়ই চিত্ত'দা আর জ্যাঠিমা আমার বাবার কাছে জীবনের নামে নালিশ দিতেন। বাবাকে অনুরোধ করতেন হাড় মাংশ গুড়া করে হোলেও জীবনকে যেনো বাবা স্কুলমুখী করেন। জীবন আমাদের অঞ্চলের সেরা মার্বেল খেলোয়ার, সেরা চাপা প্লেয়ার, সেরা হাডুডু খেলোয়ার। আর দুষ্টামীতে গোটা অঞ্চলেরই অর্জুন হল জীবন কৃষ্ণ ঘরামী। তো, সকালে জ্যাঠিমা আর চিত্ত'দা বাবাকে নালিশ দিয়ে চলে যাবার পর আমরা যথারীতি স্কুলে গেছি।

বেলা সাড়ে এগারোটা বারোটার দিকে জীবনকে নিয়ে বাবা আমাদের প্রাইমারি স্কুলে আসলেন। হেডস্যার অমৃতলাল রায় বাবু বাবার বন্ধু। হেডস্যারকে বাবা বললেন, এখন থেকে জীবন স্কুলে আসবে। যদি না আসে, শুধু আমাকে একটা খবর পাঠাবেন। আর জীবনকে রাজসাক্ষী বানিয়ে কে কে কোথায় কোথায় মার্বেল, চাপা খেলে, সেই নাম ধাম, এরিয়ার খোঁজ খবর সব শুনে নিলেন বাবা আর হেডস্যার।

পরদিনও জীবন স্কুলে আসল না। বাবা জীবনের তথ্য অনুযায়ী সেদিক হানা দিয়ে জীবনদের আস্তানা থেকে জীবন আর বেলালকে ধরে আনলেন স্কুলে। পালিয়ে যেতে সক্ষম হল রমেশ, বিধান, গৌরাঙ্গ, ছালাম, এখলাস আর ঋষিকেশ। বেলাল আর জীবনকে স্কুলে আটকে রেখে বাবা ওদের বাড়িতে আমাদের মত নিয়মিত স্টুডেন্টদের দিয়ে খবর পাঠালেন। খবর পেয়ে বেলালের বাবা আসলেন।

জীবনের মা আমাদের জ্যাঠিমাও আসলেন। তাদেরকে জানিয়ে দেওয়া হল, ওরা স্কুলে না আসলে ভাত বন্ধ। আর রমেশ-ঋষিকেশদের বাড়িতেও অনুরূপ খবর পাঠানো হল। আর আমাদের চেয়ে বড় একটি দলকে ওদের খেলার আসর থেকে ধরে আনার জন্য ভলান্টিয়ার বানানো হল। আমরা অনেকেই তখন পালিয়ে স্বেচ্ছায় ভলান্টিয়ার হলাম।

আমাদের কাজ তখন দুইটি। প্রথম কাজ ওদের সঙ্গে মিশে কিছুক্ষণ ওদের সঙ্গে মার্বেল বা চাপা খেলা। তারপর ওদের বলা, যে চল তোরা স্কুলে। আজ যবের ছাতু দেবে। ওরা সেই ফাঁদে পা দিয়ে খেল ধরা।

ইতোমধ্যে রমেশের বাবা, গৌরাঙ্গের মা, ছালামের বাবা, এখলাসের বড় ভাই আর ঋষিকেশের মা-বাবা স্কুলে হাজির হলেন। তাদের উপস্থিতিতে আমাদের অঞ্চলে বাবা মার্বেল আর চাপা খেলা নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেন। আর কেউ যদি স্কুলে না আসে তাকে ধরে আনা হবে বলে হুমকি দিলেন। সবার মা-বাবা একাজে সহায়তা করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিলেন। কয়েক দিনের মধ্যেই আমাদের স্কুলের চেহারা গেল বদলে।

জীবন, রমেশ, বিধান, ছালাম, এখলাস, বেলাল, গৌরাঙ্গ, ঋষিকেশদের দেখাদেখি একে একে স্কুলে আসা শুরু করল শশধর, সঞ্জয়, কেতু, বিরেন, সুখময়, গৌতম, কৃষ্ণ, ভজন, এনায়েত, সুখরঞ্জন, বিবেক, সুবোধ, আর অনিমেশরা। আমাদের স্কুলে যাতে মন টেকে সেজন্য স্কুলের পরিত্যক্ত লম্বা যে ঘরটা, যেটায় ছাদ নেই, সেখানে ঋষিকেশ জীবনরা মিলে দাড়িয়াবাধার কোর্ট কাটল। রোজ আমরা আগে আগে স্কুলে আসা শুরু করলাম। স্কুল শুরু হবার আগে আমরা এক পশলা দু'দলে ভাগ হয়ে দাড়িয়াবাধা খেলতাম। আবার কখনো টিফিনের ফাঁকে বা ছুটির পরেও সেই খেলা চলতো।

এভাবে শুরু হল জীবনদের স্কুলে আসার পর্ব। জীবনরা আমাদের চেয়ে বয়সে অনেক বড়। নিয়মিত স্কুলে আসলে ওরা হয়তো ক্লাস ফোর ফাইভে পড়তো। কিন্তু দেরিতে স্কুলে আসা শুরু করায় ওরা সবাই আমাদের ক্লাশফ্রেন্ড হয়ে গেল। ওদের মধ্যে ঋষিকেশ সবচেয়ে ভালো ছাত্র হিসেবে ক্লাশ টুতে ওঠার সময় ভেলকি দেখিয়ে থার্ড হয়ে গেল।

কৃষ্ণ হল ফোর্থ। জীবন হল সপ্তম আর বাকীরা কোনোমতে পাশ করে ক্লাশে উঠলো। যারা পাশ করে নাই তাদেরও বয়সের কথা বিবেচনা করে বাবার অনুরোধে উপরের ক্লাশে প্রমোশোন দেওয়া হল। আর বলা হল, এবার পড়াশুনা না করলে হাড় মাংশ গুড়া বানিয়ে দেওয়া হবে। পরে ক্লাশ ফাইভ পর্যন্ত প্রায় সবাই পড়াশুনায় টিকে রইল।

এরমধ্যে কৃষ্ণ আর গৌরাঙ্গরা সপরিবারে ভারতে চলে গেল। ক্লাশ ফাইভে আমাদের থানার সকল ছাত্রছাত্রীদের সেন্টার পরীক্ষায় পাশ করেই কেবল হাইস্কুলে ভর্তি হবার নিয়ম ছিল। বিধান, ভজন, শশধর, বিরেন, সুখময়, ছালাম, বেলাল, এখলাস, এনায়েতরা প্রথম দফায় ফেল করে আর হাইস্কুলে পড়ার সুযোগ পেল না। আমরা হাইস্কুলে ভর্তি হবার পর জীবন খুব ভালো করা শুরু করলো। ক্লাশ সিক্স থেকে ক্লাশ সেভেনে ওঠার সময় জীবন চতুর্থ স্থান দখল করলো।

জীবন ইংরেজি আর বাংলায় খুব ভালো ছিল। অংকে একটু কাঁচা। এরমধ্যে বিধান স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিল। ঋষিকেশরা ভারতে চলে গেল। ছালাম, বেলাল, এখলাসরা তাদের নিজ নিজ বাবার সঙ্গে ক্ষেতের কাজ শুরু করলো।

হঠাৎ করেই সাপের কামড়ে ভজনের বাবা মারা গেল। ভজনের স্কুলে আসাও বন্ধ হয়ে গেল। এভাবে দুলছুট ছাত্রদের মধ্যে কেবল জীবন কৃষ্ণ ঘরামী আমাদের সঙ্গে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহন করতে পেরেছিল। জীবন অবশ্য ক্লাশ এইটে আমাদের সঙ্গে স্কলারশিপ পরীক্ষা দেওয়ার জন্যে দিঘীরজান মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে নির্বাচিত হয়েছিল। আমরা একসঙ্গে স্কলারশিপ দিয়েছিলাম আমি, প্রাণেশ, প্রকাশ, জীবন, নির্জন, আহসান, শাহনাজ আর বিকাশ।

ক্লাশ এইটে আমাদের ক্রমিক নম্বর ছিল আমার বরাবরই এক, কারণ আমি ছিলাম সব সময় ক্লাশের ফার্স্টবয়। প্রাণেশের দুই, শাহনাজের তিন, প্রকাশের চার, জীবনের পাঁচ, বিকাশের ছয়, আর আহসানের সাত। নির্জন হল আমাদের ইংরেজি শিক্ষক নরেন স্যারের ছেলে। নির্জন আমাদের এক ক্লাশ উপরে পড়তো। স্কলারশিপ দেওয়ার জন্য নাইনে না উঠে সে আমাদের সঙ্গে ক্লাশ এইটে থেকে গেল।

নির্জনের ক্রমিক নং ছিল ক্লাশ এইটে আমাদের সঙ্গে ৭০। আমরা আটজন স্কলারশিপ দিয়ে আমি আর প্রাণেশ স্কলারশিপ পেলাম। ক্লাশ নাইনে ওঠার ফাইনাল পরীক্ষায় আমি আবারো ফার্স্ট হলাম। প্রাণেশকে হারিয়ে নির্জন হয়ে গেল সেকেন্ড। প্রাণেশ হল থার্ড।

শাহনাজকে টপকে প্রকাশ হয়ে গেল ফোর্থ। জীবন ফিফথ, বিকাশ সিক্সথ, শাহনাজ সেভেনথ, আর আহসান হল অষ্টম। স্কুলে তখন আমাদের মধ্যে তুমুল হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। আমি ওদের চেয়ে মোটামুটি সুবিধাজনক ব্যবধানেই ফার্স্ট হতাম। আর নির্জন ও প্রাণেশ গায়ে গায়ে লড়াই করতো।

প্রকাশ আর জীবনও গায়ে গায়ে লড়াই করতো। শাহনাজ আর বিকাশও গায়ে গায়ে লড়াই ছিল। আর আহসানের সঙ্গে লড়াইয়ে যোগ দিল স্বপন খরাতী। এছাড়া যারা তখন আমাদের ক্লাশে ভালো ছিল তারা হল তাপস মল্লিক, মিনতী মল্লিক, পুতুল রায়, ঝর্না রায়, মানু, জাকির হোসেন, খোকন মজুমদার, ফারুখ খান, শেখ মোহাম্মদ রহিম। এদের সবারই এসএসসিতে প্ফার্স্ট ডিভিশান পাবার কথা ছিল।

কিন্তু আমরা মোট বারোজন পেলাম। তার মধ্যে প্রাণেশ আবার আমার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গোটা থানায় প্রথম হতে পারবে না বলে আমাদের সঙ্গে আর এসএসসি পরীক্ষা দিল না। ১৯৮৬ সালের এসএসসি পরীক্ষায় আমি গোটা থানায় প্রথম স্থান অধিকার করেছিলাম। আর প্রাণেশ পরের বছর ১৯৮৭ সালে গোটা থানায় ফার্স্ট হয়েছিল। আমরা যখন কলেজে ভর্তি হওয়া নিয়ে ব্যস্ত জীবন তখন চিত্ত'দার সঙ্গে ঝামেলা পাকিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে একা একা ভারতে চলে গেল।

আসরা যখন একাদশ শ্রেণী শেষ করে দ্বাদশ শ্রেণীতে তখন জীবন এসে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হল। একাডেমিকভাবে জীবন এই প্রথম আমাদের থেকে পিছিয়ে গেল। আমরা কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসলাম, হঠাৎ একদিন জ্যাঠিমা'র কাছে শুনলাম- জীবন আর কলেজেও যায় না। জুনিয়র পোলাপাইন নাকি জীবনকে ঠিকমতো সম্মান করে না। তাই সে স্বচ্ছায় কলেজ ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

আমি যখনই বাড়িতে যেতাম জীবনকে পরীক্ষা দেবার জন্য প্রস্তুতি নিতে উৎসাহ দিতাম। কিন্তু জীবনের একটাই কথা- তোরা সবাই পাশ করে চলে যাবার পর, চারপাশটা বড্ড ফাঁকা হয়ে গেছে। কারো সঙ্গেই ক্লাশের পড়াশুনা নিয়ে একটু আলাপ করব সেই সুযোগ নেই। আমাদের অঞ্চলে যারা তখন এইচএসসি পরীক্ষা দেবার কথা তারা সবাই জীবনের চেয়ে সত্যি সত্যিই অনেক জুনিয়র পোলাপাইন। আমরাও জীবনের অনেক জুনিয়র ছিলাম।

কিন্তু জীবন আমাদের সঙ্গে যেভাবে মানিয়ে নিয়েছিল সেভাবে আর নতুনদের সঙ্গে পারেনি। অনেক পিড়াপিড়ির পর দুই বছর শেষে জীবন এইচএসসি পরীক্ষা দিল। পাশ করলো। ডিগ্রিতে ভর্তি হল। কিন্তু আর শেষ করলো না।

জীবন হল আমাদের এলাকায় ঘরামী গোষ্ঠীতে প্রথম এসএসসি পাশ করা সূর্য সন্তান। প্রথম এইচএসসি পাশ করা চন্দ্রবাবু। কিন্তু জীবন আর ডিগ্রি পরীক্ষা আর দিল না। দিলে হয়তো ঘরামী গোষ্ঠীর প্রথম ডিগ্রি পাশের খেতাবটাও জীবনের নামের সঙ্গে যুক্ত হতো। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় শেষ না করতেই জীবন বিয়ে করলো।

জীবনের দুই ছেলে। উত্তম আর রাজীব। উত্তম গত বছর এসএসসি পাশ করেছে এ প্লাস নিয়ে। আর রাজীব আগামী বছর এসএসসি পরীক্ষা দেবে। জীবন এখন পুরাদস্তুর রাজমিস্ত্রী।

কৃষি মৌসুমে জীবন এলাকার একজন আদর্শ কৃষক। বর্ষা মৌসুমে নিজে মাছ ধরে। শীতের মৌসুমে যাত্রায় অভিনয় করে। অবসরে তাস খেলে। জীবন আমাদের এলাকায় সবচেয়ে তুখোর ইন্টারন্যাশনাল ব্রিজ খেলোয়ার।

ইন্টারন্যাশনাল ব্রিজ খেলে জীবনকে হারানো খুব কঠিন কাজ। জীবনের মনে মনে হিসাবটা একেবারে কড়ায় গণ্ডায় কেমন যেনো মিলে যায়। বাম পাশের বিপক্ষের খেলোয়ারের হাতে কি কার্ড আছে তা জীবন মুহূর্তে হিসেব করে ছক করে, সে অনুযায়ী রিক্স নিয়ে খেলে। আমার জীবনে জীবনের মতো সেরা ইন্টারন্যাশনাল ব্রিজ খেলোয়ার দেখিনি। জীবন কৃষ্ণ ঘরামী এখন একজন আদর্শ বাবা।

একজন প্রেমিক স্বামী। একজন নন-গ্রাজুয়েট রাজমিস্ত্রী। কিন্তু বিল্ডিংয়ের নকশা এবং নির্মাণে জীবন ভারী দক্ষতা অর্জন করেছে। আমাদের অঞ্চলে এখন যতো দালান বাড়ি, তার প্রায় সবগুলোই জীবনের নকশা ও নির্মাণে গড়ে উঠেছে। এছাড়া বর্তমানে জীবন সামাজিকভাবে একজন দক্ষ শালিশম্যান।

অনেকেই নানা ধরনের গ্রাম্য বিচার শালিশে জীবনকে বিচারক মানেন। এলাকার যে কোনো নির্বাচনে জীবন একটি বড় ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে কার বাক্সে ভোট যাবে তা নিয়ন্ত্রণ করার মতো জীবন একজন কুশলী রাজনীতিবিদও বটে। আমরা একসঙ্গে পড়াশুনা করলেও জীবনকে সবসময় আমি জীবন'দা ডাকতাম। আর জীবন'দা আমাকে ডাকতো ভাডি।

এখনো আমাদের সেই মধুর দাদা-ভাডির সম্পর্ক অটুট আছে। আমরা যখন ক্লাশ থ্রিতে পড়ি, প্রায় প্রতি সপ্তাহে জীবন দা তখন টিফিন পিরিয়ডে বলেশ্বরের হাটুজলে দাঁড়িয়ে ভাঙা ব্লেডে সেইভ করতো। আমাদের গালে তখন দাড়ির রেখাও দেখা যাবার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু জীবন দা নিজের সেইভের পাশাপাশি আমাদেরও সেইভ করে দিতেন। আমরা বলেশ্বরের হাটুজলে গালে কাদামাটি মেখে দাঁড়িয়ে থাকতাম দল বেধে।

জীবন দা সবার গালেই নিজের দক্ষ হাতে ভাঙা ব্লেড দিয়ে সেইভ করে দিতো। জীবন'দার সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি। সেগুলো আবারো কোথাও লেখার ইচ্ছে রইল। জয়তু জীবন দা। জয়তু ব্রিজ মাস্টার।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১০ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.