আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হ্যালো! কে? আবুল মাল সাহেব বলছেন? স্যার ... আমার মোবাইলে ব্যালেন্স নাই! ২০ টা টাকা ফ্লেক্সি করে দিবেন? প্লীজ?

মনে প্রাণে ঘৃণা করি রাজাকার। পাকিস্তানের দালালি করার শখ থাকলে এখানে ল্যাদাতে না আসার জন্য বলা হচ্ছে। ছাত্রজীবনের শেষের দিকে এসে মা আমাকে একটা মোবাইল টেলিফোন আর একটা গ্রামীণ সংযোগ কিনে দিয়েছিল। Siemens c55 মডেলের সেই সেটের দাম পড়েছিল ছয় হাজার টাকা আর সিমটা নিয়েছিল পাঁচ হাজার আটশ টাকা। একটা মোবাইলের জন্য আমি যে খুব অবুঝের মত বায়না ধরেছিলাম এমনটা না।

কিন্তু মায়ের কাছ থেকে তিনশ কিলো দূরে যেয়ে মাসের পর মাস থাকতে কিছুতেই কিছু ভাল লাগতনা আমার। একবার যখন ছুটিতে আসলাম দুদিন থাকার পর ফিরে যাবার জন্য ব্যাগ গোছাচ্ছি এমন সময় মা এসে বলল – আব্বু আর দুটা দিন থেকে গেলে খুব সমস্যা হবে তোর? আমি বলেছিলাম- হ্যাঁ মা সামনে একটা পরীক্ষা আছে, এখন ক্লাস মিস করলে নির্ঘাত ফেল করতে হবে। মা তখন বলল- একটা দিন থেকে যা। খুব সুন্দর একটা গিফ্‌ট দিব তাহলে। এরপর এক কথা দু কথার পর আমাকে যাওয়ার প্রোগ্রাম বাতিল করতেই হল।

যতটা না গিফট পাওয়ার লোভে তার চেয়ে অনেক বেশি মায়ের কান্নাভেজা কণ্ঠের আকুতি উপেক্ষা করার মত দুঃসাহস বা ইচ্ছা কোনটাই ছিল না বলে। পরদিন মা আমার জন্য একটা সংযোগ সহ মোবাইল কিনে এনে দিলেন। খুব আনন্দ হয়েছিল সুন্দর একটা বড়দের খেলনা হাতে পেয়ে, ভাল লাগছিল এটা ভেবে যে এখন আর আমার আমার মাকে আমার সাথে কথা বলার জন্যে আমার কোন বন্ধুকে ফোন করতে হবে না। কিন্তু এই আনন্দের পিছনে একটা নির্মম সত্য সেদিন আমার চোখের আড়ালেই থেকে গিয়েছিল। আমাকে একটি টেলিফোন কিনে দিতে গিয়ে আমার মা যে তার একমাত্র সোনার অলংকারটি বিক্রি করে দিয়েছেন সেদিন আমি সেটা জানতেও পারিনি।

অনেকেই জানেন সেই সময়ে মোবাইলে এক সেকেন্ড কথা বলতে হলেও গুনে গুনে সাতটি টাকা চলে যেত। তিনশ টাকার নীচে রিচার্জও করার উপায় ছিল না তখন। তারোপর একুশ দিন পর পর রিচার্জ করতেই হতো লাইন জীবিত রাখতে হলে। একটা তিনশ টাকার কার্ড রিচার্জ করার পর আপনি একটি টাকাও খরচ করুন আর নাই করুন ঠিক একুশ দিন পর আবার আপনাকে রিচার্জ করতেই হবে! এরপর মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়ে গেল। নতুন নতুন অনেক মোবাইল কোম্পানি এল, নানা রং তামাশার প্যাকেজ প্ল্যান এলো গেলো।

কত আজব এবং আজিব বিজ্ঞাপন দেখলাম আমরা, মাঘ মাসের শীতে একদল তরুণ তরুনির উদ্দাম নৃত্য দেখলাম, অতি দরিদ্র মাছ বিক্রেতার পুত্রকে দেখেছি বিশেষ কোন মোবাইল কোম্পানির কল্যাণে বড়লোক হয়ে যেতে। তবু আজো মাস শেষে মোবাইলের খিদা মেটাতে এখনো সেই কাড়ি কাড়ি টাকাই গুনে যাচ্ছি। মোবাইল কোম্পানিগুলোর চটকদার সব বিজ্ঞাপন আর ভিন্ন ভিন্ন সময়ে প্রয়োজনের ভিন্নতার দরুণ এযাবৎ কত ধরনের সিম আর প্যাকেজ যে ব্যাবহার করে ফেলেছি তার হিসেব কেউ চাইলে দিতে পারবোনা নিশ্চিত। এখন পেশাজীবন। ছাত্রজীবনের ‘যা খুশি তাই, করতে দ্বিধা নাই’ টাইপের মজার জীবন পিছনে ফেলে এসেছি।

পেশাজীবনে এসে বুঝেছি এতদিন যা কিছু জানতাম, যা কিছু ভাবতাম তার প্রায় কিছুই ঠিক ছিলোনা। জীবন অনেক কঠিন, অনেক নির্মম। পুরনো দিনে বন্ধুকে যখন টিউশানির টাকায় কাচ্চি খাওয়াতে নিয়ে যেতাম তখন সেটা একদম গায়ে লাগত না। আর এখন যদি রিকশাওয়ালাও দুটা টাকা বেশি ভাড়া নিয়ে নেয় তবে মনে মনে তার গুষ্ঠি উদ্ধার না করে ছাড়ি না। এই দুর্মূল্যের বাজারে কিভাবে একটা টাকা বাঁচানো যায় সেই চেষ্টাটা অবচেতন মনে থেকেই যায় সবসময়।

তাই মোবাইল টেলিফোন নামের যন্ত্রণাটাও খুব বুঝে শুনে ব্যবহার করি আজকাল। গত প্রায় মাস দু’এক ধরে আমাদের বাসার কলিং বেলটা অকেজো হয়ে পড়ে আছে। বাড়িওয়ালাকে বেশ কয়েকবার বলার পরও সেটা ঠিক হয়নি, তাই যতবার আমাদের ঘরের কেউ বাসায় ঢোকে ততবারই এই কলিং এর কাজটা আমরা মোবাইলে সাড়ি। ‘মা গেট খোল’ কথাটা বলতে যেহেতু তিন সেকেন্ডের বেশি লাগেনা সেহেতু মাত্র ৩*২= ৬ পয়সার এই ডাকাডাকিতে আমার খুব একটা অসুবিধা হচ্ছিল না। কিন্তু আজ সকালে অফিস আসার পথে পত্রিকা হাতে নিয়ে দেখলাম আমাদের অতীব জ্ঞানী অর্থমন্ত্রী আবুল মাল এখানেও একটা ‘রাবিশ’ ঢোকানোর ব্যবস্থা করেছেন।

‘ I am sorry যে আমি এটা বলছি, but আমাকে বলতেই হচ্ছে যে তিনি আসলেই একটা মাল!’ কিছুদিনের মধ্যেই আমরা মোবাইল কোম্পানিগুলোর মনকাড়া অন্যসব অফারের মতোই নতুন আরেকটা আকর্ষণীয় অফার পেতে যাচ্ছি। কি সেই অফার? বিদ্যুতের ঘাটতি কমানোর জন্য প্রতি মোবাইল ফোনকলের ওপর ১৫ থেকে ২০ পয়সা সারচার্জ আরোপ করতে যাচ্ছে সরকার...অর্থাৎ কোনো মোবাইল ফোন থেকে কল করলেই প্রতিবার ১৫ থেকে ২০ পয়সা করে বাড়তি ব্যয় হবে গ্রাহকের... কি বুঝলেন? আপনার ঘরে বিদ্যুতের লাইন থাক বা না থাক, আপনি সারাদিন সারারাত লোড শেডিঙের যাঁতায় পড়ে নরক যন্ত্রণা ভোগ করুন আর না করুন আপনাকে দান খয়রাতের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে সরকারের প্রতি! আর দিবেনই বা না কেন বলুন? যারা আপনাকে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা দিচ্ছে, আপনার ঘরে বলতে গেলে বিনা খরচায় গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ পৌঁছে দিচ্ছে, বাজারে নামমাত্র মূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার সুযোগ করে দিচ্ছে, ঘরে যেয়ে যেয়ে আপনাকে চিকিৎসা সেবা পৌঁছে দিচ্ছে তারা যদি এতো বড় আশা করে আপনার কাছে একটা কিছু চায় তাহলে আর দিতে আপত্তি কি বলুন? তবে আমার আপত্তিটা সেখানে নয়। আপত্তি হল এই জায়গায় যে- আমাদের কাছ থেকে তো এই রাজনৈতিক নেতাগুলো সবই নিল একেক করে। এখন যদি আবারো আমাদের কাছ থেকে ভিক্ষা নিতেই হয় তবে সেটা ভিক্ষার মত করেই নেয় না কেন? আবুল মাল সাহেব বাংলার প্রতি ঘরে ঘরে তার লোক পাঠিয়ে দিক, সেই লোকেরা এসে চাঁদমুখ নিয়ে বলুক যে আমাদের মাল স্যার পাঠিয়েছেন, দুইডা খয়রাত দেন! তাতো করছে না, এমন ভাবে তারা আমাদের কাছ থেকে টাকা নিবে বলে ঠিক করেছে তাতে মনে হচ্ছে যে এটা তাদের বাপ দাদার অধিকার! দেশের একটা খাতের উন্নতি করতে যদি জনগনের প্রত্যক্ষ সাহায্য প্রয়োজন হয় তবে আমি জানি বাংলাদেশের মানুষের অন্তত এই আন্তরিকতাটুকু আছে যে তারা সবাই মিলে একসাথে সেই সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে সানন্দে। কিন্তু আমার কথা হল – এই যে আমরা প্রতিদিন সরকারকে নানা ভাবে দিয়ে যাচ্ছি দুই টাকার শেভিং ব্লেড থেকে শুরু করে দুই হাজার টাকার চাইনিজ মোবাইল যাই কিনিনা কেন, সরকার তা থেকে রাজস্ব কেটে নিচ্ছে সে টাকা কোথায়? এই যে দিয়েই যাচ্ছি প্রতিনিয়ত তার বিনিময়ে আমরা দেশের মানুষগুলো কি পাচ্ছি তাদের কাছ থেকে? যে কোন মুহূর্তে গুম বা খুন হয়ে যাবার আতংক, রাস্তার মাঝখানে খাল-বিল, বাজারে অগ্নিমূল্য, দিনের বেলা ট্র্যাফিক জ্যাম, রাতের বেলা লোডশেডিং এর নরক যন্ত্রণা! আর কত সইব আমরা? আর কত? বাংলাদেশের সরকারী বেতন কাঠামোয় যে লোক প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা হিসেবে নতুন চাকরিতে ঢুকল তার বেতন সর্বসাকুল্যে বিশ হাজার তিনশত সত্তুর টাকা (এটা হল সরকারী বেতন স্কেলের নবম গ্রেড)।

আর সেই স্কেল অনুসারে একজন সরকারী কর্মকর্তার বেতন বছর বছর বাড়তে থাকে এবং উপরের গ্রেডের দিকে এগোয়। এই স্কেলের সবচেয়ে উপরের বেতন হল ৪০০০০ টাকা। অর্থাৎ একজন সরকারি কর্মকর্তার বেতন এর চেয়ে বেশি হতে পারেনা। কিন্তু আপনি আপনার পুরোটা চোখ খুলে তাকান একবার তাহলে দেখবেন আমাদের দেশের মন্ত্রী, সচিবদের ঢাকাতে তিন চারটা করে ফ্ল্যাট, কোটি টাকার দুই তিনটা করে গাড়ি আছে। আপনার আমার ছেলে মেয়ে ভাই বোনদের আমরা হয়তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার টাকাটা ঠিক মত দিতে পারি না কিন্তু এই লোকগুলোর ছেলেমেয়েরা প্রায় সবাই পড়াশোনা করে উন্নততম দেশগুলোর নামি দামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে।

আমার জিজ্ঞাসা হল এই টাকা তারা কোথায় পায়? সর্বোচ্চ চল্লিশ হাজার টাকার চাকরি করে মাসে মাসে তারা লক্ষ লক্ষ টাকা কিভাবে খরচ করে? এই টাকা গুলো কি আপনার আমার টাকা না? এদেশের সরকারি অফিসগুলোতে টেবিলের নীচ দিয়ে (এখন অবশ্য উপর দিয়েই হয়) যত টাকা যাওয়া আসা করে তার অর্ধেকও যদি দেশের কাজে ব্যয় করা হয় তবে শুধু বিদ্যুৎ খাত কেন প্রতিটি ক্ষেত্রেই তো আমাদের উন্নতির সবচেয়ে উপরের লেভেলেই থাকার কথা ছিল, তাইনা? ঢালাও ভাবে বর্তমান মন্ত্রী এমপিদের নামে বলতে থাকলে আপনারা কেউ কেউ হয়তো আমাকে কোন ট্যাগ লাগিয়ে দিতে পারেন। না ভাই তেমন কোন ট্যাগ খাওয়ার কোন ইচ্ছে আমার নেই, কোন বিশেষ দল বা লোকের প্রতি কোন আলগা দরদও আমার নেই। তবে হ্যাঁ প্রবল একটা ঘৃণা আমার আছে সেটা আমি উঁচু গলায় সবাইকে বলে দিতে চাই- ৭১ এ বাংলায় জন্মে যে সকল বেজন্মা তার নিজ দেশের মা বোনদেরকে তুলে দিয়েছিল পাক দোসরদের হাতে তাদের প্রতি আমার ঘৃণা ঠিক ততোটুকুই যতটুকু ঘৃণা একটা মানুষ নিজের মাঝে ধারন করতে পারে। এই কালের মন্ত্রী এমপিরা আছে নিজেদের আখের গোছানোই ব্যস্ত, জনগনের বুকে বাতাস, পেটে খাদ্য আর চোখে শান্তির নিদ্রা আছে কি নাই সেটা নিয়ে এদের কোন মাথা ব্যথাই নেই। এইতো কয়েকটা দিন আগেই পত্রিকায় পড়লাম বর্তমান সময়ের প্রায় আট দশজন সচিব নাকি গত ছয় মাসের মধ্যে আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড আর মালয়শিয়াতে বাড়ি কিনেছে এবং ইতোমধ্যে তাদের পরিবারের সদস্যদেরকে সেখানে পাঠিয়েও দিয়েছে! এবার বুঝুন অবস্থা! আমাদের টাকায় তারা বিদ্যুৎ তৈরি করে সেই বিদ্যুতে তাদের ঘরের একাধিক এসি চালাবে, আমাদের দিবে লোড শেডিং উপহার।

আর এভাবে যখন সব চুষে নিতে নিতে আমরা ছিবড়ে হয়ে যাবো, কিছু আর বাকি থাকবে না আমাদের মাঝে তখন তারা সুন্দর আখেড় গুছিয়ে বিদেশে পাড়ি জমানোর রাস্তা করবে। একদিকে সরকার তার উন্মাদ মন্ত্রীসভা দিয়ে আমাদের প্রাণের এই দেশটাকে একটা সার্কাস মঞ্চ বানাচ্ছে, আরেক দিকে বিরোধী দল যে দলের জন্মই হয়েছিল সেনা ব্যাড়াকে তারা লোক দেখানো গণতন্ত্র বলে চিৎকার করতে করতে ঠোঁটের দুই কোনে নোংরা থুথু জমিয়ে ফেলছে। আর ঠিক তাদের পিছনে দাঁড়িয়ে খুশিতে বগল বাজাচ্ছে এই মাটিতে জন্মানো সর্বকালের সবচেয়ে ঘৃণ্য জানোয়ার রাজাকার গুলো। আর এইসব দেখেও না দেখতে দেখতে আমরা আমজনতা প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠি, রোজ অফিসে যাই ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্যামের মধ্যে সিদ্ধ হয়ে, কাজ শেষে বাড়ি ফিরে দিয়াশলাই খুঁজতে লাগি মোমবাতি জ্বালাবো বলে! এই আমাদের জীবন। বুক ফেটে কান্না আসে মাঝে মাঝে কিন্তু কাঁদতে পারিনা, কান্নাগুলো বাষ্প হয়ে গলার মাঝে এসে আটকে থাকে! খুব কষ্ট হয়! তবে কি ভুল সময়ে জন্মেছি? এই জন্ম কি তবে আজন্ম পাপই হয়ে রবে? এরচেয়ে কি ৭১ এ জন্ম নিয়ে যুদ্ধের মাঠে মরে যাওয়াই ভাল ছিলোনা? বাঁচা না হয় নাই হতো অন্তত মরণটাতো হতো বাঁচার মত! ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।