আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এরপর না হয় সমস্বরে কোরাস গাইবো- সড়ক দুর্ঘটনা প্রাকৃতিক, অপ্রতিরোধ্য !

এ আকাশ এমন আকাশ, কখনো ছায় মেঘে- সে আবার সুখেই ভাসে, দখিন হাওয়া লেগে একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না। তা শুধু দুর্ঘটনাকবলিত ব্যক্তির জন্য অভিশাপ নয়, বরং তার শুভাকাঙ্ক্ষী, স্বজন-বান্ধব সকলের জন্যই মত্ত বিভীষিকা। মৃত্যু অনিবার্য আল্লাহ্‌র বিধান। যার উপর কারো হাত নেই, তা ঘটবেই এবং বৈশ্বিক শক্তি দিয়ে প্রতিরোধ করা অসম্ভব। সড়ক দুর্ঘটনা আমাদের দেশে যে প্রবল বিক্রমে ঘটছে- তাতে মনে হয়, আমরা আমাদের প্রচেষ্টার হাল ছেড়ে দিয়ে বসে আছি।

যা ঘটে ঘটুক- কোন ধরণের প্রচেষ্টা বৈ এরূপ মনোভাব পালন করলে তা আত্মঘাতী বলেই প্রতিভাত হবে প্রায়োগিক দিক দিয়ে আইন যে দেশে যত সমৃদ্ধ সে দেশ তত বেশি সুশৃঙ্খল। সড়ক দুর্ঘটনা নিরসনে আইনের উল্লেখযোগ্য কিছু ভূমিকা অবশ্যই আছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, যানবাহন সংক্রান্ত আমাদের যে আইন আছে, তা একে তো মান্ধাতার আমলের, আবার দুর্ঘটনা রোধে সরাসরি কোন ধারার সন্নিবেশ একেবারেই নেই। একটি হল ব্রিটিশ প্রণীত The Vehicles Act, 1927 আরেকটি হল The motor vehicle ordinance, 1983। বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৩০৪ বি ধারায় সড়ক দুর্ঘটনার কাণ্ডারিকে শাস্তির আওতায় আনার বিধান যদিও রয়েছে, বাস্তবে কতজন আইনের মুখোমুখি হচ্ছে? কেউ পালিয়ে যাচ্ছে, কেউ বা কৌশলে মুক্তি পাচ্ছে- আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে।

প্রশ্ন আসতে পারে, আইনের ব্যাখ্যা শুরু করে দিলাম নাকি? না, আসলে সচেতনতা বা সতর্কতা কতটা জরুরী- আমরা সবাই জানি, মানি। তবে আইনের কার্যকর উপস্থিতি যে কত জাদুকরী ভূমিকা রাখতে পারে, তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। আমি কুয়ালালামপুর ভ্রমণ করি ২০০৫ এ- আট বছর আগে। ওদের যে ট্র্যাফিক ব্যবস্থা দেখেছি, এক বাক্যে অনুসরণ যোগ্য। এয়ারপোর্ট থেকে শহরের মূল অংশ ঘণ্টা দেড়েকের পথ, হাইওয়েতে পাবলিক কোচ গুলোর গতিসীমা ১১৫-১২০ কিমি (অবশ্যই আইনের আওতায়)।

দেখলে অবাক হতে হয়, কত নিখুঁত এবং নিয়ন্ত্রণপূর্ণ গাড়ি চালনা তারা করে। ওভারটেকিং এর বালাই তো নেই ই, খোদ একটা হর্ন বাজাতে হয়না, আর একটা গাড়ির পেছন পেছন আরেকটা গাড়ির ঝাঁকুনি দুরের কথা। তুলনায় আসুন, বাংলাদেশে অবস্থা একেবারে বিপরীত কোণে। অনেকেই মনে করতে পারেন, এ আর এমন কি? ইউরোপ, আমেরিকার জাঁকালো সব শহরগুলো তো এমনই। মালেশিয়ার প্রসঙ্গ এই কারণে আনা যে- তারা বহু প্রাচীন স্বাধীন রাষ্ট্র নয়, বরং আমাদের স্বাধীনতার সময়ে তারা মানে-গুণে পিছিয়েই ছিল।

আর আজ, আইন-শৃঙ্খলার রথে সওয়ার হয়ে তারা কোথায়, আমরা কোথায়? আমাদের মিষ্টি মিষ্টি বুলি আওড়ানোর তুলনা হয় না, কাজের বেলায়- ডুমুরের ফুল। সড়ক দুর্ঘটনা আইনের ব্যাপকতাময় পরিভাষায় Accident on Act of God বা Force Mesure, যা ঘটবে, অনিবার্য। তবে আইনবোদ্ধা গণ যখন এসব নামকরণ করেছিলেন, তখন হয়তো সড়ক দুর্ঘটনার সীমিত দৌরত্ন্য ছিল। আদতে Act of God তথা Force Mesure হল তা, যখন যথাসম্ভব প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থা, সর্বোচ্চ সতর্কতা থাকা সত্ত্বেও কোন দুর্ঘটনা ঘটে। এ অর্ধে সড়ক দুর্ঘটনাকে নিছক দুর্ঘটনা বলে আমাদের দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার কোন অবকাশ নেই।

আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গেছে- বলার মাধ্যমে অসীম স্রষ্টার কোর্টে বল ঠেলে দিচ্ছি, অথচ আল্লাহ সতর্কবাণী জারি করেছেন- তোমরা সতর্ক দৃষ্টি রাখ, চেষ্টা করো- বান্দা যতক্ষণ না পর্যন্ত অগ্রসর হয়, আমি কোন সহায়তা করি না। কাজেই সময় এসেছে- সমস্যার শিকড়মূলে কুঠারাঘাত করার। আমাদের সড়ক/ ট্র্যাফিক পরিস্থিতির সমগ্র চালচিত্র পরিবর্তন, পরিমার্জন, ফকফকা করার এই তো সম্য়। বাসের সিটে আরোহণ করার আগে এক ফাইল গাঁজা আর সিটে বসে ঘুম ঘুম চোখে, ঠোটে সিগারেট ধরিয়ে স্টিয়ারিং ধরা, অতঃপর মোবাইলে খোশ গল্পে মেতে ওঠা যে ড্রাইভারের নিত্য অভ্যাস- সে গাড়ির কষ্ট করে দুর্ঘটনায় পতিত হতে হবে না, দুর্ঘটনাই সে গাড়িকে খুঁজে নেবে। আইনের সময় উপযোগী আধুনিকায়ন অত্যন্ত জরুরী।

আমাদের আইনে যে ধরণের ধারার সন্নিবেশ, তা মহানগরীয় যানবাহন গুলোর জন্যে সামঞ্জস্য পূর্ণ। আরো গভীরে যেতে হবে- ড্রাইভার নিয়োগে সর্বোচ্চ যত্ন, যাচাই-বাছাই, গাড়ি চালনার সময়কালীন, আগে-পরের কানুন (manner), চলন্ত বাসে মনোযোগিতা, তাদের উপযোগী প্রশিক্ষণ- সব আইনের আওতায় আনা অবিকল্প বাঞ্ছনীয়। এতে করে সচেতনতার বীজ বপিত হবে তাদের মননে। আমাদের কিছু কিছু মহাসড়ক বিশ্বমানের, সন্দেহ নেই; তবে শুধু সেই সড়কগুলোতে নয় বরং সব রাস্তা দিয়েই গাড়ি চলে- তাই অনুন্নত রাস্তার সংস্কার অপরিহার্য। অনুনমেয় বাঁকগুলো চিহ্নিত করে যথার্থ পদক্ষেপ নিতে হবে।

আইন ভঙ্গকারীর শাস্তি হতে হবে চরম কঠোর, কোন আপোষ বা হালকা মীমাংসা করলে কাজ হবেনা। কুয়েতের সেই অপূর্ব আইনচর্চার প্রাসঙ্গিক অবতারণা করছি- তাদের সড়ক অধিদপ্তরের চেয়ারম্যান গাড়ি পার্কিং করতে গিয়ে একটু গড়িমসি করেছিল, সঠিক পার্কিং স্লটে গাড়ি রাখতে দেরি হয়ে যায়। সাথে সাথে ডিউটি পুলিশ অফিসারের রিপোর্ট এবং স্পট কেইস! চেয়ারম্যানও কম যান না! কাজ শেষ করে অফিস থেকে বের হয়ে যেইনা গাড়িতে উঠতে যাবেন, দেখেন সেই পুলিশ পাশেই সিগারেট ধরানোর প্রয়াস নিয়েছেন। তৎক্ষণাৎ আইডি কার্ড বের করে পুলিশকে পাবলিক প্লেসে ধূমপানের অপরাধে স্পট কেইস দিয়ে অন্য এলাকায় প্রত্যাহার করে দেন সেই চেয়ারম্যান। এই না রসময় আইনের প্রয়োগ! আমাদের দেশে হলে কি হত, সহজেই অনুমেয়।

তাই আইন এবং জনসচেতনতার যুগপৎ কার্যক্রম দরকার। আমরা সচেতন হব, আইনে সব সন্নিবেশিত হবে, সচেতন হতে বাধ্য হব। নিয়ম ভাঙ্গার অনিয়ম দেখাতে গেলেই শাস্তি খাবো। মনে হতে পারে, বড্ড কঠিন কাজ, দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। তা নয় একেবারেই- আইনের উৎকর্ষ আসুক, সচেতনতা বেড়ে যাবে, সমস্যার তীব্রতা হ্রাস পাবে কয়েক বছরেই, সে নিশ্চয়তা দেওয়া যায়।

দায়হীনতা, অবহেলার মূলোৎপাটন না করে উপর দিয়ে পানি ঢাললে দুর্ঘটনা নামের ভাইরাস/আগাছা দমন পরিষ্কার অসম্ভব। ক্ষমতাপ্রাপ্ত সুধিজনদের প্রতি অনুরোধ, শুরুতে একটু ঝাঁকুনি আসলেও ঠিকই কাজ হবে। আমজনতার কোন ক্ষমতা নেই, আইনের প্রতিভূ এবং রাষ্ট্রনায়কগণ পারেন সড়ক দুর্ঘটনা মোকাবেলায় দুর্মর হাতিয়ার হতে। আমরা আইনের ফাঁকফোকর পূরণ করে, যথা সম্ভব আনুসঙ্গিক অসঙ্গতি দূর করে, পূর্ব সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়েই দেখিনা- এরপর না হয় সমস্বরে কোরাস গাইবো- সড়ক দুর্ঘটনা প্রাকৃতিক, অপ্রতিরোধ্য (Act of God)! ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।