আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বন্ধুদের আমলনামা-৫ : : রাজা ভানু সিং রাজীব নূর ।। রেজা ঘটক

বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা... একনিষ্ঠ উপন্যাস পাঠক হিসেবে বন্ধুদের মধ্যে যার জুরি নেই সে হল রাজীব নূর। রাজীব নূর নিজেও গল্প লেখেন। নব্বই দশকের গল্পকারদের মধ্যে রাজীব নূরও অন্যতম। কিন্তু সংবাদপত্রের বিশাল বিশাল লেখার ভারে রাজীবের গল্প ধীরে ধীরে কোথায় যেনো জোছনা দেখতে চুপ করে বসে আছে। অথবা রাজীব গোপনে কোথাও সব লিখে রাখছে যার খবর পাওয়া নিতান্তই কঠিন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে অনার্স মাস্টার্স করার সময় থেকেই সংবাদপত্রে হাতেখড়ি। চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদী পত্রিকায় তখন রাজীবের গল্পও ছাপা হত। চট্টগ্রাম পর্ব শেষ করে ঢাকায় এসে আবার তখনকার দিনে সবচেয়ে উচুমানের পত্রিকা দৈনিক ভোরের কাগজে যোগ দিল রাজীব। ততোদিনে সাংবাদিকতার পাঠেও হাত পেকে গেছে। ভোরের কাগজ থেকে যখন মতিউর রহমান বেরিয়ে গিয়ে দৈনিক প্রথম আলো বের করার চিন্তা করলেন, তখন সেই দলে রাজীব নূরও রইলেন।

সবাই বলেন, মতিউর রহমান সবচেয়ে যে রিপোর্টারকে বেশি স্নেহ করেন সে হল আমাদের রাজীব নূর। আমরা একই বছর এসএসসি, এইচএসসি, অনার্স ও মাস্টার্স পাস করলেও ঢাকায় পরিচয়ের প্রথম দিন থেকে আমি ডাকি রাজীব দা। আর রাজীব নূর আমাকে ডাকেন শুধু রেজা। আমাদের সসম্পর্কটা আপনা আপনি'র। ২০০২ সালে আমিনুর রহমান মুকুলের নের্তৃত্ব আমরা যখন পালাকার গঠন করি তখন থেকই রাজীব দা'র সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতার শুরু।

তারপর ২০০৩-এর জুন মাস থেকে প্রায় আড়াই বছর আমরা একই বাসায় ব্যাচেলর লাইফ যাপন করেছি। রাজীব দা খুব ভালো গরুর মাংস রান্না করতে জানেন। আর খুব ভালো নুডুলস বানাতে পারেন। রাজীব দার সঙ্গে রাজীব'দার কম্পিউটারে আমরা ১৯ কাঁঠালবাগানের বাসায় প্রচুর ছবি দেখেছি। রাজীব দার বইয়ের সংগ্রহ ইর্ষা করার মতো।

সেই সুযোগে আমি প্রচুর বই পড়েছি তার বুক সেলফ থেকে। রাজীব নূরের বিয়ের আগের এবং বিয়ের পরের দুটো পর্বই আমার জানা। সেই বিষয়ে কথা না বলাই ভালো। কালো সে যতোই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ চোখ, কৃষ্ণকলি বলে গাঁয়ের লোক... একবার এফডিসির উপর রাজীব নূর একটা সিরিয়াল নিউজ করলেন। রোজ প্রথম আলোতে তা ধারাবাহিক ছাপা হচ্ছিল।

সেই সময় রাজীব দা'র গলা ভাঙা। যতো ফোন আসে রিসিপ করি আমি। এফডিসি থেকে প্রাক্তন অভিনেতা রাজীব সাহেব ফোন করে হুমকি দিলেন। এসব তথ্য তুমি কোথায় পেলে? আসো, দুপুরে একত্রে লাঞ্চ করি? রাজীব দা একটু ঘাবড়ে গেলেন। প্রথম আলো'র ক্রাইম বিট করেন তখন পারভেজ খান।

তিনি রাজীব দাকে সাজস যোগালেন। রাজীব দা এমনিতে খুব দুঃসাহসী। কিন্তু কেউ হুমকি দিলে তখন তার নরম দিলের খবরটা বোঝা যায়। ততোদিনে রাজীব নূরকে প্রথম আলো থেকে মটর সাইকেল দেওয়া হয়েছে। দিনে আমাদের বন্ধু শিল্পী শাহীনুর রহমান, ডাক্তার কল্লোল চৌধুরী, গোলাম রসুল আর রেজাউল কবির মাহমুদ নাছিম রাজীব দাকে মটর সাইকেল পালানোর প্রশিক্ষণ দেন।

আর রাতে কখনো আমি যাই কখনো নাছিম যায়। এভাবে পালা করে রাজীব দাকে মটর সাইকেল চালানো শেখানো হল। মটর সাইকেল চালানো শিখলেন শাহীনের মটর সাইকেল দিয়ে। কারণ ওটা একটু সাইজে ছোট। কয়েক দিন না যেতে প্রথম আলো থেকে পাওয়া মটর সাইকেল চালানো শুরু করলেন।

বন্ধুদের চোখ তখন ছানাবড়া। একবার রাতে আমি আর রাজীব দা ধানমন্ডি চক্কর মেরে সাত মসজিদ রোড ধরে মোহাম্মদপুর হয়ে আসাদ গেটের দিকে যাচ্ছি। রাত প্রায় বারোটা। ফাঁকা রাস্তা। রাস্তার বামপাশে সারি সারি থামানো রিক্সাভ্যান।

কি মনে করে হঠাৎ রাজীব দা সেই ভ্যানের স্তূপের মধ্যে মটর সাইকেল ঢুকিয়ে দিলেন। পাল্টি খেয়ে দু'জনের অবস্থা কেরোসিন। দুঃখ ভুলতে রাজীব দা জাফরকে ফোন করলেন। জাফরের বাসা ফিজিক্যাল কলেজের পেছনে। সাত মসজিদ রোডে জাফর আসলো।

আমরা চায়ের দোকানে চা খেলাম। জাফর বললো, দে, আমি একটু ট্রাই করি। মটর সাইকেল নিয়ে জাফর সাই করে আবাহনী মাঠ পর্যন্ত ঘুরে ব্যাক করলো। রাজীব দার সেই দৃশ্য বিশ্বাস হচ্ছিল না। জাফরও মটর সাইকেল চালাতে পারে? এটা রাজীব নূরের বিশ্বাস করতে আর চোখে সেই দৃশ্য সরাসরি ধারণ করতে টাসকি খাবার দশা।

কথায় কথায় বললেন, জাফর পারলেও আপনি নিশ্চয়ই পারেন না। জবাবে বললাম, আমি পারি কিন্তু ঢাকায় কখনো চালাইনি। রাজীব দার চোখে আবারো অবিশ্বাসের ছায়া। পরে কলাবাগান অফিসার্স কোয়ার্টারের মাঠে এসে আমাকে মটর সাইকেল চালিয়ে দেখিয়ে প্রমাণ করতে হয়েছিল যে, আমিও পারি। তারপর রাজীব দা বায়না ধরলেন, আপনি রাস্তায় পারেন না? পরে কলাবাগানের অফিসার্স কোয়ার্টারের ছোট্ট রাস্তায় চালিয়ে দেখালাম যে, নিশ্চয়ই বড় রাস্তায়ও পারার কথা! ততোদিনে রাজীব দা কাঁপাকাঁপি নিয়ে চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

একরাতে হঠাৎ শাহীনের বউ রাজীব দাকে ফোন করে বললো, সন্ধ্যা থেকে শাহীনের কোনো খবর নাই। জানা গেল বিকালে গোলাম রসুল আর শাহীন উত্তরা একটা অফিসের কাজে বেরিয়েছিল। রাজীব দা বললো, নিশ্চয়ই অফিসে রাত জেগে গোলাম রসুলের কোনো কাজ করছে শাহীন। আমাদেরও সেই ধারণা হল। তবু নিশ্চিত হবার জন্যে আমরা কাঁঠালবাগান থেকে মটর সাইকেল নিয়ে বের হলাম।

সোজা সিদ্দেশ্বরী শাহীনের অফিসের সামনে গিয়ে দেখি অফিসে কোনো আলো নেই। গেইট বন্ধ। তার মানে ওরা উত্তরা থেকে ফেরেনি। আমাদের দু'জনের মোবাইলেই টাকা ফুরিয়ে গেছে। সিদ্ধান্ত হল, প্রথম আলোতে গিয়ে কয়েক জায়গায় ফোন করা হবে।

তারপর ঢাকা মেডিকেলে চেক করতে যাবো। উল্লেখ করা উচিত, তখনকার দিনে প্রায়ই শাহীন আর গোলাম রসুল মটর সাইকেল অ্যাকসিডেন্ট করতো। আমারা নিউ বেইলী রোড ধরে মগবাজারের দিকে টার্ন করব। বিপরীত দিকে বেশ গতিতে বিশাল সাইজের ট্রাক আসছে। আমাদের উচিত ট্রাক চলে যাবার পর রাস্তা ক্রোচ করা।

কিন্তু রাজীব দা ট্রাককে পাত্তা দিলেন না। আমরা যাচ্ছি, ট্রাকও আসছে। রাজীব দা হঠাৎ কি মনে করে জায়গায় ব্রেক কষে দিলেন। ট্রাক চালক রাজীব দা'র চেয়ে দক্ষ। কোনো মতে ফুটপথে তুলে দিয়ে আমাদের সেইফ করলেন।

আমার গায়ে মরনের বাতাস ছুঁয়ে গেল। এখনো কেউ যদি ভিকারুন নেছা স্কুলের ওই ক্রোচিংয়ে টেলিফোন থাম্বাটা একটু খেয়াল করেন, দেখবেন ওটা দেয়ালের দিকে ঝুঁকে দক্ষিণে সিজদা দেবার ভান করছে। প্রাক চালক বাজখাই গলায় আমাদের বকা দিলেন। আমরা বকা খেয়ে মটর সাইকেল না চালিয়ে ঠেলতে ঠেলতে প্রথম আলোতে পৌঁছালাম। সেখানে মটর সাইকেল রেখে রাজীব দা অনেক জায়গায় ফোন করলেন।

তারপর আমরা ঢাকা মেডিকেল ঘুরে আবার প্রথম আলো থেকে মটর সাইকেল নিয়ে যখন ব্যর্থ হয়ে ফিরছি, তখন শাহীনের বউয়ের মোবাইলও বন্ধ। পরে জানা গেল শাহীন বাসায় যাবার পরেই শাহীনের বউ মোবাইল সুইস অফ করেছিল আর শাহীনের ফোনে চার্জই ছিল না। হুট করে একদিন রাজীব দা প্রথম আলো'র চাকরিটা ছেড়ে দিলেন। একটা বিজ্ঞাপনী সংস্থার অফিস দিলেন পান্থপথ। তিন বন্ধু পার্টনার।

আমাকেও পার্টনার হবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। আমার টাকা নাই তাই হই নাই। কবি শাহেদ কায়েস, রাজীব নূর আর আরেকজন মিলে সেই অফিস। জাকজমক করে সাজানো হল। অনেকগুলো কম্পিউটার কেনা হল।

প্র্রসিডেন্ট সেক্রটারির আলাদা আলাদা রুম। বিশাল কারবার। দৈনিক সংবাদপত্রের এক্সকুলুসিভ নিউজগুলো তারা সেই অফিসে আর্কাইভ করা শুরু করলো। কয়েক মাস না যেতেই রাজীব নূর সেই ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে পান্থপথে আরেকটা বিজ্ঞাপনী সংস্থা দিলেন। এবার পার্টনার ছয় জন।

রাজীব নূর। রাজীব নূরের বউ তনূজা আতবর, কবি শাহেদ কায়েস, সত্যজিৎ পোদ্দার বিপু, কবি অতনু তিয়াস, আর কে যেনো একজন। সংস্থার নাম দিল যোগসূত্র। ঐতিহ্য-প্রথম আলো গল্প লেখা প্রতিযোগিতার আয়োজন করলো যোগসূত্র। ভারী মার মার কাট কাট ব্যস্ততা।

প্রজেক্ট যখন শেষ তখন ঐতিহ্যের আরিফুর রহমান নাঈম আর রাজীব নূরের মধ্যে দেখা দিল এক রহস্যময় দ্বন্দ্ব। সেই দ্বন্দ্বের জের ধরে রাজীব নূর যোগসূত্রের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে পাঠসূত্র প্রকাশনী'র কাজ শুরু করলেন। প্রথম বছরে ২০০৭ সালে অমর একুশে বইমেলায় পাঠসূত্রের নিজস্ব কোনো দোকান ছিল না। পরিবেশকের মাধ্যমে বইমেলা বই তোলা হল। দ্বিতীয় বছরে আমিও রাজীব দা'র সঙ্গে যোগ দিলাম।

যোগসূত্রের পাওয়া বিভিন্ন ইভেন্ট থেকে টাকা আয় করে পাঠসূত্রে ব্যয় করা শুরু হল। ২০০৭ সালের এপ্রিল থেকে ২০১০ সালের মার্চ পর্যন্ত আমি যোগসূত্র ও পাঠসূত্রে ছিলাম। যোগসূত্র এই সময় বিভিন্ন প্রজেক্ট থেকে কোটি টাকার উপরে ইনকাম করেছে। ইভেন্ট শেষেই রাজীব নূরের কাছে টাকা নেই!! পরে অবশ্য গাজীপুরে একটি জমির সন্ধান মিলেছিল। সেখানেও জমির দখল নিয়ে জমির ক্রেতাদের দেন-দরবার শুরু হবার পর আমি জানতে পারলাম।

শাহীন, ডাক্তার কল্লোল আর রাজীব নূর সেই জমি শেয়ারে কিনেছিল। পরে বিক্রি করে সব টাকা ফেরত পেয়েছে কিনা জানি না। যোগসূত্র থেকে আমি থাকা কালীন অনেক ইভেন্ট করেছি। ওয়ার্লড হেলথ অরগাইনেজাশান থেকে চারটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এন্টি ট্যোবাকো ক্যাম্পেইন, গানচিল থেকে চ্যানেল আই সেরা কণ্ঠদের সিডি কভার, কনসার্ন ওয়ার্লড ওয়াইড থেকে বিভিন্ন ইভেন্ট আমরা করেছিলাম। আমি যো্গসূত্র থেকে চলে আসার পর রাজীব নূরের মাথায় শুদু আইডিয়া খেলা করে।

শেষ পর্যন্ত যোগসূত্র বন্ধ করে দিয়ে রাজীব নূর আবার চাকরি নিয়ে প্রথম আলোতে সাংবাদিকতা শুরু করেছন। রাজীব নূরের গল্প সংকলন প্রকাশিত হয়েছে দুইটি। বাংলা একাডেমী থেকে 'ধ্রুপদী ও তার প্রেমিকেরা' আর ঐতিহ্য থেকে কি যেনো নাম ভুলে গেলাম!!! রাজীব নূর ১৯৬৯ সালের ৮ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে জন্মগ্রহন করেন। বিয়ে করেছেন তনুজা আকবরকে। রাজীব-তনুজা'র এক কন্যা।

কন্যার নাম অপার সর্বজয়া। অপরের বয়স এখন চার বছর। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১১ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.