আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যারা বলেন জাফর ইকবাল আওয়ামীলীগের সমালোচনা করেনা তদের জন্য দুটি লিঙ্ক।

আপনি আমাকে পছন্দ করেন কি করেন না তাতে আমার কিছু যায় আসে না, আপনাকে খুশি করার জন্য আমি এ পৃথিবীতে আসিনি। জাফর ইকবাল নাকি আওয়ামীলীগের দালাল। তিনি নাকি আওয়ামীলীগের কোন সমালোচনাই করেন না। ২৫-৫-২০১২ তারিখের তার একটি লেখায় তিনি বলেছিলেন আওয়ামীলীগ যদি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে যেতে পারে তাহলে তিনি তাদের এ প্লাস দিবেন। এই কথা নিয়ে ব্লগে তার বিরুদ্ধে অনেক সমালোচনার ঝড় উঠেছে দেখলাম।

এর পরে তিনি ২৬ ও ২৭-৫-২০১২ তারিখে আরো দুটি লেখা দেন। সেগুলোতে আওয়ামীলীগকে তুলোধুনো করেছেন। কিছু বাদ রাখেন নি, আওয়ামীলীগের দোষ প্রায় সবগুলোই উল্লেখ্য করেছেন। কিন্তু অবাক করার মত ব্যাপার হচ্ছে যারা তার সমালোচনা করে, তাকে আওয়ামীলীগের দালাল বলে তারা এই দুটি লেখা এড়িয়ে গেছেন। আমি এড়িয়ে গেছেনই বলব, কারণ যারা প্রথম লেখাটা পড়তে পেরেছেন তারা পরের লেখাগুলো পড়েন নি সেটা আমি বিশ্বাস করি না।

যাইহোক কথা না বাড়িয়ে লেখাগুলোর লিঙ্ক দিচ্ছি। পড়ে দেখুন সবাই। সাদাসিধে কথা: রাজনীতি নিয়ে আমার ভাবনা—২ গতকালের পর ৪. এবার একটু আওয়ামী লীগের কথা বলি। গত নির্বাচনের ফলাফলের দিনটি ছিল আমাদের মতো মানুষের জন্য খুব আনন্দের একটি দিন। সেদিন এই দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে, ডিজিটাল বাংলাদেশের পক্ষে—এক কথায় একটা আধুনিক বাংলাদেশের পক্ষে রায় দিয়েছিল।

দেশের মানুষের উৎসাহ-উদ্দীপনা আর স্বপ্ন নিয়ে আওয়ামী লীগ তাদের যাত্রা শুরু করেছিল—(আরও একবার আওয়ামী লীগ দেশের মানুষের অনেক আশা-ভরসা নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল, সেটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের পর প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশে। ) বাংলাদেশ মানেই হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে স্বপ্ন দেখা সেই দেশ, তাই যখন বাংলাদেশকে কেউ মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে ঠিক করে দেওয়া পথ থেকে সরিয়ে অন্য পথে নেওয়ার চেষ্টা করে তখন দেশটা আর বাংলাদেশ থাকে না। বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে সেই স্বপ্ন থেকে সরে এসেছে—কোনো দল জামায়াতে ইসলামীকে সহযোগী হিসেবে নিলে সেটি আর মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করতে পারে না, কাজেই বাংলাদেশকে বাংলাদেশ হিসেবে টিকিয়ে রাখার দায়িত্বটি এখন পুরোপুরি আওয়ামী লীগের ওপর। প্রশ্ন হলো আওয়ামী লীগ সেই দায়িত্বটি নিতে রাজি কি না (আমি কিন্তু জিজ্ঞেস করিনি প্রস্তুত কি না, আমি জিজ্ঞাসা করেছি রাজি কি না!) আমরা আমাদের চারপাশে যেসব ঘটনা ঘটতে দেখছি তাতে মনে হয় তারা সেই দায়িত্বটি নিতে আর আগ্রহী নয়। একাত্তর সালে তারা দায়িত্ব নিয়েছিল, যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিল।

এখন আর যুদ্ধ করার সুযোগ নেই, এখন দায়িত্ব নিতে হলে ভোট পেতে হবে, ভোট পেতে হলে সম্ভাব্য ভোটারদের খুশি রাখতে হবে, আমরা সবাই দেখছি তারা হিসেব করে যে কাজগুলো করছে সেগুলো হচ্ছে ঠিক তার উল্টো। কয়েকটা উদাহরণ দিই। শুরু করতে হবে প্রফেসর ইউনূসকে দিয়ে। প্রফেসর ইউনূস সারা পৃথিবীর মাঝে একজন অত্যন্ত সম্মানী মানুষ। তিনি শুধু যে ২০০৬ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তা নয়, কিছুদিন আগে তাকে স্টিভ জবস, বিল গেটস কিংবা গুগল বা ফেসবুকের প্রবর্তকদের মতো সমান কাতারের মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।

আমি তাকে অসম্ভব পছন্দ করি (আশির দশকেই আমি একটা লেখায় তাঁর নোবেল পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনার কথা বলেছিলাম) কাজেই তাঁর সম্পর্কে আমার লেখায় যুক্তিতর্ক খুঁজে লাভ নেই! কিন্তু প্রফেসর রেহমান সোবহান তাঁর লেখায় লিখেছিলেন এই মানুষটি সারা পৃথিবীর অল্প কয়েকজন মানুষের ভেতর একজন, যিনি যেকোনো সময় পৃথিবীর যেকোনো রাষ্ট্রনায়কের সঙ্গে টেলিফোন তুলে কথা বলার অধিকার রাখেন, কাজেই বাংলাদেশের উচিত হবে এই অসাধারণ সুযোগটি দেশের মঙ্গলের জন্য গ্রহণ করা। আওয়ামী লীগ সরকারের এই সুযোগ গ্রহণ করা তো দূরের কথা, তারা তাদের সব শক্তি নিয়োগ করেছে তাকে অপমান করার জন্য। হিলারি ক্লিনটন ঘুরে যাওয়ার পর সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম প্রফেসর ইউনূস সম্পর্কে যে ভাষায় যে কথাগুলো বলেছেন সেগুলো পড়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে আতঙ্ক অনুভব করেছি। সম্মানী মানুষ সম্পর্কে অসম্মানজনক কথা বললে তার সম্মানের ক্ষতি হয় না, কিন্তু কথাগুলো বলে একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী তাঁর নিজের মানসিক পরিপক্বতার যে নমুনা আমাদের সামনে তুলে ধরলেন সেটা দেখে কি দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাদের আতঙ্ক হতে পারে না? প্রফেসর ইউনূস আসলেই রক্তচোষা মহাজন কি না আমি সেই কুতর্ক শুরু করতে চাই না, শুধু বলতে চাই এই দেশে তার তৈরি করা গ্রামীণ ব্যাংকের প্রায় এক কোটি সদস্য এবং তাদের আত্মীয়স্বজন মিলে কয়েক কোটি মানুষ আছে, যাদের সবাই ভোটার। এই দেশের প্রায় সত্তর-আশি লাখ মানুষ বিদেশে থাকে তারাও ভোটার (ভোটের সময় তারা আসলে ভোট দিতে পারেন কি না সেটি অবশ্য ভিন্ন প্রশ্ন)।

এই দেশের তরুণেরা প্রায় কয়েক কোটি, তাদের একটা বড় অংশ ভোটার। আমি যে তিনটি দলের মানুষের কথা বলেছি তাদের প্রত্যেকে প্রফেসর ইউনূসকে পছন্দ করেন এবং যখন তাঁকে অসম্মান করা হয়েছে তারা সবাই খুব বিরক্ত হয়েছে। যে দল ভোটের রাজনীতি করে সেই দল এক সঙ্গে এত ভোটারকে এত দক্ষতার সঙ্গে অন্য কোনোভাবে বিরক্ত করেছে বলে আমার জানা নেই, কী কারণে সেটা করেছে তার কারণটা আমি এখনো জানি না। আমাদের প্রধানমন্ত্রী প্রফেসর ইউনূসকে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট করার প্রস্তাব দিয়েছেন, তা না করে তাঁকে যদি তাঁর অফিসে শুধু একবার চা খেতে ডাকতেন তা হলেই এ দেশের কত মানুষের বুকের ভার যে লাঘব হতো সেটা কি তাঁরা জানেন? বাংলাদেশে প্রায় ২৫ লাখ আদিবাসী রয়েছে (মতান্তরে ৪০ লাখ)। তবে বিচিত্র ব্যাপার হচ্ছে যে সরকার হঠাৎ করে একদিন ঠিক করেছে তাদের আর আদিবাসী বলা যাবে না, তাদের উপজাতি কিংবা ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী বা এ ধরনের আরও কঠিন এবং অসম্মানজনক কিছু বলতে হবে।

আওয়ামী লীগ সরকার কেন এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটি এখনো আমার কাছে রহস্য। লোকমুখে শুনেছি এই সিদ্ধান্তের ব্যাপারে সেনাবাহিনীর একটা চাপ রয়েছে, জাতিসংঘের লোভনীয় চাকরিতে সেনাবাহিনী যেতে পারবে কি পারবে না এই নামকরণের সঙ্গে তার একটা সম্পর্ক রয়েছে। সরকারের মানুষদের সঙ্গে এ ব্যাপারে নিরিবিলি কথা বলার চেষ্টা করলে তাঁরা ঘাড়ের রগ ফুলিয়ে তর্ক করে দেন। কিন্তু এত দিন কেন তাহলে তাদের আদিবাসী বলা হলো, হঠাৎ করে কেন আর তাদের আদিবাসী বলা যাবে না, সেটার ব্যাখ্যা দিতে পারেন না। কোনো একটা কিছু বোঝাতে যখন একটা শব্দ ব্যবহার করা রেওয়াজ হয়ে যায় তখন সেটাই যে প্রচলিত হয়ে যায় এই সোজা কথাটা কে বোঝাবে? কিছুদিন আগে আমার চোখে একটা সরকারি সার্কুলারের অনুলিপি চোখে পড়েছে, যেখানে বলা হয়েছে আগস্ট মাসকে শোকের মাস দেখিয়ে আদিবাসী দিবসকে উদ্যাপন করতে যেন সব মহলকে নিরুৎসাহিত করা হয়।

বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডকে এ রকম কূটকৌশলে একটা হীন কাজে ব্যবহার করা হবে সেটি বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না! যাই হোক, যে সরকারকে ভোটে জিতে আসতে হবে তাদের মনে করিয়ে দিতে হবে, চল্লিশ লাখ আদিবাসীর অন্তত বিশ লাখ ভোটার! এতগুলো ভোটারকে এত অবলীলায় ক্ষুব্ধ করে তোলার উদাহরণ আর কোথায় পাওয়া যাবে? একসাথে দেশের অনেক মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তোলার আরেকটা সহজ উপায় কী হতে পারে? সেটা হচ্ছে ঈদে যেন মানুষজন তাদের বাড়িতে যেতে না পারে তার ব্যবস্থা করে দেওয়া। এই সরকারের আমলে ঠিক এই ব্যাপারটা ঘটেছিল। ঈদের আগে আগে দেখা গেল রাস্তাঘাটের অবস্থা এত খারাপ যে সেই পথে কোনো কোনো বাস যেতে পারছে না। আমরা দেখতে পাই ঢাকা শহরের ভেতর দিয়ে নানা ধরনের উড়ালসেতু, ফ্লাইওভার তৈরি হচ্ছে, একটি নয় দু-দুটি পদ্মা সেতু তৈরি নিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকার আলোচনা হচ্ছে (তার প্রস্তুতির জন্য নিশ্চয়ই এর মাঝে কয়েক শ কোটি টাকা খরচ পর্যন্ত হয়ে গেছে) কিন্তু সাধারণ মানুষ ঈদের ছুটিতে বাড়ি যেতে পারছে না, এর চেয়ে দুঃখের ব্যাপার আর কী হতে পারে? দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ছিলেন সৈয়দ আবুল হোসেন, কাজেই রসিক বাঙালি এখন ভাঙাচোরা বেহাল রাস্তাঘাট বোঝানোর জন্য বলে আবুলি রাস্তা! ডিকশনারিতে একটা নতুন শব্দ যোগ করে আমাদের বাংলা ভাষা হয়তো একটু সমৃদ্ধ হলো কিন্তু ব্যাপারটা আওয়ামী লীগের জন্য ভালো হলো কি? বিষয়টা আরও গুরুতর হয়ে গেল যখন দেখা গেল রাস্তাঘাট ঠিক করার জন্য টাকার বরাদ্দ আছে কিন্তু সেই টাকা খরচ করে রাস্তাঘাট ঠিক করার জন্য কারও গরজ নেই। কারণটা বোঝার জন্য রকেট সায়েন্টিস্ট হতে হয় না, দেশের ভেতরকার রাস্তাঘাট তৈরিতে পয়সা-কড়ি নেই, বিশাল বিশাল ফ্লাইওভার, বড় বড় পদ্মা সেতুতে অনেক টাকা-পয়সা।

কাজেই উৎসাহটা সেখানেই বেশি। সৈয়দ আবুল হোসেন বেশ অনেক দিন থেকে আলোচনার মাঝে রয়েছেন। আমাদের দেশের দুর্নীতির খবর সাধারণত দেশের ভেতরেই থাকে। আমাদের এই মন্ত্রীর কারণে দুর্নীতির খবরটি মোটামুটিভাবে একটা আন্তর্জাতিক রূপ পেয়েছে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এবং দেশের সরকারের সঙ্গে উত্তপ্ত চিঠি চালাচালি হচ্ছে, উইকিলিকস থেকে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টির অত্যন্ত অসম্মানজনক বক্তব্য বের হয়ে আসছে, কানাডার কোর্টে মামলা হয়ে রায় বের হচ্ছে সেখানে মন্ত্রীর ফার্মের সঙ্গে যোগাযোগ খুঁজে পাওয়া গেছে।

সব মিলিয়ে একেবারে পরিপূর্ণ লেজেগোবরে অবস্থা। পদ্মা সেতুর টাকা আটকে গেছে, যে পদ্মা সেতু দেখিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার দেশের মানুষকে তাক লাগিয়ে দিতে পারত, সেই পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারিতে এখন তাদের মুখে চুনকালি লাগানোর অবস্থা। সরকার যদিও ভাঙা রেকর্ডের মতো ‘কোনো দুর্নীতি হয়নি’ বলে যাচ্ছে কিন্তু দেশের মানুষের আসল সত্যিটি বুঝতে কোনো সমস্যা হয়নি। মন্ত্রীরও কোনো সমস্যা হয়নি, তিনি একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় থেকে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে চলে গেছেন। এই বিষয়টা থেমে যাওয়ার আগেই আমাদের রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের নাটক মঞ্চস্থ হলো।

তদন্ত রিপোর্টে দেখা গেছে, মন্ত্রীর কোনো দোষ নেই, কিন্তু দেশের কতজন মানুষ এই রিপোর্টটিকে বিশ্বাস করে? রাজনৈতিক নেতারা এত কিছু বোঝেন কিন্তু কেন জানি একটা অত্যন্ত সহজ জিনিস বোঝেন না—আসলে কী ঘটেছে তার থেকে অনেক অনেক অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সেটা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণাটি কী। কাগজে-কলমে অনেক কিছু লিখে ফেলা যায়, অনেক কিছু প্রমাণ করা যায়, কিন্তু তাতে সাধারণ মানুষের কোনো পরিবর্তন হয় না। দুর্নীতির ছাপ ‘পার্মানেন্ট ইংক’-এর ছাপের মতো, একবার লেগে গেলে শতবার ঘষেও তোলা যায় না। যাদের ওপর এই ছাপ পড়েছে তাদের সরে যাওয়া ছাড়া এর কোনো বিকল্প নেই। (তৃতীয় কিস্তি আগামীকাল) সাদাসিধে কথা: রাজনীতি নিয়ে আমার ভাবনা—৩ গতকালের পর ৫. ‘আবুলি রাস্তা’র কথা যেহেতু বলা হয়েছে ‘শাজাহানি ড্রাইভারে’র কথা বলা না হলে বিষয়টা অসম্পূর্ণ থেকে যায়।

আমরা সবাই জানি, বাংলাদেশের রাস্তাঘাট পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক জায়গা, যুদ্ধের মাইন ফিল্ড থেকে এটি কোনো অংশে কম নয়। এর প্রধান কারণ হচ্ছে ড্রাইভাররা, তারা যেভাবে গাড়ি চালায় (কিংবা মালিকদের চাপে যেভাবে চালাতে বাধ্য হয়), সেটি অবিশ্বাস্য। বাংলাদেশের জন্য সৃষ্টিকর্তার এক ধরনের মায়া আছে, তা না হলে প্রতিদিন রাস্তাঘাটে আরও অসংখ্য মানুষ মারা যেত। আমাদের জিডিপি ৬ নাকি ৭—এ নিয়ে তুমুল তর্ক-বিতর্ক চলছে অথচ কেউ খেয়াল করে না যে সড়ক দুর্ঘটনায় কারণে আমাদের দেশে জিডিপির ১ থেকে ২ অংশের অপচয় হয়ে যাচ্ছে। অর্থনীতির সঙ্গে সড়ক দুর্ঘটনার এত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, কিন্তু সেটি নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই, দেখে খুব কষ্ট হয়।

হঠাৎ করে যখন সবার খুব প্রিয়জন যিনি একই সঙ্গে দেশের সম্পদ, একটি অর্থহীন গাড়ি অ্যাকসিডেন্টে মারা যান, তখন সারা দেশে সেটা নিয়ে হইচই শুরু হয়ে যায়। সেই সময় যখন আমাদের নৌপরিবহনমন্ত্রী সড়ক দুর্ঘটনার নায়ক ড্রাইভারদের আরও সহিংস হতে উৎসাহ দিয়ে কথাবার্তা বলেন, তখন সেগুলো এই দেশের সব মানুষের একেবারে স্নায়ুতে গিয়ে কামড়ে ধরে। শাজাহান খানের দেওয়া উৎসাহে অনুপ্রাণিত হয়ে যখন কোনো ড্রাইভার বেপরোয়াভাবে রাস্তায় গাড়ি চালায়, তাদের নতুন নামকরণ হয়েছে ‘শাজাহানি ড্রাইভার’। ডিকশনারিতে একটা নতুন শব্দ আওয়ামী লীগের কতগুলো ভোটকে নষ্ট করে সেই হিসাবটা কেউ কি করছে? আওয়ামী লীগ সরকারের আরেকটি বড় মাথাব্যথার কারণ হচ্ছে স্টক মার্কেট। আমি আগেই বলে রাখি স্টক মার্কেট কীভাবে কাজ করে, আমি সেটা জানি না।

চেষ্টা করলে বিষয়টা যে বুঝতে পারব না তা নয়, কিন্তু আমার বোঝার কোনো আগ্রহ নেই। বেঁচে থাকতে হলে মানুষকে টাকা-পয়সা রোজগার করে সংসার চালাতে হয় এবং সে জন্য পরিশ্রম করতে হয়। কোনো পরিশ্রম না করে শুধু টাকা-পয়সা নাড়াচাড়া করে কেউ যদি টাকা উপার্জন করে তখন আমার কাছে মনে হয় এর মাঝে কিছু একটা গোলমাল আছে। যেহেতু সারা পৃথিবীই এই গোলমালকে মেনে নিয়ে চলছে, কাজেই আমি স্বীকার করে নিচ্ছি সমস্যাটা পৃথিবীর নয়, সমস্যাটা আমার। এই স্টক মার্কেটে টাকা ঢেলে এই দেশের অনেক মানুষ সর্বস্বান্ত হয়েছে।

যারা সর্বস্বান্ত হয়েছে, তারা সাধারণ মানুষ এবং যারা তাদের সর্বস্বান্ত করেছে, তারা এই দেশের বড় বড় রাঘববোয়াল। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত হয়েছে, দেশের বিশ্বাসযোগ্য মানুষেরা তদন্ত করে রাঘববোয়ালদের চিনিয়ে দিয়েছেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই হয়নি! রাঘববোয়ালরা আরও বড় রাঘববোয়াল হয়েছেন। ভবিষ্যতে আবার সাধারণ মানুষদের সর্বস্বান্ত করে দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন এবং দেশের মানুষ নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে আছে। আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য শুধু একটি তথ্য দেওয়া প্রয়োজন, সেটি হচ্ছে এরা সবাই ভোটার। এই দেশের মানুষের জন্য একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে টিপাইমুখ বাঁধ।

আমি এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নই কিন্তু বিশেষজ্ঞ না হয়েও যেকোনো বিষয়ের মূল অংশটুকু বুঝে ফেলা যায়, কাজেই টিপাইমুখ বাঁধ দিয়ে যখন ভারতবর্ষ আমাদের নদীর পানিকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতাটুকু পেয়ে যাবে, সেটা এই দেশের জন্য সুখবর হতে পারে না। বিষয়টি নিয়ে এই সরকারের কথাবার্তা এত নরম সুরের যে শেষ পর্যন্ত রাশেদ খান মেনন বলতে বাধ্য হয়েছেন, ‘আমাদের প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাদের কথা শুনলে মনে হয় তাঁরা যেন আমাদের নয়, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা। ’ অনেক দুঃখে বলা কথা কিন্তু এই কথার মাঝে যে অনেকখানি সত্যতা আছে, সেটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টারা ইনিয়ে-বিনিয়ে এই দেশের পাবলিককে টিপাইমুখ খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন। পরিষ্কার করে তাদের বুঝতে হবে, এই দেশের পাবলিক টিপাইমুখ খাবে না।

বাঁধ দেওয়ার পর পানির পরিবর্তে শরবত এলেও খাবে না, কাজেই তাদের আরও স্পষ্ট ভাষায় কথা বলতে হবে! নেতিবাচক কথা বলতে বা লিখতে ভালো লাগে না, আমি এতক্ষণ এতগুলো নেতিবাচক কথা লিখতে লিখতে একটু ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, এবার শুধু শেষ একটি বিষয় ক্ষান্ত দিই। সেই বিষয়টা হচ্ছে ছাত্রলীগ। একেবারে ভেতর থেকে দেখে আমি আবিষ্কার করেছি ছাত্ররাজনীতি থেকে অনেক বেশি ভয়ংকর হচ্ছে শিক্ষক-রাজনীতি। যেসব ধুরন্ধর শিক্ষক এই রাজনীতি করেন, তাঁরা সব সময় ছাত্রদের ব্যবহার করেন এবং মজার ব্যাপার হলো, খবরের কাগজে ছাত্রদের মাস্তানির খবরটাই আসে, শিক্ষকদের ষড়যন্ত্রের খবরটা আসে না। যখনই ছাত্রলীগের দুই দল কিংবা উপদল (কিংবা উপ-উপদল!) মারামারি করে তখন খবরের কাগজে সেই খবরটা অনেক বড় করে প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপানো হয়, সেখানে অবধারিতভাবে অস্ত্র হাতে ছাত্রদের ছবি থাকে।

সাধারণ মানুষদের এই ছবিগুলো ভয়ংকরভাবে ধাক্কা দেয়। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় নিয়েই তাদের মাঝে এক ধরনের বিতৃষ্ণার জন্ম হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের বিশাল একটি অর্জন কোনো প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছাত্রলীগের একজন কর্মীর তুচ্ছ একটা ঘটনার কারণে ম্লান হয়ে যেতে পারে। এই সরকারের বিষয়টি বুঝতে হবে, যেহেতু অনেক বড় কাজ ছোট একজন মানুষের নির্বুদ্ধিতার কারণে সাধারণ মানুষের কাছে অর্থহীন হয়ে যায়, তাই এগুলোকে যেভাবে সম্ভব নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। "‘জয় বাংলা’ এবং ‘জয় বঙ্গবন্ধ’ু স্লোগান দিয়ে যখন ছাত্রলীগের কর্মীরা কোনো একটা অঘটন ঘটায়, তখন তারা যে বাংলা এবং বঙ্গবন্ধুর কত বড় অসম্মান করে, সেটা কি তারা জানে? তবে ইদানীং আমি আরও একটি বিষয় লক্ষ করতে শুরু করেছি, ছাত্ররাজনীতি বলতেই দলবাজি, টেন্ডারবাজি, মাস্তানি করা, একরোখা অসহিষ্ণু অস্ত্র হাতে মাস্তানদের যে ছবি ভেসে ওঠে সেটাই কিন্তু পুরো চিত্র নয়।

তার বাইরেও অনেক ছাত্র-ছাত্রী আছে যারা কোনো রকম স্বার্থের জন্য ছাত্ররাজনীতিতে আসেনি। এই বয়সী ছেলেমেয়েদের জন্য সেটা খুবই স্বাভাবিক, তারা সত্যি সত্যি একটা আদর্শের জন্য রাজনীতিতে এসেছে। তাদের দেশের জন্য গভীর মমতা এবং মুক্তিযুদ্ধের জন্য সত্যিকারের ভালোবাসা রয়েছে। রাজনীতির জগৎটা যেহেতু ঘোলাটে এবং কলুষিত, তাই যারা এই ছাত্রদের ব্যবহার করতে চায় তারাই শুধু তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে, অন্যরা তাদের থেকে দূরে দূরে থাকে। এই ছাত্রগুলোর কেউ কেউ যেহেতু মাঝে মাঝে আমার কাছে আসে, তাই আমি জানি তাদের মাঝে নানা বিষয়ে বিভ্রান্তি আছে।

শুধু তা-ই নয়, তাদের মাঝে এক ধরনের ক্ষোভ আর অভিমানও আছে। কিছুদিন থেকে আমার মনে হচ্ছে, সম্ভবত বিষয়টা আমাদের আরও একটু মমতা দিয়ে দেখা উচিত। এ কথাটি সত্যি, একজন আরেকজনকে অমানুষিক অত্যাচার করে খুন করে ফেলতে পারে, এ রকম ছাত্র সত্যিই আছে। আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে যখন সেনাবাহিনী মাত্রা ছাড়িয়ে ফেলেছিল, তখন তাদের বিরুদ্ধে তো এই ছাত্ররাই প্রথম প্রতিবাদ করে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল। ছাত্ররাজনীতির শুধু নেতিবাচক দিকগুলো ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে না দেখে তাদের আদর্শিক দিকগুলো আরও একটু আন্তরিকভাবে দেখলে শেষ পর্যন্ত আমরাই কি লাভবান হব না? নেতৃত্ব খুব রহস্যময় একটা ব্যাপার, যারা ভবিষ্যতের নেতা হবে আমরা কি এখন তাদের একটু সাহায্য করব না? যারা আওয়ামী লীগ করেন তাঁরা সম্ভবত এই লেখাটি পড়ে আমার ওপর খুব ক্ষুব্ধ হবেন, তারা মনে করবেন এত কিছু করার পরও আমি তাদের সম্পর্কে বলার মতো একটা ভালো কিছু খুঁজে পেলাম না।

বিষয়টি মোটেও সে রকম কিছু নয়, আমি আওয়ামী লীগ আর বিএনপিকে তুলনা করার জন্য লেখাটি লিখছি না। আমি যেহেতু মনে করি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে বিএনপি বাংলাদেশ নামের এই রাষ্ট্রের পরিচালনার নৈতিক অধিকার হারিয়েছে, তাই আমি আওয়ামী লীগকে মনে করিয়ে দিচ্ছি দেশটিকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের একটি দেশ হিসেবে বাঁচিয়ে রাখার পুরো দায়িত্ব এখন তাদের। যদি তারা সত্যি সত্যি এই দেশকে ভালোবাসে, তাহলে তাদের কোনো ভুল করার অধিকার নেই। কী কী ভুল করা হতে পারে আমি শুধু আমার মতো করে সেগুলো মনে করিয়ে দিয়েছি, তার বেশি কিছু নয়। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী যদি এই দেশের মানুষকে নতুন জীবনের একটি স্বপ্ন দেখিয়ে নির্বাচনে জিতে আসে, তাহলে আমাদের কারও কিছু বলার নেই।

কিন্তু তারা যদি এই দেশের মানুষকে নতুন কোনো স্বপ্ন দেখাতে না পারে, শুধু আওয়ামী লীগ সরকারের ভুলগুলোর জন্য দেশের মানুষ ত্যক্তবিরক্ত হয়ে তাদের ক্ষমতায় ডেকে আনে, তাহলে সেটা খুব দুঃখের একটা ব্যাপার হবে। যুদ্ধাপরাধীরা জেলখানা থেকে বের হয়ে আসবে, গাড়িতে জাতীয় পতাকা লাগিয়ে রাজাকারেরা ঘুরে বেড়াবে, নতুন বাংলা ভাইদের জন্ম হবে—চিন্তা করেই আমার কেমন জানি গা গুলিয়ে আসে। যে কথাটি দিয়ে শুরু করেছিলাম সেই কথাটি দিয়েই শেষ করি। আমার এই লেখাটি খুব গুরুত্ব দিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন নেই, এখানে যা লেখা হয়েছে সেগুলো আমার ব্যক্তিগত ভাবনা। আমার ব্যক্তিগত ভাবনা সব সময় সঠিক হয়, আমি সেটা কখনো দাবি করি না।

তবে লেখাটি পড়ে কেউ যদি মনে করে আমি দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশার মাঝে আছি, তাহলে তাদের মনে করিয়ে দিতে চাই আমি মোটেও হতাশ নই। দেশকে নিয়ে আমি অসম্ভব আশাবাদী। আমাদের চারপাশে মন খারাপ করার মতো অনেক কিছু ঘটছে, হরতাল, খুনোখুনি, গুম, ক্রসফায়ার, রাজনৈতিক কোন্দল, কিন্তু এই সবকিছুর মাঝখানে থেকেও কিন্তু আমাদের স্বপ্ন দেখার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। লেখাপড়ার মাঝে একটা বিপ্লব শুরু হতে যাচ্ছে। পৃথিবীর অন্য অনেক দেশ যেটা পারেনি আমরা সেটা পেরেছি, মেয়েদের ছেলেদের পাশাপাশি সমান সমান জায়গায় নিয়ে এসেছি।

এইটুকুন একটা দেশে এতগুলো মানুষ, তার পরও এই দেশ চাল রপ্তানির কথা ভাবছে। দেশে এত দিন শুধু গ্যাস পাওয়া যাচ্ছিল, এখন তেলও খুঁজে পাওয়া গেছে, তার চেয়ে বড় কথা সেই তেল খুঁজে পেয়েছে এই দেশের প্রযুক্তিবিদেরা। বিদ্যুতের সমস্যাটা মিটিয়ে দিতে পারলে আমার আর কিছু চাওয়া নেই। একটা সময় ছিল যখন বাংলাদেশকে নিয়ে বাইরের দেশগুলো শুধু মন খারাপ করা কথা বলত, এখন হয়েছে ঠিক তার উল্টো। বাংলাদেশকে নিয়ে কিছু বলতে হলে তাদের ভালো ভালো কথা বলতেই হয়, সম্ভাবনার কথা বলতেই হয়! আমি খুব আশাবাদী।

বাইরের পৃথিবী বলছে সে জন্য নয়, এই দেশে বসে থেকে আমি অনুভব করতে পারি সে জন্য। (শেষ) সমালোচনা করুন সমস্যা নেই, কিন্তু সত্য গোপন করে কেন করবেন? আপনারা তার প্রথম লেখার সমালোচনা করেছেন কিন্তু দ্বিতীয় আর তৃতীয় লেখা সম্পর্কে কিছু বলবেন না কেন? ডঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল আমার কাছে কোন দরবেশ না। আমি নিজেও অনেকের পোস্টে তার সমালোচনা করেছি। কিন্তু একটা ব্যাপার হচ্ছে তার অধিকাংশ লেখার সাথে আমার চিন্তা ভাবনা মিলে যায়। আমার মনে হয় অধিকাংশ ছেলেমেয়ে জাফর ইকবালকে এই জন্যই পছন্দ করে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.