আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জাতীয় কবির ১১৩তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে- কবির বৈচিত্রময় কান্ড কারখানা ও হাসিকান্নার ঘটনা নিয়ে দীর্ঘতম পোস্ট- অচেনা রূপে কাজী নজরুল

তরুণ নামের জয়মুকুট শুধু তাহার, বিপুল যাহার আশা, অটল যাহার সাধনা কাজী নজরুল ইসলাম দেখতে কেমন ছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে কাজী নজরুল এলেন কলকাতায়। ১৯২০ সালের কথা। বিশ একুশ বছর বয়সী তরুণ নজরুল তখনও সৈনিক জীবনের মায়া ছাড়তে পারেন নি। অস্বীকারের উপায় নেই, তার এ সৈনিক জীবনে তিনি যতদিন করাচীতে ক্যাম্পে ছিলেন, সেখানেও তিনি সবাইকে মাতিয়ে রাখতেন। এ সৈনিক জীবনে তিনি এক মৌলভীর কাছে ফার্সী ভাষাটা আরও ভালভাবে শিখে কবি হাফিজের বেশ কিছু কাব্য অনুবাদ করেছিলেন বাংলায়।

এ ছাড়া তিনি কিছু লেখালেখি করতেন সেখানে বসে আর সেগুলো পাঠিয়ে দিতেন কলকাতার মোসলেম ভারত ও অন্যান্য পত্রিকায়। কলকাতায় এসেও তিনি নামের আগে কাজী আর হাবিলদার খেতাব ব্যবহার করতেন, শুধু তাই নয়, খেয়ালী কবি কারো কথা তোয়াক্কা না করে তখনও বুট পরে কখনও সৈনিক পোষাক পড়ে বিভিন্ন সভায় হাজির হতেন, তার হো হো অট্টহাসি শুনে সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখতো, এ আবার কোত্থেকে এল? একুশের সেই নজরুলকে কেমন লাগতো দেখতে তখন? নজরুলকে নিয়ে তার তৎকালের বন্ধুরা সবাই প্রায় একই ভাষায় তার অবয়ব বর্ণনা করেছেন, এর সারাংশ হচ্ছে এই- সবল শরীর, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, চোখ দুটো যেন পেয়ালা, আর সে পেয়ালা দুটো যেন কখনো খালি নেই, প্রাণের অরুণ রসে সদা ভরপুর, তার গলা সারসের মতো পাতলা নয়, বরং পুরুষের গলা যেমন হওয়া উচিত তেমনি সরল বীর্য-ব্যঞ্জক, গলার স্বর ছিল ভারী, তার সেই মোটা গলার সুরে ছিল যাদু, ঢেউয়ের আঘাতের মতো তার গান আছড়ে পড়তো ঝড়ের ঝাপটা হয়ে শ্রোতার বুকে। প্রবল হতে সে ভয় পেতো না, নিজেকে মিঠে দেখানোর জন্য সে চেষ্টা করতো না। এ বর্ণনা করেছেন সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর। নজরুল ছিল একাই একশো।

চওড়া মজবুত জোরালো তার শরীর, লাল-ছিটে লাগা বড়ো বড়ো মদির তার চেজাখ, মনোহর মুখশ্রী, লম্বা ঝাঁকড়া চুল তার প্রাণের ফূর্তির মতোই অবাধ্য, গায়ে হলদে কিংবা কমলা রঙের পাঞ্জাবী এবং তার উপর কমলা কিংবা হলদে রঙের চাদর, দুটোই খদ্দরের। কেউ জিজ্ঞেস করেছিল, আপনি রঙীন জামা পরেন কেন? ‘সভায় অনেক লোকের মধ্যে চট করে চোখে পড়ে তাই’, বলে ভাঙা ভাঙা গলায় হো হো করে হেসে উঠেতেন তিনি। কথার চেয়ে বেশী তার হাসি, হাসির চেয়ে বেশী তার গান। একটি হারমোনিয়াম এবং যথেষ্ট পরিমাণ চা এবং অনেকগুলো পান দিয়ে বসিয়ে দিতে পারলে সব ভুলে পাঁচ-ছয়-সাত ঘন্টা একনাগাড়ে গান করতে থাকতেন। নজরুল যে ঘরে আড্ডা জমাতেন, সে ঘরে আর কেউ ঘড়ির দিকে তাকাতো না।

এ বর্ণনা কবির বন্ধূ বুদ্ধদেব বসুর। আবুল মনসুর আহমদও এক লেখায় কবিকে ১৯২২ সালে প্রথম দেখার কথা বর্ণনা করেছিলেন এ ভাষায়, সভায় গিয়ে অন্যান্য সবার সাথে নজরুল ইসলামের সাথেও পরিচয় হলো। মিলিটারী ইউনিফর্ম পরা কাঠখোট্টা লোক, কবি বলে পছন্দ হলোনা, কিন্তু চোখ দুটো তার ভাসা ভাসা হরিণের মতো, দেখে আকৃষ্ট হলাম। আমার এক কথায় সভার সমবেত সবার হাসির আওয়াজ ছাপিয়ে যে ছাদ ফাটানো গলা শুনতে পেলাম, সেটি নজরুলের আওয়াজ। সভা শেষে তিনি আমাকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরলেন যে, আমি তার গায়ের অসাধারণ শক্তিতে বিস্মিত হলাম।

আবুল কালাম শামসুদ্দীন লিখেছেন, অবশেষে প্রতীক্ষার প্রহর শেষ হল, নজরুল এলেন। সৈনিক বেশ, কাঠখোট্টা চেহারা, দাঁিড় গোফ নেই, খনখনে অট্টহাসিতে ঘর মুখরিত করে আমাদের কাছে এগিয়ে এলেন। প্রবোধ কুমার লিখেছেন, নজরুল যখন তার অনুরাগরঞ্জিত কবি জীবন নিয়ে এসে দাঁড়ালেন কলকাতার রাজপথে, তখন তার একদল লক্ষীছাড়া বন্ধুভিন্ন অপর সহায় সম্বল বিশেষ কিছু ছিল না। কিন্তু তার সঙ্গে ছিল এমন একটি প্রবল উজ্জ্বল প্রাণ, এমন একটি সরল উজ্জ্বল ও হাস্যোদ্দীপ্ত জীবন, যেটি সর্বক্ষণ অনুপ্রাণিত করে রাখতো তার বন্ধু সমাজকে। তার স্বভাবের দীপ্তি, তার প্রাণবন্যা এবং তার হাস্যমুখরতা- এদের আকর্ষণে একদা কলকাতার রাজপথে ভীড় জমে যেত।

আব্দুল হালিম লিখেছেন, কবির সুডৌল বলিষ্ঠ দেহ, বড় বড় বিস্ফরিত উজ্জ্বল চোখ, মাথায় রুক্ষ দোলায়মান লম্বা চুল, সহাস্য মুখ, দীর্ঘ পিরান, পীত শিরস্ত্রাণ, গৈরিক বেশ হাতে বেণূ কবিকে মহিমান্বিত করে তুলতো। ঘন্টার পর ঘন্টা চলে যাচ্ছে গান ও কবিতায়। শেষ হচ্ছে কাপের পর কাপ চা। নজরুলের মুখে হাসির ফোয়ারা ছুটছে, কলহাস্যে মজলিস মুখরিত, আহার নেই, নিদ্রা নেই, কবি তার ছন্দ দোলায় গান ও কবিতা রচনা করে চলেছেন, শত কোলাহলের মধ্যেও তার লেখনী স্রোতের মতো বেগবান। নজরুলকে যারা গভীর ভাবে দেখেছেন তারা সবাই স্বীকার করেছেন, মৃত্যু অবধি কাজী নজরুলের দু চোখে যে অপূর্ব দীপ্তি ও তেজোদ্দীপ্ত চাহনী ছিল, তাতে সরাসরি কেউ তার চোখের দিকে বেশীক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারতো না।

তার শরীর ছিল নাদুস নুদুস, যে অসুখে ভুগে তিনি মৃত্যুশয্যায় শায়িত হলেন, এর আগে পুরো যৌবন ও তারুণ্যে কখনো তিনি কোন অসুখে পড়েন নি। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুলের লেখা বিজ্ঞাপন তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে অনেক কিছুই হয়তো আমরা জানি না। মাত্র কয়েক বছরের কাব্যসাধনায় যে কবি বাংলা সাহিত্যে প্রাণের জোয়ার বইয়ে দিলেন, তার ব্যক্তিগত স্বভাব চরিত্র ও অনেক কিছুই ছিল ব্যতিক্রমী। কবিতায় তার যে সত্ত্বা আমরা দেখতে পাই, এর সাথে অনেক পার্থক্য ছিল তার খেয়াল খুশীর। মোসলেম ভারত নামের একটি পত্রিকায় নজরুল লিখতেন।

সেকালে পত্রিকাটির জনপ্রিয়তা ছিল আকাশছোঁয়া। কলকাতার এক বাদ্যযন্ত্র ব্যবসায়ী কবি নজরুলের কাছে এসে বায়না ধরল একটি বিজ্ঞাপন লিখে দিতে। কোম্পানিটির নাম ডোয়াকিন এন্ড সন্স। তাদের নির্মিত হারমোনিয়ামের জন্য কবি নজরুল তখনই কাগজ কলম নিয়ে বসে লিখে ফেললেন এই বিজ্ঞাপনটি- কি চান? ভাল হারমোনী?? / কাজ কি গিয়ে- জার্মানী? / আসুন দেখুন এই খানে, / যেই সুর যেই গানে, / গান না কেন, দিব্যি তাই, / মিলবে আসুন এই হেথাই, / কিননি কিন, ডোয়ার কিন.. কলকাতার পার্কসার্কাস এলাকায় আরেকটি কোম্পানী ছিল, বাহাদুর কোম্পানী। এটিও বাদ্যযন্ত্র হারমোনিয়ামের ব্যবসা করত।

পত্রিকায় ডোয়াকিন কোম্পানীর বিজ্ঞাপন দেখে তারাও ছুটে এল কবি নজরুলের কাছে। তাদেরও দাবী, আমাদের জন্যও লিখে দিন এমন একটি বিজ্ঞাপন। কী আর করা? কবি আবারও লিখে ফেললেন, মিষ্টি বাহা বাহা সুরে, চান তো কিনুন ‘বাহাদুর’/ দুদিন পর বলবেনা কেউ- ‘দূর দূর’, / যতই বাজান ততই মধুর মধুর সুর!! / করতে চান কি মনের প্রাণের আহা দূর? / একটি বার ভাই দেখুন তবে ‘বাহাদুর’,/ যেমন মোহন দেখতে তেমনি শিরীন ভরাট, / বাহা সুর, চিনুন, কিনুন বাহাদুর। এরপর কয়েক মাস ধরে একই পত্রিকায় এ দুটো বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছিল এক সাথে। কোম্পানীও ব্যবসা করেছিল দেদারসে।

পরে মাথার চুলের জন্যও তিনি লিখেছিলেন একটি সুন্দর বিজ্ঞাপন। খেয়ালী নজরুল থেকে এভাবে কতো ব্যক্তি ও কোম্পানী যে উপকৃত হয়েছে, তার হিসেব নেই। কুইজঃ কাজী নজরুল তার আনন্দ প্রকাশ করার জন্য কোন কথাটি বলে সবাইকে চমকে দিতেন? উত্তরঃ দে গরুর গা ধুইয়ে। বাবাজী বেশে কাজী নজরুলের ঢাকা ভ্রমণ ক্যালান্ডারের পাতায় তখন ১৯২৭ সাল। বাঙালী খেলোয়াড়দের নিয়ে গঠিত মোহনবাগান ক্লাবের সাথে আজ আরডিসিএলআই দলের খেলা।

এ দলটি বিদেশী ফুটবলারদের নিয়ে গড়া। কাজেই খেলা নিয়ে তুমুল উত্তেজনা। হাসির আওয়াজে আসমান ফাটানো কাজী নজরুল এ খেলা দেখতে যাবেন না, তা কি করে হয়? কবির বন্ধুরা তাই সারাদিন এদিক ওদিক ঘুরে টিকেট খুঁজে হয়রান, কিন্তু কোথাও মিললনা। সবাই যখন একটু মন ভার করে কবির অফিসে এসে হাযির, কবি তাদেরকে দেখালেন, এ খেলার জন্য তিনি আগেই সবার জন্য টিকেটের ব্যবস্থা করে রেখেছেন। সবাই আনন্দে খেলা দেখতে যাওয়ার জন্য তৈরী হল।

এ সময় তিনি প্রায় প্রতিদিন কাজ শেষে বন্ধুদের নিয়ে খেলার মাঠে যেতেন। ক্রীড়ামোদী হিসেবে তখন তার বেশ পরিচিতিও ছিল বন্ধুমহলে। জীবনের শুরু ও শেষে নিদারুণ অর্থকষ্টে কাটানো কবি নজরুল এ সময়টাতে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে ছিলেন। কাজ করতেন সওগাত পত্রিকার অফিসে। বেতন হিসেবে পেতেন কমপক্ষে তৎকালে দু শ টাকা।

কবিতা গান গল্প আর রচনা লিখে আরও বেশ কিছূ কামাই হতো তার। এমন সুদিনে তিনি বন্ধুদের নিয়ে মেতে থাকতেন হৈ হুল্লোড়ে। তার খামখেয়ালীপনার কান্ড কারখানা দেখে আনন্দের বন্যায় ভেসে যেত বন্ধুদের সব দুঃখ বেদনা। খেলা শুরু হল। কবির দু পাশে তার বন্ধুরা তাকে বেষ্টনী দিয়ে রেখেছেন প্রহরী হিসেবে।

খেলা দেখার সময় সব ভুলে একেবারে অন্যমানুষ যেন ছোট শিশুর মত হয়ে যেতেন নজরুল। কখনো আনন্দে লাফ দিয়ে কারো গায়ে পড়ে যেতেন, নয়তো কাউকে বল ভেবে পদাঘাত করে বসতেন, গোল গোল বলে জ্ঞানশূন্য হয়ে কাঁিপয়ে তুলতেন চারদিক তুমুল চিৎকারে। মাঠভর্তি দর্শক হা করে তাকিয়ে দেখত বিদ্রোহী কবির শিশুসুলভ কান্ডকারবার। বিস্ময়ে বিমুগ্ধ হতো আশেপাশের মানুষ। খেলা শেষ হলো।

ছয় গোলে মোহনবাগান হারিয়েছে বিদেশী ফুটবলারদেরকে। নজরুলের আনন্দ তখন আর দেখে কে? শুরু হল বন্ধুদের নিয়ে তার উল্লাস নৃত্য। সবাইকে নিয়ে নেচে খেলে ক্লান্ত হলেন কবি। তারপর ঢুকলেন পাশের খাবারের দোকানে। পেট ভরে সবাই তৃপ্ত হল।

তবু মন ভরেনা দুরন্ত কবির। এই চল, চন্দননগন থেকে ঘুরে আসি। প্রাণখোলা নজরুলের মুখে এমন কথায় সবাই একলাফে রাজী। কারো বাড়ীতে কেউ জানালোনা, সবাই চলল চন্দননগর। চন্দননগরে এসেও মন মানে না কবির।

আরও দূরে যেতে চান তিনি। একটু আনন্দ আর প্রানখোলা হাসিতে জগত ভরিয়ে দিতে তার চঞ্চল মন তাকে শান্ত হতে দিচ্ছেনা যে। নাহ, চল, সবাই ঢাকা থেকে বেড়িয়ে আসি। যা হয় হোক। কবির এমন খেয়ালীপনা তার বন্ধুদের কাছে নতুন কিছু নয়।

কোনো নিয়মের শেকল তাকে আটকাতে পারেনি, ছোটবেলা থেকে নির্বাক হওয়া অবধি। কোথায় চন্দননগর আর কোথায় ঢাকা? কিন্তু যেখানে সাধ্যের চেয়ে সাধ বড়, সেখানে আর কে ঠেকায়? বাঁধনহারা নজরুলের ডাকে এক কাপড়ে সবাই ছুটল শিয়ালদা ষ্টেশনে। এবার টিকেট কাটতে গিয়ে হুঁশ এল সবার। এক নজরুলের পকেটে যে টাকা আছে, তা দিয়ে সবার ঢাকা ঘুরে আসা সম্ভব নয়, বাকী সবার পকেট শূন্য। তবে কি সবাই ফিরে যাবে কলকাতায়? নিছক টাকার জন্য ঢাকা যাত্রা বাতিল হচ্ছে? যেখানে নজরুল, সেখানে সব হিসেব ভুল।

সবাইকে হাঁক দিয়ে বললেন, এই তোরা দাঁড়া, চিন্তা করিসনে, ব্যবস্থা করে আসছি। লম্বাচুলের বেশে বলিষ্ঠ দেহের সুপুরুষ তাগড়া জোয়ান নজরুলকে তখন অনেকেই চিনতো। তিনি ষ্টেশনের গেটে যাওয়া মাত্র তাকে দেখে দৌড়ে এলেন মাস্টার। নমস্কার জানিয়ে তাকে শ্রদ্ধা জানালেন লোকটি। নজরুলও তাকে সম্ভাষণ জানিয়ে বললেন, এই যে শুনুন, আমরা কয়েকজন ঢাকা যাব, কিন্তু সবার যাওয়ার মত খরচ নেই, আমরা ভেন্ডার গাড়ীতে যেতে রাজী আছি।

’ কবির কথায় কাজ হলো। দেশজুড়ে তামাম জনতা যার কবিতায় মত্ত হয়ে যায়, সামান্য মাস্টার সেখানে তেমন কি? সবার যাওয়ার ব্যবস্থা হল। ইষ্ট বেঙ্গল মেলে চড়ে সবাই ছুটলো হাসি আনন্দ আর গান বাজনার মধ্য দিয়ে। সবাই এসে নামলো গোয়ালন্দ স্টেশনে। এখান থেকে বাকী পথ যেতে হবে জাহাজে।

টাকা নেই, টিকেট নেই। এই এতদূরে ভিনদেশে কে চিনে নজরুলকে? এবার উপায়। নজরুল পড়লেন বিপদে, তার বন্ধুরা দুশ্চিন্তায়। কিছুক্ষণ কী যেন ভাবলেন কাজী নজরুল। যেখানে নজরুল সেখানে সব রীতি ভন্ডুল।

নজরুল তাই সবাইকে চুপে চুপে কী যেন বলে নিজে একটি টিকেট আর একখানা মাদুর কিনলেন ঘাট থেকে। তারপর সোজা কোন তোয়াক্কা ছাড়া মাদুর বিছিয়ে বসে পড়লেন জাহাজের ডেকে। কোনদিকে না তাকিয়ে ভরাট গলায় টান দিলেন, প্রাণভোলানো সুরে শুরু করলেন গজল গাওয়া। চুপে চুপে বলে আসা বুদ্ধিমত তার বন্ধুরা ততক্ষণে তার চারপাশ ঘিরে বসে তালি বাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। কেউ হাততালি দিচ্ছে, কেউ মাথা নাড়াচ্ছে, এ যেন আসমানী জলসা।

কবি তখন গভীর ভাবের সাগরে ডুব দিয়ে একের পর এক গাইছেন ভুবন ভোলানো গজল। বন্ধুদের কারো কাছে টিকেট নেই, তাতে কী? সবাই তখন দেওয়ানা মাস্তানা নজরুলের দরাজ সুরের সাগরে। দেখতে দেখতে জমে গেল ভীড়। ছুটে এল খোদ জাহাজের কর্মচারী ও কর্তারাও। কার সাধ্য, নজরুলের কথা ও সুরের যাদুকে ঠেলে দেয়, যেমনই তার কথা তেমনই তার সুর, যে শুনেনি, তাকে কে বুঝাবে তার যাদুকরী মনমোহনীর ক্ষমতা।

শ্রোতা দর্শকের ভীড়ে ও চাপে জাহাজ কাত হয়ে যাচ্ছে, এমন গুরুতর দশা দেখে উপর থেকে নীচে নেমে এলেন জাহাজের ক্যাপ্টেন। রাগের মাথায় নীচে নেমে তিনিও মজে গেলেন সবার সাথে। বিনয় শ্রদ্ধার সাথে নজরুল ও তার সাথীদেরকে আমন্ত্রণ জানিয়ে একেবারে জাহাজের মাঝখানে বসিয়ে দিলেন কবিকে। শুধূ কি তাই, টিকেট পরীক্ষকও সব ভুলে ডুবে থাকলেন নজরুলের মায়াবী হৃদয়দোলানো সুরের সাগরে। দৌড়ে গিয়ে নিজের রুম থেকে তবলা এনে হাতে তুলে দিলেন নজরুলের বন্ধুদের, বারবার জানতে চাচ্ছিলেন কোন সেবার কিংবা কিছুর প্রয়োজন আছে কিনা? এভাবে পুরো পথ পাড়ি দিয়ে রসিক নজরুল এসে পৌঁছলেন আমাদের ঢাকায়।

কবি হিসেবে তার নাম ডাক তখনো তেমন ছড়ায়নি, এই ঢাকায় তাকে সমাদর করবে কে? তাছাড়া এত বন্ধু বান্ধব মিলে তো আর একজনের বাড়ীতে উঠা যায়না, সবাই তখন বুদ্ধি করে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে যার যার স্বজন পরিজনদের বাসায় গিয়ে উঠলো। নজরুল থাকলেন বুদ্ধদেব বসুর দলে। আরও কয়েকজন সাথে নিয়ে এ দলের দায়িত্ব নিলো বুদ্ধদেব। তার এক আত্মীয় ঢাকায় উচ্চপদস্থ সরকারী কর্ত। সবাই মিলে সেখানে গিয়ে উঠার পরিকল্পনা চূড়ান্ত হলো।

এবার আরেক বিপদ। এ দলের সবাই হিন্দু শুধু কবি নজরুল ছাড়া। বন্ধুরা বিপদে পড়লেন এ প্রাণের বন্ধুকে নিয়ে। তৎকালে ঢাকায় হিন্দুদের সমাজে ছিল জাতিভেদের প্রথা আর কৌলীন্যের বড়াই। তাই নজরুল নাম শুনলে তাকে কেউ ঘরে তুলবে না।

তবে কী করা যায়? সবাই মিলে নজরুলের নাম আপাতত বদলে দিল। তার নাম স্বামী রামানন্দ। লম্বা ঝাঁকড়া চুলের বিশাল বপুর অধিকারী নজরুলের সাথে নামটা একেবারে মিলে গেল। তার চোখ মুখের অপূর্ব দীপ্তি আর ভরাট গলা শুনলে তাকে বাউল সন্যাসী না ভেবে উপায় নেই। বুদ্ধদেব বাবু তার এ দল নিয়ে হাজির হল তার আত্মীয়ের বাসায়।

বাবরী চুলের নজরুলকে দেখে পরিচয় জানতে চাইল ঘরের লোকজন। ইনি বেলুড়মাঠের রামানন্দ বাবাজী’ বলে সবাইকে জানিয়ে দিলো দলনেতা। মুহূর্তে সাড়া পড়ে গেল সারা বাড়ীজুড়ে। কাছে গিয়েও যার পদধুলি পায়না মানুষ, তিনি এসেছেন এ বাড়ীতে অতিথি হয়ে, সাধক পুরুষের পদধুলিতে ধন্য হবে সবাই, নিজেদেরকে বড্ড সৌভাগ্যবান ভাবতে লাগলেন বাড়ীর কর্তারা। শুধু কি কবি? নজরুল ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার ভান্ডার।

কখনো তিনি হাতের রেখা বলে ভবিষ্যত বলে দিতেন। বেদ বেদান্তদ, উপনিষেদ, রামায়ণ আর মহাভারতসহ হিন্দু ধর্মের নানা গ্রন্থে তার জানাশোনা ছিল প্রচুর। হিন্দুয়ানী ধর্মের তত্ত্বকথাতো বটেই, তাদের শ্যামাসঙ্গীতেও তিনি ছিলেন পটু। আর তাই বাবাজী বেশধারী নজরুল এ কয়টা দিন ধর্মের গুরুগম্ভীর আলোচনা, কখনো শ্যামাসঙ্গীতের উজাড় করা সুরে ভরিয়ে দিতেন সবার মন। এমন সাধক বাবার সুনাম শুনে পাড়া পড়শীরা ছুটে আসতে লাগলো ফলমূল আর মিষ্টান্ন মিঠাই নিয়ে।

ভক্ত অনুরক্তের আগমনে ভরে গেল কর্তার ঘর আঙিনা। একটু প্রনাম জানাতে নানা পদের আহারাদী নিয়ে ছোট বড়রা আসতে লাগল যে কদিন নজরুল ওখানে ছিলেন। আত্মভোলা নজরুলের বেশ ভালোই লাগছিল এ বাবাজী জীবন। আড়ালে মুখ টিপে তখন হাসছিল তার বন্ধুরা। এই না হলে কি আর তাদের প্রাণবন্ধু নজরুল।

এক প্রফেসরের গলায় গান ধরালেন কবি কবি নজরুল তখন খুব ব্যস্ত। নিয়মিত গ্রামোফোন কোম্পানীর রিহার্সাল রুমে আসেন, গান লিখেন, সুর করেন, গান শিখিয়ে দেন। বেশীর ভাগ গান গাইছে কে মল্লিক। একদিন এই কে মল্লিকের কাছে এক লোক এল। লোকটির নাম প্রফেসর জি দাস।

এসে ধরল মল্লিক কে- দেখুন মল্লিক বাবু, আপনার বাড়ী কালনা, আমার বাড়ী কাটোয়া, বলা চলে একই দেশের লোক। আমাকে কি আপনি একটু উঠতে দিবেন? আরে, দেশের লোক উঠতে পারলে তো আমারই খুশী। তো কী চান বলুন। আমি গান গাইতে চাই, নেবেন আমাকে? কিন্তু গান গাইতে হলে তো পরীক্ষা দিতে হবে আমাদের কোম্পানীতে। জ্বী আমি রাজী।

পরীক্ষা নেয়া হল প্রফেসরের। ফলাফল একেবারে অচল। গান নেওয়া হবে না শুনে ওখানেই হাউমাউ করে কেঁদে ওঠলেন বেচারা প্রফেসর। কে মল্লিক যতই সান্তনা দেন, বেচারা ততই দ্বিগুণ কাঁেদন। আওয়াজ শুনে এলেন কোম্পানীর বড়বাবু।

তিনি সব শুনে প্রফেসরকে বললেন, আপনার গলা এখনও ঠিক হয়নি। সুর তাল লয় ঠিক থাকছেনা, কদিন পর আসুন, দেখা যাক কী হয়। প্রফেসর লোকটি তখন বড়বাবুর কাছে কয়েকজনের নামে বিচার দিলেন যারা তাকে ফুঁসলিয়ে মিষ্টি খেয়ে নিয়েছে তার কাছ থেকে। ওরা নাকি তাকে এও বলেছে যে তোমার গলা ভাল হলেও কে মল্লিক হিংসা করে তোমাকে গান গাইতে দিবে না। বড়বাবু বুঝলেন যে বেচারা খুব সরল মানুষ, তাকে যেভাবে বুঝানো হয়েছে সে বুঝেছে।

প্রফেসরের কান্না আর থামছে না। এমন সময় রুমে ঢুকলেন কাজী নজরুল। কী ব্যাপার? বলে তিনি মনোযোগী হলেন কান্নাকাটির কারণ জানতে। বড়বাবু আর কে মল্লিক তাকে সব খুলে বললেন। কবি তখন বললেন, বেচারা থেকে রেকর্ডের আশ্বাস দিয়ে যখন মিষ্টি খাওয়া হয়েছে, অতএব তার একটা গান রেকর্ড করতেই হবে।

আরে কাজীদা, কী বলছেন আপনি? দেখছেন না লোকটা একজন পাগল। আরে মল্লিক, আমারা বাঙালীরাও কিন্তু কম হুজুগে নই, দেশটাও হুজুগে। এই বলে কবি প্রফেসরের দিকে তাকিয়ে বললেন, শোনো, তুমি কাল এস, তোমাকে শিখিয়ে আমি রেকর্ড করিয়ে নিব। কবি নজরুল বলে কথা। মল্লিক আর বড়বাবু তাকে ভাল করেই জানেন।

কাজেই সবাই পরবর্তী কান্ড তামাশা দেখার অপেক্ষায় থাকলেন। পরদিন কবি এসে দেখেন, প্রফেসর জি দাস অনেক আগেই এসে হাজির। কবি তাকে দেথে বললেন, যাও মল্লিককে ডেকে আনো। আবার মল্লিকের নাম শুনে মন খারাপ হয়ে এল বেচারার। কাজীদা, ঐ লোকটি এলে আমার গান খারাপ করে দেব’ বলে অভিযোগ করলেন মল্লিকের বিরুদ্ধে।

কবি তাকে সন্তনা দিয়ে বললেন, আরে না, মল্লিক খুব ভালো লোক, তোমার সাথে কেমন সুন্দর হারমোনিয়াম বাজায়, তুমি দেখো। খবর পেয়ে মল্লিক সাহেব এলেন। কাজী নজরুল তাকে দেখে বললেন, আরে আসুন আসুন, প্রফেসরের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি তবলাওয়ালাকে ডাকো, তারপর দরজায় খিল এঁটে দাও। রিহার্সাল রুমে তখন চারজন। কাজী নজরুলের কান্ড দেখার জন্য মল্লিক সাহেব চোখ বড় করে তাকিয়ে আছেন।

তবলাওয়ালাও ভাবছে, এই পাগলকে দিয়ে কী গাওয়াবেন কাজী সাহেব, কে জানে? কবি এবার তৈরী হয়ে প্রফেসরকে বললেন, শোনো, তোমাকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করে, কী গাইবে, কিছুই বলবেনা তখন। খুব সাবধান, বাজারে রেকর্ড এলে যেন সবাই শুনে। তার আগে যেন কেউ টের না পায়। বেচারা প্রফেসর মাথা নেড়ে সুবোধ বালকের মত সায় দিল। হেসে হেসে বলল, না , না, কাউকে শোনাবো না।

আচ্ছা, এবার গান ধরো, বলে কাজী নজরুল তাকে বলতে বললেন, কলা গাড়ি যায় ভষড় ভষড়/ ছ্যাকরা গাড়ী যায় খচাং খচ/ ই্িচং বিচিং জামাই চিচিং/ কুলকুচি দেয় করে ফচ। । অদ্ভুত এমন গান শুনে উপস্থিত বাকী দুজন ওখানেই হাসতে লাগলেন, কবির কান্ড দেখে তারা ততক্ষণে খেই হারিয়ে ফেলছেন। পরের দিন এর আরেকা জোড়া লিখে আনলেন কবি, এবার অপর পিঠে রেকর্ড করালেন আরেক গান- মরি হায় হায় হায়. কুব্জার কী রুপের বাহার দেখো। / তারে চিৎ করলে হয় যে ডোঙা/ উপুড় করলে হয় সাঁকো।

/ হরি ঘোষের চার নম্বর খুঁেটা, মরি হায় হায় হায়// এ গানে প্রফেসরকে যে চতুষ্পদ বানানো হচ্ছে, তাও কেউ টের পেলনা। খুব উৎসাহে প্রফেসর রিহার্সাল করতে থাকল। রেকর্ডিং ম্যানেজারকেও জানানো হলনা, কী গান কাকে দিয়ে রেকর্ড হচ্ছে? চরম গোপনে গান দুটো রেকর্ড হল, তারপর বাজারে ছাড়া হল। বাজারে প্রকাশিত হওয়ার দু একদিন পর কবি মল্লিককে ডেকে বললেন, একটু দেখে আসুন তো বাজার থেকে, কেমন বিক্রি হচ্ছে গান দুটো? বাজারে খোঁজ নিয়ে এসে মল্লিক হাসতে হাসতে বললেন কবিকে, কাজী দা, খুব বিক্রি হচ্ছে অদ্ভুত গানদুটো। ক্রেতারা কিনছে আর গাইছে, কলা গাড়ী যায় ভষড় ভষড়..... কোম্পনীর ম্যানেজার তো দারুণ খুশী।

বড়বাবুকে ডেকে বললেন, তুমি তো বলেছিলে, লোকটি পাগল। ওর গান তো বেশ সেল হচ্ছে, আরো দু একটা নাও না ওর গলায়.. মল্লিক সাহেব দৌড়ে গিয়ে কাজীকে কর্তার প্রস্তাব জানালেন। কবি হাসতে হাসতে বললেন, মল্লিক সাহেব, এবার কিন্তু গালাগাল খেতে হবে, হুজুগে দেশে এসব একবারই চলে। বলেই আবার জোরে হাসিতে ফেটে পড়লেন আমাদের কবি কাজী নজরুল ইসলাম। এই ছিল তার রসিক কান্ড, খেয়াল খুশীতে তিনি পাগলকে দিয়েও বাজার মাত করে ফেললেন, অবাক হয়ে পুরো কোম্পানী তার প্রতিভার কাছে তাই মাথা নুইয়ে থাকতো।

কবি নজরুলের বুলবুলপ্রীতি কবি নজরুলের প্রথম ছেলেটির নাম ছিল বুলবুল। কবি তার এই ছেলেটিকে খুব ভালবাসতেন, তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন। বাবা হিসেবে মনের মত করে তিনি তাকে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, তার জীবন ও যৌবন সাজাতে চেয়েছিলেন। বুলবুল এর গলাও ছিল অসাধারণ মিষ্টি। কবির সাথে যারা আড্ডা দিতে আসতেন, তারাও তাকে আদর করতেন, তার মুখের কথা শুরে অবাক হতেন।

শুধু কি তাই, কবি যখন হারমোনিয়াম হাতে নিয়ে কোন সুর বাজাতেন, ছোট্ট ছেলে বুলবুল সবাইকে তাক লাগিয়ে বলে দিত, আব্বু এখন এই গানটি করবেন, এ বাজনা এ গানেরই। তার গলায় গান শুনে অবাক হয়েছিলেন তৎকালে কবির বন্ধুবান্ধবরা। কবি যেখানে যেতেন, এই ছোট খোকাকে সাথে নিয়ে যেতেন। বুলবুলকে নিয়ে কেটে যেত তার হাসি আনন্দে ভরা উচ্ছল সময়গুলো। বাধা বন্ধনহীন কবির ছন্নছাড়া জীবন ধীরে ধীরে সুশৃঙ্খল হয়ে উঠছিল বুলবুলকে ঘিরে।

জন্মের পর থেকে দুঃখ যার নিত্য সঙ্গী, সেই দুখুমিয়া কবি নজরুলের কপালে এ সুখ আনন্দ বেশীদিন সইলো না। অল্প বয়সে কবির ছেলেটি অসুখে ভুগে চলে গেল পরপারে। আদরের প্রথম সন্তান ছোট খোকা বুলবুলের এ মৃত্যু কবিকে ভেঙে চুরমার করে দিল। জীবনের প্রথম স্বপ্নসৌধ অবেলায় টুকরো টুকরো হয়ে গেল সদা হাস্যপ্রাণ কবি নজরুলের। মাত্র কয়েক লাইন লিখে কবির দুঃখ বেদনা আর মুষড়ে পড়ার কথা এখানে বুঝানো অসম্ভব।

কাঁদতে কাঁদতে কবির চোখদুটো ফুলে গিয়েছিল, নাওয়া খাওয়া ভুলে এমন ”ঞ্চল কাজী নজরুল একেবারে নীরব হয়ে গেলেন, কতখানি শোকে বিদ্রোহী কবি পাথর হয়ে চুপচাপ হয়ে যেতে পারেন, তা অনুমান করা হয়তো কিছুটা সম্ভব। বুলবুলের সব খেলনা, জামা কাপড় কবি পরম আদরে সাজিয়ে রেখেছিলেন। তাকে সান্তনা জানিয়ে তার বন্ধুরা যেসব চিঠিপত্র পাঠাতেন, সেসব পড়ে কবি জোরে জোরে কেঁদে বুক ভাসাতেন নয়নের জলে। বুলবুলের চিকিৎসায় তার অনেক টাকাও খরচ হয়েছিল, কাজেই মৃত্যুশোকের সাথে এবার যোগ হল অর্থকষ্ট। ভরাক্রান্ত কবির কাছে এ দিনগুলো ক্রমেই অসহনীয় হয়ে উঠছিল।

তার জীবনীকারদের কেউ কেউ লিখেছেন, প্রথম সন্তানের মৃত্যুর পর থেকে কবির জীবনে একটি ভাবান্তর আসে, কবি তখন সবার অলক্ষ্যে আধ্যাত্মিক জীবনের দিকে আসক্ত হয়ে পড়েন, তার রচনা ও লেখার স্রোত ধীর হয়ে আসে, এভাবে চলতে থাকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত, এরপর তো তিনি চিরতরে নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। পঞ্চানন ঘোষাল তখন কলকাতার তরুণ পুলিশ অফিসার। কাজী নজরুলকে তিনি ভালোবাসেন এবং মাঝে মাঝে তার সাথে গল্প করেন। একবার কবির বাসায় তল্লাশীর হুকুম এল উপর থেকে। এ বেচারাকে দায়িত্ব দেয়া হল সে দলে থাকার।

গোয়েন্দারা তাকে নিয়ে দরজায় কড়া নাড়ল কবির ঘরের। কাজী নজরুল দরজা খুলে দিলেন এবং সঙ্গত কারণে এই তরুণ অফিসার এবং কবি দুজনই পরস্পরকে না চেনার ভান করে রইলেন। গোয়েন্দা পুলিশের দল কবির ঘরে সবকিছু তছনছ করে তল্লাশী চালাচ্ছে, কবিও তাদেরকে যথাসম্ভব বাক্স খুলে খূলে দেখাচ্ছেন। হঠাৎ ঘরের কোনে পরম যতেœ উঠিয়ে রাখা একটি বাক্সে নজর পড়ল তাদের। তারা সেটি খুলে দেখতে চাইল।

কবি অসহায়ের মত দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে বলে উঠলেন, না না, ওটাতে হাত দিবেন না যেন। কবির বিচলিত মুখভঙ্গি দেখে পুলিশদের সন্দেহ তীব্র হল। তাদের একজন সজোরে সেটি খুলতেই সেই বাক্সটি থেকে ঝরে পড়ল কিছূ খেলনা আর ছোট ছোট জামা কাপড়সহ বাচ্চাদের অন্যান্য সামগ্রী। এভাবে সেগুলো আছড়ে মাটিতে পড়তে দেখে কবির দু চোখ পানিতে ভরে গেল। ঝরঝর করে তিনি কেঁদে দিলেন সবার সামনে।

এমন সুকঠিন মুখখানা তার ব্যাথায় ও দুঃখে কালো হয়ে এল। এ খেলনা ও ব্যবহার্য সামগ্রীগুলো ছিল কবির আদরের সন্তান এই ছোট বুলবুলের। তার মৃত্যুর পর এসব বুকে জড়িয়ে কবি সান্তনা খূঁজে পেতেন, আদর আর চুমো পৌঁছে দিতেন বুলবুলের গালে। এ অফিসার তার এক লেখায় নিজেকে অত্যন্ত ব্যর্থ ও লজ্জিত উল্লেখ করে লিখেছেন, এরপর কত মানুষের কত ঘর সার্চ করেছি, কিন্তু সেদিনের মতো এমন কষ্ট আর কোথাও পাইনি। নজরুল লিখলেন তার বুলবুলকে নিয়ে, আমার কাননের বুলবুলি উড়ে গেছে, যে দেশে গেছ তুমি- সে কি বুলবুলিস্তান ইরানের চেয়েও বেশী সুন্দর।

’ আরেক জায়গায় লিখেছেন, আমি যখন আমার পথ খুঁজছি, তখন আমার প্রিয়তম পুত্রটি সেই পথের ইঙ্গিত দেখিয়ে আমার হাত পিছলে মৃত্যুর সাগরে হারিয়ে গেল। মৃত্যু এই প্রথম আমার কাছে ধর্মযাজকরূপে দেখা দিল, সেই মৃত্যুর পশ্চাতে আমার অন্তরাত্মা নিশিদিন ফিরতে লাগল...ধর্মরাজ আমার পুত্রকে শেষবার দেখিয়ে হেসে চলে গেলেন। ’ এ সময় কবি প্রায়ই ধ্যানমগ্ন থাকতেন, নীরব হয়ে দিন কাটাতেন, এমনকি এ দুরন্ত কবি তার বন্ধুদেরকে, যাদেরকে নিয়ে দিনরাত ভুলে হাসি আড্ডায় মেতে থাকতেন, তাদেরকে একবার বলে ফেললেন, আমি এ ভারতের সর্বসেরা ধ্যানমগ্ন ব্যক্তি। কবির জীবনে বুলবুলের মৃত্যুতে যে ধাক্কা লেগেছিল, তা তিনি নির্বাক হওয়ার আগ পর্যন্ত আর ভুলতে পারেন নি। কবিতার আগুনে জ্বালাময়ী লেখায় আর ভরাট গলার টানে যে কবি পুরো বাংলাকে যাদুগ্রস্ত করে মোহময় করে রাখতেন, এমন বিদ্রোহী আর অশান্ত কবি নজরুলের মমতাময় মনের এমন প্রকাশ দেখে তার বন্ধুরাও নিশ্চুপ হয়ে থাকতেন।

কাজী নজরুল যেভাবে ছড়া ও গান কবিতা লিখতেন কাজী নজরুল এসেছেন কুমিল্লায়। উঠেছেন শ্রী ইন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের বাড়ীতে। একদিন তার কানে একটি শিশুর আওয়াজ ভেসে আসল। তিনি কান পাতলেন, চোখ মেলে তাকালেন, দেখেন, সেই বাড়ীরই ছোট মেয়েটি একটি পেয়ারাডালে বসা কাঠবেড়ালীর সাথে ভাব জমাচ্ছে। এই ভয় দেখায়, আবার আদর করে, কখনো নিজেই রাগ করে, আবার অভিমান ভুলে যায়, কখনো মেয়েটি কাঠবেড়ালটিকে বলছে, তোমার সাথে আমার আড়ি, যাও।

কবি নজরুল এ দেখে নিজেও যেন শিশুর জগতে মিশে গেলেন। তিনি তন্ময় হয় ছোট্ট মেয়েটির ভাব জমানো দেখছিলেন, মেয়েটি রাগ হয়ে বলছিল, হেই ভগবান, একটি পোকা যাস পেটে ওর ঢুকে। ’ শিশুমনা নজরুল দারুণ মজা পেলেন তার এ দুষ্টুমী দেখে। তখনই কাগজ কলম নিয়ে বসে ফেললেন এবং হাসতে হাসতে লিখে ফেললেন তার সেই ছড়াটি, অজস্র শিশুর প্রথম পাঠ্য বইয়ে আজো সেই ছড়াটি বিদ্যমান। গ্রামোফোন কোম্পানীতে কাজী নজরুল তখন খুব ব্যস্ত সময় কাটাতেন।

চারিদিকে তখন শিল্পীদের ভীড়। তিনি লিখে চলেছেন অবিরাম, সুর করে শিখিয়ে দিচ্ছেন বিরামহীনভাবে। রিহার্সাল ঘরে তুমুল হৈ হুল্লোড়ে বসে কবি সবার সাথে মিসে যেতেন আনন্দে। হঠাৎ দেখা যেত, কবি চুপ হয়ে আছেন। যেন ভাবান্তর ঘটেছে তার মনে।

আনন্দে ব্যস্ত রুমভর্তি মানুষদের কেউ তার এ আচমকা নীরবতা টের পেলনা। এত গোলমাল আর হট্টগোলের মধ্যে তিনি মুখভর্তি পান চিবোতে চিবোতে আধ ঘন্টার কম সময়ে লিখে ফেলতেন দশ বারোটি গান। তারপর হাতে হাতে তা বিলি করে দিতেন। যেন মাথায় তৈরী করা ছিল, শুধু কাগজে তুলে দিলেন। একদিন এলেন শিল্পী আব্বাস উদ্দীন।

এসে কবিকে বললেন, এই যে কাজীদা, দেখুন, পাশের রুমে পিয়ারু কাওয়াল উর্দু কাওয়ালী গানের রিহার্সাল দিচ্ছে। বাজারে সেসব গান খুব চলছে। আপনি বাংলায় এমন কিছু গান লিখে দেন না কেন? কোম্পানীর বাঙালী সাহেব বলে উঠলেন, না না, ওসব চলবে না বাজারে। এভাবে চলে গেল প্রায় এক বছর। কী ভেবে এবার কর্তা রাজী হলেন।

আব্বাসউদ্দীন ছুটে গিয়ে কবিকে বললেন, কাজীদা, কর্তা রাজী হয়েছেন। এ খবর শুনে নজরুল একটি আলাদা রুমে গিয়ে ঢুকলেন। আব্বাসকে বললেন, কিছু পান নিয়ে এসো। তিনি পান নিয়ে এলেন ঠোঙা ভর্তি করে। কবি নজরুল তখন বললেন, দরজাটা বন্ধ করে এবার চুপচাপ বসে থাক।

পনেরো থেকে বিশ মিনিট। কবি মাথা তুলে তাকিয়ে বললেন, এই যে এসো, নাও, ধরো, সুর শিখে নাও। শিল্পী আব্বাস উদ্দীন অবাক। এই ক মিনিটে তার কাজীদা লিখে ফেলেছেন, ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো...। শুধু কি লিখলেন, সুরও ধরিয়ে দিলেন সাথে সাথে।

আর বললেন, কাল এসো আবার। রেকর্ডের অপর পৃষ্ঠার জন্য আরেকটি লিখে দিব। পরদিন তিনি এলেন এবং কবি তার জন্য লিখে দিলেন, ইসলামের ঐ সওদা লয়ে এলো নবীন সওদাগর। চারদিন পর গজল দুটো রেকর্ড হল এবং বাজার মাত হয়ে গেল। এভাবে শুরু হল তার গজল লেখা।

কোম্পানীও দেদারসে মুনাফা করল এসব বিক্রি করে। মাত্র কয়েক মিনিটে জন্ম নেওয়া সেসব গানগজল এর মহিমা ডিঙাতে পারেনি আজও কোন কবি কিংবা শিল্পীর গান। কুইজঃ কাজী নজরুলের কি কোন গানের ওস্তাদ ছিল? উত্তরঃ গ্রামোফোন কোম্পানীতে নিমন্ত্রণ পাওয়ার পর কবি ভাবলেন, গানের বিদ্যাটা একটু ভালো করে শিখে ঝালিয়ে নেওয়া দরকার। সেসময় ১৯২৯ সালে তিনি ওস্তাদ জমীরুদ্দীন খানের কাছে কিছু তালিম নিয়েছিলেন, যাতে ওস্তাদী করতে তার কাজে লাগে। এর প্রমাণ মিলে ১৯৩২ সালে সেপ্টেম্বরে তার গানের বই ‘বনগীতি’ উৎসর্গপত্রে তিনি লিখেছিলেন, ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত কলাবিদ আমার গানের ওস্তাদ জমীরউদ্দীন খান সাহেব এর দস্ত মোবারকে।

’ কাজী নজরুল ইসলামের হাস্যরস ও রসিক কারবার কাজী নজরুল এসেছেন সিরাজগঞ্জে। ইসমাইল হোসেন সিরাজীর প্রতি কবির ছিল অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা ও বিনয়মিশ্রিত ভালোবাসা। সিরাজীর কবরের পাশে দাঁড়িয়ে কবি কাঁদলেন, খোদার কাছে মাগফেরাত চাইলেন। বেদনাবিধুর কণ্ঠে তিনি উপস্থিত লোকদেরকে শোনালেন, সিরাজী সাহেব আমাকে যে আদর করেছিলেন, তা আমার জীবনে শ্রেষ্ঠ পাওয়া। এমন আদর আমাকে এই বাংলার আর কেউ করে নাই।

এই সিরাজগঞ্জ থেকে তিনি আমার জন্য মানি অর্ডার করে সেকালে দশটি টাকা পাঠিয়েছিলেন, বলেছিলেন, একটি কলম কিনে নিও. আমার কাছে এর বেশী এখন নেই, থাকলে তোমায় পাঠিয়ে নিজেকে ধন্য মনে করতাম। ’ কথাগুলো বলার সময় বিদ্রোহী কবির চোখে অশ্র“ ছলছল করছিল। সফরের তৃতীয় দিন কবি খেতে বসেছেন আসাদউদ্দৌলা সিরাজীর ঘরে। সবার পাত্রে ইলিশ ভাজা পরিবেশন করছেন তিনি। কবির পাত্রেও একখানা দিয়েছিলেন, কবি সেটি খেয়ে কেবল শেষ করছিলেন, তখনই একজন আরও কিছু ইলিশভাজা তার প্লেটে দিতে যাচ্ছিলেন, রসিক কবি নজরুল তাকে বাধা দিয়ে হো হো করে বলে উঠলেন, আরে আরে করছ কী? শেষকালে আমাকে বিড়াল কামড়াবে তো? উপস্থিত সবাই কবির কথাটা বুঝতে পারল না।

গিয়াসুদ্দীন নামে একজন জিজ্ঞেস করলেন, মানে? কবি বলতে লাগলেন তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে, আরে বুঝলেন না! ইলিশ মাছের গন্ধ মুখে লালা ঝরায়, বিড়াল মাতাল হয়ে যায় এর ঘ্রাণে, বেশী খেলে কি আর রক্ষে আছে, সারা দেহ থেকে গন্ধ ছুটবে আর সে গন্ধ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.