আমি স্বপ্ন দেখি একদিন বাংলাদেশ দুর্নীতিমুক্ত হবে পর্ব:২ Click This Link
পর্ব-৩: হাকিমের আদালত
পরদিন ভোরে মাহফুজ ভাই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল গেলেন; ময়না তদন্তের বিষয়টা দ্রুত সুরাহা করতে। দিনের আলো ফুটতে না ফুটতেই আমার কাছে সাংবাদিক ও আত্মীয়দের ফোন আসতে শুরু করল; সবাই আসল ঘটনা জানতে চায়। একটু বেলা হলে থানায় শুরু হলো আরেক নাটক; সকালে পত্রিকা খুলে আমার অফিসের সহকর্মীরা জানতে পারেন আমি হাজতে। ছোট-বড় সব জাতীয় দৈনিকে আমাদের খবরটা চলে এসেছে; একটি সস্তা পত্রিকা নাকি লিখেছে, পুলিশ গভীর রাতে আমাদেরকে বাসা থেকে গ্রেফতার করেছে; সেটা পড়ে অনেক আত্মীয় আতংকিত হয়ে আমাদেরকে ফোন করছেন। আমার সহকর্মীদের কেউ কেউ ফোন করে চলে এলেন আমাকে উদ্ধার করতে; অবশ্য আগের রাতে আমার লাইন ম্যানেজার সাজিদ ভাইকে এস.এম.এস. পাঠিয়ে জানিয়েছিলাম বিষয়টি; ভোর না হতেই ছুটে এসেছেন আমার অফিসের মইন ভাই, রতন ভাই, বিপ্লব ভাই, মাসুম ভাই; কয়েকঘন্টা অপেক্ষা করার পর তাঁরা ওসি সাহেবের দেখা পেলেন, কোন ফল হয়নি; তবু বিপদের এই ক্ষণে তাঁদেরকে পাশে পেয়ে খুব ভাল লাগল আমার।
একটু বেলা হলে এলেন আঞ্চলিক ডি.সি. সাহেব; আরেক দফা আমাকে ও মৌমিতাকে পৃথকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো; তাঁর আচরণ ভীষণ ভদ্র এবং মনে হলো তিনি আমাদেরকে বিশ্বাস করেছেন। কিন্তু আমাদের ছাড়বার কোন লক্ষণই দেখা গেলনা। ইতোমধ্যে আমার মা তাঁর এক বান্ধবীর পরিচিত একজন উকিলকে পাঠিয়েছেন থানায়। উকিল সাহেব সব শুনে বললেন, কোন চিন্তা করবেননা; আজই জামিন হয়ে যাবে। শাহেদ ভাইয়া জরুরী কাজে আটকে গেছেন কোথায় যেন; তিনি তাঁর ছোট ভাই শাওন ভাইয়াকে পাঠালেন।
শাওন ভাইয়া বয়সে আমার বছর দশেক বড় হলেও তাঁর সাথে আমার খাতির ছোটবেলা থেকে; তাঁকে পেয়ে আমার মনে হলো, আমি একা নই; কেউ আমার কিছু করতে পারবেনা।
মাহফুজ ভাই ফোনে জানালেন ঢাকা মেডিক্যালের এক সার্জন বন্ধুকে নিয়ে তিনি মর্গে লাশটা দেখিয়েছেন। এখন সেই কালো ছোপ ছোপ দাগগুলো নেই; ওটা ছিল চাপ চাপ রক্তের দাগ। শক্ত কার্পেটের ওপর শোয়া অবস্থায় মারা যাবার ফলে সব রক্ত শরীরের তলায় জমাট বেঁধেছিল বলে এমনটা হয়েছিল। পোস্ট মর্টেম যিনি করবেন, তাঁকে খুজেঁ বের করে সব দ্রুত সমাধান করবেন বলে মাহফুজ ভাই ফোন রাখলেন।
শুনে আমরা ওকটু আশ্বস্ত হলাম; তখনও আমরা ভাবছি, বিকেলের মধ্যে পোস্ট মর্টেম হয়ে যাবে এবং আমরা আজই বাসায় ফিরব।
সকালে আমাদেরকে বসানো হয়েছে একটা বড় হল ঘরে, যেখানে সব এস.আই.-রা বসেন। অনেক রকম লোকের আনাগোনা দেখতে লাগলাম আমি; যে এস.আই. গতরাতে আমাদেরকে এখানে এনেছেন, তিনি আমার একটা অফিসিয়াল স্টেটমেন্ট লিখে একটা ফাইলে রেখে দিলেন। সেই একই ইতিহাস কতবার যে কতজনকে বলতে হবে, কে জানে?
শুদ্ধকে সামলানো হয়েছে আরেক কঠিন কাজ; এত বড় হল ঘর পেয়ে সে এপ্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ছুটে বেড়াচ্ছে। মৌমিতা ওকে জুস-বিস্কিট খাওয়ানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো।
হঠাৎ চড় মারার শব্দ পেয়ে সবার দৃষ্টি চলে গেল এক এস.আ্ই.-এর দিকে; দেখি, তিনি ১৬-১৭ বছরের এক দারোয়ানগোছের কিশোরকে চড়-থাপ্পড় মারছেন আর গালি গালাজ করছেন; কিশোরটির হাতে হাতকড়া এবং একই হাতকড়ার আরেক অংশ বাঁধা সবুজ টি-শার্ট পরা এক তরুণের হাতে। তাদের দুজনকেই সেই এস.আই. গালি দিচ্ছেন চোর বলে; অশালীন কিছু গালিও আছে বাক্যালংকার হিসেবে; এরা নাকি কোন এক নির্মানাধীন ভবনের রড চুরি করেছে।
এদিকে আমার উকিল সাহেব আমার এই কেসের তদন্তকারী এস.আই.-এর সাথে কিছুক্ষণ গুজগুজ করলেন। তারপর আমার কাছে এসে বললেন, আপনি তো মহাবোকা! পুলিশকে বলেছেন কেন যে মহিলা মারা যাবার পর আপনি হাসপাতালে নিয়ে গেছেন?
আমি বললাম, সেটাই তো সত্যি। আমি কোথাও কাউকে এক বিন্দু মিথ্যা বলিনি।
আর মিথ্যা বলব কেন? আমরা কোন অপরাধ তো করিনি…
উকিল আমাকে থামিয়ে বললেন, এত সত্যভাষণের দরকার নেই। আমি এস.আই.কে বলে আপনার জবানবন্দী একটু বদলে দিয়েছি। এটাই কোর্টে যাবে।
কোর্টে? আমি অবাক হয়ে বললাম, কোর্ট পর্যন্ত কেন যাবে?
যাবেনা? এটা ফিফটি ফোর কেস!
ফিফটি ফোর কী? আমি আবার বোকার মতো প্রশ্ন করলাম।
উকিল সাহেব বিরক্ত হলেন, ফিফটি ফোর মানে চুয়ান্ন ধারা; সন্দেহজনক মামলা।
আপনাকে খুনী হিসেবে এদের সন্দেহ হয়েছে; তাই পুলিশ নিজে বাদী হয়ে মামলা করেছে। এখন যদি মৃত মহিলার পরিবার এসে মামলা প্রত্যাহার করতে আবেদন করে তো ভাল, আর তারাও যদি বলে যে, তাদের কাছে এটা মার্ডার কেস বলে মনে হচ্ছে, তখন এটা অন্য ধারায় যাবে। আকাশের যত তারা, আইনের তত ধারা; তখন কিন্তু জামিন করানো কঠিন হয়ে যাবে…।
আর কিছু আমার কানে ঢুকলোনা। আমার পায়ের তলায় মনে হলো কিছু নেই।
আমি শূন্য থেকে যেন শূন্যর দিকে পড়ে যাচ্ছি…। মৌমিতা এসে আমাকে ধরল। বলল, একটু জুস খাও। সব ঠিক হয়ে যাবে।
মৌমিতার কণ্ঠে কোন জোর নেই; ওর কথায় আমার কোন বিকার হলোনা।
উকিল সাহেব বললেন, যা বলি সেই মতো করেন; আমার ওপর বিশ্বাস রাখেন; আর আপনার শ্বশুর সাহেবকে বলেন, মহিলার পরিবারকে টাকা-পয়সা দিয়ে শান্ত রাখতে।
বেলা ১২টায় আমাদেরকে বলা হলো, আমাদেরকে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে যেতে হবে। উকিল সাহেব বললেন, আইনত: গ্রেফতারের পরদিন কোর্টে চালান করতে থানা বাধ্য; তবে চিন্তার কিছু নেই, তিনি আমাদের জামিন করিয়ে বিকেলের মধ্যে সব মিটিয়ে ফেলবেন। ওদিকে বুয়ার আত্মীয়দের নিয়ে আমার শ্বশুর পৌঁছেছেন শাহেদ ভাইয়ার বাসায়। শাহেদ ভাইয়া ও ভাবী তাদের যথাযথ আপ্যায়নের ব্যবস্থা করেছেন।
ফোনে ফোনে ঠিক হলো, তারা উকিল সাহেবের অফিসে প্রথমে যাবেন; তারপর ম্যাজিস্ট্রেটকোর্টে গিয়ে লিখিত জানাবেন যে আমার বা আমার স্ত্রীর বিরুদ্ধে তাদের কোন অভিযোগ নেই।
থানা থেকে একজন পুলিশ পাহারায় আমরা তিনজন শাওন ভাইয়ার গাড়ীতে গেলাম সি.এম.এম. কোর্টে। সারাপথ আল্লাহকে বলেছি, আমরা যেন আজই জামিন নিয়ে বাসায় যেতে পারি। কোর্টে পৌঁছে আমাদের মোবাইল ফোন দু’টি শাওন ভাইয়ার কাছে দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। গেইটের ভেতরের পরিবেশ সম্পূর্ণ অন্যরকম।
এখানে আলো কম। সরু এক গলির একপাশে উঁচু দেওয়াল, অন্য পাশে সারি বাঁধা কয়েকটি কারাগার। আমার মনে পড়ল, ‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’ চলচ্চিত্রে এমন একটি সরু গলির দৃশ্য দেখেছিলাম, যখন তিশা এসেছিল মোশাররফ করিমের সাথে দেখা করতে…।
অবাক হলাম যখন দেখলাম কাগজপত্রে আমাদেরকে আসামী হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে, অথচ এতকাল শুনে এসেছি দোষী প্রমাণিত হবার আগে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে বিবাদী বলা হয়, আসামী নয়। আমাকে পুরুষ কারাগারে এবং মৌমিতা ও শুদ্ধকে মহিলা কারাগারে ঢুকিয়ে তালাবদ্ধ করা হল; এই প্রথম মনে হল, আমি খাঁচায় বন্দী হলাম; চাইলেও আমি বের হতে পারবনা।
পারবনা আমার প্রিয়তমা স্ত্রীর সাথে একটু কথা বলতে, একবার ওর মুখটা দেখতে; কেঁদে মরলেও আমাকে দেওয়া হবেনা আমার ছেলেটাকে একবার আদর করতে, ওর নরম গালে একটু হাত বোলাতে..; খুব কান্না পেলো। কান্না চেপে চারদিক তাকালাম; ঠাসাঠাসি ভীড়ের এই ১৫ফুট বাই ১৫ ফুট খাঁচায় প্রায় একশ লোক। মনে হল সবাই আমার দিকে তাকিয়ে ভাবছে, আমার মতো বেকুব চেহারার একজন এখানে কেন?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।