আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কণ্ঠে যাদের সুরের খেলা জীবন তাদের বেসুরো পালা

কণ্ঠে যাদের সুরের খেলা জীবন তাদের বেসুরো পালা ডা.সুরাইয়া হেলেন ময়মনসিংহ শহরটি সবমসয়ই ছিলো শিল্প-সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ!প্রায় বাড়িতেই নাচ,গান,সেতার ,গিটার,আবৃত্তির চর্চাটা ছিলো!নাচ-গান শেখানোর কয়েকজন বিখ্যাত ওস্তাদ ও গুরুও ছিলেন। তাঁরা বাসায় গিয়ে শিক্ষাদান করতেন। বিনিময় ছিলো অল্প কিছু সম্মানী!জগাদা ছিলেন নাচের একচেটিয়া শিক্ষক । ছোট বড় সবারই জগাদা!গানের নামকরা ওস্তাদ ছিলেন,বিজয় ধর(পদবীটা ঠিক মনে নেই,কারণ তাঁকে আমরা বিজয় কাকু ডাকতাম),মিথুন দে,সুনীল ধর,ধীরেন বাবু আর ছিলেন গৌরীপুর রাজবাড়ির বিখ্যাত সেতার বাদক বিপিন দাশ!এঁদের সবার সাথেই আমাদের বেশ ভালো পরিচয় ছিলো!আরও কয়েকজন ছিলেন,তবে তারা অতটা পরিচিত ছিলেন না!স্কুল ,কলেজ সহ প্রায় প্রতিটি পাড়ায়ই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষে!নববর্ষ,বর্ষা বরণ,বসন্ত বরণ,নজরুল জয়ন্তী,রবীন্দ্র জয়ন্তী,ঈদ,পূজা উপলক্ষেও অনুষ্ঠান ,প্রতিযোগিতা হতো! নাটক হতো পাড়ার ক্লাবের,আর স্কুল কলেজের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে । নাটকের জন্য তো অমরাাবতী নাট্যমন্দির অডিটরিয়ামই ছিলো,এটা পরে ছায়াবাণী প্রেক্ষাগৃহে রূপান্তরিত হয় ।

নাটক হতো পাড়ায় পাড়ায় স্টেজ বেঁধে,রাধাসুন্দরী স্কুলের নাটক আর সাংসকৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য পাকা বাধানো উঁচু স্থায়ী স্টেজ ছিলো!বিদ্যাময়ী সরকারী বালিকা বিদ্যালয়ের হলরুমেই হতো স্টেজ বেঁধে অনুষ্ঠান ,নাটক!আর নাটকের জায়গা ছিলো টাউন হল । বড় বড় অভিনেতাকে হায়ার করে আনা হতো!টাউনহলের নাটকে অভিনয় করতেন,বিখ্যাত চিত্রাভিনেতা আনোয়ার হোসেন,মঞ্জুশ্রী বিশ্বাস,চিত্রনায়িকা নূতন,নূতনের মা গীতা দেবী সহ আরও অনেক শিল্পী !রাধাসুন্দরী স্কুলে সেসময় নটির পূজা,শ্যামা,চিত্রাঙ্গদার মতো নাটকও হতো!বিদ্যাময়ী স্কুলে আমাদের ১বছর সিনিয়র ছিলেন লাকী ইনাম,তার ছোট বোন লুসি ছিলো আমাদের সহপাঠী । লাকী আপার নাটক দেখেছি বলে মনে হয়না । নাটক করতেন,বাবলী আপা,বেণু আপা(অর্থনীতিবিদ রাশিদা চৌধুরি,কবীর চৌধুরির মেজো মেয়ে),রওশন আপা,আর বড় ক্লাশের আপারা!মিতালী(গায়িকা মিতালী মুখার্জি),আমদের ৩ বছরের জুনিয়র,ও তখন ছোট,গান গাইতো না,তবে দলীয় নৃত্য,ছোটদের নাটক আর আবৃত্তি করতো!আমাদের সহপাঠী ফ্লোরা আর নাদিরা নাচ,গানের তালিম দিতো!মহড়াকক্ষে আমরা ভীড় করে থাকতাম!নাচ করতো আমার সহপাঠী বান্ধবী লীনু,বন্যা(নৃত্যশিল্পী শামিম আরা নিপার খালা),বন্যার আরেক বোন এরা!ঝুলনের সময় মানুষ ঝুলনে রাধা সাজতো লীনু আর কৃষ্ণ মিতালী । লীনু খুব সুন্দর ছিলো ,গায়ের রং ফর্সা,আর একদম কবরীর মতো দেখতে!তাই ওকে রাধা সাজাতো।

মিতালী শ্যামলা ছিলো,ওকে নীল রং মাখিয়ে কৃষ্ণ সাজানো হতো!আমরা ভীড় করে সব অনুষ্ঠান,পূজাতেই যেতাম!খুব গর্ব হতো এই ভেবে,আমার বান্ধবী লীনু সবটাতেই আছে। কলেজে যখন অনুষ্ঠান করতাম,স্ক্রিপ্ট তৈরি,ধারা বর্ণনা,অনুষ্ঠান পরিচালনা,এমনকি শিল্পী নির্বাচন করে তাদের আনা নেয়া সব দায়িত্ব বেশিরভাগ আমার ওপরই ছিলো!সেসময় গানের মহড়া দেয়ার জন্য ওস্তাদ সুনীল ধরকে নিয়ে আসতাম । তিনি আমার সরাসরি গানের শিক্ষক ছিলেন! বিজয় কাকু থাকতেন আমাদের পাড়ায় । দীর্ঘদেহী,ফর্সা,সৌম্য চেহারার বৃদ্ধ লোকটি দেখতে রাজার মতো ছিলেন !তিনি গাইতেন ও শেখাতেন বিভিন্ন রাগ-রাগিনী,খেয়াল,টপ্পা,রাগপ্রধান গান। আমরা প্রাইমারি পড়েছি রাধাসুন্দরী স্কুলে আর মাধ্যমিক বিদ্যাময়ীতে ।

বিজয় কাকুর মেয়েরা আমাদের সাথে রাধাসুন্দরীতে co‡Zv|G‡m¤^jxi সময় আমি শপথ পাঠ করাবার পর,কাকুর বড় মেয়ে জাতীয় সঙ্গীত গাইতো,‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ,পাকিস্তান জিন্দাবাদ...আমরা সাথে সুর মেলাতাম । বিজয় কাকু প্রায় সময়ই তার বাসার বারান্দার পাকা পৈঠায় বসে থাকতেন!আমরা সামনে দিয়ে গেলেই ডেকে নিয়ে বিভিন্ন রাগ-রাগিনী শেখানো শুরু করতেন!আমাদের কণ্ঠ পরীক্ষা করে বলতেন,‘তোকে দিয়ে হবে। তোর বাবাকে বলতে হবে দেখছি!’আমরা পারতপক্ষে তার সামনে পরতে চাইতাম না!তাঁর বড় ছেলে বিশ্বদা!বাবার মতোই রাজপুত্রের মতো দেখতে ছিলেন!বিশ্বদা প্রায়ই সেতার হাতে বাইরে থেকে ফিরতেন । আমাদের দিকে তীব্র দৃষ্টিতে একটু তাকিয়ে ঘরে ঢুকে যেতেন!মাঝে মাঝে মন মেজাজ ভালো থাকলে জিজ্ঞেস করতেন,‘কী রে,বাবা ঘুমিয়ে আছে,তাই এখানে আড্ডা!রাগ-রাগিনী তো কিছুই শিখলি না,খালি চটুল গান!’আমাকে বলতেন,‘তোর পড়াশোনা কেমন চলছে রে?এবারও ফার্স্ট হতে পারবি তো?নাকি সারাদিন ঘুরে ফিরে দিন কাটাস?রেজাল্ট খারাপ হলে কাকাবাবু(আমার বাবা) আর আস্ত রাখবে না,বুঝলি?’আমি বলতাম,‘হয়েছে হয়েছে,খেয়াল নিয়ে আছেন,তাই থাকুন গিয়ে,আমাদের দিকে খেয়াল না দিলেও চলবে। বিশ্বদা হেসে বলতো,‘বাঃ রে,ভারি কথা শিখেছিস তো?বড় হয়ে গেছিস খুব!’’তিনি খুব বিখ্যাত উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শিল্পী ছিলেন!বিজয় কাকুদের অবস্থা মোটামুটি ছিলো।

নিজেদের বাড়িতেই থাকতেন । বোধ করি ১৯৬৫ সালের পাকভারত যুদ্ধের পর তারা কলকাতা চলে যান!কারণ মাঝে মাঝে আকাশবাণী থেকে বিশ্বদার উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের অনুষ্ঠান শুনতাম আমরা। খুব অহঙ্কার হতো,এই লোকটিকে আমরা চিনতাম,আমাদেরই পাড়ার দাদা বলে!শুনেছি,কলকাতায় খুব ভালো অবস্থায় ছিলেন না তারা! মিথুন দে’র দুই মেয়ে জয়ন্তী,দময়ন্তী পড়তো আমাদের সাথেই । দুই বোনই সুন্দরী,হাসি খুশি ¯^fv‡ei!Z‡e এরা গান গাইতো কিনা জানিনা,শুনিনি কখনো!মিথুন কাকুও গানের মাস্টারি করতেন। ওদের বাসায় গিয়েছি কয়েকবার।

তেমন একটা ¯^”Qj ছিলেন না,মনে হতো। পরবর্তীতে ওরা বোধ করি ঢাকায় চলে এসছিলো। ওদের আর কোন খোাঁজ পাইনি। বোধহয় ৭১-এর পর কলকাতা চলে গিয়ে থাকবে। সেখানে কেমন আছে,কে জানে? আগেই বলেছি,সুনীল ধর ছিলেন আমার গানের ওস্তাদ ।

বাবড়ি চুল আর মাথায় টুপিতে, তাঁকে দেখতে লাগতো কবি নজরুলের মতো!তিনি নজরুল গীতিই বেশি গাইতেন। নজরুল একাডেমির প্রিন্সিপাল ছিলেন। নওয়াব এন্ড কোম্পানী থেকে জার্মান ডবল রীডের আমার হারমোনিয়মটি তিনিই নিজে দেখেশুনে আমাকে কিনে দিয়েছিলেন!সিটি কলেজ আর মন্ত্রী মনোরঞ্জন ধরের বাড়ির বিপরীত দিকে একটি অতি ক্ষুদ্র ঘরে থাকতেন তিনি !দারিদ্রতা সারাজীবনই সঙ্গী হয়েছিলো!তাঁর প্রিয় গান যেটি সবসময় তিনি আমাদের শেখাতেন,নিজেও বারবার গাইতেন,‘চাঁদ হেরিছে চাঁদ মুখ তাই,সরসী আরশীতে....’!খুব দরদ দিয়ে সুরের সাথে মিশে গিয়ে গাইতেন । অথচ তার জীবনে চাঁদের জোছনা কখনই ছিলো না! বিপিন দাশ গৌরীপুর রাজবাড়িতেই থাকতেন । ময়মনসিংহে এলে আমাদের বাসায় উঠতেন।

তার মেয়ে আভা,সেও ভালো সেতার বাজাতে আর উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত গাইতে পারতো। আভাও আমাদের বাসায় এসে থেকেছে। ওরা যখন আসতো,সাথে গিলাফ পরানো সেতারটাও থাকতো!আব্বা তার সেতারের মুগ্ধ শ্রোতা ছিলেন। তাদের খবরও জানিনা। শুনেছি বিপিন কাকুর ছেলে সমীরদা ভালো গিটারবাদক হয়েছিলেন! এখন যার কথা বলবো,আসলে তাকে নিয়ে লিখতে বসেই এতো কথা লিখে ফেলেছি!ধীরেন কাকুর মেয়ে লীনু!আমার বান্ধবী।

ঐ যে বলেছি,কবরীর মতো দেখতে!স্কুলের পর ওর সাথে আর কোন যোগাযোগ ছিলো না!আমি তখন মেডিকেল কলেজে পড়ি। হঠাৎ একিিদন দুর্গাবাড়ির রাস্তায় ওর সাথে দেখা হয়ে গেলো!প্রচন্ড গরমে হেঁটে হেঁটে কোথাও যাচ্ছে!আমি রিক্সা থামিয়ে ডাকলাম,‘এই লীনু,উঠে আয়। ’ও চমকে আমার দিকে তাকালো!ঘেমে নেয়ে ফর্সা মুখ লাল হয়ে আছে!মুখ মুছে শূন্য দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো!আমি বললাম,এই লীনু,চিনতে পারছিস না?কোথায় যাচ্ছিস?উঠে আয় রিক্সায়। ’ ও বলল,‘চিনতে পারবো না কেন?আমি যাচ্ছি না,ফিরে এলাম। নাম তুই।

চল আমাদের বাসায়। কতদিন পর দেখা,বলতো?তোর খবর রাখি আমি। মেডিকেলে পড়ছিস তো?ও হাত ধরে নামালো আমাকে। ‘তোদের বাসা কোথায়?এখানে নামালি কেন?রিক্সায়ই তো যেতে পারতাম। ’নামতে নামতে বলি আমি ।

ও হাত তুলে একটা গলি দেখালো,‘রিক্সা ঢুকবে না রে!ঐ তো কাছেই,চল। ’ রাস্তায় যেতে যেতে ও মোটামুটি ওদের দুরবস্থার কথা বলে ফেললো! ধীরেন কাকুও গানের টিউশনি করেই সংসার চালাতেন। তিনি হঠাৎ করে মরে গিয়ে,পরিবারটিকে একবারে পথে বসিয়ে গেছেন!ভাইবোনদের মাঝে লীনুই বড়। একমাত্র ভাই গোপালের বয়স মাত্র ৮-৯বছর!লীনুর ওপরই পুরো সংসারের ভার !বললো,‘কাজ খুঁজতে বেরিয়েছিলাম। নাচের টিউশনি যদি পেতাম তাহলে পারতাম ।

পাচ্ছি না কোথাও । গানটা যদি ভালো করে শিখতাম,বাবার টিউশনিগুলিই নিতে পারতাম!কোনদিন তো ভাবিনি এমন করে বাবা মরে যাবে!লেখাপড়ায়ও তো তোদের মতো ভালো ছিলাম না। পড়াশোনাটাও হলো না রে!চারদিক অন্ধকার দেখছি!গোপালকে ব্রাহ্মনবাড়িয়া মাসীর বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি। কী যে করবো,ভাবতেই পারছি না! মনটা খারাপ হয়ে গেলো। বললাম,কী করে চলছে সংসার? ও বললো,‘মায়ের গয়নাগাটি একটা একটা করে বিক্রি করছি!ঘরের তামা কাসার জিনিস তো সব কাজে লাগে না,ওগুলোও বিক্রি করে এখনও চলছি কোনমতে! এভাবে কতদিন চলবি?তোদের আর কোন আত্মীয় ¯^Rb নেই? ‘না থাকারই মতো!ওরাও গরিব।

কে নেবে একটা সংসারের দায়িত্ব?পারুক না পারুক,সব কাজে বাধা দিতে ওস্তাদ! ‘কেন কী করেছে? লীনু বললো,গত মাসে সুমিতা দেবী(চিত্র নায়িকা) এসেছিলো ,আমাকে খবর দিয়ে নিয়ে বললো,সিনেমায় কবরীর ছোট বোনের চরিত্রে অভিনয় করতে। আমি রাজিই ছিলাম। কিন্তু এই আত্মীয় ¯^Rb মাকে বললো,কিছুতেই যেন আমাকে সিনেমায় অভিনয় করতে না দেয়!এর চেয়ে না খেয়ে মরে যাওয়া ভালো!মা কিছুতেই রাজি হলো না!’ গলির সামনে চলে এসেছি। সরু,এঁদো কাদা ভেঙে অনেক কষ্টে একটা বস্তির মতো জায়গায় ছোট্ট একটা টিনের ঘরে ঢুকলাম । অন্ধকার ঘুপচি ঘর!আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিলো।

চারদিকে দারিদ্রের ছাপ প্রকট হয়ে ব্যঙ্গ করছে!ঘরের ছোট জানালার মত ফাঁক দিয়ে উৎসাহি কিছু মুখ উঁকি ঝুঁকি মারছে!চারদিকের খোলা ড্রেন,আবর্জনা,কাঁচা পায়খানার গন্ধে আমার বমি এসে যাচ্ছে!কোনরকমে A¯^w¯Í নিয়ে বসলাম ঘরের একমাত্র নড়বড়ে চৌকির ওপর । চৌকির নিচে আর ওপরে তক্তায় জ্যাম করে রাখা পুরনো জিনিষপত্র!একটা আলনা দিয়ে ঘরটি পার্টিশন করা!আলনাতে শতচ্ছিন্ন ময়লা কাপড় চোপড়ের স্ত্প!আমি ঘরে ঢুকতেই সবাই আলনার ওপাশে চলে গেলো!কিছুক্ষণ পর মাসীমা এলেন একটা পরিস্কার কাপড় পরে!আমি সালাম করতেই আশীর্বাদ করলেন। বললেন,‘অনেক বড় হও মা। শুনেছি ডাক্তারী পড়ছো। নিজের পায়ে দাঁড়ানোটাই উচিৎ মেয়েদের।

লীনুর তো পড়াশোনাটাও হলো না,মাথায় গোবরও নেই!কী যে করবো কিছুই ভেবে পাইনে !’ আমি চুপ করে রইলাম । লীনুর ছোট বোনকে মিষ্টি আনতে পাঠানো হয়েছে দোকানে!একটু পর ও একটা প্লেটে করে দুটো সন্দেশ আর এক গ্লাস পানি এনে আমার সামনে রাখলো। আমি বুঝতে পারলাম,এই সন্দেশ দুটো কিনতে ওদের কতটুকু কষ্ট করতে হয়েছে!লীনু আর মাসীমা বারবার খাবার জন্য জোরাজুরি করতে লাগলেন!কিন্তু এ সন্দেশ আমার গলা দিয়ে নামবে না। লীনুকে বললাম,‘আমি এখন কিছুই খেতে পারবো না,কেন ওসব আনতে গেলি? লীনু মন খারাপ করে ফেললো। ওর মুখের দিকে চেয়ে বললাম,আমি সবটা খেতে পারবো না,এঁটো হয়ে যাবে।

তুই বরং অর্ধেকটা ভেঙে আমার হাতে দে। ’ঐ অর্ধেক সন্দেশ আমি প্রায় পানি দিয়ে কোনমতে গিলে ফেললাম!দুপুরের খাবার সময় হয়ে আসছে,ওদের আর কোন বিপদে ফেলতে চাইনা। তাড়াতাড়ি বিদায় নিয়ে বের হয়ে এলাম। সাথে লীনু । বড় রাস্তায় এসে আমার কাছে যা সামান্য কয়টা টাকা ছিলো,তাই লীনুর হাতে গুঁজে দিলাম।

লীনু কিছু বললো না!ওর হাত দুটি ধরে বললাম,কে কী বললো,তা শুনলে চলবে?তুই সুমিতা দেবীর সাথে যোগাযোগ কর। আর আমাদের শহরের ক্লাবগুলোতে গিয়ে দেখা কর,ওদের নাটকে যদি কাজ করতে পারিস?রত্না(চিত্রনায়িকা নূতন),ওর মা গীতা,ওরা তো নাটক করছে। (পরবর্তীতে সুমিতা দেবী এই রত্নাকে নতুন প্রভাত সিনেমার নায়িকা করে চিত্রজগতে নিয়ে আসেন)। লীনুর সামনে রিক্সায় উঠতে সংকোচ হচ্ছিলো। বললাম,‘আসি রে।

’লীনু বললো,‘আবার আসিস। ’চলে এলাম আমি,মানে পালিয়ে এলাম মনে হলো!আমি কীইবা করতে পারি?আমার সমবয়সী এই মেয়েটি কী করে এই সংসারের হাল ধরবে?কোন সহজ সরল রাস্তা তো খোলা নেই!ম্যাট্রিকটা পাশ করতে পারলেও বাবাকে বলে একটা চাকরি যোগাড় করে দেয়া যেতো!যতক্ষণ দেখা যায়,লীনু আমার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়েছিলো বুঝতে পারলাম। আমার আর সাহস হয়নি পেছন ফিরে তাকাতে! এরপর পড়াশোনা,হলে চলে যাওয়া,পরীক্ষার চাপে লীনুদের আর কোন খবর নিতে পারিনি!প্রায় বছর খানেক পরে কলেজের আ্যনুয়াল ফাংশানের জন্য মিতালীকে গান গাওয়ার জন্য বলতে গেলাম। মাসীমাকে বললাম,ফাংশানের দিন গাড়ি পাঠিয়ে দেবো,আপনি মিতালী আর শিবানীকে নিয়ে চলে আসবেন। ’হঠাৎই সে সময় লীনুর কথা মনে হলো।

ও তো ভালো নাচ করে। যদি ওকে নিতে পারি,তবে কালচারাল সেক্রেটারিকে বলে ,কিছু টাকা ওকে দেয়া যাবে। মিতালীকে জিজ্ঞেস করলাম,লীনুর খবর কী?ও বললো,আমি ঠিক জানি না। ’ ওখান থেকে বেরিয়ে গীতা(তসলিমা নাসরীনের ভাই কামালের স্ত্রী)দের বাসায় গেলাম,ও নাচবে অনুষ্ঠানে । বললো,‘দিদি আমার তো নাচের ভালো কোন শাড়ি নেই,তোমার চুমকির কাজ করা লাল শাড়িটা দেবে?ওটা পরেই নাচবো।

’বললাম,‘অনেক শাড়ি আছে আমার বান্ধবীদের,যেটা পছন্দ হয় পরিস। সময় মতো চলে আসবি কিন্তু?আর শোন,লীনুর খবর কিছু জানিস?’ও বললো,‘শুনেছিলাম তো সিনেমায় নামবে। আর কিছু জানি না। ’ গীতাদের বাসা থেকে বেরিয়ে সোজা চলে এলাম লীনুদের সেই গলির সামনে। ভাবলাম,এতোদিন পর এলাম,কী ভাববে ও?আরও আগে আসা উচিৎ ছিলো।

কে জানে,কী অবস্থা?গলি পেরিয়ে ওদের ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালাম। পরিচিত কোন মুখ দেখতে পেলাম না!ঐ ঘর থেকে এক মহিলা বেরিয়ে এলেন। তাকে লীনুদের কথা জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন,‘ওরা তো অনেক আগে এখান থেকে চলে গেছে!’কোথায় গেছে,তিনি বলতে পালেন না। আশপাশের কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলাম।

কেউ বললো,‘ব্রাহ্মনবাড়িয়া ওর মাসীর কাছে চলে গেছে। ’আবার কেউ বললো,‘আগরতলা,নয়তো কলকাতা। ’ঠিক করে কেউ কিছু বলতে পারলো না! এরপর লীনুর আর কোন খোঁজ খবর পাইনি। জানি না কোথায় সে?কেমন আছে?বেঁচে থাকলে আজ আমরই মতো বয়স হয়েছে। হয়তো বিয়েথা করে সংসার করছে,ছেলেপুলের মা হয়েছে।

হয়তো এর কোনটাই নয়!হারিয়ে গলো লীনু! আজ ভাবি ,এখনকার সময় হলে এই অতি রূপসী,গুণবতী মেয়েটি টি.ভি,সিনেমায় অভিনয় করেই বিখ্যাত হয়ে যেতে পারতো! এই লেখাটিতে যাদের কথা কমবেশি বললাম,তাদের সবার কণ্ঠে ছিলো সুর,সখ্য ছিলো সঙ্গীতের সঙ্গে। অথচ তাদের জীবন ছিলো পুরোপুরি বেসুরো ,কঠিন এক নির্মম গদ্য!‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়,পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি...!’ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.