আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নৈতিকতা বিবর্জিত রাজনীতির কাছে জিম্মি রাষ্ট্র ও মানুষ

নৈতিকতা বিবর্জিত রাজনীতির কাছে জিম্মি রাষ্ট্র ও মানুষ ফকির ইলিয়াস ======================================== তীব্রতর সংকটের দিকে ধাবিত হচ্ছে বাংলাদেশ। লাগাতার হরতাল চলছে। একজন জীবন্ত মানুষ নিখোঁজ হয়ে গেলেন। তার কোন খোঁজ এখন পর্যন্ত পাওয়া গেল না। এটা তো কারোই কাম্য ছিল না।

ইলিয়াস আলীর অপরাধ কী ছিল। কী কারণে তাকে গুম করা হলো কিছুই জানতে পারল না দেশের মানুষ। রাজনীতিক তিনি। তারপরও তার একটি বড় পরিচয়, তিনি একজন পিতা, একজন স্বামী, একজন পুত্র ও একজন নাগরিক। কেউ অপরাধ করলে তার বিরুদ্ধে মামলা হবে।

আইনি প্রক্রিয়া চলবে। সেটাই নিয়ম। সে নিয়ম বাংলাদেশে মানা হচ্ছে না। হলে এমন একজন মানুষকে কেন বিনা নোটিসে গুম করা হবে? ভীষণ হতাশা আর ঘৃণা বুকে নিয়ে বড় হচ্ছে এই প্রজন্ম। বিশ্বের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এগোতে পারেনি বাংলাদেশ।

তার ওপর নগ্ন পেশিশক্তির দাপট, অরাজকতা গোটা রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভিতকে নড়বড়ে করে তুলেছে। একটি কথা আমার বারবার মনে ওঠছে প্রশ্নবোধক হয়ে। বিরোধীদল বলছে, সরকারের কোন এজেন্সি ইলিয়াস আলীকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে। আর সরকার পক্ষ বলছে, বিরোধীদলই ইলিয়াস আলী ইস্যুতে নানারকম খেলছে। প্রশ্নটি হচ্ছে, সরকারের কোন এজেন্সি যদি ইলিয়াস আলীকে ধরে নিয়ে যেত, তাহলে এত রক্তপাত এত হরতালের পরও কি তাকে সরকার পক্ষ মুক্তি দিত না? মাত্র দেড় বছর পর নির্বাচন।

সরকার কী এমন স্পর্শকাতর ইস্যু তৈরি করে নিজেদের পায়ে কুড়াল মারবে? নিজেদের সর্বনাশ করতে চাইবে? এভাবে হরতাল কি কাম্য সরকার পক্ষের? না, সরকারে থাকা অভিজ্ঞ রাজনীতিকরা এমন বোকার স্বর্গে বসবাস করছেন না। অন্যদিকে বিরোধীদল নিজেদের নেতার এমন সর্বনাশ চাইবে না, তা স্পষ্ট করে বলা যায়। আজ ইলিয়াস আলীর পরিবার বিপন্ন। শোকাতুর তার বর্ষীয়ান জননী। চোখের জলে ভাসছে তার স্ত্রী, পুত্র ও কন্যা।

এমন দৃশ্য নিশ্চয়ই দেখার জন্য প্রস্তুত নয় নিজেদের দল বিএনপি। তাহলে ইলিয়াস আলীকে অপহরণ করেছে কে? কেন করেছে? এই প্রশ্নটির সঠিক বিশ্লেষণ দরকার। কোন রাষ্ট্রে যখন নিরাপত্তা ব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়ে, তখন সুবিধাবাদী নানা অপশক্তি মাথা তুলে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের সার্বিক রাষ্ট্রব্যবস্থা, উন্নয়নের গতিধারা, প্রজন্মের পরিশুদ্ধ পথচলাকে স্থবির করে দেয়ার জন্য এমন কোন অপশক্তি মাঠে রয়েছে কিনা, তা গভীরভাবে খতিয়ে দেখা রাষ্ট্র পরিচালকদের দায়িত্ব। কারণ দেশের, দেশের মানুষের নিরাপত্তা দেয়ার জন্যই তো সব গোয়েন্দা বাহিনী।

আমার কেন মনে হচ্ছে, একটা তৃতীয় পক্ষ ইলিয়াস আলীকে গুম করে সরকার এবং বিরোধীদলকে রণক্ষেত্রে নামিয়েছে। দেশে আজ বিরাজ করছে চরম সহিংস অবস্থা। যা প্রকারান্তরে বর্তমান সরকারকেই বেকায়দায় ফেলতে পারে। দেশে অতি সম্প্রতি বেশকিছু লোমহর্ষক ঘটনা ঘটে গেছে। সাগর-রুনি হত্যাকা-, সৌদি কূটনীতিক খালাফ হত্যাকা-, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএসের অর্থ কেলেঙ্কারি, এরপরে ইলিয়াস আলী নিখোঁজের ঘটনা একই সূত্রে বাধা কিনা, তা খতিয়ে দেখার জন্য রাষ্ট্রের বিভিন্ন গোয়েন্দা শক্তি কাজ করছে, এ বিশ্বাস দেশবাসীও করতে চান।

কিন্তু তা পারছে না কেন? এত দীর্ঘ ব্যর্থতার কী কারণ থাকতে পারে? দেশে পরপর আরও দুই দিন হরতাল হয়েছে। ৫ মে বাংলাদেশ সফর করবেন যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অফ স্টেটস (পররাষ্ট্রমন্ত্রী) হিলারি ক্লিনটন এবং ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি। এর আগেই দেশকে চরম অশান্ত করে তোলা হয়েছে। বিরোধীদলীয় জোট বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে। সেখান থেকে আরও কঠিন কর্মসূচি দেয়া হবে বলে জানানো হয়েছে।

দেশ আসলে কোথায় যাচ্ছে, তা এখন আর নতুন প্রশ্ন নয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে দেশে কি সংঘাত চিরস্থায়ী রূপ নিতে যাচ্ছে? দেশ কি কতিপয় অরাজকদের দখলে চলে যাবে? কারণ সরকার ও বিরোধীদলের সংঘাত যখন প্রবল হয়, তখন মাঝখানে একটি পক্ষ চরম অরাজকতা সৃষ্টির সুযোগ গ্রহণ করে। বাংলাদেশে তেমন কোন শক্তির উদ্ভব হয়েছে কিনা- তা সবার ভাবা খুবই জরুরি। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বেশকিছু নেতার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। গ্রেফতারে তোড়জোড় চলছে! পুলিশভ্যানে তোলা হচ্ছে, আবার ছাড়া হচ্ছে।

সব মিলিয়ে একটা হ-য-ব-র-ল অবস্থা তৈরি হয়েছে বাংলাদেশে। এর জন্য দায়ী যাদেরই করা হোক না কেন শুদ্ধ রাজনীতির স্খলন বাংলাদেশে স্থায়ী রূপ নিতে যাচ্ছে, তা খুব দুঃখের সঙ্গে না বলে উপায় নেই। আরেকটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা দরকার। যারা সুশীল সমাজের তকমা ধারণ করে নীতিবাক্য বলছেন, লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এরা প্রধান দুই দলের কাছ থেকে সুবিধার হিস্যা নিয়েছেন, অথবা বঞ্চিত হয়েছেন। দলীয় রাজনীতি করতে না পেরে 'সুশীল' 'বিবেকবান' বলে যাওয়ার ইতিহাস বাংলাদেশে নতুন নয়।

পঁচাত্তরের পট-পরিবর্তনের পর অনেকেই 'রাষ্ট্রীয় কল্যাণের' দোহাই দিয়ে জাতির জনকের খুনিদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। এরা স্বৈরশাসকদের সামরিক ছায়াতলে থেকে নানা সুযোগ-সুবিধাও নিয়েছেন। বাংলাদেশে আজও যারা 'তৃতীয় শক্তির' দোহাই দেন তাদের সবিনয়ে বলতে চাই, গণতন্ত্রকে সুসংহত করার জন্য রাজনীতিকদের ভুলভ্রান্তি নিয়ে সাহস নিয়ে কথা বলুন। নিজে সক্রিয় রাজনীতি করতে পারছেন না, কিংবা কোন দল নমিনেশন দেয়নি, দেবে না_ এই ক্ষোভে সামরিক শক্তির তল্পিবাহক হওয়ার চেষ্টা না করাই ভালো। মনে রাখা দরকার পাকিস্তানের ত্রাতা রাজনীতিকরা সামরিক শক্তিকে পোষ্য হিসেবে মদত দিয়েছিলেন বলেই, সেদেশে জঙ্গিবাদ আজ স্থায়ীরূপ নিয়েছে।

রাষ্ট্রীয় কল্যাণের কথা বিবেচনায় রাখলে ছাড় দেয়া ছাড়া রাজনীতির কোন বিকল্প থাকে না। বাংলাদেশে সরকার ও বিরোধীদলীয় পক্ষ কীভাবে, কতটা ছাড় দেবেন, তা নিয়ে একটি সমঝোতা হওয়া দরকার। নির্বাচনের এখনো দেড় বছর বাকি। এই দেড় বছর কি মানুষ কৃত্রিম নরকের আগুনে পুড়বেন? রাজনীতিকরা এভাবে দেশটিকে নরক বানিয়ে রাখবেন? কেন রাখবেন? তারা তো এই মেহনতি মানুষের জন্যই রাজনীতি করছেন। বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়েছে।

ধরপাকড়ের জন্য দৌড়ঝাঁপ চলছে। সেটা কোন সুস্থ গণতান্ত্রিক ধারার জন্য সহায়ক হতে পারে না। কারণ দমনপীড়ন করে প্রকারান্তরে গণতন্ত্রকেই আহত করা হয় নির্মমভাবে। একজন ইলিয়াস আলী আজ বিরোধীদলের আন্দোলনের প্রতীকে পরিণত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী টঙ্গীর জনসভায় বলেছেন, এই নেতা নাকি গত বছর ব্যাংকক গিয়েছিলেন প্রায় নিখোঁজ হয়েই।

পরে দেশে এসে বলেছিলেন, চিকিৎসার জন্য দেশ ছেড়েছিলেন। আমার মনে হয় না বর্তমান পরিস্থিতি তেমন। ইলিয়াস আলী নিশ্চয়ই নিজে 'গুম' হয়ে দেশের এমন পরিস্থিতি করতে চাইবেন না। কারণ তিনিও তো মানুষের জন্য রাজনীতি করেন। সে যাইহোক, রহস্য উন্মোচন করা সরকারের দায়িত্ব।

এই অচলাবস্থার শীঘ্রই অবসান হওয়া দরকার। দেশটি যদি সবার মাতৃভূমি হয় তবে দেশটিকে ভালোবাসার দায়িত্ব নিতে হবে। দখলের মানসিকতা নয়, সেবার মানসিকতা নিয়ে রাজনীতি না করলে কখনই মানবমুক্তি সাধন করা সম্ভব নয়। দেশবাসীর উচিত এই দেশের গত চলি্লশ বছরের শাসনামলের তুলনামূলক বিবেচনা করা। কে কি অতীতে করেছেন, তার একটা সমানুপাতিক আলোচনা-পর্যালোচনা করা খুবই জরুরি দরকার।

নিউইয়র্ক, ২ মে ২০১২ -------------------------------------------------------------- দৈনিক সংবাদ / ঢাকা / ৪ মে ২০১২ শুক্রবার প্রকাশিত ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।