আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হরতালকে লাশের সাথে ভর্তা বানিয়ে খান অথবা হরতালের বিকল্প কিছু বের করুণ

তুমি আমি আমরা ...... –"বেলা দুইটার দিকে গাড়ির সামনের দিক থেকে আগুনের তাপ নাক ও মুখে লাগলে আমার ঘুম ভাইঙ্গ্যা যায়। তাকাইয়া দেহি, সামনের দিক থেইকা আগুনের ঝলকানি আইতাছে। এ সময় জানালার ফাঁক দিয়া লাফাইয়া পড়ি। আগুনের গোলায় আমার চুল পুইড়া গেছে। তাপ লাগে পিঠেও।

'' তারপর , –"আমার একটু হুশ আইতেই দেখি ওস্তাদ ভিতরে , বাইর হইবার পায় নাই , আমার চক্ষের সাম্নেই আমার ওস্তাদ পুইরা মইরা গেল , আমি কিছুই করবার পাইলাম না “ না পাঠক বিভ্রান্ত হবেন না , আপনারা ডিপজল অভিনীত বাংলা ছায়াছবির কোন ভক্তিমূলক ডায়ালগ শুনছেন না ; শুনছেন পুড়ে ছাই ছাই হওয়া বাস চালক বদর আলী বেগের হেলপার মো. মোতালেব এর কথা । ঘটনার সময়কাল গত শনিবারের , ২০১২ , এপ্রিলের ২১ তারিখ ২০১২ । এখন কথা আসতে পারে বাস চালক বদর আলী কেন মারা গেল ! তার অপরাধ কি ? --"তার অপরাধ সে বাংলাদেশে বাস চালায় । " এইডা কি কন !বাংলাদেশে বাস চালাইলে সমস্যা কি ! চাউলের গুদামের মালিক মন্ত্রণালয় চালাইতে পারলে , বদর আলী কেন দেশে বাস চালাইতে পারবো না ? সত্য কইরা কন তো তিনি কি করছিলেন ? --"তিনি হরতালের আগের দিন রাজধানীর খিলগাঁও সরকারি উচ্চবিদ্যালয় কলোনির পাশের রাস্তার বাস থামিয়ে বাসের ভিতরে কোনমতে কাচুমাচু হয়ে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করছিলেন , ইচ্ছা ছিল রাতে খুলনায় নিজ ঘরে ফিরবে , ঘরে তার জন্য অপেক্ষা করছে তার স্ত্রী আর ফুটফুটে দুই সন্তান । " তিনি কি ফিরতে পেরেছিলেন ? --হুম ফিরেছে , তবে আগুনে ঝলসানো লাশ হয়ে ।

এমন ঘটনা একটি নয় , বগত কয়েক বছর যাবত এমন সব ঘটনা হাজারে হাজারে চলছে । প্রতি হরতালে এমন সব পোড়াও , জ্বলাও, ধুমাধুম মৃত্যুর খবর শুনতে শুনতে আমাদের অভ্যাস হয়ে গেছে , বরং কোন হরতালে যদি দুই তিনজন মারা না যায় যায় , ৪০-৫০ টা গাড়ী ভাঙচুর না হয় , শতশত মানুষের উপর বেদড় লাঠি চার্জ না হয় , এক পক্ষ আরেক পক্ষের উপর বোমা না ছুড়ে তবে নিজের কানের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহ দেখা দেয় ! মনে হয় — “আমার কান কি আমার সাথে আছে নাকি শামসুর রাহমানের চিল আমার কান নিয়ে উড়ে গেছে !! হরতালে মানুষের লাশ পড়বে এইটাই এখন ফরজ । নট সুন্নত ! কথা আসতে পারে , বর্তমান প্রেক্ষাপটের এই ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টিকারী হরতাল কি শুরু থেকেই এমন মৃত্যুলীলা ছিল ? না , হরতাল এর জন্ম লক্ষ্য এই ধ্বংস বানানোর হাতিয়ার ছিল না । গুজরাটি এই শব্দের মানে ছিল স্থবির , অবরোধ , অচল । অন্যায় এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদী অবরোধ ।

প্রায় ষোড়শ শতকে অধিকার আদায়ের আন্দোলনে জন্য হরতাল ব্যবহার করার কথা জানতে পারা যায় । উপমহাদেশে এর প্রচলন শুরু হয় ১৯০৫ সালের ৭ আগস্ট মহাত্মা গান্ধীর হাত ধরে , ইস্যু ছিল বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে অবস্থান । ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে এই হরতালকে কার্যকরী মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয় প্রথম ১৯১৯ সালের ৬ এপ্রিল সেই গান্ধীজির হাত ধরেই । কিন্তু এই আন্দোলনে ৩০০ জনের মৃত্যু সাথে প্রচুর হতাহতের ঘটনায় পরবর্তীতে তিনি আর এরূপ কর্মসূচি দেন নি । পরবর্তীতে বাংলা ভাষা রক্ষা করার জন্য ছাত্র – জনতা ৫২ তে কার্যকরী হরতাল পালন করছে ।

দেশ রক্ষার জন্য শোষক শ্রেণীর টনক নাড়িয়ে দেয়া সেইসব হরতালে ছিল জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন । শুধু তাই না , নব্বইয়ের স্বৈরাচারী সরকারের উৎপাটনে এই হরতাল কার্যকরী ভুমিকা পালন করে । হরতাল তখন ছিল সত্যিকারের গনতন্ত্র নিয়ন্ত্রনের মোক্ষম হাতিয়ার । কিন্তু গনতান্ত্রিক সেই হরতালের ধারা কে দলীয় স্বার্থে জঘন্নভাবে ব্যাবহার শুরুর সাথে সাথে হরতাল তার মূল নীতি থেকে সরে ধ্বংসনীতি গ্রহণ করে । সরকারের অসীম ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে দেশের স্বার্থে বিরোধী দল প্রতিবাদ করবে , রক্ষা করবে গনতন্ত্র , তার জন্য তৈরি হরতালের , ব্যাপারটা অনেকটা মাছ কাঁটার সময় ছাই এর মতো , ছাই দিয়ে মাছ ধরে তারপর মাছ সাইজ করা ।

তবে চরম চুলকানির বিষয় সেই ছাই এখন গনতন্ত্রকে ধরার জন্য নয় , বরং মানব দেহের মাংসের ছাই প্রনয়নের উছিলায় পরিণত হয়েছে । এই যুগের হরতাল মানে হাহাকার , ক্ষতির বিস্তর কর্মশালা । এমনেতেই দেশে সপ্তাহে দুইদিন সরকারী ছুটি , শুক্র ,শনি । তার সাথে সপ্তাহে একদিন হরতাল মানেই সাত দিনের ভিতরে তিন দিন পুরো দেশ কার্যত বেকার !! আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য এ যে কত বড় অভিশাপ টা সহজেই অনুমেয় ! ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন (এফবিসিসিআই) গতবছর এক সাংবাদিক সম্মেলনে জানিয়েছেন, একদিনের হরতালে ক্ষতি হয় ১০ হাজার কোটি টাকা। এ ব্যাপারে এফবিসিআই সভাপতি একে আজাদ বলেন, ‘এক দিনের হরতালে ক্ষতির পরিমাণ সঠিকভাবে নিরূপন করা না গেলেও দেশের ৬৪ জেলায় মোট ক্ষতির পরিমাণ কোনোভাবেই ১০ হাজার কোটি টাকার নিচে হবে না।

হরতালে কী পরিমাণ ক্ষতি হয় বর্তমানে বড় কোনো সংস্থার কাছে নির্ভরযোগ্য তথ্য না থাকলেও ২০০৫ সালে ইউনাইটেড ন্যাশনস্ ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (ইউএনডিপি) এক জরিপ করে। তাদের প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়, ‘এক দিনের হরতালে দেশের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৫৫৪ কোটি টাকা। তবে এর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি আরও অনেক বেশি। ’ ওই গবেষণায় বলা হয়, হরতালের ফলে ১৯৯০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে দেশের ৮০ হাজার ৩৮৪ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এ হিসাবে গড়ে প্রতি বছর ক্ষতির পরিমাণ আট হাজার ৩৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা।

আর্থিক ক্ষতি ছাড়াও হরতাল দেশের নেতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে তোলে। বৈদেশিক বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হয়। শুধু ১৯৯৯ সালে হরতালে ক্ষতির পরিমাণ ছিল দুই হাজার ১৩৫ কোটি টাকারও বেশি। বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) তথ্য মতে, এক দিনের হরতালে শুধু গার্মেন্ট শিল্প খাতেই ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ১০৮ কোটি টাকার বেশি। চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের ৯২ শতাংশ চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে সম্পন্ন হয়।

হরতালের কারণে চট্টগ্রাম বন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রম ব্যাহত হয়। রপ্তানি পণ্য নিয়ে বন্দরে কনটেইনার ঢুকতে পারে না। একইভাবে আমদানি পণ্যও বন্দর থেকে বাইরে আনা যায় না। ফলে অর্থনীতিতে এর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। হরতালের কারণে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হয় দেশের তৈরি পোশাক শিল্প।

অর্ডার বাতিল হয়ে যায় । কমে যায় বৈদেশিক বিনিয়োগ । এই কথা সবাই জানে দেশ বর্তমানে দুভাগে বিভক্ত । এখনকার আইওয়াশ হরতাল তাদের নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্যই তৈরি , যখন দল বিরোধী দলে থাকবে সে তখন এই অস্ত্র ব্যাবহার করবে প্রশ্ন আসতে পারে কারা হরতাল দেয়ায় বেশী পারদর্শী ? উত্তর সহজ -- “ সব রসুনের একই পশ্চাৎদেশ “ , যদিও সরকারী দলে থাকাকালীন সময়ে কেউ হরতাল বরদাস্ত করতে পারে না কিন্তু ৫ বছর পর বিরোধী দলে গেলেই এই হরতালই তাদের কলিজার টুকরা হয়ে যায় । একটা পরিসংখ্যান দেখলেই হিসাব আরও সহজ হবে – ১৯৯১ সালে পট পরিবর্তনের পর থেকে হরতালের রাজনীতি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, হরতাল দেওয়ার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ-বিএনপি প্রায় সমানে সমান।

১৯৯১ সাল থেকে ’৯৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায় আওয়ামী লীগ সারাদেশে হরতাল করেছে মোট ১৭৩ দিন। ’৯৬ থেকে ২০০১ সময় পর্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায় বিরোধী দল বিএনপি হরতাল করেছে সারাদেশে ৫৯ দিন। এ সময় স্থানীয় পর্যায়ে ২৩৩ দিন হরতাল করেছে দলটি। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতাসীন ছিল বিএনপি। এ সময় বিরোধী দল আওয়ামী লীগ হরতাল করেছে সারাদেশে ১৩০ দিন।

বর্তমান মহাজোট সরকারের আমলে বিএনপি হরতাল পালন চলছেই , চলবে । ( পরিস্থিতি তাই বলে ) যেখানে রাজনৈতিক দলের আদর্শ ছিল – “ বাক্তির আগে দল , দলের আগে দেশ “ কিন্তু কালের লোভনীয় চাহিদায় সেই স্থানে রাজনৈতিক দলের সংজ্ঞা এখন ডিগবাজী খেয়ে ধারন করছে — –“ আব্বে হালা সবার আগে নিজের আখের , পরে দলের চামচামি , শেষে কিছু অবশিষ্ট থাকলে দেশ “ । ফলে হরতাল আজ ব্যবহার করা হচ্ছে গুটি কয়েক মানুষের স্বার্থসিদ্ধির হাতয়ার রুপে , যেখানে কোন জনসমর্থন নেই , আছে করুণ জন দীর্ঘশ্বাস ! আছে গাড়ী পোড়ার গন্ধ , আছে লাশের পর লাশ । সবাই সব জানে , দেখছে কিন্তু তারপরও এই হরতালের গ্যাঁড়াকল থেকে মানুষ মুক্তি পাচ্ছে না , তার কারন হতে পারে প্রতিবাদ জানানোর অন্য কোন ভাষা এখনো সুচারু ভাবে চালু হয়নি হরতাল ব্যাতিত , আসল কথা চালু করা হয় নি ইচ্ছাকৃতভাবে । বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো বিরোধী দলে প্রবেশ করলে সরকারকে চেপে ধরতে হরতাল ছাড়া অন্য কোন বিকল্প মাধ্যম বের করেনি ।

কেনই বা বের করবে ? বিনা কারণে দেশ অচল করাই তো পরবর্তীতে ক্ষমতায় যাবার লাল গালিচা ! কথা বলার জন্য রাস্তা এখন ফাক (!) করা দরকার , খালি রাস্তায় একদল আরেকদলকে " তুই তুকারি " করে জামা কাপড় খুলে নিবে , এই কথা বলার স্থান রাজপথ ছাড়া উত্তম আর কিছুই নেই কারন সরকারী দল আর বিরোধী দল প্ল্যানমাফিক কথা বলার জায়গা সংসদকে করে তুলেছে “ নিষিদ্ধ পল্লি “( সংসদ সদস্যদের ভাষ্য অনুযায়ী ) সংসদ অকার্যকর করে নিজেরা নিজেদের ফায়দা তুলছে , আর জনগন সংসদে তাদের ভোটের ডান প্রতিনিধিদের চেহারা না দেখতে পেরে জি বাংলায় দিদি নাম্বার ওয়ান গিলছে । আর হরতাল নামের প্রতিবাদী ভাষা রূপ নিচ্ছে লাশ তৈরির গঠনমূলক অস্ত্রে এবং দিন দিন এর লাশের ক্ষিদা বেড়েই চলছে , বেড়েই চলছে । কালে কালে অনেক বেলা হয়েছে , সময় এসেছে হরতাল এর বিকল্প ভাষার । অন্যায় , অবিচারের এর বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য এমন কিছু খুঁজে বের করতে হবে যেখানে থাকবে জনসমর্থন , যেখানে লাশের স্তূপ থাকবে না , থাকবে না অসহায় মানুষের কান্না । সকল রাজনৈতিক দলের উচিৎ হরতাল ব্যাতিত প্রতিবাদ জানানোর বিকল্প কার্যকরী মাধ্যমকে খুঁজে বের করা ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.