আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কিশোরের ওপর স্বরূপকাঠি থানা পুলিশের অকল্পনীয় নির্যাতন

ভালো। পুলিশের দারোগার সঙ্গে তর্ক করেছিল নবম শ্রেণীর ছাত্র তš§য়। এই একটি মাত্র অপরাধের জন্য তার ফুলের মতো জীবনটা ধ্বংস করে দিয়েছে পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি থানা পুলিশ। পকেটে গাঁজা ঢুকিয়ে দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে তাকে দেয়া হয়েছে ৬ মাসের কারাদণ্ড। এখানেই শেষ নয়, চরম বিতর্কিত কারাদণ্ডাদেশের পর থানা হাজতে রাতভর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়েছে তার ওপর।

পরিস্থিতি এমন যে শরীর থেকে কেটে বাদ দিতে হতে পারে তার বাম পা। বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তš§য়কে নিয়ে বড়ই উদ্বিগ্ন তার পরিবার। ছেলের কোন রকম খোঁজখবরও নিতে পারছেন না বাবা-মা। কেবল চলছে কান্না আর আহাজারি। বিষয়টি নিয়ে স্বরূপকাঠির সাধারণ মানুষের মাঝে সৃষ্টি হয়েছে তীব্র ক্ষোভ।

ন্যক্কারজনক এই ঘটনার বিরুদ্ধে বড় ধরনের আন্দোলনের প্রস্তুতি চলছে সেখানে। যেভাবে ঘটনা : উš§ুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্র তামজিদ ইসলাম তš§য়। বাড়ি স্বরূপকাঠী উপজেলার সুঠিয়াকাঠী ইউনিয়নের দক্ষিণ কৌড়িখাড়া গ্রামে। বাবা শহিদুল ইসলাম গ্রাম থিয়েটার বরিশাল বিভাগের বিভাগীয় সমন্বয়কারী এবং সংবাদকর্মী। নাট্যকার শহীদ নামে এক ডাকে সবাই চেনে তাকে।

২৬ মার্চ বিজয় দিবসের র‌্যালিতে অংশগ্রহণ শেষে উপজেলার ইন্দেরহাট বাজারে সিঙ্গার শোরুমের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল তš§য়। এ সময় সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন স্বরূপকাঠী থানার উপ-পরিদর্শক কবির হোসেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, তুচ্ছ বিষয় নিয়ে তাদের দু’জনের মধ্যে কথা কাটাকাটি এবং পরে ঝগড়া বাধে। এক পর্যায়ে এসআই কবির তাকে গ্রেফতার করে নিতে চাইলে প্রতিবাদ করে তš§য়। দু’জনের ধস্তাধস্তিতে মাটিতে পড়ে যান কবির।

পুরো ঘটনাটি দূর থেকে দেখছিলেন সোহাগদল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুর রশিদ। যুগান্তরকে দেয়া বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘দু’জনের ধস্তাধস্তি এবং হাতাহাতির এক পর্যায়ে তাদের আমার পরিষদে নিয়ে আসি। এ সময় এসআই কবির অভিযোগ করেন তš§য় তার সঙ্গে অশোভন আচরণ করেছে। আমি দু’জনকে পরিষদে বসিয়ে বিষয়টি মীমাংসা করার চেষ্টা করি। আলোচনা চলতে থাকার মধ্যেই হঠাৎ করে থানা থেকে আরও পুলিশ এসে তš§য়কে সেখান থেকে ধরে নিয়ে যায়।

পরে শুনি গাঁজা পাওয়ার অপরাধে ভ্রাম্যমাণ আদালতে তার সাজা হয়েছে। তবে আমার এখানে থাকাবস্থায় গাঁজা বা এই সংক্রান্ত কোন কথা হয়নি। ’ ঘটনাস্থল সিঙ্গার শোরুমের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং সংশ্লিষ্ট এলাকার লোকজনও একই কথা বলেন। গাঁজা প্রাপ্তি কিংবা গাঁজা উদ্ধার বিষয়ে কোন কিছুই শোনেননি তারা। প্রশ্নবিদ্ধ বিচার এবং কিশোরের কারাদণ্ড : স্বরূপকাঠি ইউএনও দফতরের একাধিক কর্মচারীর বক্তব্য অনুযায়ী, রাত সাড়ে ৭টা থেকে পৌনে ৮টার দিকে তš§য়কে পুলিশ সেখানে নিয়ে যায়।

ইউএনও আবদুর রহমানের দফতর থেকে তারা বেরুনোর পর শুনতে পাই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে গাঁজা রাখার অপরাধে তাকে ৬ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। বরিশাল জেলখানায় চিকিৎসাধীন তš§য় জানায়, ‘রাতে ইউএনও সাহেবের দফতরে নেয়ার পর গাঁজা পাওয়ার বিষয়টি যে বানোয়াট তা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করি। কিন্তু নামাজের ব্যস্ততার কথা বলে কোন কিছু না শুনে তিনি রায় দিয়ে দেন। ’ ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচার পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে বরিশালের জেলা প্রশাসক এসএম আরিফ-উর-রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে সংঘটিত এবং উদঘাটিত অপরাধের তাৎক্ষণিক বিচার প্রক্রিয়াই হচ্ছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। এটি যে কোন সময় যে কোন স্থানে ঘটতে পারে।

’ কয়েকজন বিশিষ্ট আইনজীবীর সঙ্গে আলাপকালে তারাও একই মন্তব্য করেন। ঘটনাস্থল থেকে ইউএনওর দফতরের দূরত্ব প্রায় ২ কিলোমিটার। তার ওপর বেলা ১১টায় গ্রেফতার হওয়া তš§য়ের বিচার রাত ৮টায় নিজের দফতরে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে কি করে করলেন জানতে চাইলে স্বরূপকাঠীর ইউএনও আবদুর রহমান বলেন, ‘ঘটনা উদঘাটিত এবং সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে রায় দেয়া হয়েছে। ’ পুরো প্রক্রিয়াটির আইনগত বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হলে তিনি বলেন, ‘নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে এটা করার এখতিয়ার আমার রয়েছে। ’ আবদুর রহমানের দেয়া দণ্ডাদেশের কপিতেও রয়েছে গলদ।

সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে রায় দেয়ার কথা বলা হলেও তার লিখিত দণ্ডাদেশে এসবকিছুর কোন উল্লেখ নেই। এমনকি কোথায় এবং কখন তিনি এই বিচার কার্য করলেন তারও কোন উল্লেখ নেই রায়ের কপিতে। বরিশালের বিশিষ্ট আইনজীবী অ্যাডভোকেট শামসুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘পুরো বিষয়টিই সম্পন্ন হয়েছে বেআইনি প্রক্রিয়ায়। তাছাড়া ভ্রাম্যমাণ আদালতে এত দীর্ঘকালীন দণ্ডাদেশ দেয়ারও কোন নজির নেই। ’ স্বরূপকাঠির একাধিক সূত্র যুগান্তরকে জানায়, রহস্যজনক কারণ এবং পুলিশের স্বার্থ রক্ষার জন্যই তিনি এই কাজটি করেছেন।

এক্ষেত্রে নেপথ্যের কোন প্রভাবশালী ব্যক্তির হস্তক্ষেপও থাকতে পারে। পঙ্গু হওয়ার পথে তš§য় : সোহাগদল ইউনিয়ন পরিষদ থেকে থানায় আনার পথেই তš§য়ের ওপর নির্যাতন শুরু করে পুলিশ। ইন্দেরহাট থেকে থানায় যেতে পাড়ি দিতে হয় ইন্দেরহাট নদী। স্থানীয় জাকির হোসেনের ট্রলারে তš§য়কে নিয়ে নদী পার হয় পুলিশ। এই ট্রলারেই শুরু হয় তার ওপর লাঠিপেটা।

বেদম মারধরে তš§য়ের আর্তচিৎকারে ইন্দেরহাটের শিল্পি ব্যাটারী নদী ঘাটে ভিড় করে কয়েকশ’ মানুষ। বর্তমানে বরিশাল জেলখানায় কয়েদি হিসেবে থাকা তš§য় জানায়, ‘পুরো নদী পথে আমাকে লাঠি দিয়ে পেটায় দারোগা কবির এবং তার সঙ্গে থাকা অন্য পুলিশরা। দুপুর ১২টায় স্বরূপকাঠী থানায় পৌঁছানোর পর তাকে ঢুকিয়ে রাখা হয় হাজতে। রাতে কয়েকটা গাঁজার পুরিয়াসহ নেয়া হয় ইউএনও অফিসে। সেখানে দণ্ড ঘোষণার পর আবার ফেরত নেয়া হয় হাজতে।

রাত ১০টার দিকে থানায় প্রথমে তার চোখ বেঁধে ফেলেন এসআই কবির। পরে ৪/৫ জন মিলে বেদম লাঠিপেটা করে তাকে। এক পর্যায়ে সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। সকাল ৭টার দিকে টেনে তোলা হয় তাকে। এ সময় তার হাঁটু এবং হাতের কনুই দিয়ে রক্ত ঝরছিল।

টেনে তুলে থানার গাড়িতে করে নেয়া হয় স্বরূপকাঠি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। সেখানে সামান্য চিকিৎসার পর কোর্টের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেয়া হয় পিরোজপুর জেলা কারাগারে। ট্রলারে পিরোজপুর নেয়ার সময়ও বেধড়ক লাঠিপেটা করে কবির। স্বরূপকাঠি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক তুষার বিন্দু হালদার জানান, ‘২৭ মার্চ সকালে তš§য়কে হাসপাতালে আনার সময় তার সারা শরীরে ছিল নির্যাতনের চি?হ্ন। সবচেয়ে মারাÍক ক্ষত ছিল হাতের কনুই এবং বাম পায়ের হাঁটুতে।

প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার পাশাপাশি জরুরি ভিত্তিতে পিরোজপুর সদর হাসপাতালে ভর্তির জন্য তাকে নিয়ে আসা পুলিশ কর্মকর্তাকে বলে দিয়েছি। ’ পিরোজপুর জেলা কারাগারের তত্ত্বাবধায়ক আলমগীর হোসেন বলেন, ‘তš§য়কে যখন কারাগারে আনা হয় তখন তার শরীরে ছিল অসংখ্য নির্যাতনের দাগ। একই সঙ্গে সে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খাচ্ছিল। এতেও তার অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় ১০ এপ্রিল সকালে তাকে পিরোজপুর সদর হাসপাতালে ভর্তি করাই। সেখানকার চিকিৎসকরা আরও উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে পরদিন বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়।

বর্তমানে সে বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারের অধীনে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। ’ পরিচয় গোপন রাখার শর্তে পিরোজপুর সদর হাসপাতালের একজন চিকিৎসক বলেন, ‘যতদূর দেখেছি ওর বাম পায়ের অবস্থা খুবই খারাপ। জেলখানার নিয়ন্ত্রণে এর সঠিক চিকিৎসা হওয়া প্রায় অসম্ভব। আর চিকিৎসায় গাফিলতি হলে কেটে বাদ দিতে হতে পারে তার বাম পা। ’ প্রায় একই কথা বলেন বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তš§য়ের চিকিৎসা করা চিকিৎসকরা।

তš§য়ের ওপর এমন অমানুষিক নির্যাতনের বিষয়টি অবশ্য স্বীকার করেনি স্বরূপকাঠি থানা পুলিশ। মূল অভিযুক্ত পুলিশের এসআই কবির হোসেন দাবি করেন, ‘গাঁজাসহ আটকের সময় ধস্তাধস্তির কারণে সে সামান্য আহত হয়। চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে কোন সমঝোতা বৈঠক হয়নি। ধস্তাধস্তির কারণে আহত হওয়ায় তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়। আদালত থেকে জামিন নেয়ার জন্য আসামিপক্ষ মিথ্যা বলছে।

’ স্বরূপকাঠি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মেজবাহ উদ্দিন আহম্মেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘ঘটনার সময় আমি থানায় ছিলাম না। ’ সর্বশেষ পরিস্থিতি : এখনও বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারে আছে তš§য়। তার জামিন এবং উন্নত চিকিৎসার আবেদন জানিয়ে পিরোজপুর আদালতে করা আর্জি খারিজ করে দিয়েছেন বিচারক। বাম পাটি ক্রমেই অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে তš§য়ের। মা সেলিনা ইসলাম যতবারই জেলখানায় তার সঙ্গে দেখা করতে যান ততবারই হাউমাউ করে কাঁদে সে।

সেই সঙ্গে চোখের পানিতে বুক ভাসে জননীর। তাদের কান্না দেখে গলে যায় কারাগারের অন্য সবার মন। কিন্তু মন গলে না নিষ্ঠুর আইন আর কিছু অমানুষের। তš§য়ের বাবা শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘সংবাদকর্মী হিসেবে বহু অন্যায়-অবিচারের কথা কাগজে লিখেছি। নাট্যকর্মী হিসেবে মঞ্চে প্রতিবাদ জানিয়েছি অনিয়মের।

কিন্তু আজ আমি আপনাদের কাছে আমার ছেলের জীবন ভিক্ষা চাই। দয়া করে আপনারা ওকে বাঁচান। ’ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.