আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ছাত্রছাত্রীদের কেন নৈরাজ্যবাদী হওয়া উচিত? নোওম চমস্কির সাক্ষাৎকার

১৪ জুন ২০১১ তারিখে ইনডিবেই ডট অর্গ সাইটে জেইট ক্যাম্পাস এর সঙ্গে স্বস্বীকৃত নৈরাজ্যবাদী নোওম চমস্কির এক সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। এই সাক্ষাতকারটি বেশ মজার মনে হয়েছে আমার নিজের একটি প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার প্রেক্ষিতে। সুশীল বুদ্ধিজীবিদের শাণিত বুদ্ধিদীপ্ত কথার ফুলঝুরির সামনে একটি প্রশ্ন অনেকসময় করতে ইচ্ছে হতো: আপনার মত ' সুশীল বুদ্ধিজীবী ' কি আদৌ কিছু সমাধা করতে পারে? এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন নোওম চমস্কি। তার প্রত্যুত্তরটি এতটাই সাদামাটা যে সাক্ষাতকারটি অনুবাদের ইচ্ছা জাগলো। চমস্কির যে বিষয়টি আমাকে সবচে বেশী ভাবিয়েছে তা হলো তার ' কৌশলহীন ' উত্তরদানের কৌশল, যেন কোন ত্যানা পেঁচাপেঁচি ছাড়াই ভেতর থেকে আসা উত্তর।

আপনাদের বিশেষ কোন অনুভূতি হলে শেয়ার করলে ভাল লাগবে। প্রফেসর চমস্কি, আপনি এমন এক পন্ডিত যাকে সারা বিশ্বে বারবার উদ্ধৃত করা হয়ে থাকে, সেসঙ্গে ৪৫ বছর ধরে আপনি একজন রাজনৈতিক একটিভিস্ট হিসেবেও কাজ করে যাচ্ছেন। আজকের রাজনীতির দিকে তাকিয়ে কেউ যদি প্রশ্ন করে: আপনার মত ' সুশীল বুদ্ধিজীবী ' কি আদৌ কিছু সমাধা করতে পারে, তাহলে আপনি কি বলবেন? আপনি কি ভেবে অমন প্রশ্ন করলেন? আফগানিস্তানে যুদ্ধ চলছে। পুরো বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার চাপে ভুগছে। সামাজিক দূরত্ব বেড়েই চলেছে, এমন আরো কত কিছু ঘটছে।

সমস্যাটা খুব সাধারণ। বেশীরভাগ বুদ্ধিজীবিই ক্ষমতার দাস এবং সরকারের আজ্ঞাবহ ও পরামর্শক। তারা নিজেদেরকে বিশেষজ্ঞ দাবি করে। এভাবে এমন বুদ্ধিজীবিরা শতাব্দিকাল ধরে সম্মান অর্জন করে আসছে, এটা কেবল বর্তমান বিশ্বের কথা না। তবে প্রতিটি সমাজেই প্রান্তিক সীমানায় বাস করা কিছু সমালোচক বুদ্ধিজীবি বাস করে আসছে।

দুধরনের বুদ্ধিজীবিরই প্রভাব আছে: তা সে ক্ষমতার দাস হোক কিংবা বিরুদ্ধবাদীই হোক। আমরা এখনো সন্দিহান। গত ৪৫ বছরে আপনি কি পরিবর্তন করেছেন? ব্যক্তিগতভাবে আমি কোন কিছু পরিবর্তন করিনি। আমি একটি আন্দোলনের অংশ ছিলাম এবং এই আন্দোলন বেশ কিছু সমাধা করেছে। আজকের জগত ৪৫ বছর আগের জগতের চেয়ে মৌলিকভাবে আলাদা।

নাগরিক অধিকার, মানবিক অধিকার, নারী অধিকার, পরিবেশ সংরক্ষণ, নিপীড়ন ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন এই পৃথিবীকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে। আমি ঠিক বুঝছি না কেন আপনি বলতে চাচ্ছেন যে কোন কিছুর পরিবর্তন ঘটেনি। আপনি কি মনে করেন যে আজকের বিশ্ব ৪০ বা ৫০ বছর আগের চেয়ে শ্রেয়? অবশ্যই! আপনি এখানে ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিট্যুট অব টেকনোলজির উম্মুক্ত প্রান্তর ধরে হাঁটাহাটি করেন। দেখতে পাবেন, অর্ধেক শিক্ষার্থী নারী। এক তৃতীয়াংশ এসেছে জাতিগত সংখ্যালঘু সমপ্রদায় থেকে।

মানুষ এখন অনেক বেশী অনানুষ্ঠানিক-স্বাচ্ছন্দময় পোষাকে চলাফেরা করছে। তারা যে কোন কিছু করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছে। আমি যখন এখানে আসি সেই ৫০ বছর আগে, তখন এটি ছিল অন্যরকম এক স্থান। সেসময় দেখতেন, শ্বেতাঙ্গ পুরুষ, আনুষ্ঠানিক পোষাকে সজ্জিত, তারা কেবল নিজের কাজেই আগ্রহী ছিল। একই রকম পরিবর্তন আপনি দেখবেন জার্মানিতে আর সবখানে।

কিন্তু শিক্ষার্থীরা কি এখন বেশী রাজনীতিমনস্ক? আজকের প্রজন্মকে দোষ দেয়া হয় একথা বলে যে তারা এই বিশ্ব সম্বন্ধে উদাসীন। এই দোষারোপ মিথ্যে বলে মনে করি। বিশ্ববিদ্যালয়ে অতি উচ্চ রাজনীতিমনস্ক পরিবেশ ছিল ক্ষণস্থায়ী- সেই ১৯৬৮ থেকে ১৯৭০। এর আগে শিক্ষার্থীরা রাজনীতিমনস্ক ছিল না। ভিয়েতনাম যুদ্ধের কথা ধরুন, সেটা ছিল ২য় বিশ্ব যুদ্ধ শেষে সবচে বড় অপরাধ।

তখন প্রথম চার পাঁচ বছর আমেরিকায় তেমন কোন প্রতিবাদের চাঞ্চল্য চোখে পড়েনি। প্রতিবাদমুখর হওয়ার কিছু পরে ১৯৭০ এর শেষের দিকেই তা আবার মিইয়ে যায়। ইরাক যুদ্ধের আগ পর্যন্ত অবস্থাটা বেশ আলাদা ছিল। আমার জানা মতে, পৃথিবীর ইতিহাসে ইরাক যুদ্ধ সেই যুদ্ধ যা ঘটার আগেই পৃথিবীব্যাপী প্রতিবাদ আন্দোলন হয়েছে। আমার শিক্ষার্থীরা আমার বক্তৃতা না শুনে প্রতিবাদ সভায় গেছে।

৫০ বছর আগে এটা কখনো ঘটেনি। এই প্রতিবাদ যুদ্ধ থামাতে পারেনি, সত্য, কিন্তু তা যুদ্ধটাকে সীমাবদ্ধ রাখতে পেরেছে। আমেরিকা ভিয়েতনামে যা করেছে তার একাংশও ইরাকে করতে পারে নি। এসব প্রতিবাদ কি কেবলই প্রতিবাদ ছিল? আজকের রাজনীতিকরণ ১৯৫০ এর চেয়ে অনেক বেশী ব্যাপ্তি ও গভীরতা পেয়েছে। বিভিন্ন ধরনের স্থায়ী একটিভিজম বৃদ্ধি পেয়েছে যার মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন খন্ডযুদ্ধ জিততে পারছি।

উদাহরণ চাইলে নারী অধিকারের বলা যায়, এক্ষেত্রে আমরা ক্রমাগত উন্নয়ন অর্জন করেছি। আমি যদি আমার দাদীকে জিজ্ঞেস করতাম: তুমি কি নিপীড়িত? তাহলে তো দাদী বুঝতেই পারতো না আমি কি বলতে চাচ্ছি? আমার প্রশ্নটিই বুঝতে পারতো না। আমার মা বলতো: আমি নিপীড়নের শিকার কিন্তু আমি জানি না আমার কি করা উচিৎ। এমন প্রশ্ন করলে আমার মেয়ে হয়ত আমার দিকে চেঁচিয়ে কথা বলবে। আমাদের জগতটা এখন আগের চেয়ে অনেক মানবিক! আপনি কি ঐতিহাসিক উন্নয়নে বিশ্বাসী? উন্নয়ন একটি ধীর প্রক্রিয়া, তবে লম্বা সময় পরে তা দেখলে একে নাটকীয় মনে হয়।

দাসপ্রথার বিলোপের কথা ধরুন, অথবা বাকস্বাধীনতার কথা ধরুন। অধিকার কখনো এমনি এমনি দিয়ে দেয়া হয় না। যারা বিভিন্ন বাহিনী বা দলে যুক্ত হয়েছে, একত্রিত হয়েছে তারা একথা ভাল বুঝবে। তবে উন্নয়ন একরৈখিক বিষয় না। অবশ্য কখনো কখনো তা পিছনেও হেঁটে চলে।

তাহলে যদি সামনে এগোনো যেমন আছে, তেমনি যদি পেছনে যাওয়াও ঘটে থাকে, তাহলে এখন থেকে ৫০ বছর পরের পৃথিবী কি শ্রেয় হবে? ৫০ বছর পরে পৃথিবী কেমন হবে তা নির্ভর করছে আজকের যুব প্রজন্ম কি করছে তার উপর। দুটি বিপদ পৃথিবীর অস্তিত্বকে হুমকির মুখে রেখেছে: পরিবেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ও পারমানবিক অস্ত্র। পারমানবিক অস্ত্রের কথা না হয় বাদই দিলাম, আমরা যদি পরিবেশের বিষয়ে খুব শক্তিশালী অবস্থান না নিই, তাহলে ৫০ বছর পরে আমরা অতি গুরুতর পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবো। ফুকুশিমার উদাহরণ আমাদেরকে দেখিয়ে দিয়েছে যে, পারমানবিক শক্তির অসামরিক ব্যবহারও মানবজাতিকে অতি ভয়ানক বিপদের মুখোমুখি করতে পারে। কোন অবস্থাতেই আমরা এসবকে উপেক্ষা করতে পারি না।

৬০ বছর পরে এখনকার ছাত্রছাত্রীরা আপনার মত বৃদ্ধ হয়ে যাবে। তাদের কি করা উচিত যাতে তারা পরবর্তীতে জীবনের দিকে পিছন ফিরে তাকালে সন্তুষ্টি পেতে পারে? স্বাভাবিকভাবে তারা বলতেই পারে যে, তারা বন্ধুবান্ধব, সন্তান এবং ফানসহকারে জীবন কাটিয়েছে। তবে সত্যিকার অর্থে পরিপূর্ণ ও সন্তুষ্টির জীবন যাপনের জন্য তাদেরকে পৃথিবীর সমস্যা অনুধাবন করতে হবে এবং তা সমাধানে অবদান রাখতে হবে। ৮০ বছর বয়সে পেছন ফিরে তাকিয়ে যদি বলতে না পারে, হ্যাঁ, কিছু একটা করেছি, তাহলে তার জীবনে সার্থকতা থাকবে না। ৮২ বছর বয়সে আপনি কি আপনার জীবনে সন্তুষ্ট? সন্তুষ্ট হওয়া অসম্ভব।

আমার জীবনে বহু ক্ষেত্র, মাত্রা আছে, পরিবার, পেশা, রাজনীতি এবং আরো কিছু। কিছু ক্ষেত্রে আমি সন্তুষ্ট, তবে অন্যান্যগুলোতে নয়। এই পৃথিবীর সমস্যাগুলো বিশাল। আমেরিকায় অসাম্যের লেভেল এখন ১৯২০ দশকের মতো এবং অর্থনীতি এখনো আমাদের জীবনে বিশালবপু প্রভাব রাখে। এসব প্রেক্ষিতে আমার সন্তুষ্ট হওয়া সম্ভব না! আপনার মত এমন রাজনীতিক সংশ্লিষ্টতা পন্ডিতদের মধ্যে বিরল।

আপনার কি কখনো ' ক্ষমতার দাসদের ' প্রতি, আপনি যেভাবে বলেছেন, অথবা যারা কেবল তাদের একাডেমিক কাজের মধ্যে ডুবে আছে সেসব সহকর্মী প্রফেসরদের প্রতি বিরক্তিতে ক্রোধোম্মত অনুভুতি জাগে? ক্ষমতার সিস্টেম এর সমর্থক হওয়াটাকে আমি অনৈতিক মনে করি। তার মানে এই নয় যে আমি কারো প্রতি ক্ষুব্ধ, বিরক্ত, ক্রোধোম্মত। সহজাতভাবে পন্ডিতেরা অন্যদের চেয়ে বেশী গভীর রাজনৈতিক মননের অধিকারী হন না, তারা অন্যদের চেয়ে নৈতিকভাবেও উন্নত না। তবে তাদের কর্তব্য হচ্ছে রাজনীতিবিদদের সাহায্য করা যেন রাজনীতিবিদরা সত্যকে খোঁজেন এবং তা পান। মনে হচ্ছে যেন বৃদ্ধ বয়সে আপনি এখন নমনীয় হয়ে পড়ছেন।

না। কয়েক দশকেও আমার মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটেনি। কৈশোরে যা বিশ্বাস করতাম, এখনও তা করি। এটা কি ভাল কিছু? এমন কিছুতে বিশ্বাস করা যা আপনি ৭০ বছর আগে বিশ্বাস করতেন? হ্যাঁ, ভাল। যখন মৌলিক নীতির প্রশ্ন বিচারে তা ঠিক থাকে।

অবশ্যই বিভিন্ন বিষয়ে আমি আমার অভিমত পরিবর্তন করেছি। কিন্তু আমার আদর্শ সেই একই আছে। আপনি প্রায়ই বলেন, আপনি একজন নৈরাজ্যবাদী। একথা বলে আপনি কি বোঝাতে চান? নৈরাজ্যবাদীরা ক্ষমতার কাঠামো বুঝতে চায়। তারা ক্ষমতা প্রয়োগকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে তাদের কাজের বৈধতার প্রমাণ দিতে বলে।

এই বৈধতা প্রমাণের চেষ্টা বেশীরভাগ সময় সফল হয় না। তখন নৈরাজ্যবাদীরা মুখোশ উম্মোচনের ও কাঠামো পুনর্নিমানের কাজে রত হয়। এসব হতে পারে পিতৃতান্ত্রিক পরিবার, আন্তর্জাতিক মাফিয়া ব্যবস্থা অথবা অর্থনীতির বেসরকারি অত্যাচার বা করপোরেশন এর মুখোশ উম্মোচন এর কাজ করার মাধ্যমে। কোন বিশেষ অভিজ্ঞতা আপনাকে নৈরাজ্যবাদী করেছে? তেমন কোন কিছুই জীবনে ছিল না। বার বছর বয়স থেকে আমি পুরনো বই বিক্রির দোকানে যেতে শুরু করি।

সেগুলো বেশীরভাগই ছিল স্পেন থেকে আসা নৈরাজ্যবাদীদের দ্বারা পরিচালিত। আর তাই আমার পক্ষে নৈরাজ্যবাদী হওয়াটা বেশ স্বাভাবিক হয়ে পড়েছে। সব শিক্ষার্থীরই কি নৈরাজ্যবাদী হওয়া উচিৎ? হ্যাঁ। শিক্ষার্থীদের উচিৎ অথরিটিকে প্রশ্ন করা এবং এভাবে নৈরাজ্যবাদীদের সুদীর্ঘ ইতিহাসের সারিতে অংশ নেয়া। ' অথরিটিকে প্রশ্নের মুখোমুখি করা ' - লিবারাল বা মডারেট বাম ধারার ব্যক্তিরা এটাকে সাদরে গ্রহন করতে পারে।

যখনই কেউ অবৈধ ক্ষমতাকে চিহ্নিত করে, তাকে প্রশ্নের মুখোমুখি করে এবং তাকে পরাভূত করে তখনই সে নৈরাজ্যবাদী হয়ে পড়ে। বেশীরভাগ মানুষই নৈরাজ্যবাদী। তারা নিজেদেরকে কোন দলের অন্তর্ভূক্ত করে তা নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা নেই। এখনকার ছাত্রসমাজকে কোন বিষয় বা কোন ব্যক্তির চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে? এই জগতটা যন্ত্রণাভোগ, বঞ্চনা, সন্ত্রাস এবং দুর্যোগে পরিপূর্ণ। শিক্ষার্থীদের অবশ্যই সিদ্ধান্ত নিতে হবে: এসব কিছু কি তোমাকে পীড়িত করছে? নাকি করছে না? আমি বলি: তোমার চরিদিকে তাকাও, সমস্যার বিশ্লেষণ করো, নিজেকে জিজ্ঞেস করো তুমি কি করতে পারো এবং এরপর কাজে নেমে পড়ো! ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.