আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মাঝে মাঝে যদি তব দেখা পাই - ১ম পর্ব

[১] “ফাগা...। ফাগা ওঠ...” কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে আবার, “ফাগা ওঠ । ফাটাফাটি নিউজ আছে । ” আমি তারপরও নাক-মুখ গুঁজে শুয়ে থাকলাম । “ফাগা, দোস্ত... ইমারজেন্সী ।

” এইবার ধীরে ধীরে খুব বিরক্ত ভঙ্গীতে পাশ ফিরে তাকালাম আমি । রিফাত । ওর পরিচয় হিসেবে বলা যায়, আমার রুমমেট, একজন কবি এবং আধ-পাগল । আমি ঝিমাতে ঝিমাতে প্রার্থনা করতে লাগলাম যাতে ও পুরো পাগল হয়ে যায় আর রুম ছেড়ে পাগলা-গারদে ঠাঁই পায় । হাই তুলতে তুলতে বললাম, “বল তোর কি ইমারজেন্সী ?” রিফাত এবার মহানন্দে বলতে লাগল, “আমি একটা কবিতা লিখেছি ।

দাঁড়া তোকে পড়ে শোনাই । ” তারপর আমাকে কিছু বলতে না দিয়ে শুরু করে দিল, “যার ‘ওয়েট’ আমি করি সারারাত, যার ভাবনায় ভাঙ্গে ঘুম, আমার হঠাৎ হঠাৎ । সে আসে, হ্যাঁ আসে আসে, কিন্তু দেয় না ‘নক’ আমায় দেখ, সে আজ...” কবিতার মাঝেই আমি বলে উঠলাম, “কয়টা বাজে দেখ তো ?” “সাড়ে চারটার মত । ” “এই মাঝ রাতে তোর ইমারজেন্সী কাজ হিসেবে আমাকে কবিতা শুনতে হচ্ছে ?” “আসলে হঠাৎ লিখে ফেললাম তো । তাই ভাবলাম, তোকে শুনিয়ে দেখি কেমন হয়েছে ।

কেমন লেগেছে ?” “গুড । কিন্তু হাউ হাউ জানি লাগে। ” “মানে কি ?” “তোর বাংলিশ কবিতার মতই বাংলিশ মন্তব্য করলাম । ” রিফাত মুখ কালো করে ফেলাতে জিজ্ঞেস করলাম, “অর্ককে বাদ দিয়ে আমাকে শোনাতে আসলি কেন ? আমি কি পাপ করেছিলাম ?” রিফাত আরও গম্ভীর হয়ে উত্তর দিল, “রিফাতকে একদিন কবিতা শোনাতে, বাজে কথা বলেছিল । ” “কি বাজে কথা ?” “হালার পো ।

দূরে গিয়া মর – এটা বলেছে । তুই-ই বল, কোন সুশীল মানুষ এরকম মন্তব্য করতে পারে ?” আমি অনেক কষ্টে আমার হাসি চাপলাম । রিফাত বয়সেই বড় হচ্ছে, মনটা এখনও বাচ্চাদের মতই রয়ে গেছে । আমি আবার শুয়ে পড়লাম । শেষ রাতে এসে ঘুম নষ্ট করার কোনো মানে হয় না ।

অর্ক আমার আরেক রুমমেট । আমরা তিনজনই মহসীন হলের এই ছোট রুমটাতে থাকি । এখানে প্রথম আসার পর অর্ক, রিফাত দু’জনকেই অদ্ভুত মনে হত । রিফাতের কথা বলেছি, এখন অর্কেরটা বলা যাক । অর্কের সাথে পরিচয় হবার সময় ও নিজের নাম বলেছিল, “আর্খ”।

এটা ওর নাম না, অন্য কিছু এটা জানতে আমার কয়েকদিন লেগে গিয়েছিল । পরে বুঝেছি, ও ডিজুস প্রজাতির মানুষ । হেই হেই, ইয়ো ইয়ো ছাড়া কথা-ই বলতে পারে না । প্রতি মাসে নাকি দুইবার করে গার্ল ফ্রেন্ড পাল্টায় । অর্কের মুখ থেকে এসব শুনতাম, আর মুখ গোল করে বলতাম, “ও আচ্ছা,” সব কিছু ঠিকই ছিল, কিন্তু প্রায় প্রতি মাসেই আমার কাছ থেকে টাকা ধার করার ব্যাপারটা ছাড়া ।

মাসে কমপক্ষে একবার অর্ক আমাকে দেখে বলে, “দোস্ত, ইম্পরট্যান্ট কথা আছে । ” আর আমি বুঝে যাই, আমার বিপদ সংকেত । অর্ককে ধার দেয়া টাকাটা আর কখনোই পাওয়া হয় না আমার । কালেভদ্রে যদি কখনও কথায় কথায় টাকার কথাটা তুলি, তখন অর্ক হঠাৎ করে ব্যস্ত হয়ে যায়, এখান ওখান থেকে ফোন আসা শুরু করে । আমিও নিতান্তই ভালোমানুষের মত টাকার ব্যাপারটা ভুলে যাই ।

এবার আমার পরিচয় দেওয়া যাক । আমার নাম, সৈয়দ ইরফান হাসান । ডানে,বামে,উপরে,নিচে- কোনোভাবেই আমার নামের সাথে “ফাগা” শব্দটার মিল খুঁজে পাই নি আমি । অথচ আমার বন্ধুরা আমাকে ‘ফাগা’ নামেই ডাকে । আমি বড় হয়েছি ছোট্ট শহর কুমিল্লায় ।

কিভাবে কিভাবে যেন, ঢাবিতে চান্স পেয়ে গেলাম । সাড়ে তিন বছর পরও অবাক লাগে আমার । ভাই-বোনদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট হওয়ায় অনেক বেশী সুযোগ-সুবিধা পেয়েই বড় হয়েছি । কিন্তু মা এর হুমকি-ধমকি থেকে রেহাই পাই নি । আমার বাবাটাও নিতান্তই ভালোমানুষ গোত্রের ।

কোনদিন যে, মায়ের ‘অত্যাচারে’ ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে সন্ন্যাসী হয়ে যান, কে জানে । বাবার ছোট ব্যবসায়ের যা আয়, তা দিয়েই আমাদের চার ভাই-বোনের সংসার মোটামুটি চলে যেত । এখন অবশ্য বোনদের বিয়ে হয়ে গেছে । ভাইয়াও বিয়ে করেছে, মাস খানেক আগে । বাকি আছি, শুধু আমিই আর কি ।

[] আমার বাবা বেশ খানিকটা খরুচে স্বভাবের । সেই দিক থেকে মায়ের অত্যাচারগুলোকে সাধুবাদ জানাতে হয় । মাঝে মাঝে মনে হয়, মায়ের কড়া নজর-দারির কারণেই আজ আমরা চার ভাই-বোনের সবাই শিক্ষিত হতে পেরেছি (আমি পেন্ডিং এ যদিও)। মাসের শুরুতে মায়ের গুনে গুনে হিসেব করে পাঠানো টাকা পাওয়ার দুই দিনের মাথায় বাবার কাছ থেকে আরও কিছু টাকা পাই । বাবা অনেক দুঃচিন্তায় থাকেন, আমি কিভাবে থাকি, না থাকি তা নিয়ে ।

হাজার হোক তাঁর ‘একমাত্র ছোট ছেলে’ বলে কথা । আমি অবশ্য ঢাকায় এসে বেশ খানিকটা কিপ্টে হয়ে গেছি । আসলে, কিপ্টেও বলা যায় না ঠিক । ছোট-খাট সমাজসেবী হয়ে গেছি, তাই মিতব্যয়ী বলা যেতে পারে । বস্তির শিশুদের নিয়ে বিনামূল্যে পড়ানোর জন্য একটা স্কুল আছে ।

আমি সেখানে পড়াই । মাঝে মাঝে কাঁটাবন বা শাহবাগের রাস্তার আশেপাশে কোন অস্থায়ী পরিবার পেলে তাদের একবেলা খাবার কিনে দেই । বলতে ভুলে গিয়েছিলাম, আমি একটা টিউশনিও করি । বাবা-মা’র কাছ থেকে পাওয়া টাকায় আমার মাস চলে যায় কোনোমতে । তাই টিউশনির টাকাটা খরচ করি ওদের পেছনে ।

মাঝে মাঝে জ্বর-টর হলে দলবেঁধে যখন আমার খোঁজ নিতে আসেন তারা, আনন্দে চোখে পানি এসে যায় আমার । না চাইতেই যে ভালবাসা পাওয়া যায়, সেটাই বা মন্দ কি ! ও... আমি কিন্তু গিটারও বাজাই । আমার জীবনের প্রথম ও শেষ ভালোবাসা এই গিটারই । এমনকি আমার ফেসবুকে রিলেশনশিপ স্ট্যাটাসেও লেখা আছে – “In a relationship with “My Guitar”. লেখাপড়ায় অমনোযোগী আমি । সারাদিনের ছোট-খাট সমাজ-সেবা, গিটার প্র্যাকটিস, বন্ধুদের সাথে আড্ডায় সময় দিতে গিয়ে নিজেকে খুব ব্যস্ত বলেই মনে হয় দিন শেষে ।

আমি খুব সাধারণ একটা মানুষ । এরচেয়ে বেশী আর কি-ই বা চাইতে পারি ? তবে আমিও কোনো একদিনের ঘটনায় বদলে যেতে থাকি... ধীরে ধীরে । (চলবে)  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.