আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ছোটগল্পঃ মতলববাজ মতলব

মতলব মেম্বারের নামটা মতলব হলেও আসলে তার মাথায় কোন মতলব খেলতে পেত কিনা তা নিয়ে বিস্তর সন্দেহের সুযোগ রয়েছে। মতলব খেলবার পক্ষে পর্যাপ্ত ফাঁকা স্থান তার মগজে ছিল কিনা এটাও এক বড় প্রশ্ন। কারণ মেম্বারের মাথাটা এতটাই নিরেট ছিল যে তার ভারে তিনি কোনদিন মস্তক সোজা করে দাঁড়াতে কি হাঁটতে পারেননি, চেয়ারম্যানের কাছ থেকে গমের বখরা ঠিকঠাক বুঝে নেয়াতো দূরের কথা। গ্রামের আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মতই মতলবের জীবনটা দুঃখে-কষ্টে একরকম কাটতে পারত। কিন্ত দূর্ভাগ্যবশতঃ গ্রামের লোকেরা তাকে কেন যেন সৎমানুষ বলে ঠাওর করত।

আর তার পরিণাম এইযে মতলবকে চার-চারবার ইলেকশনে দাঁড়িয়ে তিনবারই জিততে হল। ইলেকশনে দাঁড়াতে মতলবের যে মন্দ লাগত তা নয়। বরং শেষদিকে এসে কেমন নেশা ধরে গিয়েছিল। কোন চেষ্টা নেই, উদ্যোগ নেই, ঘুরাঘুরির পরিশ্রম একটু থাকলেও তা ধর্তব্যের মধ্যে নয় আর টাকা-পয়সাতো কোনদিনই ছিলনা; এতসব নেইর মাঝখান থেকেও কেমন করে জানি বাঘা বাঘা সব প্রতিযোগীকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে পিছনে ফেলে মতলব তার মেম্বারত্ব ঠিকই অক্ষুণ্ন রাখতে পারত। তবে এই রূপকথার গল্পের মত ঘটনা তখনই ঘটেছিল যখন দেশ-জাতির কর্ণধার ছিলেন একজন দেশবন্ধু।

আপসহীন নেত্রীর আমলে এসে মতলবকে তিন ভোটের ব্যাবধানে হেরে যেতে হল। এরপরের নির্বাচনে মতলবকে খাড়া করবার জন্য কারো কোনো উদ্যোগ দেখা গেলনা। ততদিনে মতলব অনেকটা বুড়োও হয়ে পড়েছে। বুড়ো হয়ে এবং মেম্বার পদ হারিয়ে মতলব বাড়ির এককোনে নির্জীব পড়ে থাকল। তার দু-দুটি জোয়ান বৌ দেড়গন্ডা ছেলেমেয়ে নিয়ে এবং বড় ছেলে আরও দুটো কচি বৌ এবং পৌনে একগন্ডা আন্ডাবাচ্চা নিয়ে গোটা বাড়িময় রাবন-রাজত্ব করে বেড়াতে লাগল।

ঘরের কানাছে বুড়ো বরই গাছটার ছায়ায় কোনকালে খেজুর পাকায় বোনা ছেড়া-ফাড়া পাটিটায় শুয়ে-বসে সে এই অপ্রয়োজনীয়ভাবে বৃহৎ সংসারটার দিকে চেয়ে চেয়ে আঁৎকে ওঠে। সর্বনাশ! কবে কোন দুর্বুদ্ধিবশে সে এদেরকে জুটিয়েছে! পরমাসুন্দরী একখানা বৌ প্রথম যৌবনে তার ভাগ্যে জুটেছিল। সেটাই তার সারাজীবনের জন্য যথেষ্ট হতে পারত। অথচ মধ্যবয়সে এসে সে প্রেমে পড়ল ফুলমতির। তারপর দুই বৌ মিলে যখন দুটি করে চাঁদপানা মুখ তাকে উপহার দিতে শুরু করল তখন সে একদিন দুটোকেই ধরে পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্রে নিয়ে গেল।

কিন্ত ছোটবৌ শয়তানটা কেমন করে যেন ঠিক পালিয়ে এল। সে লাইগেশন করাবেনা কারণ আল্লাহ্ এখনো তারে ছাওয়াল দেয় নাই। ক্ষোভে-দুঃখে মতলব সেদিন নিজেই ভেসেকটমি করিয়ে এসেছিল। ফুলমতির ছাওয়ালের শখ চিরদিনের মত ঘুচিয়ে দিলেও একদিন ফুলমতি নিজ উদ্যোগেই লাইগেশনটা করিয়ে নেয়। একখানা শাড়ি, নগদ একশ টাকা এসব প্রাপ্তির লোভতো ছিলই, তার চেয়ে বড় ছিল মান ইজ্জ্বতের লৌকিক নিরাপত্তা।

বিষয়টা একটু খোলাসা করা যাক। তখনো মতলব মেম্বার হয়নি। এ গাঁয়ে কোন মেম্বার ছিলওনা। প্রায় বিলের মাঝে গড়ে ওঠায় মূল গ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন এ ছোট্টপাড়াটায় ভদ্রলোক বলে যারা দাবীদার তারা একদিন মতলবকে ধরে বসল। এ গ্রামের সবচে নিরীহ, গোবেচারা, খানিকটা নির্বোধ ও উপহাস্য যে মতলব তাকে নাকি তারা মেম্বার বানাবে।

এ যাবৎ এ গ্রাম থেকে একজনই মেম্বার পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আসছে। কিন্ত তার ভোটসংখ্যা দেখলে অনায়াসেই বোঝা যায় যে তার নিজ গ্রামবাসীরাও তাকে ভোট দেয়না। এ নিয়েতো রীতিমত একটা প্রবাদই চালু হয়ে গেছে। একটা অতি পরিচিত পুরনো প্রবাদকে বিকৃত করে পাড়ার দুষ্টু ছেলের দল সুর করে বলে, গাঁয়ে মানেনা কাজীর ব্যাটা, ভোট দেয়না বৌ মারে ঝাঁটা। কাজীর ব্যাটা মানে এ গাঁয়ের চিরঅপ্রতিদ্বন্দ্বী অথচ ইউনিয়ন পরিষদে চিরপরাজিত মেম্বার পদপ্রার্থী কাজী আহমেদ পারভেজ সুজা।

কাজী সুজা পঁচিশ বছর বয়স থেকে নিয়মিত নির্বাচনে দাঁড়িয়ে আসছে। কিন্ত ঐ দাঁড়ান পর্যন্তই। তার নামের আগে বা পরে মেম্বার তকমাটা বোধকরি কোনদিনই যুক্ত হবার নয়। অথচ এমনটা হবার কথা নয়; কাজী সুজা মানুষ হিসেবে খারাপ নয়; বরং শিক্ষিত,সজ্জন; তবে একটু কৃপন প্রকৃতির--এইযা। সমস্যাটা বুঝতে হলে একটু পিছনে ফিরে তাকান দরকার।

একসময় অর্থাৎ ইংরেজ আমলে কাজীরা ছিলেন এ তল্লাটের জমিদার। খুব বড় জমিদারী হয়ত নয়, দুএক হাজার বিঘা সম্পত্তি; তবুতো জমিদারী। ইংরেজরা এদেশ ছেড়ে গেল, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তও রইলনা, জমিদারদের মুখে কাল ছায়া পড়ল কিন্ত মনের অহংকারের কালি তাতে বাড়ল বৈ কমলনা। জমিদারী প্রথাটা গেলেও নানা কৌশলে নামে-বেনামে নামজারি করিয়ে যে সস্পত্তি কাজী পরিবারের থাকল তাতে করে তারা এতদঞ্চলের অপ্রতিদ্বন্দ্বী ভূস্বামী বলেই চিহ্নিত হয়ে রইল। তাদের এককালের প্রজাদের কেউ কেউ এখন বিদ্যা শিক্ষাসহ নানা উপায়ে ভদ্রপর্যায়ভুক্ত হতে চেষ্টা করছে ঠিকই কিন্ত কাজীরা তাদের মানুষ বলে ভাবতে মনে মনে আজও নারাজ বলে।

তাই তারাও এখন কাজীদেরকে মনে মনে অমানুষ ভেবে তাদের প্রতি অপ্রকাশ্য নিরব অবহেলা ধারণ করে একেবারে বিমুখ হয়ে বসে আছে। এমনই পটভূমিতে একদিন মতলবকে মেম্বার বানাবার প্রস্তাবটা দিল এ গাঁয়ের এক উঠতি মাতব্বর যে সম্পর্কে মতলবের দূরসম্পর্কের ফুপাত ভাইও বটে। এতদিন কাজী সুজা, এ গ্রামের একমাত্র প্রার্থী ছিল। কিন্ত এ গ্রামের লোকেরা বরাবরই ভিন গাঁয়ের লোককে ভোট দিয়ে এসেছে। এখন এই গ্রামে একজন মেম্বার চাই কিন্ত কাজীর ব্যাটাকে নয়।

কাজীর বংশকে বাদ দিয়ে গ্রামের ইজ্জ্বত বাড়ানোর জন্য সেই উঠতি মাতব্বরের খুবই উৎসাহ দেখা গেল। চাইলে নির্বাচনটা সে নিজেই করতে পারে কিন্ত তার বয়স কম হলেও এরই মাঝে তার নামের সাথে যুক্ত হয়েছে নানান বদনাম। কাজী বাড়িতে দুএকবার ডাকাতির চেষ্টা, নারীঘটিত ছোটখাট দু-একটা ঝামেলা তার জীবন ইতিহাসে যেভাবে লিখিত হয়ে পড়েছে তাতে করে আগামী কয়েক বছর সাদা জীবনযাপনের চেষ্টা করে সাধারণের মন হতে ঐসব স্মৃতি মলিন হওয়ার পূর্বে ইলেকশনে দাঁড়ালে বড় মুখ করে ভোট চাওয়া সম্ভব নয়। উঠতি মাতব্বরে উদ্যোগে মতলবের কিছু সমর্থকও জুটে গেল যারা মতলবের হয়ে দৌড়-ঝাঁপ করে তাকে নির্বাচনে দাঁড় করিয়ে দিল। ক্যাম্পেইন করবার লোকেরও অভাব দেখা গেলনা।

দেখা গেল ভোটারদের মনেও মতলবের প্রতি দারুণ অনুকম্পা। অকর্মা, অলস মতলবের ঘরে দু-দুটি সুন্দরী বৌ, অথচ চুলোয় তার হাঁড়ি চড়েনা বললেই চলে। এখান-ওখান, এবাড়ি-ওবাড়ি করে যেভাবে মতলবের সংসার চলে তা দেখলে মনে হয় মানুষ বুঝি হাওয়া খেয়ে বাঁচতে শিখেছে। এমন দৈন্যদশাকে পুঁজি করে নিরীহ, বিনয়ী মতলব অতি অনায়াসে ভোটারদের মন ভিজিয়ে দিতে সক্ষম হল। নির্বাচন শেষে জানা গেল এ নির্বাচন বাবদ মতলবের কিছু না হলেও উদ্যোক্তাদের কিঞ্চিৎ খরচ হয়েছে।

সে খরচ পুষিয়ে নিতে মতলবকে শিখন্ডী করে তারা এলাকায় অপ্রতিহত ক্ষমতাধর হয়ে উঠল। কখন জানি মতলবের বৌ দুটো আপনা থেকেই বারোয়ারী বনে গেল। চোরের বৌ যেমন দারোগার বৌ হয়, মেম্বারের বৌরা তেমনি তার পৃষ্ঠপোষকদের বৌয়ে পরিণত হল। শোনা যায় তার দু-একটি সন্তান দেখতে এদেরই কারো কপি। সে যাই হোক মতলব মেম্বার ভেসেকটমি করে আসার পর লাইগেশন না করে ফুলমতির আর উপায় রইলনা।

এরপরও মতলব আরও তিনবার নির্বাচনে দাঁড়িয়েছে, দুইবার জিতেওছে। মেম্বার থাকাকালে তার সংসারে কোনদিনই খাদ্যাভাব ঘটেনি। ভাতের অভাব ঘটলে রুটি এসে বাসনের কোনে ঠাঁই পেতেছে। আসলে ক্ষুধা নিবৃত্তিই যেখানে বড়কথা সেখানে পলান্ন কি খুদের জাউ সবই সমান আদর পায়। তিনবেলা ঠিকঠাক পেট ভরতে পারলেই মতলব ও তার পরিবারবর্গ খুশি, এর বাইরে তারা কিছু ভাবতে চায়না।

তাদের সঞ্চয় বলতে কিছু নেই, অন্যকোন কাজকর্মেরও চেষ্টা নেই—এসব নিয়ে কোন ভাবনাও তাদের নেই। এখন মতলব তার বরইগাছটার তলায় ছেড়াফাঁড়া পাটিতে পা ছড়িয়ে বসে পথপানে ক্ষীণ ঘোলাটে দৃষ্টি রেখে উদাসভাবে কি যেন ভাবছে। বোধকরি সে ভাবছে তার ফেলে আসা জীবনের কথা—বাল্যকালে ঘুড়ি ওড়ানো, ডোবা ছেঁচে মাছ ধরা, ঝুম বৃষ্টিতে হাডুডু খেলা, প্রথম যৌবনের প্রেম, প্রথম নারীসঙ্গ, ভরা যৌবনের উন্মাতাল কাম কিংবা সে হয়ত ভাবছে নির্দিষ্ট কোন দিন বা ক্ষণের কথা। যেমন- প্রথম ইউপি মেম্বার ঘোষিত হবার ক্ষণটির কথা, চেয়ারম্যানের কাছ থেকে ত্রাণের ঢেউটিন বুঝে পাবার দিনটির কথা(আহা! মতলবের বহু শখের টিনের ঘর! পুরো একখানা দোচালা ঘর তুলবার মত টিন চেয়ারম্যান তাকে দেয়নি, তাই একচালা ছাপড়া পাততে হয়েছিল। তবু টিনের ঘরতো! মতলব বহুত খুশি হয়েছিল।

), অথবা চাঁপাতলার শেখের পো জব্বার শেখের বড় ব্যাটার জিয়াফতে যে খাসীর মাংস খেয়েছিল তার জিভে পানি আনা স্বাদ। কতকিইতো মতলব ভাবতে পারে। ভাবনার অঢেল সময় মতলবের আছে বটে। সংসারে কারো জন্যই যাকে ভাবতে হয়না সেতো নিজের অতীত দিনের সুখ ভাবনায় বিভোর থাকতেই পারে। সংসার মতলবের কাছে এখন আর কিছু চায়না, আবার মতলবের যে সংসারের কাছে কিছু চাওয়ার থাকতে পারে তা অনুভবের ঠেকাও সংসারের পড়েনি।

((২)) বোধকরি হাওয়ায় ভেসে কথাটা মতলবের কানে ঢোকে। ইদানীং চোখে সে খুব কম দেখলেও কান তার দিব্য পরিষ্কার। কয়েকদিন ধরেই একটা গোপন ষড়যন্ত্র চলছে। কোথায় যেন কী একটা বদল ঘটে যাবে। বরইগাছটার তলায় বসে আজ হঠাৎ মতলব কেঁদে ওঠে, ওরে তুরা আমারে ফ্যালায়ে কহানে যাবি? বড়বৌ আলোজান উঠান ঝাঁট দেয়া থামিয়ে থমকে দাঁড়ায়, কিডা কইল আমারা কুনুহানে যাচ্ছি? কাঁদতে কাঁদতেই মতলব বলে, আমি ট্যার পাই, আমি সব ট্যার পাই।

তুরা আমারে থুয়ে ঢাহা যাবি। ঢাহায় চাকরি ওরবি, ভালমন্দ খাবি, আমারে সাথে নিবিনে, আমি সব ট্যার পাই। --- সব ট্যার পালিতো বালোই। তা এতদিন কিছু ট্যার পাইতে না? সুংসারডা ক্যাম্মায় চইলতেছে, হাঁড়িতে ক্যাম্মায় ভাত ফুইটতেছে, পিন্দনের রঙিন ছাপা কাপুড় কহানেত্থে আইসতেছে এসব ভাইবতেনা? মতলব মাথাটা আরো ঝুঁকিয়ে কাঁদতে থাকে। আলোজান পুনরায় ঝাঁট দিতে দিতে আপন মনে বলে, জুয়ানমদ্দ সুয়ামী থাকতিউ নটিগিরি কইরে সুংসার চালাতি হইছে; সুয়ামী দেহেও দেহেনাই, বুঝেও বুঝেনাই।

তিনতিনবার মেম্বার হইছে, সৎমানুষ ভাইবে উনারে মেম্বার বানাইছে; হুঁ, সৎ মানুষ! উনি মেম্বার হয়ে ফুলবাবু সাইজে, বাসনা ত্যাল মাথায় দিয়ে সদরে গেছেন, আর আমাগের ঘরে দিনি-দুপুরি মানুষ ঢুহে খিল লাগাইছে। বড় গরবে ছিলাম, মেম্বারের বৌ! তা এহনতো সে মেম্বারগিরিও নাই। দুই মাগী মিলে ছিনালি ওইরেও এহন সুংসার চলেনা। শুওরের বাচ্চারা এহন আমাগেরে বুড়ি কয়, বৌ-মাইয়েগের সাথে শুতি চায়। কিন্ত জুয়ান-কচি বৌ-মাইয়েই যদি ইজ্জ্বত বেচে সুংসার চালাবি তাইলে এহানে ক্যা? এত সস্তায় ক্যা? বড় মাইয়েতো এর মদ্যিই গিরামের সস্তা খানকির খাতায় নাম লিহে ফেইলছে।

বাদবাহিডারে নিয়ে আমি ঢাহায় যাব। ঐ খানকি এহানে ফিরি ঘরে গাহাক বসাক। তালি আর ওর কষ্ট ওইরে বাঁশঝাড় কি কুষ্টার ভুঁইতি যাতি হবিনে। এইবার শরীরের সমস্ত শক্তি এক করেই বুঝি মতলব খেঁকিয়ে ওঠে, হারামজাদি মাগী, ছিনালের মাইয়ে ছিনাল, চুপ কর। তোর মুখ পাড়াইয়ে আমি ছিঁড়ে ফ্যালাব কলাম।

--- ক্যান, কষ্ট ঠ্যাহে? মাইয়েতো প্যাট বাদায়ে ছাওয়াল বানাইয়ে সারল, ঠ্যাহাতি পাইরছো? তুমি তহন মেম্বার ছিলে, তাও মাইয়েডা ক্ষিদে প্যাটে একমুঠ ভাজার লোভে আট ছাওয়াল-মাইয়ের বাপের ঘরে দুফোর বেলায় ঢুইকলো। তুমারে মেম্বার বানাইয়ে এই গিরামের কতজনের চারচালা টিনির ঘর ওইলো, গাভীন গরু ওইলো, তুমার কী ওইছে? আলোজান তীক্ষ্ণ, তিক্তস্বরে বলে চলে, ছাওয়ালডা ওইছে ছ্যাচ্ছোড়, বাপের মতন জুড়ায় জুড়ায় বিয়া অরা আর জম্ম দিয়া ছাড়া আর কুনো মুরোদ নাই। বাপের নাম ভাঙ্গায় মেম্বার হবি সে গুড়ি বালি। তুমার বড় মাইয়ের কির্তি পাঁচ গিরামে জানাজানি ওইছে। তাছাড়া ফহিরির ছাওয়াল মেম্বার ওতি গিলি যে তার বৌগেরে নটি ওতি অয় তাতো বালোই বুঝছি।

আর নটিই যদি ওতি অয় তালি এত সস্তায় ক্যা? খালি কয়ডা চাল-ডাইল-ত্যাল-নুন কি পাঁচ-দশ টাহার বদলে ক্যা? মতলবের মুখে আর কোন কথা যোগায়না। প্রবল আতঙ্কের সাথে সে শুধু ভাবতে থাকে তার অনাগত দিনের কথা। এরা ঢাকায় যাবে, উপার্জন করতে যাবে, ভাল ভাল খেতে পরতে যাবে; তার কী হবে? কে তাকে খেতে দেবে? কোর্মা-পোলাও নয়, খাসীর মাংসের ঝোল নয়, সাধারণ একমুঠ ভাত আর শাকভর্তা যা দিয়ে সে আজীবন তার ক্ষুধা নিবৃত্ত করে আসছে তাও এখন তার বরাত থেকে উঠে যাবে? ভিক্ষে করবে মতলব? কিন্ত সে যে ভাল করে হাঁটতেই পারেনা। তাছাড়া ভিক্ষার সেই একমুঠো খুঁদই বা তাকে ফুটিয়ে দেবে কে? বড় মেয়ে নূরী? কিন্ত সে কি বাড়ি থাকে? বছর দেড়েকের জারজ ছেলেটাকে কাঁখে করে সেইযে সকালে সে বেরোয় আর ফেরে সন্ধ্যার পর। কী সে করে আর করেনা তা কেউ জানেনা।

তবে মা-ছেলের স্বাস্থ্য দেখে বেশ বোঝা যায় যে তারা সারাদিন নিতান্ত অভুক্ত থাকেনা। তবু রাতের বেলা খাবার ওক্তে নিজের বাসনখান নূরী ঠিকই তার মার সামনে পেতে রাখে। সবার পাতে একমুঠো পড়ে কিছু বাঁচলে তবেই আলোজান নূরীর বাসনে কিছু দেয়। মাঝে মাঝে এ নিয়ে গালমন্দও করে আলোজান, সারাদিন মারা খাইয়ে আইসে রাত্তির বেলা মেনি বিলাইয়ের নাহাল ভাগ নিতি বসিস হারামজাদি, তোর শরম নাই? নূরী সেকথা গায়ে মাখেনা। ভাগটা পেলে ভালই, না পেলে মায়ের উদ্দেশ্যে ছাপার অযোগ্য অশ্লীল কয়েকটি গালি ঝেড়ে ছেলে নিয়ে মাচানে গিয়ে শুয়ে পড়ে।

এখন মতলব বুঝতে পারেযে তার জীবনে আরো ভয়ঙ্কর দিন আসছে। কিন্ত কী সে করতে পারে? বুড়ো বয়সে মানুষ সাধারণতঃ তার বিগত দিনের পাপের জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে ক্ষমা চায়, একটা সুন্দর মৃত্যু কামনা করে আর পরকালে বেহেশত্ নসীব চেয়ে বিধাতার কাছে ফরিয়াদ করে। মতলব ওসব পাপ-পুণ্য, পরকাল নিয়ে কোনদিন ভাবেনি। পাপ করবার ইচ্ছে বা সাহস কোনটাই মতলবের ছিলনা। পুণ্য করবার সামর্থ্যই বা তার কোথায়।

আর পরকাল বিষয়ে বিশ্বাসীরাই বেশি দুর্ভাবনা করেনা আরতো মতলব। তবে হ্যা, মৃত্যুকে সে ডরায়, বহুত ডরায়। সে বেঁচে থাকতে চায়। কিন্ত বাঁচতে চাইলেই যে বাঁচা হয়না তাও মতলব জানে। পাপ-পুণ্য-পরকাল বিষয়ে যে মতলব কোনদিন চিন্তা করেনি আজ সে তা নিয়ে ভাবতে বসে।

এসব বিষয়ে তার ধারণা অস্পষ্ট হলেও সামাজিক শিক্ষা থেকে প্রাপ্ত কিছু সাধারণ বোধ থেকে পাপ-পুণ্য বিষয়ে তার কিছু ধারণা ছিল। আজ সে তালিকা করতে বসে যে জীবনে সে ঠিক কী কী পাপ করেছে যার জন্য তাকে খুব কষ্টের মউত মরতে হতে পারে। মিথ্যা বলা, চুরি-ডাকাতি করা, জেনা করা--এসব পাপ। অন্যের মাথায় বাড়ি মারা অর্থাৎ অন্যের সর্বনাশ করা একটা বড় পাপ। না, এসব পাপ মতলব করেনি।

সে কথা খুব কম বলত, কোন মকদ্দমায় কোনদিন তাকে সাক্ষ্য দিতে হয়নি; তাই মিথ্যা বলার প্রয়োজন তার পড়েনি। চুরি ডাকাতি করারতো প্রশ্নই ওঠেনা। চেয়ারম্যান তাকে যে গমের বখরা দিত কি ত্রাণের টিন দিত, সেসব মতলব নিজে চুরি করেনি। চেয়ারম্যান ছোট বস্তা দেখিয়ে বলত, বাড়ি নিয়ে যাও; সে নিয়ে আসত। এর বেশি সে কোনদিন তলিয়ে দেখেনি।

আর জেনাতো মতলব করেনি। আলোজানকে সে বিয়ে করেছিল উঠতি যৌবনে, পরে ফুলমতিকে দেখে প্রেমে পড়লে তাকেও বিয়ে করে ফেলে। অন্যলোকের বৌ-ঝির দিকে কুদৃষ্টি দেবার খাসলত মতলবের নয়। হ্যা, আলোজানকে বিয়ের পূর্বে এক কিশোরীকে মতলব মনেমনে ভালবেসেছিল কিন্ত সেটাতো কেবলই ভালবাসা। কোন কুমতলবতো তার মনে বাসা বাঁধেনি।

তাহলে আর বাকি থাকে অন্যের মাথায় বাড়ি মারা। নাহ্, মতলব কোনদিন কারো ক্ষতি কামনা করেনি, অনিষ্ট করাতো দূরের কথা। তাহলে কোন পাপ সে করেছে যার জন্য তাকে ভয়্ঙ্কর কষ্টে মৃত্যুর দিন গুনতে হবে? একঝলক বিদ্যুৎ বুঝি হঠাৎই তার মগজের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে তীক্ষ্ণ অনুরণন তুলে বয়ে যায়। সেই ঝলকে তার অন্তরচক্ষুর চিরমুদ্রিত পাতা বুঝি খুলে যায়। হ্যা, সে মতলব সত্যিকার একজন মতলববাজ।

কে বলে তার মগজে কোন মতলব খেলেনা? দুটো বৌকে পুঁজি করে যে সে তার মেম্বার তকমাটা গায়ে চড়িয়ে অন্যের চোখে সৎ সৎ ভাবটা বজায় রেখে ডাঁট হয়ে বেড়িয়েছে, সেটা মতলববাজি নয়? সে জানতনা কেন গাঁয়ের জোয়ান মরদের দল তাকে মেম্বার করতে উঠেপড়ে লেগেছে? শুধু কি তার সৎস্বভাব আর কাজী সুজাকে হঠানোর নিয়ত? আরো কোন মতলব কি তাদের মগজে খেলতনা? মেম্বারির সুবাদে পাটনাই গমের রুটি খেয়ে তার বৌদের চেকনাই ছিল বহাল। মেম্বারিই যদি না থাকত মতলবের তবে আজকের মতই তার বৌরা আখের গোছাতে কবেই মতলবকে ছেড়ে পাততাড়ি গোটাত। মতলবের সেইসব তাগড়া স্বজনেরা(!) চায়নি যে অত সুন্দর বৌ দুটো গাঁ-ছাড়া হোক। মতলবকে মেম্বার বানিয়ে তার ঘরকে তারা কসবিখানা বানাতে পেরেছিল। এসবকি মতলব একেবারেই বুঝতনা? তবুও কি সে নিরব ছিলনা? তাহলে সবচে বড় মতলববাজ আসলে কে? নিজেকে আবিষ্কার করে এতক্ষণে মতলবের একটুখানি হাসি পায়।

সেই সাথে তার মগজে একখানা দার্শনিক চিন্তারও উদয় হয়। পৃথিবীতে কে না মতলববাজ? সবাই কি সারাক্ষণ নিজ নিজ স্বার্থ হাসিলের ফিকিরই খুজছেনা? তাহলে মতলব কেন একা কষ্ট পাবে? এই মতলবি পাপের জন্য যদি তাকে না খেয়ে কুকুরের মরণ মরতে হয় তাহলে বাদশাহী মরণ যারা মরে তাদের আমলনামায় কত পূণ্য জমা থাকে? পুন্যের হিসাবটা মতলবের চিরকাল নুয়ে থাকা নিরেট মাথায় কুলায়না। মতলব মেম্বারের নামটা মতলব হলেও আসলে তার মাথায় কোন মতলব খেলতে পেত কিনা তা নিয়ে বিস্তর সন্দেহের সুযোগ রয়েছে। মতলব খেলবার পক্ষে পর্যাপ্ত ফাঁকা স্থান তার মগজে ছিল কিনা এটাও এক বড় প্রশ্ন। কারণ মেম্বারের মাথাটা এতটাই নিরেট ছিল যে তার ভারে তিনি কোনদিন মস্তক সোজা করে দাঁড়াতে কি হাঁটতে পারেননি, চেয়ারম্যানের কাছ থেকে গমের বখরা ঠিকঠাক বুঝে নেয়াতো দূরের কথা।

গ্রামের আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মতই মতলবের জীবনটা দুঃখে-কষ্টে একরকম কাটতে পারত। কিন্ত দূর্ভাগ্যবশতঃ গ্রামের লোকেরা তাকে কেন যেন সৎমানুষ বলে ঠাওর করত। আর তার পরিণাম এইযে মতলবকে চার-চারবার ইলেকশনে দাঁড়িয়ে তিনবারই জিততে হল। ইলেকশনে দাঁড়াতে মতলবের যে মন্দ লাগত তা নয়। বরং শেষদিকে এসে কেমন নেশা ধরে গিয়েছিল।

কোন চেষ্টা নেই, উদ্যোগ নেই, ঘুরাঘুরির পরিশ্রম একটু থাকলেও তা ধর্তব্যের মধ্যে নয় আর টাকা-পয়সাতো কোনদিনই ছিলনা; এতসব নেইর মাঝখান থেকেও কেমন করে জানি বাঘা বাঘা সব প্রতিযোগীকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে পিছনে ফেলে মতলব তার মেম্বারত্ব ঠিকই অক্ষুণ্ন রাখতে পারত। তবে এই রূপকথার গল্পের মত ঘটনা তখনই ঘটেছিল যখন দেশ-জাতির কর্ণধার ছিলেন একজন দেশবন্ধু। আপসহীন নেত্রীর আমলে এসে মতলবকে তিন ভোটের ব্যাবধানে হেরে যেতে হল। এরপরের নির্বাচনে মতলবকে খাড়া করবার জন্য কারো কোনো উদ্যোগ দেখা গেলনা। ততদিনে মতলব অনেকটা বুড়োও হয়ে পড়েছে।

বুড়ো হয়ে এবং মেম্বার পদ হারিয়ে মতলব বাড়ির এককোনে নির্জীব পড়ে থাকল। তার দু-দুটি জোয়ান বৌ দেড়গন্ডা ছেলেমেয়ে নিয়ে এবং বড় ছেলে আরও দুটো কচি বৌ এবং পৌনে একগন্ডা আন্ডাবাচ্চা নিয়ে গোটা বাড়িময় রাবন-রাজত্ব করে বেড়াতে লাগল। ঘরের কানাছে বুড়ো বরই গাছটার ছায়ায় কোনকালে খেজুর পাকায় বোনা ছেড়া-ফাড়া পাটিটায় শুয়ে-বসে সে এই অপ্রয়োজনীয়ভাবে বৃহৎ সংসারটার দিকে চেয়ে চেয়ে আঁৎকে ওঠে। সর্বনাশ! কবে কোন দুর্বুদ্ধিবশে সে এদেরকে জুটিয়েছে! পরমাসুন্দরী একখানা বৌ প্রথম যৌবনে তার ভাগ্যে জুটেছিল। সেটাই তার সারাজীবনের জন্য যথেষ্ট হতে পারত।

অথচ মধ্যবয়সে এসে সে প্রেমে পড়ল ফুলমতির। তারপর দুই বৌ মিলে যখন দুটি করে চাঁদপানা মুখ তাকে উপহার দিতে শুরু করল তখন সে একদিন দুটোকেই ধরে পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্রে নিয়ে গেল। কিন্ত ছোটবৌ শয়তানটা কেমন করে যেন ঠিক পালিয়ে এল। সে লাইগেশন করাবেনা কারণ আল্লাহ্ এখনো তারে ছাওয়াল দেয় নাই। ক্ষোভে-দুঃখে মতলব সেদিন নিজেই ভেসেকটমি করিয়ে এসেছিল।

ফুলমতির ছাওয়ালের শখ চিরদিনের মত ঘুচিয়ে দিলেও একদিন ফুলমতি নিজ উদ্যোগেই লাইগেশনটা করিয়ে নেয়। একখানা শাড়ি, নগদ একশ টাকা এসব প্রাপ্তির লোভতো ছিলই, তার চেয়ে বড় ছিল মান ইজ্জ্বতের লৌকিক নিরাপত্তা। বিষয়টা একটু খোলাসা করা যাক। তখনো মতলব মেম্বার হয়নি। এ গাঁয়ে কোন মেম্বার ছিলওনা।

প্রায় বিলের মাঝে গড়ে ওঠায় মূল গ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন এ ছোট্টপাড়াটায় ভদ্রলোক বলে যারা দাবীদার তারা একদিন মতলবকে ধরে বসল। এ গ্রামের সবচে নিরীহ, গোবেচারা, খানিকটা নির্বোধ ও উপহাস্য যে মতলব তাকে নাকি তারা মেম্বার বানাবে। এ যাবৎ এ গ্রাম থেকে একজনই মেম্বার পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আসছে। কিন্ত তার ভোটসংখ্যা দেখলে অনায়াসেই বোঝা যায় যে তার নিজ গ্রামবাসীরাও তাকে ভোট দেয়না। এ নিয়েতো রীতিমত একটা প্রবাদই চালু হয়ে গেছে।

একটা অতি পরিচিত পুরনো প্রবাদকে বিকৃত করে পাড়ার দুষ্টু ছেলের দল সুর করে বলে, গাঁয়ে মানেনা কাজীর ব্যাটা, ভোট দেয়না বৌ মারে ঝাঁটা। কাজীর ব্যাটা মানে এ গাঁয়ের চিরঅপ্রতিদ্বন্দ্বী অথচ ইউনিয়ন পরিষদে চিরপরাজিত মেম্বার পদপ্রার্থী কাজী আহমেদ পারভেজ সুজা। কাজী সুজা পঁচিশ বছর বয়স থেকে নিয়মিত নির্বাচনে দাঁড়িয়ে আসছে। কিন্ত ঐ দাঁড়ান পর্যন্তই। তার নামের আগে বা পরে মেম্বার তকমাটা বোধকরি কোনদিনই যুক্ত হবার নয়।

অথচ এমনটা হবার কথা নয়; কাজী সুজা মানুষ হিসেবে খারাপ নয়; বরং শিক্ষিত,সজ্জন; তবে একটু কৃপন প্রকৃতির--এইযা। সমস্যাটা বুঝতে হলে একটু পিছনে ফিরে তাকান দরকার। একসময় অর্থাৎ ইংরেজ আমলে কাজীরা ছিলেন এ তল্লাটের জমিদার। খুব বড় জমিদারী হয়ত নয়, দুএক হাজার বিঘা সম্পত্তি; তবুতো জমিদারী। ইংরেজরা এদেশ ছেড়ে গেল, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তও রইলনা, জমিদারদের মুখে কাল ছায়া পড়ল কিন্ত মনের অহংকারের কালি তাতে বাড়ল বৈ কমলনা।

জমিদারী প্রথাটা গেলেও নানা কৌশলে নামে-বেনামে নামজারি করিয়ে যে সস্পত্তি কাজী পরিবারের থাকল তাতে করে তারা এতদঞ্চলের অপ্রতিদ্বন্দ্বী ভূস্বামী বলেই চিহ্নিত হয়ে রইল। তাদের এককালের প্রজাদের কেউ কেউ এখন বিদ্যা শিক্ষাসহ নানা উপায়ে ভদ্রপর্যায়ভুক্ত হতে চেষ্টা করছে ঠিকই কিন্ত কাজীরা তাদের মানুষ বলে ভাবতে মনে মনে আজও নারাজ বলে। তাই তারাও এখন কাজীদেরকে মনে মনে অমানুষ ভেবে তাদের প্রতি অপ্রকাশ্য নিরব অবহেলা ধারণ করে একেবারে বিমুখ হয়ে বসে আছে। এমনই পটভূমিতে একদিন মতলবকে মেম্বার বানাবার প্রস্তাবটা দিল এ গাঁয়ের এক উঠতি মাতব্বর যে সম্পর্কে মতলবের দূরসম্পর্কের ফুপাত ভাইও বটে। এতদিন কাজী সুজা, এ গ্রামের একমাত্র প্রার্থী ছিল।

কিন্ত এ গ্রামের লোকেরা বরাবরই ভিন গাঁয়ের লোককে ভোট দিয়ে এসেছে। এখন এই গ্রামে একজন মেম্বার চাই কিন্ত কাজীর ব্যাটাকে নয়। কাজীর বংশকে বাদ দিয়ে গ্রামের ইজ্জ্বত বাড়ানোর জন্য সেই উঠতি মাতব্বরের খুবই উৎসাহ দেখা গেল। চাইলে নির্বাচনটা সে নিজেই করতে পারে কিন্ত তার বয়স কম হলেও এরই মাঝে তার নামের সাথে যুক্ত হয়েছে নানান বদনাম। কাজী বাড়িতে দুএকবার ডাকাতির চেষ্টা, নারীঘটিত ছোটখাট দু-একটা ঝামেলা তার জীবন ইতিহাসে যেভাবে লিখিত হয়ে পড়েছে তাতে করে আগামী কয়েক বছর সাদা জীবনযাপনের চেষ্টা করে সাধারণের মন হতে ঐসব স্মৃতি মলিন হওয়ার পূর্বে ইলেকশনে দাঁড়ালে বড় মুখ করে ভোট চাওয়া সম্ভব নয়।

উঠতি মাতব্বরে উদ্যোগে মতলবের কিছু সমর্থকও জুটে গেল যারা মতলবের হয়ে দৌড়-ঝাঁপ করে তাকে নির্বাচনে দাঁড় করিয়ে দিল। ক্যাম্পেইন করবার লোকেরও অভাব দেখা গেলনা। দেখা গেল ভোটারদের মনেও মতলবের প্রতি দারুণ অনুকম্পা। অকর্মা, অলস মতলবের ঘরে দু-দুটি সুন্দরী বৌ, অথচ চুলোয় তার হাঁড়ি চড়েনা বললেই চলে। এখান-ওখান, এবাড়ি-ওবাড়ি করে যেভাবে মতলবের সংসার চলে তা দেখলে মনে হয় মানুষ বুঝি হাওয়া খেয়ে বাঁচতে শিখেছে।

এমন দৈন্যদশাকে পুঁজি করে নিরীহ, বিনয়ী মতলব অতি অনায়াসে ভোটারদের মন ভিজিয়ে দিতে সক্ষম হল। নির্বাচন শেষে জানা গেল এ নির্বাচন বাবদ মতলবের কিছু না হলেও উদ্যোক্তাদের কিঞ্চিৎ খরচ হয়েছে। সে খরচ পুষিয়ে নিতে মতলবকে শিখন্ডী করে তারা এলাকায় অপ্রতিহত ক্ষমতাধর হয়ে উঠল। কখন জানি মতলবের বৌ দুটো আপনা থেকেই বারোয়ারী বনে গেল। চোরের বৌ যেমন দারোগার বৌ হয়, মেম্বারের বৌরা তেমনি তার পৃষ্ঠপোষকদের বৌয়ে পরিণত হল।

শোনা যায় তার দু-একটি সন্তান দেখতে এদেরই কারো কপি। সে যাই হোক মতলব মেম্বার ভেসেকটমি করে আসার পর লাইগেশন না করে ফুলমতির আর উপায় রইলনা। এরপরও মতলব আরও তিনবার নির্বাচনে দাঁড়িয়েছে, দুইবার জিতেওছে। মেম্বার থাকাকালে তার সংসারে কোনদিনই খাদ্যাভাব ঘটেনি। ভাতের অভাব ঘটলে রুটি এসে বাসনের কোনে ঠাঁই পেতেছে।

আসলে ক্ষুধা নিবৃত্তিই যেখানে বড়কথা সেখানে পলান্ন কি খুদের জাউ সবই সমান আদর পায়। তিনবেলা ঠিকঠাক পেট ভরতে পারলেই মতলব ও তার পরিবারবর্গ খুশি, এর বাইরে তারা কিছু ভাবতে চায়না। তাদের সঞ্চয় বলতে কিছু নেই, অন্যকোন কাজকর্মেরও চেষ্টা নেই—এসব নিয়ে কোন ভাবনাও তাদের নেই। এখন মতলব তার বরইগাছটার তলায় ছেড়াফাঁড়া পাটিতে পা ছড়িয়ে বসে পথপানে ক্ষীণ ঘোলাটে দৃষ্টি রেখে উদাসভাবে কি যেন ভাবছে। বোধকরি সে ভাবছে তার ফেলে আসা জীবনের কথা—বাল্যকালে ঘুড়ি ওড়ানো, ডোবা ছেঁচে মাছ ধরা, ঝুম বৃষ্টিতে হাডুডু খেলা, প্রথম যৌবনের প্রেম, প্রথম নারীসঙ্গ, ভরা যৌবনের উন্মাতাল কাম কিংবা সে হয়ত ভাবছে নির্দিষ্ট কোন দিন বা ক্ষণের কথা।

যেমন- প্রথম ইউপি মেম্বার ঘোষিত হবার ক্ষণটির কথা, চেয়ারম্যানের কাছ থেকে ত্রাণের ঢেউটিন বুঝে পাবার দিনটির কথা(আহা! মতলবের বহু শখের টিনের ঘর! পুরো একখানা দোচালা ঘর তুলবার মত টিন চেয়ারম্যান তাকে দেয়নি, তাই একচালা ছাপড়া পাততে হয়েছিল। তবু টিনের ঘরতো! মতলব বহুত খুশি হয়েছিল। ), অথবা চাঁপাতলার শেখের পো জব্বার শেখের বড় ব্যাটার জিয়াফতে যে খাসীর মাংস খেয়েছিল তার জিভে পানি আনা স্বাদ। কতকিইতো মতলব ভাবতে পারে। ভাবনার অঢেল সময় মতলবের আছে বটে।

সংসারে কারো জন্যই যাকে ভাবতে হয়না সেতো নিজের অতীত দিনের সুখ ভাবনায় বিভোর থাকতেই পারে। সংসার মতলবের কাছে এখন আর কিছু চায়না, আবার মতলবের যে সংসারের কাছে কিছু চাওয়ার থাকতে পারে তা অনুভবের ঠেকাও সংসারের পড়েনি। ((২)) বোধকরি হাওয়ায় ভেসে কথাটা মতলবের কানে ঢোকে। ইদানীং চোখে সে খুব কম দেখলেও কান তার দিব্য পরিষ্কার। কয়েকদিন ধরেই একটা গোপন ষড়যন্ত্র চলছে।

কোথায় যেন কী একটা বদল ঘটে যাবে। বরইগাছটার তলায় বসে আজ হঠাৎ মতলব কেঁদে ওঠে, ওরে তুরা আমারে ফ্যালায়ে কহানে যাবি? বড়বৌ আলোজান উঠান ঝাঁট দেয়া থামিয়ে থমকে দাঁড়ায়, কিডা কইল আমারা কুনুহানে যাচ্ছি? কাঁদতে কাঁদতেই মতলব বলে, আমি ট্যার পাই, আমি সব ট্যার পাই। তুরা আমারে থুয়ে ঢাহা যাবি। ঢাহায় চাকরি ওরবি, ভালমন্দ খাবি, আমারে সাথে নিবিনে, আমি সব ট্যার পাই। --- সব ট্যার পালিতো বালোই।

তা এতদিন কিছু ট্যার পাইতে না? সুংসারডা ক্যাম্মায় চইলতেছে, হাঁড়িতে ক্যাম্মায় ভাত ফুইটতেছে, পিন্দনের রঙিন ছাপা কাপুড় কহানেত্থে আইসতেছে এসব ভাইবতেনা? মতলব মাথাটা আরো ঝুঁকিয়ে কাঁদতে থাকে। আলোজান পুনরায় ঝাঁট দিতে দিতে আপন মনে বলে, জুয়ানমদ্দ সুয়ামী থাকতিউ নটিগিরি কইরে সুংসার চালাতি হইছে; সুয়ামী দেহেও দেহেনাই, বুঝেও বুঝেনাই। তিনতিনবার মেম্বার হইছে, সৎমানুষ ভাইবে উনারে মেম্বার বানাইছে; হুঁ, সৎ মানুষ! উনি মেম্বার হয়ে ফুলবাবু সাইজে, বাসনা ত্যাল মাথায় দিয়ে সদরে গেছেন, আর আমাগের ঘরে দিনি-দুপুরি মানুষ ঢুহে খিল লাগাইছে। বড় গরবে ছিলাম, মেম্বারের বৌ! তা এহনতো সে মেম্বারগিরিও নাই। দুই মাগী মিলে ছিনালি ওইরেও এহন সুংসার চলেনা।

শুওরের বাচ্চারা এহন আমাগেরে বুড়ি কয়, বৌ-মাইয়েগের সাথে শুতি চায়। কিন্ত জুয়ান-কচি বৌ-মাইয়েই যদি ইজ্জ্বত বেচে সুংসার চালাবি তাইলে এহানে ক্যা? এত সস্তায় ক্যা? বড় মাইয়েতো এর মদ্যিই গিরামের সস্তা খানকির খাতায় নাম লিহে ফেইলছে। বাদবাহিডারে নিয়ে আমি ঢাহায় যাব। ঐ খানকি এহানে ফিরি ঘরে গাহাক বসাক। তালি আর ওর কষ্ট ওইরে বাঁশঝাড় কি কুষ্টার ভুঁইতি যাতি হবিনে।

এইবার শরীরের সমস্ত শক্তি এক করেই বুঝি মতলব খেঁকিয়ে ওঠে, হারামজাদি মাগী, ছিনালের মাইয়ে ছিনাল, চুপ কর। তোর মুখ পাড়াইয়ে আমি ছিঁড়ে ফ্যালাব কলাম। --- ক্যান, কষ্ট ঠ্যাহে? মাইয়েতো প্যাট বাদায়ে ছাওয়াল বানাইয়ে সারল, ঠ্যাহাতি পাইরছো? তুমি তহন মেম্বার ছিলে, তাও মাইয়েডা ক্ষিদে প্যাটে একমুঠ ভাজার লোভে আট ছাওয়াল-মাইয়ের বাপের ঘরে দুফোর বেলায় ঢুইকলো। তুমারে মেম্বার বানাইয়ে এই গিরামের কতজনের চারচালা টিনির ঘর ওইলো, গাভীন গরু ওইলো, তুমার কী ওইছে? আলোজান তীক্ষ্ণ, তিক্তস্বরে বলে চলে, ছাওয়ালডা ওইছে ছ্যাচ্ছোড়, বাপের মতন জুড়ায় জুড়ায় বিয়া অরা আর জম্ম দিয়া ছাড়া আর কুনো মুরোদ নাই। বাপের নাম ভাঙ্গায় মেম্বার হবি সে গুড়ি বালি।

তুমার বড় মাইয়ের কির্তি পাঁচ গিরামে জানাজানি ওইছে। তাছাড়া ফহিরির ছাওয়াল মেম্বার ওতি গিলি যে তার বৌগেরে নটি ওতি অয় তাতো বালোই বুঝছি। আর নটিই যদি ওতি অয় তালি এত সস্তায় ক্যা? খালি কয়ডা চাল-ডাইল-ত্যাল-নুন কি পাঁচ-দশ টাহার বদলে ক্যা? মতলবের মুখে আর কোন কথা যোগায়না। প্রবল আতঙ্কের সাথে সে শুধু ভাবতে থাকে তার অনাগত দিনের কথা। এরা ঢাকায় যাবে, উপার্জন করতে যাবে, ভাল ভাল খেতে পরতে যাবে; তার কী হবে? কে তাকে খেতে দেবে? কোর্মা-পোলাও নয়, খাসীর মাংসের ঝোল নয়, সাধারণ একমুঠ ভাত আর শাকভর্তা যা দিয়ে সে আজীবন তার ক্ষুধা নিবৃত্ত করে আসছে তাও এখন তার বরাত থেকে উঠে যাবে? ভিক্ষে করবে মতলব? কিন্ত সে যে ভাল করে হাঁটতেই পারেনা।

তাছাড়া ভিক্ষার সেই একমুঠো খুঁদই বা তাকে ফুটিয়ে দেবে কে? বড় মেয়ে নূরী? কিন্ত সে কি বাড়ি থাকে? বছর দেড়েকের জারজ ছেলেটাকে কাঁখে করে সেইযে সকালে সে বেরোয় আর ফেরে সন্ধ্যার পর। কী সে করে আর করেনা তা কেউ জানেনা। তবে মা-ছেলের স্বাস্থ্য দেখে বেশ বোঝা যায় যে তারা সারাদিন নিতান্ত অভুক্ত থাকেনা। তবু রাতের বেলা খাবার ওক্তে নিজের বাসনখান নূরী ঠিকই তার মার সামনে পেতে রাখে। সবার পাতে একমুঠো পড়ে কিছু বাঁচলে তবেই আলোজান নূরীর বাসনে কিছু দেয়।

মাঝে মাঝে এ নিয়ে গালমন্দও করে আলোজান, সারাদিন মারা খাইয়ে আইসে রাত্তির বেলা মেনি বিলাইয়ের নাহাল ভাগ নিতি বসিস হারামজাদি, তোর শরম নাই? নূরী সেকথা গায়ে মাখেনা। ভাগটা পেলে ভালই, না পেলে মায়ের উদ্দেশ্যে ছাপার অযোগ্য অশ্লীল কয়েকটি গালি ঝেড়ে ছেলে নিয়ে মাচানে গিয়ে শুয়ে পড়ে। এখন মতলব বুঝতে পারেযে তার জীবনে আরো ভয়ঙ্কর দিন আসছে। কিন্ত কী সে করতে পারে? বুড়ো বয়সে মানুষ সাধারণতঃ তার বিগত দিনের পাপের জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে ক্ষমা চায়, একটা সুন্দর মৃত্যু কামনা করে আর পরকালে বেহেশত্ নসীব চেয়ে বিধাতার কাছে ফরিয়াদ করে। মতলব ওসব পাপ-পুণ্য, পরকাল নিয়ে কোনদিন ভাবেনি।

পাপ করবার ইচ্ছে বা সাহস কোনটাই মতলবের ছিলনা। পুণ্য করবার সামর্থ্যই বা তার কোথায়। আর পরকাল বিষয়ে বিশ্বাসীরাই বেশি দুর্ভাবনা করেনা আরতো মতলব। তবে হ্যা, মৃত্যুকে সে ডরায়, বহুত ডরায়। সে বেঁচে থাকতে চায়।

কিন্ত বাঁচতে চাইলেই যে বাঁচা হয়না তাও মতলব জানে। পাপ-পুণ্য-পরকাল বিষয়ে যে মতলব কোনদিন চিন্তা করেনি আজ সে তা নিয়ে ভাবতে বসে। এসব বিষয়ে তার ধারণা অস্পষ্ট হলেও সামাজিক শিক্ষা থেকে প্রাপ্ত কিছু সাধারণ বোধ থেকে পাপ-পুণ্য বিষয়ে তার কিছু ধারণা ছিল। আজ সে তালিকা করতে বসে যে জীবনে সে ঠিক কী কী পাপ করেছে যার জন্য তাকে খুব কষ্টের মউত মরতে হতে পারে। মিথ্যা বলা, চুরি-ডাকাতি করা, জেনা করা--এসব পাপ।

অন্যের মাথায় বাড়ি মারা অর্থাৎ অন্যের সর্বনাশ করা একটা বড় পাপ। না, এসব পাপ মতলব করেনি। সে কথা খুব কম বলত, কোন মকদ্দমায় কোনদিন তাকে সাক্ষ্য দিতে হয়নি; তাই মিথ্যা বলার প্রয়োজন তার পড়েনি। চুরি ডাকাতি করারতো প্রশ্নই ওঠেনা। চেয়ারম্যান তাকে যে গমের বখরা দিত কি ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।