আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ছোটগল্পঃ ক্ষুধা

I m not WIERD, I m just a LIMITED ADDITION ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইনের পাশের ছোট একটি গ্রাম চান্দের চর । একেবারে অজপাড়া গাঁ । বিদ্যুত্‍ এর লাইন এখনো এসে পৌছয় নি । বেশীরভাগ বাসিন্দা ক্ষেত মজুর । গ্রামে একটি মাত্র প্রাইমারী স্কুল ।

শিক্ষার আলো তাই এখানে বিকশিত হতে পারেনি । অধিকাংশই অশিক্ষিত, কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ । ছোট একটা রেল ষ্টেশন আছে বটে । সকাল বিকাল লোকাল ট্রেন থামে দুইটা । যাত্রী সংখ্যা খুবই নগণ্য ।

একজন ষ্টেশন মাষ্টার । তিনিই সব কিছু সামাল দেন । বাবুল আর কাশেম নামের কুলি আছে দুইজন । ষ্টেশনে কুলি গিরি করে আর ষ্টেশন মাষ্টারের ফুট ফরমায়েশ খাটে । ট্রেন আসলেই কিছুটা ব্যস্ততা ।

হাতেগোনা যে দুয়েকজন যাত্রী আসে তারা চলে গেলে সব কিছু থমকে যায় । কোন এক সকালে ষ্টেশন মাষ্টার রফিকুল ইসলাম দেখলেন প্লাটফর্মের কোনায় পড়ে রয়েছে একটা লোক । উটকো ঝামেলা ভেবে কাছে গিয়ে ডাক দেন । হাড় জিরজিরে শরীরটা নিয়ে কোনমতে উঠে দাড়ায় সে । দুর্বল শরীর আর কোটরাগত চোখের কারনে বয়স অনুমান করা যায় না ।

পড়নে একটা পুরোনো আধ ময়লা ছেঁড়া লুঙ্গি মাত্র । স্বভাবজাত কৌতুহল মিটানোর জন্য বললেন, - অই মিয়া, বাড়ি কই ? - অনেক দূরে । - এইখানে আইলা কেমনে ? - কাইলকা বিহালের টেরেনে আইছি । - বাড়িত যাইবা ? ভাড়া নাই ? - না যামু না । - কেন যাইবা না ? বাড়িত কেউ নাই ? - খাইতে পাই না, বাড়িত যাইয়া করমু কি ।

- নাম কি তোমার ? - রমিজ উদ্দীন । - কাম করবা আমার এইহানে ? - পেট ভইরা খাইতে দিবেন ? - হ, দিমু । - তাইলে করমু কাম । তারপর থেকে রমিজকে দেখা যেত ষ্টেশনে রফিক সাহেবের ছোট খাট কাজগুলো করে দিতে । মাঝে মাঝে কুলিগিরিও করে সে ।

রফিক সাহেব দয়া পরবশ হয়ে হয়ত মাঝে মাঝে কিছু খেতে দেয় কিন্তু রমিজের পেট ভরে খাওয়া আর হয়ে ওঠে না । চান্দের চরের চেয়ারম্যান মিন্টু খন্দকারের একমাত্র মেয়ের বিয়ে দুই দিন পরে । গ্রামে যে দুয়েকটি অবস্থা সম্পন্ন পরিবার আছে মিন্টু খন্দকার তাদের মধ্যে একজন । অনেক সম্মানী লোক । তার এক কথায় গ্রামের লোক ওঠে বসে ।

একমাত্র মেয়ের বিয়ে তাই অনেক বড় আয়োজন । বাড়িতে ইতোমধ্যেই আত্মীয় স্বজনে ভর্তি । আশেপাশের তিন গ্রামের মানুষ দাওয়াত পেয়েছে । রবিবার সকালের ট্রেনে শহর থেকে বিয়ের সামগ্রী নিয়ে আসলেন তিনি । কিন্তু কুলি দুইটাকে খুঁজে পেলেন না ।

এদিকে এত মাল পত্তর তিনি নিজে বয়ে নিয়ে যেতে পারবেন না । বসে বসে যখন কুলির জন্য অপেক্ষা করছিলেন এই সময় রমিজ এসে তার সামনে দাড়ায় । - চেয়ারম্যান ছাব কি বাবুলের লাগি বইয়া রইছেন ? - হ, এত মাল পত্তর আমি তো একলা নিতে পারুম না । - বাবুল তো গ্যাছে ইছাপুরার গঞ্জে । আইতে দেরী অইব ।

আফনে কইলে আমি লইয়া যাই । - তুই পারবি ? এত্ত ভারী বোঝা । পথ তো কম না । - হ, পারুম । তয় আমার টেকা লাগব না খালি একবেলা পেট ভইরা খাইতে দিয়েন ।

এহেন প্রস্তাবে মিন্টু সাহেব কিছুটা অবাক হন । শেষে আর কোন উপায় না পেয়ে বলেন,"ঠিকাছে, ল যাই । বাড়িত সবাই আমার লাইগা বইয়া রইছে । " ষ্টেশন থেকে চেয়ারম্যানের বাড়ি প্রায় দেড় মাইল । হাটতে হাটতে তিনি ভাবেন এত ভারী বোঝা নিয়ে রমিজ না আবার পরে যায় ।

আড়চোখে কয়েকবার রমিজের শীর্ণ শরীরটার দিকেও তাকান তিনি । এক বেলা পেট পুরে খাওয়ার আশায় রমিজও দুলতে দুলতে চলতে থাকে । সূর্য যখন মাথার উপর তখন তারা দুইজন পথক্লান্ত শরীর নিয়ে বাড়িতে ঢোকে । বাড়ির কাজের লোক কে মাল সামান ভিতরে নিয়ে যেতে বলে বাড়িতে ঢোকেন তিনি । বউকে বলেন রমিজকে খাইয়ে বিদায় করতে ।

বাড়িতে এত মেহমান, তাদের খাওয়াইতো হয়নি এই অজুহাতে বউ তাকে বলেন গঞ্জের কোন হোটেল থেকে খাইয়ে দিতে । অগ্যতা তাতেই রাজি হয়ে কাজের লোকটার সাথে রমিজকে গঞ্জে পাঠিয়ে দেন । বলে দেন হোটেল থেকে রমিজকে যেন পেট ভরে খাওয়ানো হয় । টাকা তিনি পরে দিয়ে দিবেন । দুপুরে খাওয়ার পর ভাতঘুম দেওয়াটা মিন্টু চেয়ারম্যানের বহু দিনের অভ্যাস ।

কিন্তু আজকে সেটা হল না । দুপুরে মাত্র পিঠটা বিছানায় লেগেছে অমন সময় গঞ্জ থেকে খবর এল রমিজ নাকি কি একটা গন্ডগোল পাকিয়ে বসে আছে । লোকজন তাই ভয়ে তার কাছে খবর নিয়ে এসেছে । পাঞ্জাবীটা গায়ে চড়িয়ে তাড়াতাড়ি রওনা হয়ে যান তিনি । শুভংকর ময়রার খাবার ঘরের সামনে ততক্ষণে ভীড় লেগে গেছে ।

তাকে দেখে সবাই পথ করে দেয় । ভিতরে ঢুকলে ম্যানেজার এগিয়ে আসে - আসেন চেয়ারম্যান সাব, দেইখা যান । আপনে পাডাইছেন বইলা তারে বসাইছি । এহন পর্যন্ত ছয় ডেকচি ভাত খাইছে । আরও আনতে কইতাছে ।

ম্যানেজারের কথায় হতবিহ্বল চেয়ারম্যান এগিয়ে যায় রমিজের দিকে । রমিজ তখনো গোগ্রাসে ভাত গেলায় ব্যস্ত । কি মনে করে মিন্টু চেয়ারম্যান রমিজের লুঙ্গিটা টান দিয়ে দুই ইঞ্চি নিচে নামিয়ে ফেলেন । নাহ, নেই । সন্তানের সাথে মায়ের যোগসূত্রের চিহ্ন নাভিটা নেই ।

বিস্ময়ে হতবাক তিনি রমিজের হাতটা ধরে টান দিয়ে উঠিয়ে ফেলেন । - কি করতাছেন চেয়ারম্যান সাব । আমার পেট তো অহনও ভরে নাই । - ওঠ, তোর আর খাওন লাগব না । বিকালের ট্রেনটা এর মধ্যে এসে পরেছে ।

ধাক্কা দিয়ে রমিজকে তাতে উঠিয়ে দেন তিনি । তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে দূরে সরে যেতে চান । কোন এক অজানা আশঙ্কায় পিছন ফিরে তাকাতেও ভয় পান । কিন্তু ঠিকই তিনি শুনতে পেলেন রমিজের অষ্পষ্ট কন্ঠস্বর, " কেউ আমারে পেট ভইরা খাইতে দিল না । " ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।