আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ছোটগল্পঃ সুখ

আমার লেখা জুড়ে আমার ভালবাসা ছাড়া আর কিছু নেই।

বেশ খানিক সময় ধরে, প্রীতমের বড় বাদাম খেতে ইচ্ছা করছে। ছোট ছোট বাদাম না। ওসবে ১০ টার মধ্যে ৫ টা পচা থাকে। ছোলার পর বাদাম দেখতে হয় কালো।

আর কালোগুলোর স্বাদও খুব জঘন্য। তাছাড়া দাম কম। কম দামী বাদামে চলবে না। বাদামওয়ালার কাছে, ২ রকমের বাদাম আছে। এক রকম ছোট, আর একরকম বড়।

দেখেই বোঝা যায়, ভিতরে তিনটা করে বাদাম। পচা হবার সম্ভাবনাও কম। তাছাড়া দাম বেশী। প্রীতম দামী বাদামই কিনল। কিনে খাচ্ছে, মন ভরে খাচ্ছে।

টাকা এরপর কই খরচ করা যায়, সেই চিন্তায় আছে। দামী বড় সাইজের বাদাম কিনল, টাকা খরচের জন্য। সাড়ে তিন হাজার টাকা, বললেই খরচ হয়ে যায় না। তার উপর খেয়ে খরচ করা। খুবই ঝামেলার কাজ।

একবার ভাবল, রেস্টুরেন্টে যাবে। তবেই হুড়হুড় করে খরচ টাকা। মুরগীর একটা পা দিয়ে, দাম নিবে ১৫০ টাকা। কিন্তু মন থেকে সায় দিল না। ওসব জায়গায়, নিচু মনের মানুষ যায়।

যাদের মন ভাল, তারা রাস্তার পাশে খায়। প্রীতম তাই ভাবে। হাতের টাকা খরচের পথ বের করা দরকার। এক পিচ্চি ওজন মাপছে। একটা ওজন মাপার মেশিন নিয়ে।

বয়স হবে সাত কি আট। একবার ওজনও মেপে নিল প্রীতম। ৫০ কেজি, কাটায় কাটায়। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কিছুই বের হল না। ওজন মাপা পিচ্চির দিকে ঝুঁকে বলল, দিনে কয় টাকা পাস রে?
- এই ধরেন ১০০ টাকা।


- হুম ভালই উপার্জন করিস। বল তো এই মুহূর্তে কি খেতে পারলে, তোর সবচেয়ে ভাল লাগত? তোর মন চাচ্ছে, বলছে, ইশ যদি টাকা থাকত, খেয়ে ফেলতাম। আমাকে বল, আমি খাওয়াব।
- আপনি খাওয়াইবেন ক্যান?
- আমার আজকে অনেক টাকা, খেয়ে ধেয়ে খরচ করতে হবে।


পিচ্চিটা কিছুক্ষণ মাথা চুলকালো।

কিছুক্ষণ চুলকে, অনেক ভেবে চিন্তে বলল, তাইলে একটা কুন আইসক্রিম খাওয়ান।
- এতেই হবে?
- হ।


প্রীতম আবার ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। গরীব মানুষগুলোর চাওয়া গুলোও কত ছোট, ঠিক পাওয়ার মত। এতো ভেবে চিন্তে একটা কোণ আইসক্রিম চাইল।

এর চেয়ে বেশী এরা চাইতে পারে না। মানুষ যত উপরে উঠে, চাওয়া গুলোও বাড়তে থাকে। হুড়হুড় করে বাড়তে থাকে। পিচ্চিটাকে আইসক্রিম কিনে খাইয়ে দিল প্রীতম। এতেই খুশি ও, মহাখুশি।

হয়ত অনেক দিনের সখ। ওজন মেপে টাকা হাতে নিয়ে, যাবার সময়, দোকানের সামনের ফ্রিজে আইসক্রিম দেখে। খেতে ইচ্ছে করে, বড় ইচ্ছে করে। তবে সংসারের কথা ভেবে কেনা হয় না। খাওয়া হয় না।

আজ হল । প্রীতমের জন্য হল।


প্রীতম এখনও ঘুরে ঘুরে খাবার খুঁজছে। প্রীতমের উপযোগী খাবার। অনেক দিন ধরেই, ঠিক মত খাওয়া হয় না।

হিসেব করে চলতে হয়, সপ্তাহ শেষে খরচের টাকা থেকে কিছু টাকা জমিয়ে রাখতে হয়। সীমার জন্মদিন যে। সামনেই সীমার জন্মদিন ছিল। কিছু একটা দিবে প্রীতম। তাই এভাবে চলা।

ভাল একটা কিছু দিতে হলে, ভাল অঙ্কের টাকা দরকার। সীমার খুব পছন্দ টেডি বিয়ার। বড় সাইজের টেডি বিয়ার। সেদিন গিয়ে দোকানে দাম জিজ্ঞেস করে আসলো প্রীতম। বড়টা চায়, চার হাজার টাকা।

কমিয়ে টমিয়ে, দামাদামি করে সাড়ে তিনে কেনা যাবে। এতো বড় একটা টেডি বিয়ার উপহার দিবে সীমাকে। সীমা ঠিক চমকে যাবে, অনেক খুশি হবে। খুশিতে প্রীতমকে জড়িয়েও ধরতে পারে। আর প্রীতম লাজুক ভাবে বলবে, রাস্তা ঘাটে এসব কী?
ভাবতেই ভাল লাগছে প্রীতমের।

অনেক দিন ভাল করে কথা বলে না সীমা। প্রীতমের সাথে ঠিক ভাবে কথা বলে না। কেমন কেমন যেন করে। এড়িয়ে এড়িয়ে চলে। যদিও এড়িয়ে চলাটাই স্বাভাবিক।

ভালবাসার সম্পর্ক আর নেই দুজনের। অনেক বার ব্রেক নিয়ে, শেষ বারে ব্রেক আপ হয়ে গেল। তবুও কথা হয় দুজনের। মাঝে মধ্যেই কথা হয়। প্রীতম অনেক বার কল করার পর, একবার ধরে সীমা।

আবার সীমার খুব একা লাগলেও, প্রীতমকে কল করে। দুঃখ গুলো বলে। না বন্ধু হিসেবে, না ভালবাসার মানুষ হিসেবে। বন্ধু থেকে ভালবাসার মানুষ হয়। ভালবাসার মানুষ থেকে, বন্ধু হওয়া যায় না।

কেন যেন যায় না। খুব অসম্ভব একটা কাজ।
ব্রেক আপ হলেও ভালবাসা রয়ে গেছে, মনের কোণে বা অন্য কোথাও। সেই ভালবাসা থেকেই নিজে একটু হিসেব করে চলে, টাকা জমিয়ে রাখছে প্রীতম। সাড়ে তিন হাজারের মত টাকা লাগবে।

সীমাকে জন্মদিনে উপহার দিতে। টাকা ঠিক যোগাড় হয়ে যায়। জন্মদিনের মাস খানেক আগে থেকেই সীমাকে বলছে প্রীতম, আমার সাথে কিন্তু তোমার জন্মদিনে দেখা করবে।
সীমা প্রতিবার না করে। বলে, কথা বলি তাই অনেক।

দেখা করতে পারব না। কোন সম্পর্কের জোরে তোমার সাথে দেখা করব? তোমার সাথে আমার কিছু নেই।


তবুও বলে যায় প্রীতম। কষ্টে কষ্টে টাকা জমিয়ে যায়। ভেবে নেয়, এতদিন ধরে বলছে, ঠিক দেখা করবে।

এতদিনের ভালবাসার সম্পর্ক ছিল, সেই হিসেবেও একটু টান আছে। সেই হিসেবেই প্রীতমের কথাটা রাখবে। যতই না করুক, ঠিক জন্মদিনের আগের দিন সীমা বলবে, কাল দেখা করব তোমার সাথে। একটা ভাল দেখে পাঞ্জাবি পরে এসো। আমি তোমার দেয়া সবুজ শাড়িটা পরে আসব।




তবে তেমন কিছুই হয় না। দেখা করে না সীমা। জন্মদিনের আগের দিন থেকে মোবাইল বন্ধ করে রাখে সীমা। বন্ধ করার আগে মেসেজ দেয় একটা, আমি বাসায় যাচ্ছি। মোবাইল বন্ধ থাকবে, এই তিন দিন।

কল দিও না শুধু শুধু।


সব কেমন যেন ঘোলাটে হয়ে যায়। এলোমেলো হয়ে যায় স্বপ্ন গুলো। জমিয়ে রাখা টাকা বের করে বার বার দেখে প্রীতম। বড় অসহ্য লাগছে টাকা গুলো।

রাত ১২ টা থেকে সকাল ৫ টা। টানা ৫ ঘণ্টা কল করে যায় প্রীতম। নাম্বার বন্ধ জেনেও কল করে যায়। জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাবে সবার আগে, সেই আশায় কল করে যায়। গত তিন বছর যেমন করেছে, তেমন করে জন্মদিনের শুভেচ্ছা সবার আগে করতে চায়।

হয় না। একদমই সম্ভব হয় না। নাম্বার বন্ধই থাকে। এড়িয়ে গেল, প্রীতমকে। দেখা করার ভয়ে, নাম্বারটাই বন্ধ করে রাখল।

খুব কষ্ট হয় প্রীতমের। বুকের বাম পাশে কেমন যেন ব্যথা করে। কাঁদতে ইচ্ছা করে। একটা বদলে যাওয়া মানুষের জন্য, চোখের পানি ফেলতে ইচ্ছা করে। চোখ লাল করে, সেই মানুষটাকে নিয়ে ভাবতে ইচ্ছা করে।

কষ্টে কষ্টে ঘুমহীন রাতটা কাটায় প্রীতম। সকালে উঠে গায়ে পরে নেয়, ভাল পাঞ্জাবিটা। সবুজ পাঞ্জাবিটা। কষ্টের ভিতরও , নিজের ভিতরে ভিতরে কিছু একটা অনুভব করে। সীমা প্রীতমকে ছাড়া থাকতে পারলে, প্রীতমও বেশ পারবে।

টাকা দিয়ে টেডি বিয়ার কেন কিনবে? এর চেয়ে নিজে খেয়ে ধেয়ে মোটা হবে। প্রীতম শুনেছে, কোথায় যেন শুনেছে, কষ্টের ভিতর বেশী বেশী খেলে, কষ্ট গুলো উড়ে যায়, হারিয়ে যায়, এক নিমিষে চলে যায়, খাবারের প্রতি কামড়ে। কষ্ট গুলো ভুলে থাকতে, খাবার খেয়ে বেড়াচ্ছে সকাল থেকে প্রীতম। সাড়ে তিন হাজার টাকা খরচ করে বেড়াচ্ছে। ইচ্ছা করলেই অন্য কিছু করতে পারে।

অন্য কাজে লাগাতে পারে টাকা। কিন্তু প্রীতম অন্য কাজে লাগাবে না। খেয়েই খরচ করবে। খেয়ে খেয়ে মোটা হবে। শরীরের জন্য, স্বাস্থ্যের জন্য অনেক অপমান করেছে সীমা।

উপহাস করেছে। প্রীতমকে ক্যাঙ্গারু বলেছে, চেঙ্গিস খান বলেছে। দুটাই বলেছে, দেখতে শুকনা, অনেক বেশী শুকনা, তাই। কিন্তু ক্যাঙ্গারু দেখতে কোন দিক দিয়ে শুকনা, প্রীতম বুঝে না। কি সুন্দর হৃষ্ট পুষ্ট প্রাণী।

আর শুকনা তাই কিনা ক্যাঙ্গারু ডাকে। আবার চেঙ্গিস খানকেও কোনদিন দেখেনি সীমা। সে শুকনা না মোটা তাও জানে না। তবুও চেঙ্গিস খান বলে, অপমান করার জন্য। হোক অযৌক্তিক অপমান, তবুও অপমান তো।

অনেক অপমান করেছে সীমা। কিন্তু সীমাকে কোনদিন কিছু বলেনি। বলেনি তুমি তো মোটা। সীমা সবসময় বলেছে, খেয়ে ধেয়ে মোটা হও। আমার পাশে বেমানান লাগে তোমাকে।


প্রীতম বলেনি কোনদিন, ডায়েট কন্ট্রোল করে চিকন হও। তাহলেই আমাদের মানাবে।


এখন আর মানামানির কিছু নেই। সীমা অনেক দূরে। সম্পর্কের বাইরে।

সম্পর্কের ভিতরে, সম্পর্কের বাঁধনে আর হয়ত বাঁধবে না কোনদিন। অনেক বড় টেডি বিয়ার নিয়ে, সীমার সামনে যাওয়া হবে না কোনদিন। " শুভ জন্মদিন। ভালবাসা বেঁচে থাক, যতদিন বেঁচে থাক তুমি", বলে জন্মদিনের শুভেচ্ছাও দেয়া হবে না। কষ্ট পেয়ে চোখ লাল করে ভাবতে পারবে।

চোখ লাল দেখিয়ে বলতে পারবে না, তোমার জন্য রাত জেগেছি। কাল রাতে, ছেলে হয়েও অনেক কেঁদেছি।
এসব সস্তা আবেগ। বড় সস্তা আবেগ। মনকে বুঝায় প্রীতম।

এসবে কষ্ট বাড়ে, বুকে ব্যথা বাড়ে। এর চেয়ে এইতো বেশ। একা একা জমানো টাকায়, যা ইচ্ছা খেয়ে যাচ্ছে। খাবারের সাথে, কষ্টগুলোকে চেপে যাচ্ছে। মোটা হওয়ার জন্য খাচ্ছে না।

যেমন আছে, তেমন বেশ। কারও কিছু কথায়, কিছু যায় আসে না। কষ্ট গুলোকে উড়িয়ে দেবার জন্য, খেয়ে যাচ্ছে। উপহার কেনার টাকা অন্য কাজে খরচ করছে। মনে মনে অন্য একটা সুখ পাচ্ছে।

এই সুখ কাউকে দেখানো যায় না। কেউ বুঝে না। শুধু নিজে অনুভব করে। বুক ফুলিয়ে সুখের শ্বাস নিতে পারে, নিঃশ্বাস করে কষ্ট গুলোকে তাড়িয়ে দিতে পারে। সুখ খোঁজার জায়গাটা সংকীর্ণ না।

কষ্টের জায়গা নির্দিষ্ট, সুখের জায়গা বিস্তৃত। একটু চাইলেই সুখ গুলো ছোঁয়া যায়। যার সাথে খুশি মিশিয়ে, সুখগুলো শরীরে মাখা যায়। একটু দরকার শুধু মন থেকে চাওয়া।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।