আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্বাস্থ্যখাতে প্রয়োজন আস্থার অভাব দুরীকরণ

আমরা কেন যেন এক পেশার মানুষ অন্য পেশার কাউকে শ্রদ্ধা করতে পারি না। যারা আইনজীবী তারা মনে করেন পুলিশরা খারাপ, পুলিশরা মনে করে সাংবাদিকরা জঘন্য, সাংবাদিক মনে করেন ডাক্তাররা লোভী। এতে করে আমরা অন্যদের শ্রদ্ধার চোখে দেখতে পারি না। ফলাফল কিন্তু ভালো নয়। পুলিশ জনগনের কি নিরপাত্তা দিবে উল্টো তারাই জনগনের হাতে মার খেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়।

ডাক্তাররাও এর ব্যতিক্রম নয়। মিডিয়ায় যখন চিকি?সকদের নিয়ে একের পর এক খারাপ সংবাদ পরিবেশিত হয় তখন তা জনগনের মধ্যে বিরুপ ধারণা জন্ম দেয়। ফলে জনগন ডাক্তারের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে। এটি কিন্তু মারাত্মক। ইবনে সিনা হাসপাতাল এর প্রমান।

একটি নবজাতক সাতদিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে মারা গেল। এ নিয়ে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে সংবাদ প্রচারের দরুন ওই চিকি?সককে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেয়া হল। এটা শুধু আস্থার অভাবের কারণে ঘটেছে। বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ চিকি?সকরা বলেছেন ওই নবজাতক যে রোগে মারা গেছেন তা আমেরিকায় হলেও মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটতে পারে। আমেরিকার মত এত উন্নত দেশে যদি মারা যেতে পারে তাহলে আমাদের গবীর দেশের একটি বেসরকারি হাসপাতাল তো নস্যি।

এ ঘটনায় বেশ কয়েকটি অসংগতি আছে। ওই রিপোর্টে রির্পোটার এ রোগ নিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকি?সকের মতামত নেন নি যে এ ধরণের ঘটনা ঘটতে পারে কিনা। আর একটি মারাত্মক ভুল হল চিকি?সকের রিমান্ড। রিমান্ডে নিয়ে গোপন তথ্য বেশ করার চেষ্টা করে পুলিশ। পুলিশ ডাক্তারকে রিমান্ডে নিয়ে কি এমন গোপন কথা বের করবে।

পুলিশ মেডিকেল সাইন্সের কতটুকুইবা বোঝে। কাছাকাছি সময়ে ল্যাব এইডে একজন বিখ্যাত ব্যক্তির মারা যাওয়ার ঘটনায় ৫০ লাখ টাকায় রফা হয়। এতে চিকি?সক ও রোগীদের মধ্যে দুরত্ব তৈরি হয়। ফলাফল কিন্তু ভালো হয় নি। ওই সময় রোগীদের অনেককেই চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে।

রোগীর অবস্থা একটু খারাপ দেখলেই রোগীকে অন্য হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়েছে। সে হাসপাতাল থেকে আবার অন্য হাসপাতালে। সেখান থেকে অন্যখানে। অনেক রোগী এ যাতায়াতেই মারা গেছেন। এর পেছনে কারণ হল ডাক্তার ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ খারাপ রোগীদের ব্যাপারে রিক্স নিতে চান নি।

কোন রোগী চিকি?সাকালিন মারা যেতেই পারেন। কিন্তু সব রোগী যে চিকি?সাকালিন ডাক্তারের ভুলে মারা যান তা কিন্তু নয়। তাই নিজেদের গা বাঁচাতে তারা অন্যত্র রেফার্ড করেছেন। এটা করাই স্বাভাবিক। চিকি?সা করার পর যদি জেল-রিমান্ডে যেতে হয়, জরিমানা দিতে হয় তাহলে কে নিজেকে বিপদে রেখে মুমূর্ষু রোগীর দায়ভার নিতে চাবে? যদি ডাক্তারদের নিরাপত্তা থাকত তাহলে তারা চেষ্টা করে দেখতে পারতেন।

এই যে চিকি?সকের সাথে রোগী ও তাদের আত্মীয়-স্বজনের একটা দুরত্ব তৈরি হয়েছে তা কিন্তু কোন পক্ষের জন্যই ভালো নয়। রোগী যদি তার ডাক্তারের ওপর ভরসা না পান তাহলে যতই ভালো চিকি?সা করা হোক না কেন তিনি সুস্থ হবেন না। আবার ডাক্তার যদি সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকেন এই বুঝি তার বিরুদ্ধে মামলা হল তাহলে তিনিও স্বাভাবিকভাবে চিকি?সা করতে পারবেন না। আমরা যতই বলি না কেন আমাদের চিকি?সকরা খারাপ, রক্তচোষা কিন্তু আমাদের দেশের কতজনের সামর্থ্য আছে আমেরিকা, সিঙ্গাপুরে গিয়ে চিকি?সা করার। আর যাদেরওবা এ সার্মথ্য আছে জরুরী মুহুর্তে রোগীকে তো নেয়া সম্ভব নয়।

আমরা যতই বলি না কেন আমাদের চিকি?সকরা খারাপ কিন্তু এট স্বীকার করতেই হবে যে আমাদের দেশের ডাক্তাররা কিন্তু বাইরের অনেক দেশের তুলনায় কোন অংশে কম নয়। বাইরের দেশগুলোতে যারা চিকি?সা করতে গেছেন তাদের অনেকেই এমনটা শুনে এসেছেন যে তোমাদের দেশেও অমুক ডাক্তার আছে সে তো ভালো তার কাছে চিকি?সা করো না ক্যানো? যদি ভালো না হত তাহলে বিদেশে এমন ভূয়সী প্রশংসা শোনা যেত না। হ্যাঁ, কিছু সমস্যা যে নেই তা নয়। আমাদের দেশের চিকি?সকদের ব্যাপারে একটা অভিযোগ পাওয়া যায় তারা সময় দিতে চান না, ব্যবহার ভালো নয়। সময় দেয়ার ব্যাপারটা নিয়ে একটু ভাবুন।

সরকারি হাসপতালগুলোতে প্রতিদিন একজন ডাক্তারকে ১০০-১৫০ রোগী দেখতে হয়। কোন রোগীকে ভালো করে পরীক্ষা করে দেখতে যদি ১০ মিনিটও লাগে তাহলে মোট সময় লাগবে ১৬-২৫ ঘন্টা। তাহলে ভাবুন তো এত রোগী কিভাবে দেখা সম্ভব। বাধ্য হয়ে ডাক্তারকে প্রতি রোগীর পেছনে সময় কম দিতে হয়। কোন ডাক্তার যদি বেশি সময় নিয়ে রোগী দেখেন তাহলে বিপুল সংখ্যক রোগী চিকি?সা সেবার বাইরে থাকবে।

নাই মামার চেয়ে কানা মামা তো ভালো। জেলে পানির নড়াচড়া দেখলেই বুঝতে পারে মাছ আছে কি নাই। ডুব দিয়ে দেখার প্রয়োজন হয় না। অনেক রোগ প্রতিনিয়ত চিকি?সা করতে করতে ডাক্তাররা ওই রোগ সম্বন্ধে এত অভিজ্ঞ হন যে অল্পতেই তা ধরতে পারেন। অহেতুক বেশি সময় নষ্ট করার প্রয়োজন বোধ করেন না।

সরকারি হাসপাতালের ব্যাপারে ঠিক আছে চেম্বারেও তো সময় দিতে চান না। আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ত্রুটিযুক্ত। আমাদের দেশের লোকদের ধরনা অধ্যাপক ছাড়া অন্যেরা চিকি?সার অ-ও বোঝে না। এটা কিন্তু ভুল ধারণা। চিকি?সা শিক্ষা ব্যবস্থা এমন করে গড়ে তোলা হয়েছে যে ছোটখাটো ও কমন রোগগুলোর চিকি?সা দিতে পারেন যে কোন এমবিবিএস পাশ করা চিকি?সক।

সাধারণ সর্দি-কাশির জন্য অধ্যাপক দেখানোর দরকার কি? জটিল রোগগুলোতে না হয় তাদের শরনাপন্ন হওয়া যেতে পারে। এতে করে বড় বড় অধ্যাপকদের চেম্বারে সর্দি-কাশির মত রোগবালাই নিয়ে ভীড় করেন অনেকেই। এতে তাদের চেম্বারে রোগীর সংখ্যা বাড়ে। বাধ্য হতে হয় রোগীদের কম সময় দিতে। বলতে পারেন এত রোগী দেখার দরকার কি? হ্যাঁ, তা ঠিক।

এখানে ডাক্তারদের মানসিকতা পরিবর্তন করা প্রয়োজন। তারা দিনে ৩০-৪০ টার বেশি রোগী দেখবেন না। অথবা শুধু জটিল রোগীগুলো দেখবেন। মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে আমাদেরও শুধু কয়েকটা হাঁচি দিলেই অধ্যাপকের কাছে ছুটবেন না। আশেপাশের কোনো এমবিবিএস ডাক্তারকে দেখান।

উনিই প্রয়োজন মনে করলে রেফার্ড করবেন। আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এভাবেই গড়ে তুলতে হবে। আমাদের সমাজে যেমন ভালো লোকের সংখ্যাই বেশি, দুষ্ট লোকের সংখ্যা হাতে গোনা কয়েকজন হলেও তাদের দাপটে ভালোরা উচ্চ বাচ্য করতে পারেন না। চিকি?সক সমাজের সবাই যে খারাপ তাও কিন্তু নয়। চিকি?সক সমাজের মধ্যেও দুষ্ট ডাক্তারও আছেন।

তার সংখ্যা কিন্তু বেশি নয়। সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে এদের বের করে চিকি?সক সমাজকে কুলুষমুক্ত করতে। অনেকেই অভিযোগ করেন চিকি?সক কমিশন পাবার লোভে অতিরিক্ত টেস্ট দেন। এটা ওই দুষ্ট ডাক্তারদের জন্য প্রযোজ্য। সবার জন্য নয়।

এটাও সাধারন জনগনের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি করে। ডাক্তাররা টেস্ট দিলেই মনে করেন বুঝি কমিশনের লোভ। চিকি?সা বিজ্ঞান অনেক এগিয়ে গেছে। নতুন নতুন টেস্ট আবিষ্কার হয়েছে। যেমন আগে মাথার কোন সমস্যা ধরতে হলে এক্সরের ওপর নির্ভর করতে হত।

এতে অনেক রোগ নির্ণয় করা যেত না বা করলেও ভুল হওয়ার সম্ভবনা বেশি। কিন্তু বিজ্ঞানের আগ্রগতির ফলে আবিষ্কার হয়েছে সিটিস্ক্যান ও এমআরআই। এটি মাথার ভেতরের ছবি তোলে নির্ভুলভাবে। ফলে রোগ নির্ণয় সহজ হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে সিটিস্ক্যান ও এমআরআই আবিষ্কারের পর মস্কিষ্কের ক্যান্সার আক্রান্তের হার বেড়েছে।

এর মানে হল এগুলো আবিষ্কারের পর মস্তিষ্কের ক্যান্সার নির্ণয় করা সহজ ও নির্ভুল হয়েছে। আগে অনেকেই হয়তবা মারা যেত মস্তিষ্কের ক্যান্সারে যেটা আমরা জানতাম না। এর ফলে কি হচ্ছে? একদিকে রোগ নির্ণয়ের ফলে চিকি?সা করা সহজ হচ্ছে। বেড়েছে গড় আয়ু। এক্সরে করতে ১৫০-৩০০ টাকা লাগে আর এমআরআই, সিটিস্ক্যানে খরচ ৩০০০-৬০০০ টাকা।

কেউ যদি বলেন কমিশনের লোভে সিটিস্ক্যান করাচ্ছেন। এজন্য তা না করান তাহলে বুঝতেই পাচ্ছেন কতটা রিস্ক নিচ্ছেন। আগের দিনে ডাক্তাররা রোগের লক্ষণ ও রোগীকে পরীক্ষা করে যে ডাটা পেতেন তাই দিয়ে চিকি?সা করতেন। এতে তাদের মেধার পরিচয় পাওয়া যায়। তবে এ কথাও তো ঠিক আগের ডাক্তারা এ ধরণের পরীক্ষা চাইলেও করতে পারতেন না।

কারণ দেশে তো তা সহজলভ্য ছিল না। সঠিকভাবে রোগ নির্ণয়ে যদি টেস্ট করতেই হয় তাহলে দোষের কি আছে? হ্যাঁ, তবে যারা কমিশনের লোভে অপ্রয়োজনীয় টেস্ট দেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা তো নিতেই হবে। ডাক্তাররা যেন মিডিয়া ট্রায়েলের শিকার। বেশিরভাগ পত্রিকায় দেখা যায় সাংবাদিকরা এভাবে লেখেন যে, ওমুক চিকি?সকের ভুলে রোগীর মৃত্যু। একজন সাংবাদিক কিভাবে এ ধরণের রায় দিতে পারেন? সাংবাদিক কি করে বুঝলেন যে ভুল চিকি?সা হয়েছে? একজন চিকি?সকই বলতে পারেন ভুল চিকি?সা হয়েছে কি না।

তাই তদন্ত না হওয়ার আগে কোনভাবেই এভাবে বলা ঠিক নয়। এতে জনগনের মধ্যে আস্থার অভাব দেখা দেয়। এর ফলাফল লাঞ্চিত হন চিকি?সক। প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও চিকি?সক লাঞ্চনার ঘটনা ঘটে। এতে ডাক্তারদের মধ্যে নিরাপত্তার অভাব দেখা দেয়।

তারা ভয়ে ভয়ে থাকেন। ভয়ে ভয়ে থাকলে ভালো চিকি?সা করা সম্ভব নয়। যারা চিকি?সকদের লাঞ্চিত করেন তাদের বিচার হয়েছে এমনটি আজও পত্রিকায় চোখে পড়ে নি। চিকি?সক লাঞ্চনাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। রোগীর আত্মীয়-স্বজনদেরকেও ধৈর্য্য ধরতে হবে।

মনে রাখতে হবে জন্ম-মৃত্যু আল্লাহর হাতে। হায়াত না থাকলে যত ভালো চিকি?সকই হন না কেন রোগীকে সুস্থ করা সম্ভব নয়। আমাদের দেশের প্রয়োজনেই, স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়ন কল্পেই প্রয়োজন রোগী-চিকি?সকের সম্পর্কোন্নয়ন। ডাক্তাররা রোগীর শত্রু নন, বিপরীতটিও নন। বরং সহযোগী।

কাজেই সম্পর্ক সে রকম হওয়াই তো বাঞ্চনীয় নয় কি? ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।