Notice (8): Undefined index: NextPost [APP/Controller/PostsController.php, line 738]
মার্চের উত্তাল দিনগুলো | আমাদের কথা

আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মার্চের উত্তাল দিনগুলো

মার্চের উত্তাল দিনগুলো নূর-এ-আলম সিদ্দিকী ষাট দশকের শুরু থেকেই স্বায়ত্তশাসনের দাবিটি মূলত সকল রাজনৈতিক দলেরই কর্মসূচির অঙ্গীভূত হচ্ছিল। এসময় সকল রাজনৈতিক দল তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে, নিজস্ব আঙ্গিকে স্বায়ত্তশাসনের দাবি যার যার অবস্থান থেকে সামনে নিয়ে আসে। কিন্তু ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তাহীনতা এবং সীমাহীন বৈষম্যের শিকার হওয়ার কারণে নিঃশেষিত পাকিস্তানের অর্থনীতির দিকে তাকিয়ে বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তানের রাউন্ড টেবিল কনফারেন্সে ৬ দফা কর্মসূচিটি পেশ করেন, তখন মূলত স্বায়ত্তশাসন থেকে আরেক ধাপ এগিয়ে স্বাধিকারের প্রশ্নটা সামনে এসে যায়। দুঃখজনক হলেও সত্য বঙ্গবন্ধু ফেরত এসে তার আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় যখন এই কর্মসূচিটি পেশ করেন, সেখানে এটি গৃহীত হয়নি। বঙ্গবন্ধু ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দকে ডেকে এই ৬ দফা কর্মসূচিটি তাদের হাতে তুলে দেন সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দেয়ার জন্য।

এই ৬ দফাকে সেদিন আমরা গ্রহণ করেছিলাম, ছাত্রলীগ নিয়েছিলো; স্বাধীনতার উপক্রমনিকায়। এর অন্তর্নিহিত শক্তির যে সন্ধান আমরা পেয়েছিলাম সেটি স্বাধিকার নয়, সেটি স্বাধীনতার। এই ৬ দফা আন্দোলনের সোপান উত্তরণের মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন বঙ্গবন্ধুসহ আমাদের অনেকেরই কারারুদ্ধ হতে হয়, আমিও কারারুদ্ধ হই। বঙ্গবন্ধুকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী করা হয়। কিন্তু তাই বলে আন্দোলন থেমে থাকেনি।

বরং ১১ দফার মধ্যে ৬ দফাকে সন্নিবেশিত করা হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের সময় বলা হয়েছিলো, বৈষম্যের বিরুদ্ধে এবং পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে যায় এমন কোনো কথা বলা যাবে না। তা সত্ত্বেও আমরা নির্বাচনে গেলাম, যদিও এটা অনেকটা উষ্কিয়ে দেয়ার মতো বিষয় ছিলো। কিন্তু দৃষ্টান্তসহ বলতে পারি যে, আজকে স্বাধীনতার ৪০ বছর পরও আমি অত্যন্ত প্রত্যয়ের সঙ্গে বিশ্বাস করি এবং বর্তমান প্রজন্মকে জানাতে চাই যে, ৭০-এর নির্বাচনের মেন্ডেটটি না আসলে আমাদের স্বাধীনতার আন্দোলন সফল হতো না। আমাকে বর্তমান প্রজন্ম প্রশ্ন করতে পারে যে, শেষ পর্যন্ত তো আপনাদের সশস্ত্র আন্দোলনে যেতেই হলো, তাহলে আরো আগেই কেন গেলেন না? এ প্রশ্নটা আগেও এসেছে, কিন্তু আমি তখনো যে উত্তর দিয়েছি; আজকে স্বাধীনতার ৪০ বছর পরেও আমার একই উত্তর- সেদিন যদি ওই গণরায়টি আমরা না পেতাম, ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন যদি আওয়ামী লীগের পে না আসত, তাহলে আমরা বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত হতাম।

পৃথিবীর বহু দেশে এইভাবে স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয়েছে; সিংহলে হয়েছে, কাশ্মীরে বছরের পর বছর ধরে যুদ্ধ হচ্ছে, এমনকি পাঞ্জাবের খালেস্তানি আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু তারা সফল হতে পারেনি; যেহেতু এসব আন্দোলনের পে কোনো নির্বাচনী রায় ছিলো না, গণ মেন্ডেট ছিলো না। ‘নিউকিয়াস’ বলে যে-কথাটি আলোচিত হয় সেটা একটা অতি গোপনীয়ভাবে দুই-একজনের চিন্তা-ভাবনার মধ্যে থাকতে পারে। কিন্তু এটা ব্যাপক আন্দোলনের পথপরিক্রমায় কোন একটি অবিভাজ্য অংশ ছিলো না। এটা অত্যন্ত গোপন এবং গুটিকয়েক লোকের চিন্তা-ভাবনায় ছিলো।

তখনকার রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনাটিই আবর্তিত হয়েছিলো বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করে। স্বাধীনতা এবং ছাত্রলীগ একে অপরের স্রষ্টা, একটি অপরের পরিপূরক। ১৯৭০-এর নির্বাচনে জয়লাভে বঙ্গবন্ধু নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে রেসকোর্স ময়দানে সভা করেন এবং সেই সভায় নির্বাচিতদের নিয়ে ৬ দফার প্রশ্নে কোন ছাড় না দেয়ার শপথ করেছিলেন। কোন প্রকার নির্যাতন, নিপীড়ন, প্রলোভন এমনকি মতার বিনিময়েও ৬ দফার প্রশ্নে কোন আপষ করবেন না বলে অঙ্গীকার করেছিলেন। একথাগুলো এই জন্য বলছি যে, এখন সরাসরি না বললেও অনেকে কৃতিত্ব নেয়ার চেষ্টা করছেন এবং প্রশ্ন তুলছেন এই বলে যে, সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য ২৫ মার্চ পর্যন্ত অপো করতে হলো কেন? কেউ কেউ বলছেন একটা আপষ রফার চেষ্টা চলছিলো।

আমাদের মনে রাখতে হবে, রাজনীতি একটা রণকৌশল, এর ভিন্ন ভিন্ন কলা-কৌশল থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই সময় যদি আমরা সশস্ত্র আন্দোলনের ডাক দিতাম, তাহলে আমাদের বিরুদ্ধে যে অপপ্রচার ডান এবং বাম পন্থীদের প থেকে করা হচ্ছিল (আমরা আসলেই ভারতের সঙ্গে মিশে যেতে চাই, আমরা ভারতের অনুচর, আমরা সিআই-এর দালাল ইত্যাদি) সেই অভিযোগগুলোই সত্য প্রমাণিত হতো। নির্বাচনের পর বাংলাদেশের জনমত এবং ১৬৭টি আসন পাওয়ার পরও যেহেতু একবারের জন্যও সংসদ বসতে দেয়া হলো না, সেই কারণে বিশ্ব জনমত গড়ে উঠল যে, আমাদেরকে নিশ্চিতভাবে কলোনি বা কৃতদাসে পরিণত করে শোষণের চারণ ত্রে বানানোই তাদের মূল ল্য, এটাকে পাকিস্তানের একটা অংশ হিসেবে তারা মনে করে না। যাই হোক নির্বাচনের পর ১০ মার্চ সংসদ অধিবেশন বসার কথা ছিলো। কিন্তু তার আগেই ইয়াহিয়া খান সাহেব বললেন- ‘এই অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করা হলো।

’ ওই দিকে ভুট্টো সাহেব ঘোষণা দিলেন- ‘যারা যাবে এই অধিবেশনে তাদেরকে প্রয়োজনে হত্যা করা হবে’। তখন আমাদের একটা বিরাট সুবিধা হলো এই যে, বাঙালিরা তখন মনে মনে সবাই ওদের ষড়যন্ত্রটা উপলব্ধি করতে পারল। রাজনৈতিক অঙ্গন সোচ্চার ছিলো, উচ্চকিত ছিলো, উদ্বেলিত ছিলো, তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচির মধ্যে এর প্রকাশভঙ্গি ছিলো। কিন্তু এর প্রভাব বাঙালি সেনাবাহিনী, বাঙালি প্রশাসক, সচিব থেকে শুরু করে পিয়ন পর্যন্ত, শিক, সাধারণ মানুষ সকেলই কিন্তু আন্তরিকভাবে বুঝতে পারে যে, আর বোধহয় এক সঙ্গে থাকা যাবে না। তাই আমরা যখন খবর পেলাম যে, ইয়াহিয়া খান সংসদ অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণা দিতে যাচ্ছেন, তখন আমরা ছাত্র নেতারা ওঁৎ পেতেছিলাম এই সুযোগটা গ্রহণের জন্য।

কারণ ঘোষণাটা কি হবে, সেটা আমরা জানতাম। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ বেলা প্রায় সাড়ে বারটার দিকে ইয়াহিয়া খান সাহেবের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সারা ঢাকা শহর মিছিলের নগরীতে পরিণত হলো। বঙ্গবন্ধুও খবরটি রাখতেন তার প্রমাণ হলো, তিনিও তখন সংসদীয় দলের সভা করছিলেন এই প্রেেিত যে, সংসদ অধিবেশন স্থগিতের মতো ঘোষণা এলে আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত কি হবে তা পর্যালোচনা করা। আমরা মিছিল নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে গেলাম। সেখানে আমাদের প্রাক্তন চার নেতাসহ অনেকেই ছিলেন।

আমি জীবনে একটাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম খুব বুদ্ধিমানের মত বাকিটুকু সরল-সাধারণভাবে চলার চেষ্টা করেছি। গ্র“পিংয়ের দিকেও আমার সাঙ্ঘাতিক সাংগঠনিক দতা আমি প্রমাণ করতে পারিনি, এটা আমার ব্যর্থতা। আমার পুঁজি ছিলো, বাগ্মীতা, জনপ্রিয়তা এবং সকল শ্রেণীর ছাত্র নেতা-কর্মীদের সঙ্গে আমার হৃদয়ের সখ্য। চিন্তা-চেতনায় পার্থক্য থাকলেও, পরে যারা বলেছে, আমি সমাজতন্ত্রের পরে, তারাও আমাকে অত্যন্ত ভালবাসতেন। আমার কথাগুলোকে তারা সরাসরি অগ্রাহ্য করতেন না।

তাছাড়া সংখ্যাগরিষ্ঠ, মানে বিপরীতপন্থী রাজনীতির মধ্যে এত দাপটে সভাপতিত্ব করা, সভাপতির দায়িত্ব পালন করা অত সহজ হতো না। এখানে আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করব সিরাজুল আলম খান, কাজী আরেফ এবং আরো অনেকেই আমাকে সহযোগিতা করেছিলেন, যাতে আমি ছাত্রলীগকে সঠিকভাবে নেতৃত্ব দিতে পারি। মতপার্থক্য ও চূড়ান্ত পর্যায়ে ভিন্নমতি হওয়া সত্ত্বেও তাদের সঙ্গে একটা কার্যকর সম্পর্ক ছিল। স্বাধীনতা এবং বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব এই প্রশ্নে আমাদের মধ্যে কোন মতপার্থক্য ছিলো না। এই জন্য আজকে যে যত কথাই বলুক, এই জাতীয় সঙ্গীত, এই পতাকা এসব নিয়ে আমাদের মধ্যে ব্যাপকভাবে আলোচনা হয়েছে, কিন্তু একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য আমরা বঙ্গবন্ধুর কাছে পেশ করেছি।

তিনি যেটা বলেছেন, সেটিই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হিসেবে গৃহীত হয়েছে। আমরা তর্ক করেছি, কথা বলেছি, যুক্তি দিয়েছি তাই এসব কারো একক সাফল্যের বিষয় নয়; তবে একক নেতৃত্ব ছিলো বঙ্গবন্ধুর। একক নির্দেশনা ছিলো বঙ্গবন্ধুর। এখন ঘরে বসে আলাদা-আলাদা চিন্তা করে কোন ফাঁক-ফোকর দিয়ে কোন যুক্তি ঢুকিয়ে দিয়ে কেউ যদি বলেন যে, তিনি এটা করেছেন তাহলে সেটা হবে অত্যন্ত অযৌক্তিক, হাস্যকর এবং কাল্পনিক। সে সময়ের মানচিত্র খচিত পতাকাটি মূলত প্রথমে স্বাধীনতা কিংবা বাংলাদেশের স্বাধীন জাতির পতাকা হিসেবে চিহ্নিত হয় নাই।

সার্জেন্ট জহুরুল হককে যখন ক্যান্টনমেন্টে হত্যা করা হয়, তখন রব এবং খালেদ সাহেবের নেতৃত্বে যে ছাত্রলীগ তারা ফিফটিন ফেব্র“য়ারি রেজিমেন্ট নাম করে একটি রেজিমেন্ট তৈরি করে, যা ছিলো ছাত্রলীগের রেজিমেন্ট। সেই রেজিমেন্টের ফ্যাগ ছিলো সেটা। ১ মার্চ যখন আমরা বঙ্গবন্ধুর কাছে গেলাম, বঙ্গবন্ধু তখন সোফায় বসে ছিলেন। আমি একা তার কাছে গিয়ে বসলাম এবং বললাম- ‘বঙ্গবন্ধু, সারাদেশ আজ আপনার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। ৬৯-এর ১১ দফার আন্দোলন এবং গণঅভ্যুত্থানের সময় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ছিলো।

প্রস্তাব আসছে যে, এবারো সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ হোক। কিন্তু এটা হলে, অনর্থক কর্মসূচি নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব আসবে, একটা মতানৈক্যও তৈরি হবে। দেশ আপনার নেতৃত্বের পে একক রায় দিয়েছে। তাই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ছাত্রলীগের একক নেতৃত্বে যদি গঠিত হয় তাহলে আন্দোলন পরিচালনা করতে সুবিধা হবে। ’ তখন বঙ্গবন্ধু বললেন- ‘তোমরা যাও।

পল্টন ময়দানে গিয়ে তোমরা চারজন স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ঘোষণা কর। আমি তোফায়েলকে পাঠাচ্ছি। সে গিয়ে আমার এবং আওয়ামী লীগের প থেকে তোমাদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করবে এবং মান্নান শ্রমিকলীগের তরফ থেকে সংহতি প্রকাশ করবে। ’ আমরা এসে যথারীতি ছাত্রলীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক এবং ডাকসু সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করলাম। একটা কথা এখানে ঐতিহাসিকভাবে সত্য, আর সেটা তৎকালীন যে কোন খবরের কাগজ দেখলেও এটা প্রমাণিত হবে যে, সে সময় আনুষ্ঠানিকভাবে কারো নাম আহ্বায়ক হিসেবে ঘোষিত না হলেও ওয়ারেন্ট অব প্রটোকলে যেহেতু এক নম্বর সদস্য ছিলো ছাত্রলীগের সভাপতি, তাছাড়া স্বাধীনতা পূর্ব হতে স্বাধীনতার আন্দোলন চলাকালে যত দিন পর্যন্ত স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ছিলো, তখনকার প্রতিটি সভায় সভাপতিত্ব করেন ছাত্রলীগের সভাপতি।

যাই হোক, ১ মার্চ পল্টন ময়দানের ওই জনসভাতেই সিদ্ধান্ত হয় যে, ২ মার্চ আমরা আমাদের বিস্তারিত কর্মসূচি দেব। এরই মধ্যে আমাদের বৈঠক হতো, কর্মসূচি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হতো, কি কি ঘোষণা দেয়া হবে সেগুলো আলোচিত হতো। কিন্তু আমাদের তরফ থেকে কেউ না কেউ গিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে কর্মসূচির অনুমোদন নিয়ে আসত। কিন্তু ২ মার্চ বটতলার যে সভার কথাটি এখন আলোচিত হয় সেটির বিষয় একটু আলোচনা করা দরকার। আমরা চারজন ডাকসুতে বসে আছি, খবর পেলাম যে জনতার ভিড়ে মঞ্চ-টঞ্চ নিঃশেষ হয়ে গেছে।

আমরা তখন কলা ভবনের গাড়ি বারান্দায় দাঁড়ালাম। ওখানে শাজাহান সিরাজ অনুষ্ঠানের সভাপতি হিসেবে আমার নাম ঘোষণা করলেন। আমাদের ওয়ারেন্ট অব প্রটোকল অনুযায়ী প্রথমে মাখন বক্তব্য রাখত, তারপর শাজাহান সিরাজ, এরপর আসম আব্দুর রব সাহেব এবং সব শেষে আমি সভাপতির ভাষণ দিতাম। আমরা যখন ডাকসু অফিসে ছিলাম, তখনই খবর পেয়েছিলাম যে, বঙ্গবন্ধু খবর পাঠিয়েছেন (খুব সম্ভবত রাজ্জাক ভাই এসে খবরটা দিলেন) যে, ৩ মার্চ আমাদেরকে পল্টন ময়দানে সভা করার ঘোষণা দিতে বলেছেন। সেই সভায় বঙ্গবন্ধু নিজেও উপস্থিত থাকবেন।

আমাদেরও একটা নিজস্ব পরিকল্পনা ছিলো যে, পল্টন ময়দান থেকেই আমাদের পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করব। যাই হোক, কলা ভবনের গাড়ি-বারান্দায় দাঁড়িয়েই ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের জনসভা এবং সেই সভায় বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতির কথা ঘোষণা করা হলো। মাখন বক্তব্য রাখছিল, ততণে রেসকোর্স থেকে নীলতে পর্যন্ত জনসমুদ্রে রূপ নিয়েছে। সেই অবস্থায় সম্ভবত শাজাহান সিরাজও বক্তৃতা করার অবকাশ পান নাই। এর মধ্যেই দু’টি খবর এলো, ফার্মগেটে গুলি হয়েছে এবং তাতে চার-পাঁচজন মারা গেছে।

একই সময় ঢাকা কলেজের ফিফটিন ফেব্র“য়ারি রেজিমেন্ট তাদের পতাকা মোটা একটা বাঁশে বেঁধে নিয়ে এলো। আমাদের কাছে আসার পর আসম আব্দুর রব ভাই নিচে থেকে, হামাগুড়ি দিয়ে (বাঁকা হয়ে) ওই ফ্যাগটি যখন মঞ্চের দিকে তুলে নিচ্ছেন সে অবস্থায় একটি প্রাইভেট ক্যামেরায় তোলা একটি ছবি আছে। যদিও ফ্যাগ ওঠানোর কথা বা পরিকল্পনা ছিলো না। যদি থাকত তাহলে এর জন্য উপযুক্ত বাঁশ, দড়ি থাকত। ব্যান্ড বাজত কিংবা জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার ব্যবস্থা থাকত।

কিন্তু এর কিছুই সেদিন ছিলো না। শুধু একটা ফ্যাগ নিচের থেকে বাঁকা হয়ে ওঠানো হয়েছে মাত্র। তাছাড়া পরবর্তীতে এর কোনো প্রতিক্রিয়া তো দূরের কথা কোনো প্রকার আলোচনা-সমালোচনাও ছিলো না। কোনো পত্রিকার নিউজেও বিষয়টি স্থান পায়নি। ২ তারিখ যদি আনুষ্ঠানিকভাবে পতাকা উঠত তাহলে তো সারা দেশের সমস্ত পত্রিকায় এটাই হেডলাইন হতো, যেমনটা হয়েছিলো ২৩ মার্চ পতাকা ওঠানোর পর।

২ তারিখের পতাকা তোলার ঘটনাতো কোন পত্রিকায় ছোট আকারেও ছাপা হয়নি। কিন্তু ওইদিন পতাকা প্রদর্শিত হয়েছিলো, এটা ঠিক। সে সময় মাখন, শাজাহান সিরাজ, আব্দুর রব সাহেব এবং আমি একসঙ্গে পতাকাটা তুলে ধরেছিলাম। যেহেতু সেটা কোন ঘোষণা ছিলো না তাই সেই ছবিটা কোথাও ছাপা হয়নি। রব সাহেব যখন বাঁকা হয়ে পতাকা ওঠাতে যাচ্ছিল তখন আমি হাসি-ঠাট্টাচ্ছলে বলেছিলাম, দেখেন দেখেন রব একা কি করে।

চলেন, আমরা চারজন মিলে পতাকাটা তুলে ধরি। তখনকার যারা শ্রোতা-দর্শক সকলকে এবং তৎকালীন খবরের কাগজগুলোকে সাী রেখে বলি, ওইদিন পতাকা প্রদর্শিত হয়েছে এটা ঠিক, কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে পতাকা উত্তোলিত হয় ২৩ মার্চ। ১ মার্চ পল্টন ময়দানে ‘স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ ঘোষণার পরপরই আমরা শপথ নিয়েছিলাম যে, ‘বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ল্েয আজ থেকে গণতান্ত্রিক পথ বর্জন করে প্রয়োজনে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করার জন্য সারা বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মানুষকে এগিয়ে আসার জন্য আমরা আহ্বান জানাচ্ছি এবং আমরাও শপথ গ্রহণ করছি। ’ এই শপথে মান্নান সাহেব এবং তোফায়েল সাহেবও অংশ নিয়েছিলেন। আমি শপথ বাক্য পাঠ করাতাম এই আঙ্গিকে যে, আমি আগে বলতাম, তারপর অন্যরা পাঠ করত।

এই ছবি তখন ছাপা হয়েছে সব পত্রিকায়। যাই হোক, মানচিত্র খচিত ফিফটিন ফেব্র“য়ারি রেজিমেন্টের পতাকাটিকেই তৎকালে আমরা জাতীয় পতাকা হিসেবে গ্রহণ করেছিলাম। তবে কোনো একটা বিশেষ ঘটনা বা মিটিংয়ের মাধ্যমেই এটাকে জাতীয় পতাকা হিসেবে গ্রহণ করা হয়নি; বরং বিভিন্ন আলোচনা-পর্যালোচনার পর একটা পর্যায়ক্রমিকতার মাধ্যমেই বঙ্গবন্ধু এটাকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু সম্ভবত এটাকে জাতীয় পতাকা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন মানচিত্রের প্রতি অনুপ্রাণিত হয়েই। যেমনটা হয়েছিল জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচনের বেলাতেও।

কেউ বলছিল, ‘আমার সোনার বাংলা...’ জাতীয় সঙ্গীত হবে, আবার কেউ বলছিল, ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে না’ক তুমি...’ জাতীয় সঙ্গীত হবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মধ্যে সোনার বাংলা গড়ার একটা প্রত্যয় ছিল, তিনি কথায় কথায় বলতেন- ‘আমি সোনার বাংলা গড়তে চাই। ’ সম্ভবত উনার ওই কথার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই তিনি আমার ‘সোনার বাংলা...’কে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। এখানে একটা কথা আমি নিঃশঙ্কোচে বলতে চাই, প্রত্যয়ের সঙ্গে বলতে চাই এবং সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বলতে চাই যে, আমাদের সকল সিদ্ধান্তই বঙ্গবন্ধু দ্বারা অনুমোদিত হতো। উনার অনুমোদনের বাইরে আমরা কোনো কিছু করিনি।

কিন্তু যে কথাগুলো উনি বলতে পারতেন না কিংবা পরিস্থিতির কারণে উনার মুখ দিয়ে বলা সম্ভব ছিল না, সে-কথাগুলো আমরা বলতাম। যেমন- ৩ মার্চ বঙ্গবন্ধুকে জাতিরজনক উপাধিতে ভূষিত করে যে ইশতেহার পাঠ করা হয়েছিলো, সেই ইশতিহারে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করা হয়। সেটা যদি বঙ্গবন্ধুর মুখ দিয়ে বলা হতো তাহলে তো পাকিস্তানীদের উদ্দেশ্যই সফল হয়ে যেত। তারা এটা বলার সুযোগ পেত যে, তোমরা তো সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছ। তাই সেদিন ইশতেহার আমরা পাঠ করেছিলাম।

কিন্তু সেই ইশতেহারটাও ছিল বঙ্গবন্ধুর অনুমোদিত। ‘আমার সোনার বাংলা’-কে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমরা, স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এবং আমাদের প্রাক্তন চারজন ছাত্র নেতা। কিন্তু এ সিদ্ধান্তটি অনুমোদিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধু দ্বারা। আর বঙ্গবন্ধুর এই অনুমোদন পেয়েছিলাম ২ মার্চ রাতে। ৩ মার্চের জনসভায় বঙ্গবন্ধু এলেন, সেখানে তাকে জাতির পিতা ঘোষণা করা হলো, তাকে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করা হলো।

যেহেতু এই ইশতেহারটা সেদিন শাজাহান সিরাজকে দিয়ে পাঠ করানো হলো তাই অভিমান করে আসম আব্দুর রব ৩ মার্চের সভায় বক্তৃতা করেনি। যাই হোক, সে সভায় বঙ্গবন্ধু বললেন- ‘ছাত্ররা যে সংগ্রাম করছে, যে আন্দোলন করছে তাতে আমার পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। আমি শুধু একটি অনুরোধ জানাতে এসেছি, এই আন্দোলন যেন উশৃঙ্খলতায় পরিণত না হয়। এই আন্দোলন যেন নাশকতার জন্ম না দেয় এবং আপনাদের বন্ধু বেশে এই আন্দোলনকে বিপথগামী করতে পারে এমন কাউকে প্রশ্রয় দিবেন না। আমরা সু-শৃঙ্খলভাবে আন্দোলন করে আমাদের কাঙিত ল্েয পৌঁছাব।

আগামী ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দান থেকে আমি আমার পূর্ণ কর্মসূচি ঘোষণা করব। ’ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের একটা অন্তর্নিহিত কথা আছে; সে সময়ে যারা অতি বিপ্লবী ছিলেন তাদের দাবি ছিল, ওই ভাষণে ঘোষণা দিতে হবে যে- ‘জন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে আমি শেখ মুজিবুর রহমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসাবে এই মুহূর্তে স্বাধীনতা ঘোষণা করছি। ’ আর আমাদের দাবি ছিল, উনি এমনভাবে স্বাধীনতার সুষ্পষ্ট ইঙ্গিত দিবেন যা, সকলেই বুঝতে পারবেন। ৭ মার্চের ভাষণে যা তিনি দিয়ে ছিলেনও। এই নিয়ে অবশ্য ব্যাপক আলাপ-আলোচনা হয়েছিল।

বঙ্গবন্ধুর একটা গুণ ছিল, উনি যেটা করতে চাইতেন তার সিদ্ধান্ত নিজেই নিতেন। কিন্তু বিষয়টি অন্যদের আলোচনার সুযোগ তিনি দিতেন। ৭ মার্চের বক্তৃতা করার আগে আমরা চারছাত্র নেতা রেসকোর্সের মঞ্চে চলে আসি। মাইকের দখল নিয়ে আমরা শ্লোগান দেই এবং খণ্ডিত বক্তব্য রাখি। সেখানে আমার এক খণ্ডিত বক্তব্যে বলেছিলাম- ‘বঙ্গবন্ধু তুমি বল, স্বাধীনতার এক ইঞ্চি ব্যতিক্রম আমরা হতে দিব না।

আমাকে জিজ্ঞেস করেন, নূর-এ-আলম সিদ্দিকী, তোমাদের শক্তির উৎস কোথায়, কি করে তোমরা এই হিংস্র সশস্ত্র বাহিনীর মোকাবিলা করবা? বঙ্গবন্ধু, আমাদের শক্তির উৎস পেন্টাগন নয়, আমাদের শক্তির উৎস ক্রেমলিন নয়; এই বাংলার ল-কোটি মানুষ, পল্টন ময়দানের উদ্বেলিত জনতা, বাংলার মানুষের বুক নিঃসৃত নিঃশ্বাস হলো আমাদের সমর্থন। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে হলেও আমরা তোমাকে স্বাধীনতার সূর্য উপহার দেবই। বাংলার মানুষ, তোমরা দুই হাত উত্তোলিত করে দেখাও তোমরা স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত আছো কি না। ’ সঙ্গে সঙ্গে দুই হাত তুলে ‘জয় বাংলা’ বলে ল-কোটি জনতা আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে দিয়েছিল; সেই সময় বঙ্গবন্ধু মঞ্চে উঠছিলেন। এইসব ছিলো সেদিনের পটভূমিকা, কিন্তু মূল বক্তব্যটা ছিল বঙ্গবন্ধুর।

খই ভাজার আগে তাওয়া গরম করার মত আমরা সেদিন অ্যাডভান্স পার্টি হিসেবে তাওয়া গরম করেছি। আর এর ফিনিশিং দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। এখানে ৭ মার্চের ভাষণের একটি কথা বিশেষভাবে উল্লেখ্যযোগ্য যে, ‘আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্র“র মোকাবিলা করতে হবে। প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।

এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম। ’ ঘোষণার বিন্দুমাত্র বাকি ছিল না। কিন্তু তার মধ্যেও কৌশল হিসেবে তিনি চারটি প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এক, সামরিক বাহিনীকে ব্যারাকে ফেরত নিতে হবে। দুই, শর্তহীনভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে মতা হস্তান্তর করতে হবে।

তিন, যাদের হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে এবং এর তিপূরণ দিতে হবে এবং চার, জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকতে হবে। তারপরে বিবেচনা করে দেখব সংসদে বসব কি না। কিন্তু সেইদিন যদি তিনি স্বাধীনতার সরাসরি ঘোষণা দিতেন, তাহলে আমরা আগ বাড়িয়ে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তাম। ৪১ বছর পরেও আমি মনে করি, সেটা ঠিক হতো না। ৭ মার্চের আহ্বানের পরে ছাত্র-শিক, কৃষক, সরকারি কর্মচারী, বাঙালি সৈনিক, বাঙালি বুদ্ধিজীবী, এমনকি যারা ৬ দফার আন্দোলনকালে কঠোরভাবে এর বিরোধিতা করেছিল তারা এবং বাম রাজনীতিকরাও একাকার হয়ে যায়।

তখন সকলেই একটি মিলনের মোহনায় এসে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দাঁড়িয়ে যায়। ১৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান সাহেব এলেন, ১৬ মার্চ ঢাকসুতে একটা সাংবাদিক সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল। সেখানে একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন যে, তোমরা তো রেসকোর্স থেকেও বললা যে, স্বাধীনতার একবিন্দু থেকে ব্যতিক্রম কিছু গ্রহণ করবে না। কিন্তু ৭ মার্চ তোমাদের নেতা যে চারটি শর্ত দিয়েছে, এই চারটি শর্তের যদি একশ’ ভাগও মেনে নেয়া হয় তাহলেও তো পাকিস্তান থাকে। সেই েেত্র কি তোমরা নেতার বিরুদ্ধে গিয়ে আন্দোলন চালাবা, নাকি আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিবা? আমাদের জন্য এটা ছিল একটা কঠিন প্রশ্ন।

যদিও আমরা জানতাম, আলোচনায় কিছু হবে না, বরং এটা করে শুধু শুধু তারা সময়পেণ করছে; অস্ত্র এবং সৈন্য আনার জন্য। যাতে করে সরাসরি আক্রমণ করে আমাদের চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়া যায়। কিন্তু আমরা সে-কথা বলতে পারছিলাম না। কারণ এটা বললে আমরা যে পাকিস্তানিদের দুরভিসন্ধির কথা জেনে গেছি তা ফাঁস হয়ে যায়। যাই হোক, আমরা জবাব দিলাম, বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় গুণ হচ্ছে যে, তিনি মানুষের নাড়ীর স্পন্দন বোঝেন।

আজ সারা বাংলাদেশ ঐক্যবদ্ধ হয়ে গেছে। তিনি মানুষের হৃদয়ের স্পন্দনের বাইরে গিয়ে কোন সিদ্ধান্ত নিবেন না। সময়ই বলে দিবে তার সিদ্ধান্ত কি হবে এবং আমরা তার নেতৃত্বে পরিপূর্ণভাবে আনুগত্য প্রকাশ করেছি। ১ মার্চ, ২ মার্চ, ৩ মার্চ, ৭ মার্চ তার নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে শপথ করেছি, এখনও করছি এবং আগামীতেও করব। উপস্থিত সাংবাদিকরা আমাদের জবাবে বিমুগ্ধ হয়ে গেলেন।

তারা আমাদের কথায় তাজ্যব হয়ে গেলেন। এরপরের উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল ২৩ মার্চের ঘটনা। ওই দিন সমস্ত গাড়িতে, বাড়িতে, অফিস-আদালতে, সচিবালয়ে, হাইকোর্টে পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন হয় নাই। আমরা ঘোষণা দিয়েছিলাম, ২৩ মার্চ কোথাও পাকিস্তানের পতাকা উড়বে না। ওই দিন সারা বাংলাদেশের প্রত্যেকটি ঘরে মানচিত্র খচিত বাংলাদেশের পতাকা উড়বে।

পল্টন ময়দানে আনুষ্ঠানিকভাবে পতাকা উত্তোলিত হবে এবং সকাল থেকে প্রত্যেকটি গৃহে ওই পতাকা উড়বে। সেদিন হাইকোর্ট, প্রধান বিচারপতির বাসভবনসহ সর্বত্রই মানচিত্র খচিত পতাকা উত্তোলিত হয়েছিল। অবশিষ্ট ছিল ক্যান্টনমেন্ট; তবে মিরপুর এবং মোহাম্মদপুরের কিছু বিহারী অধ্যুষিত এলাকা বাদ ছিল। পতাকা উত্তোলনের সময় আমরা চারজন (ছাত্রলীগ সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক এবং ঢাকসু ভিপি ও সাধারণ সম্পাদক) মঞ্চে উঠে দাঁড়ালাম, প্রথমে সিদ্ধান্ত ছিল চারজনের দাঁড়ানো। কিন্তু পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ সভাপতি কামাল উদ্দিন, ঢাকা নগর ছাত্রলীগের সভাপতি মনিরুল হক আমাদের পাশে দাঁড়ালেন।

বিউগল বাজল, পতাকা উঠল, আমরা অভিবাদন গ্রহণ করলাম। পরের দিন সমস্ত পত্রিকায় এটা খুব বড় করে ছাপা হলো। তখন আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, এই কর্মসূচিকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে হবে। আমরা বঙ্গবন্ধুর বাসা পর্যন্ত ব্যান্ড বাজিয়ে, প্যারেড করে গেলাম। তখন একটা বিষয় ছিল, মিছিলের দূরত্ব যত বাড়ত, মিছিলের পরিধি, পরিসর এবং জনসংখ্যাও তত বাড়ত।

অথচ এখন দেখা যায় মিছিল যত এগিয়ে যায়, মিছিল ততই খাটো হয়। যাই হোক, আমরা পল্টন থেকে ল ল জনতার মিছিল এবং প্যারেড নিয়ে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসা পর্যন্ত গেলাম, বঙ্গবন্ধু বেরিয়ে এলেন, আমি ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে মালা পরালাম, সেই ছবিও বহু পত্রিকায় পরের দিন ছাপা হয়েছিল। এরপর বঙ্গবন্ধুর হাতে পতাকা দিয়ে আমরা ২৩ মার্চের কর্মসূচির সমাপ্তি ঘোষণা করলাম। অন্যদিকে আমরা ২৩ মার্চ রাতেই ঘোষণা করলাম যে, মিরপুর এবং মোহাম্মদপুরের যে সব বাড়িতে পতাকা উঠে নাই সেসব বাড়ির বিদ্যুৎ, পানি এবং গ্যাসের লাইন বিচ্ছিন্ন করে দিতে হবে। তারা বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে পতাকা তোলে নাই।

তাই তারা এদেশের নাগরিক সেবা পেতে পারে না। এ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই এসব এলাকার পানি, বিদ্যুৎ এবং গ্যাসের লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছিল। এসব ঘোষণা সেসময় বঙ্গবন্ধুর পে দেয়া সম্ভব ছিল না, কারণ এসব ঘোষণা দিলে তিনি বিচ্ছিন্নতাবাদী বা উগ্রপন্থী হিসেবে চিহ্নিত হতেন। তাই এসব ঘোষণা দিতাম আমরা। এটাই ছিল আমাদের রাজনৈতিক কৌশল।

পাকিস্তানীরা কৌশল নিচ্ছিল আমাদের দমন করতে। আর আমরা রাজনৈতিক কৌশল নিয়েছিলাম সারা বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধুর একক নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ করতে। এর ফল আমরা পেয়েছিলাম, যেদিন বঙ্গবন্ধু বঙ্গভবনে প্রবেশ করলেন, সেদিন এমন একজন বাঙালি পুলিশও ছিল না যে ‘জয়বাংলা’ বলে শ্লোগান দেয়নি। সেদিন ইয়াহিয়া খানের জন্য সেনা এবং পুলিশ বাহিনীর বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু ল জনতার জয় বাংলা ধ্বনিতে সবাই থতমত খেয়ে গিয়ে ছিল।

অন্যসব কিছুই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। ২৫ মার্চ রাতে যে আক্রমণ হবে সে খবরটিও আমরা জানতাম। আক্রমণ আসার পর আমরা কোথায় যাব, কি করব? আবার কোথায় গিয়ে একত্রিত হব, কিভাবে সিদ্ধান্ত নিব, নেতৃত্ব দিব- এইসব ঠিক হলো। আমরা একটা রুট ঠিক করে নিলাম, কলাইতলী হয়ে রায়ের বাজার দিয়ে বেরিয়ে পদ্মা নদী পার হয়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কলকাতা চলে যাব। কিন্তু ২৫ মার্চ অবাঙালি নেতারা এসে বঙ্গবন্ধুকে বললেন, ‘আপনি ছাত্র নেতাদেরকে পাঠান, ছাত্রনেতারা এলে আমরা ২৬ মার্চ সকালে বৈঠক করব।

’ এর আগে বায়তুল মোকাররমের ছাদে জনতা ব্যাংকের এম্প­য়ীজ এসোসিয়েশনের কনফারেন্স হয়ে গেছে, সেইখানে আমি তখন একটি জনসভায়; তখন বিডিআররা (তৎকালীন ইপিআর) এসে আমাকে বলেছে যে, ‘আমরা অস্ত্র নিয়ে বেরুব রাস্তায়’। অর্থাৎ ক্র্যাকডাউন হবে, এই খবরটা আমাদের কাছে ছিল। বঙ্গবন্ধুর কাছেও হয়ত এই খবরটা ছিল। যাই হোক, সেই সভায় আমি বললাম, ‘দখলদার কর্তৃক অধিকৃত বাংলায় এই আমার শেষ ভাষণ। এরপর দখলমুক্ত বাংলাদেশে স্বাধীনতার সূর্য শিখার নিচে এসে ভাষণ দিব’।

এরপর বঙ্গবন্ধুর বাসায় গেলাম, মাখন, কাজী ফিরোজ, মাসুদসহ অনেকেই। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘একটা ভাল খবর আছে। বিহারীরা তোমাদের সঙ্গে কথা বলতে চায়। তোমরা সেখানে যাও। ’ বঙ্গবন্ধুর মধ্যে শিশুসুলভ একটা সরল মানসিকতা ছিল।

কেউ কিছু বললে, তিনি সেটা সহজ মনে নিতেন এবং বিশ্বাস করতেন। অবাঙালি নেতাদের কথাও তিনি সেভাবেই বিশ্বাস করেছিলেন। তাই আমাদের সেখানে যেতে বলেছিলেন। আমরা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তাদের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখলাম কোনো কাজের কথার বালাই নেই, শুধু উষ্ণ অভ্যর্থনা আর অনর্থক কথা বলে সময়পেণ হচ্ছে।

এক পর্যায়ে আমরা সেখান থেকে বেরিয়ে আসলাম। ফিরে আসলাম বঙ্গবন্ধুর কাছে। তিনি জানতে চাইলে বললাম, ‘ওখানে কাজের কোন আলাপ হয়নি। উনারা আলোচনার নামে শুধু অনর্থক সময় নষ্ট করছিল, তাই আমরা চলে এসেছি। ’ আমরা বঙ্গবনন্ধুর কাছে সমম্ভাব্য ক্র্যাকডাউনের কথা বললাম।

খবরটা বঙ্গবন্ধুর কাছেও ছিল। আমাদের পূর্ব নির্ধারিত সিদ্ধান্তের কথাও জানালাম। আমি বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়ে বললাম, ‘আমাদের সঙ্গে গাড়ি আছে। আপনিও চলেন, আমরা আপনাকে নিয়ে চলে যাব। ’ বঙ্গবন্ধু উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, ‘...আমাকে পালিয়ে যেতে বল? তোমরাও কেউ পালাবা না।

কিপ দ্য কন্ট্রোল’। আমি উনাকে বললাম, ‘ওরা তো আপনাকে মেরে ফেলবে। ’ তিনি বললেন, ‘তবে, আমার রক্তেই স্বাধীন হোক দেশ। ’ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময়ও আমি তার এরকম অভিব্যক্তি দেখেছিলাম। আমাদের মনোবল ধরে রাখার জন্যই এ ধরনের আচরণ করতেন নাকি উনি বাস্তবতাকে পুরোপুরি গ্রাহ্য করতেন না বা উপলব্ধি করতেন না- এ বিষয়টা তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমরা বুঝতে পারিন।

লেখক : মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, সাবেক সংসদ সদস্য ও আহ্বায়ক, প্রাক্তন ছাত্রলীগ ফাউন্ডেশন  ।

Notice (8): Undefined variable: next_posts [APP/View/Posts/view.ctp, line 142]

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।