আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলার বধু মুখে তার মধু নয়নে নিরব ভাষা

হরবোলা গতকাল ছিল বিশ্ব নারী দিবস। হরেক রকমের বক্তৃ্তা, বিবৃতি ও আলোচনা সভা, রেলি হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে নারীরা কি চায় আজও জানা যায়নি। কথায় আছে নারীর মন বিধাতাই বুঝেন না। আমি কোন ছার।

তাছাড়া মহান পদার্থবিজ্ঞানী (কসমো) স্টিফেন হকিং নারীকে সবচেয়ে রহস্যময়ী মনে করেন। শুধু রহস্যময়ী নয়, সবচেয়ে আনপ্রিডিক্টেবলও বটে। একেবারে যুক্তরাজ্যের আবহাওয়ার মত। যাক্। ফাও প্যাঁচাল বাদ।

এই বঙ্গদেশে নারীর উন্নয়ন, কল্যাণ ও ক্ষমতায়নের জন্য যুগযুগ ধরে অনেক সভা, সমিতি, সেমিনার ও সিম্পোজিয়াম হয়েছে। হয়েছে অনেক নারী কল্যাণ সমিতি। তথাপি এই দেশের নারী সমাজ অকল্যাণের মাঝে দিনাতিপাত করছে। যেসব মহিয়সী নারী এ’দেশের নারী কল্যাণে লেখালখি করেছেন তাদের মাঝে বেগম রোকেয়ার রক্ষণাত্নক, তসলিমা নাসরিনের আক্রমণাত্নক ও হালের আকিমুন রহমানের গবেষণা ও বুদ্ধিভিত্তিক লেখার জুড়ি মেলা ভার। উনাদের সমালোচনা করার দুঃসাহস আমার নেই।

তবে এইটুকুন বলি, উনারা যাদের জন্য লিখেন তারা কি উনাদের লেখায় অনুপ্রাণিত না বিরক্ত, না অন্যকিছু। আমার বোনদের জীবন থেকে নেয়া গল্প কি বলে। আমার পাঁচ বোন। বড় তিন, ছোট দুই। বর্তমানে সবাই বিবাহিত ও সুখে স্বামীর সংসার করছে।

আমার বড় বোনের বিয়ে হয় আমার চার বছর বয়সে। সে স্মৃতি আমার মনে নাই। বড় বোনের বিয়ের পর বাবা মারা যায়। আমাদের বাকীটা পথ মায়ের হাত ধরে। ফলে আমার বাবাকে কন্যাদায় গ্রস্থ পিতার অপবাদ সহ্য করতে হয়নি।

সকল ধকল আমার মায়ের উপর। আমার এক একটা বোন বিবাহ উপযুক্তা হন আর আমার মায়ের বয়স বেড়ে যায় পাঁচ বছর। বর্তমানে আমার ৭০ বছরের মাকে ৯০ বছর মনে হয়। আজ আমার মেজ বোনের গল্প দিয়ে শেষ করব। আমি যখন অষ্টম শ্রেণীতে আমার মেজ বোন বিবাহ উপযুক্তা।

আপুর গায়ের রঙ শ্যামলা। তাই আমার মায়ের কপালে কয়েক খানা ভাঁজ পড়েছে। কারণ আপু আইবুড়ো হয়ে যাচ্ছে। আহা! সবাই মাকে সহানুভুতি জানাচ্ছে। কি যে সেসব ভাষা।

আমার মা সর্বংসহা। একদিন আমার ছোট চাচা একটি সুসংবাদ দিলেন। তিনি একটি সম্বন্ধ ঠিক করেছেন। ছেলে ব্যাংক চাকুরে। বলে রাখা ভাল আপু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা।

একদিন বর পক্ষ আপাকে দেখতে আসবেন। আমরা ছোট ভাই-বোনেরা মহা খুশী। কিন্তু মায়ের চোখে ঘুম নেই। কিভাবে অতিথি আপ্যায়ণ করবেন। তার শ্যাম বর্ণের মেয়েটাকে গৌর বর্ণের তথা দুধে আলতা করার বাসনায় কত অপচেষ্টাই না করেছেন।

মায়ের সেসব আয়োজনে আপু রীতিমত বিরক্ত। কিন্তু মাকে বলতে পারছেনা। কারণ গায়ের রঙ সব নষ্টের মূল। সে সময়ে ফেনীতে বিউটি পার্লার ছিল না। তথাপি মা তার অভিজ্ঞতার চুড়ান্ত ব্যবহার করলেন।

কাঁচা হলুদ, ডাবের পানি, কাঁচা শঁসা, দুধের সর, ডিমের কুসুম আর কত কি, সে বয়েসে আমার সব মনে নেই। হায়রে পারসনা, হায়রে সুমন অ্যারোমা তোমরা তখন ছিলেনা। যথাসময়ে বরপক্ষ আমাদের বাসায় হাজির। আমার ছোট চাচা, মা ও ফুট ফরমায়েশ খাটার জন্য আমি। আর বরপক্ষে বরের ছোট বোন, বয়ষ্ক চাচা ও বরের মা এসেছেন।

বরের চাচার বয়েসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ দাঁড়ী আছে। দেখতে খুব পরহেজগার বান্দা মনে হয়। কথায় কথায় আল্লার নাম নেন। মা আপুকে শাড়ী পরিয়ে তিন দু’গুনে চার চক্ষুর সামনে হাজির করলেন। মা দোয়া ইউনুছ পড়ছেন।

আমি বরের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বরটা পিটপিট করে আপুকে দেখছে। এরই মধ্যে বরের চাচা আপুকে জিজ্ঞেস করল, “নামাজ পড় মা?” আপু বললেন পড়ি। কোরান শরিফ পড়? আপু-হ্যাঁ পড়ি। সুরা কাফেরুন পড়তো মা।

পাঠকমাত্র জানেন, সুরা কাফেরুন এর প্যাঁচ খোলা এত সহজ নয়। আপুও পারলেন না। বরের চাচা আমার মাকে বেয়াইন সাহেবা সম্বোধন করে বললেন, “মেয়েকে কোরান শরিফটাও শেখাননি!” আফসোস্! আদব লেহাজ শিখিয়েছেনতো বেয়াইনসাহেব? আমার ছোট চাচাও মাকে আপরাধী মনে করলেন। লজ্জায় আমার মায়ের চোখে পানি। ঘোমটায় ঢাকার বৃথা চেষ্টা।

আমার ভীষণ রাগ হচ্ছিল বুড়ো লোকটার উপর। ঐ বয়সে ও ইচ্ছে করছিল কষে দু’টো ঘুষি মারি। সম্বন্ধ ভেস্তে গেল। পরে আপুর বিয়ে হয়েছিল এক স্কুল মাস্টারের সাথে। যিনি একজন প্রগতিশীল ও সুন্দর মনের মানুষ।

আমার মা শুধু কন্যাদায় গ্রস্থ মাতা নন, ভাগ্য দোষে পুত্রদায় গ্রস্থ মাতা ও বটে। যুগের পরিবর্তন হয়েছে। আজকাল ছেলেরাও আইবুড়া হয়, মেয়েরা ক্লাসমেটকে পছন্দ করে বলে। আমার মায়ের দুর্ভাগ্য উনি কারো মেয়েকে সুরা কাফেরুন জিজ্ঞেস করতে পারেন নি। বেচারী! তার জন্য আমার খুব করুনা হয়।

কিছুদিন আগে আমার মা এক মেয়েকে সুরা কাফেরুন জিজ্ঞেস করার জন্য প্রবৃত্ত হলেন। মেয়ে ঢাবির ম্যানজম্যান্টে স্নাতকোত্তর করেছে মাত্র। মায়ের মুখে শুনা-মেয়েটি বুদ্ধিমতী, যথোপযুক্ত উচ্চতা সম্পন্ন। কিন্তু গায়ের রঙ কালো বলে আমার সেই মেজ আপু মাকে নিরুৎসাহিত করলেন। তবুও আমার মা আমাকে মেয়েটার কথা জানালেন এবং ভৈরব গিয়ে দেখে আসতে বললেন।

মেয়েটির মায়ের ফোন নাম্বার দিলেন আমাকে। আমি আনকোড়া, সরাসরি ফোন করলাম মেয়ের মাকে। মেয়েটার ঠিকানা নিয়ে ফেইসবুকে রিকোয়েস্ট পাঠালাম। সে একসেপ্ট করল। আমি তার, সে আমার ছবি দেখল।

প্রাথমিকভাবে দু’জন দু’জনার। এবার মুখোমুখী বসার পালা। মেয়েটি আমাকে ভৈরব যেতে বলল। আমি তাকে বললাম এই বঙ্গদেশে যুগযুগ ধরে ছেলেরা মেয়ে দেখে। আপনিতো ঢাবির ছাত্রী আসুন না একবার ঢাকায় আমাকে দেখার জন্য।

বসি, আমার বাসার কাছে ওয়েস্টার্ন গ্রীলে অথবা জিনজিয়াং–এ। আমার সাথে আমার মা থাকবেন। আপনি আমাকে আমার উচ্চতা জিজ্ঞেস করবেন। এতদিন বিয়ে করিনি কেন জিজ্ঞাসিবেন। আমি গান গাইতে পারি কিনা জানবেন।

আমার মাকে জিজ্ঞেস করবেন ছেলেকে গান শিখায়নি কেন? চাইলে আমাকে সুরা কাফেরুনও জিজ্ঞেস করতে পারেন। আমিও মুখস্থ পারিনা। মেয়েটি ওই দিন রাখি বলে রেখে দিল। পরদিন ফেইসবুকে আমাকে ব্লক করে দিল। আমি মেয়েটির মাকে ফোন দিলাম।

কারন আমি আমার মাকে সম্মান করি। সম্মান করি আমার বোনকে। বউকে প্রাপ্য সম্মান করার শিক্ষাও আমার মা আমাকে দিয়ে রেখেছেন। কিন্তু মেয়েটির মা তথা ভদ্র মহিলার এক কথা। তোমার মাকে আমাদের যা বলার বলে দিয়েছি বাবা।

মাকে জিজ্ঞেস করলাম ওরা কি জানিয়েছে? মা বললেন, “তোমার মত পাগল ছেলে যার আছে তাকে লোকে যা খুশী বলতে পারে। ” তার মানে তারা কি আমাকে পাগল বলেছে? শুধু পাগল না মেয়ে বলেছে তোমার মাথায় দোষ আছে। সাথে তোমাকে হেমায়েতপুরে ভর্তি করানোর ব্যাবস্থাপত্রও দিয়েছে। শ্রদ্ধেয়া বেগম রোকেয়া, তসলিমা নাসরিন ও আকিমুন রহমান আমাকে পাগল বলার কারণ জানাবেন কি? আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রী পড়াই। সিভিল সার্জন থেকে সুস্থতার সনদপত্রও জমা দিয়েছি।

মাননীয়া, আপনারা যতই লিখুন না কেন, বঙ্গনারীরা এখনও নাকে নোলক ও নাখফুল, কানে দুল, কো্মরে বিছা, বেনারসী শাড়ীতে, পায়ে নুপুর পরিয়া ঝুনঝুনি বাজিয়ে পূরুষকূলকে আকৃষ্ট করতে ভালবাসে। এখনও এক নারী অপর নারীকে সম্মান করতে শিখেনি। এরা পরনের বোরখা পেলে দিলেও মনের বোরখা অপসারণ করতে পারেনি। এরা এখনও অবলা সেজে সুবিধা নিতে ভালবাসে। সম্মুখযুদ্ধে অবতীণ হতে সাহস পায়না।

এরা পতিসেবা করে বেহেস্ত পাবার আশায় বিভোর। এরা খেলোয়াড়ের চেয়ে দর্শক হতে ভালবাসে। যারা এদের জন্য কলম ধরেছ, এরা তাদের ঘৃণা করে। এদের মাজা সোজা না থাকলেও ভাবের ঠাট আছে। এরা শিঃরদাড়া সোজা করতে না পারলেও ক্লিনটনকে বিবাহ করিবার জন্য নির্ঘুম রাত কাটাতে পারে।

বঙ্গদেশের পূরুষকূল এখনও বুক ফুলিয়ে, মেরুদণ্ড খাড়া করে হাত নাড়িয়ে বলতে পারে নারীর পূ্র্ণতা পূরুষে। পূরুষের পূ্র্ণতা নারীতে এ’কথা বলার সৎসাহস বঙ্গনারীদের হয়েছে কি? ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.