আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চিরঞ্জীব বায়ান্নোর ভাষাশহীদগণ

দেয়ালে দেয়ালে ছায়া দিয়ে লেখা মিথ্যা স্লোগান সত্যি হয়ে উঠুক একদিন মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা ও অধিকার রক্ষার্থে রক্ত ও জীবন সঁপে দেওয়া শহীদগণ বাংলার অমর সন্তান। বায়ান্নোর এই দিনে তাঁরা বিজাতীয় সরকারের পুলিশ বাহিনীর উদ্ধত বুলেটের মুখে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে শামিল হয়েছিলেন। শাসকের বুলেটে ছিন্নভিন্ন হয়েছিল তাঁদের শরীর। জাতি হয়েছিল শোকে স্তব্ধ। কিন্তু এদেশের ভূমিপুত্রদের সংগ্রামী চেতনায় সেই শোক অচিরইে শক্তিতে রূপান্তরিত হয়।

সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এদেশের ভূখন্ড থেকে শত্র“দের বিতাড়িত করে তাঁরা। প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। সচেতন ও সংঘবদ্ধ জাতি হিসেবে পরিচিত বাঙালির জাতিসত্ত্বাকে বিনষ্ট করার লক্ষ্যে প্রথমেই আঘাত আনা হয় বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর। রুখে দাঁড়ায় গোটা জাতি। প্রতিবাদের চরম প্রকাশ ঘটে বায়ান্নোর একুশে ফেব্র“য়ারি।

এদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের সামনে আমতলায় সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদ কর্তৃক এক বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সিদ্ধান্ত হয় পূর্ব-ঘোষিত ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার। বেলা একটার পর চারজন করে ছাত্র-ছাত্রীরা পুলিশের লাঠির ব্যারিকেড ভাঙে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করে সর্বস্তরের জনতা। পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিচার্জ, টিয়ার গ্যাস ছুঁড়ে এবং গণগ্রেপ্তার চালায়।

কিন্তু বাঙালির চোখে সেদিন ছিল ভয়ের পরিবর্তে ঘৃনার আগুন। তাই পিছু হটেনি। এরই এক পর্যায়ে বেলা তিনটার দিকে পুলিশ হোস্টেল চত্বরে ঢুকে নির্মমভাবে গুলি চালাতে থাকে। ঘটনাস্থলেই শহীদ হন কয়েকজন। এদিন মোট কতজন শহীদ হন তার সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি।

কারন, পরের দিন তাদের জানাজা হবে ছাত্ররা মাইকে এই ঘোষনা দিলে সে রাতেই মিলিটারী ও পুলিশ অনেক শহীদের লাশ ঢাকা মেডিকেলের মর্গ হতে গুম করে ফেলে। যাঁদের লাশ পাওয়া যায় তাঁরা হলেন : রফিকউদ্দিন আহমেদ, আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, আবদুস সালাম, শফিউর রহমান, অহিউল্লাহ, আবদুল আওয়াল ও একজন বালক। এঁদের মধ্যে প্রথম চারজন ২১ ফেব্র“য়ারিতেই হসাপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনজন ২২ তারিখে শহীদ হন। ২২ ফেব্র“য়ারিতে জানাজার পর শহীদদের স্মরণে বিশাল শোক মিছিল প্রদক্ষিণ করে।

সে মিছিলে সশস্ত্র বাহিনী একটি ট্রাক চালিয়ে দিলে আবদুল আওয়াল নামে আরেকজন নিহত হন। পাকসরকার অজ্ঞাত পরিচয় এক বালকের মৃত্যুর মতো এ ঘটনাকেও নিছক দুর্ঘটনা বলে মিথ্যা বিবরণী সম্বলিত প্রেসনোট জারি করে। একইসঙ্গে অন্যান্য ভাষা-শহীদদের নামে অপপ্রচার চালানোর প্রয়াস গ্রহণ করে। ভাষাশহীদ রফিক উদ্দিন আহমেদ (১৯২৬- ১৯৫২) ১৯২৬ সালের ৩০ অক্টোবর মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলার বলধারা পারিল (বতর্মানে রফিকনগর) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন রফিক উদ্দিন আহমেদ। বাবা আবদুল লতিফ মিয়া, মা রাফিজা খাতুন।

প্রাথমিক পড়াশুনা শেষে তিনি বাড়ী থেকে ৭ মাইল দুরে অবস্থিত বায়রা উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৪৯ সালে এখান থেকে ম্যাট্রিকুলেশ পাশ করে ভর্তি হন দেবেন্দ্র কলেজে। এখানে অধ্যয়নকালেই তিনি ঢাকায় এসে পিতার সঙ্গে প্রেস পরিচালনা করতে শুরু করেন। পুনরায় ভর্তি হন জগন্নাথ কলেজে। এই কলেজে পড়ার সময়ে তিনি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন।

রফিক ভালোবাসতেন একই গ্রামের মেয়ে রাহেলা খাতুন পানুকে। তাঁদের এ ভালোবাসাকে মেনে পারিবারিকভাবে বিয়ের দিনক্ষন ঠিক করা হয়। ২১শে ফেব্র“য়ারী বিয়ের শাড়ী-গহনা ও কসমেটিকস নিয়ে সন্ধ্যায় তাঁর বাড়ী ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু রফিকের কাছে তখন ব্যক্তিগত প্রেম-ভালোবাসার চেয়ে দেশমাতার ভাষা-সংস্কৃতি রক্ষার আবেদন বড় হয়ে দেখা দেয়। আর তাই বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সামনে থেকে মিছিল বের হবে শুনে ছুটে যান ছাত্র-জনতার সমাবেশে।

সমাবেশে ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে মিছিল করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে তিনি এ মিছিলের অগ্রভাগে অংশগ্রহণ করেন। এ ঘটনায় দিশেহারা পাক-সরকার পুলিশকে ছাত্র-জনতার মিছিলে গলি চালানোর নির্দেশ দেয়। গর্জে ওঠে আগ্নেয়াস্ত্র। রফিক উদ্দিনের মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হোস্টেল প্রাঙ্গনে থাকা অবস্থাতেই পুলিশি হামলার শিকার হয়। হঠাৎ একটি গুলি এসে রফিকের মাথায় লাগে, উড়ে যায় মাথার খুলি।

ঘটনাস্থলেই শহীদ হন তিনি। ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ রফিক উদ্দিন আহমেদ। পাকিস্তান সরকার তাঁকে মেরেই ক্ষান্ত হয়নি, ঢাকা মেডিক্যাল থেকে তাঁর লাশ লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা চালায়। এরপর প্রবল জনরোষের চাপে পরদিন শহীদ রফিককে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হলেও তাঁর কবরের কোন চিহ্ন রাখেনি পাক-সরকার। মাতৃভাষার সম্মার রক্ষার্থে নিজের ভালবাসার মানুষ, নতুন জীবনের স্বপ্ন ও সম্ভাবনাকে বিসর্জন আর জীবনের সবচয়ে মূল্যবান জীবন বিলিয়ে দিয়ে তিনি গোরস্থানের হাজারো কবরের ভিড়ে মিশে যান।

২০০০ সালে বাংলাদেশ সরকার ভাষাশহীদ রফিককে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করেন। এরপূর্বে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান প্রশিকার উদ্দ্যোগে তাঁর বাড়ী সংলগ্ন একটি ছোট লাইব্রেরী গঠন করা হয়। এখানে সাহিত্য ও সংস্কৃতিপ্রেমী শহীদ রফিকের বইপত্র ও অন্যান্য স্মৃতি সংরক্ষেণের প্রয়াস পাওয়া হয়। এরপর ২০০৬ সালে সরকারিভাবে তারঁ নিজ গ্রামে ভাষাশহীদ রফিক উদ্দিন পাঠাগার ও স্মৃতি যাদুঘর স্থাপন করা হয়। গ্রামের নামকরণ করা হয় রফিকনগর।

ভাষাশহীদ আব্দুল জব্বার (১৯১৯- ১৯৫২) ১৯১৯ সালের ১০ অক্টোবর ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও উপজেলার পাঁচাইর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন আব্দুল জব্বার। পিতা হাছেন আলী (মতান্তরে আব্দুল কাদের), মাতা সাফাতুন নেছা। স্থানীয় ধোপাঘাট কৃষিবাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশুনা চলাকালে আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে এক পর্যায়ে তা বন্ধ করে দেন। যুক্ত হন পৈত্রিক পেশা কৃষিকাজে। এরপর ১৫ বছর বয়সে তিনি পরিবারের সঙ্গে অভিমান করে ভাগ্যান্বেষনে বেরিয়ে পড়েন।

কাজ নেন নারায়গঞ্জ জাহাজঘাটে। বছর খানেক কাজ করার পর সেখানে তাঁর সঙ্গে এক ইংরেজ নাবিকের সখ্য গড়ে ওঠে। নাবিক আব্দুল জব্বারকে বর্তমান মিয়ানমারের রেঙ্গুন শহরে একটি চাকরির ব্যবস্থা করে দেন। সেখানে তিনি ১০-১২ বছর চাকরী করে পুনরায় নিজ গ্রামে ফিরে আসেন। গ্রামে ফিরে তিনি স্থানীয় তরুণ-যুবকদের নিয়ে নিয়ে একটি গ্রাম্য ডিফেন্স দল গঠন করেন।

এরপর ১৯৪৯ সালে তিনি তাঁর এক বন্ধুর বোন আমেনা খাতুনকে বিয়ে করেন। ১৯৫১ সালের শেষের দিকে সংসারে তাঁদের একমাত্র ছেলে নুরুল ইসলাম বাদলের জন্ম হয়। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্র“য়ারীর ২ দিন আগে তিনি তাঁর ক্যান্সারাক্রান্ত শাশুড়ীকে চিকিৎসা করাতে ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তি করান। ঢাকা মেডিক্যালের বাইরে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যা¤পাসে তখন বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষার দাবীতে ছাত্র-জনতা সোচ্চার। শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত ঢাকার রাজপথ।

জীবন-সংগ্রামের লড়াকু সৈনিক আব্দুল জব্বার শামিল হন স্বজাতির ভাষা ও সংস্কৃতির সংগ্রামে। গুলিবিদ্ধ হওয়ার কিছুক্ষণ আগে তিনি অসুস্থ শাশুড়ীর জন্য কিছু ফল কিনতে মেডিকেলের গেইটের বাইরে এসে ছাত্র-জনতার সমাবেশ-মিছিল দেখে ফল কেনার কথা ভুলে একটি ব্যানার হাতে মিছিলের অগ্রভাগে এসে দাঁড়ান। এর কিছু সময় পরেই ছাত্র-জনতার মিছিল-সমাবেশ লক্ষ্য করে পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি বর্ষণ শুরু করে। আব্দুল জব্বার গুলিবিদ্ধ হন। গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হয়।

কিন্তু অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তিনি কিছুক্ষণ পরেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। ঢাকার আজিমপুর পুরনো কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়। ২০০০ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ভাষাশহীদ আব্দুল জব্বারকে মরনোত্তর ২১শে পদক দিয়ে সম্মানিত করেন। ভাষাশহীদ আবুল বরকত (১৯২৭-১৯৫২) ১৯২৭ সালের ১৬ জুন (মতান্তরে ১৩ জুন) ওপার বাংলার মুর্শিদাবাদ জেলার ভরতপুর থানার বাবলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আবুল বরকত। বাবা শামসুদ্দিন, মা হাসিনা বিবি।

তাঁরা আবুল বরকতকে আদর করে আবাই বলে ডাকতেন। পিতার কাছ থেকে হাতেখড়ি, এরপর প্রাথমিক শিক্ষা। ১৯৪৫ সালে পার্শ্ববর্তী গ্রাম তালিবপুর ইংলিশ হাই স্কুল থেকে মেট্রিক এবং ১৯৪৭ সালে বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। এরপর চলে আসেন বাংলাদেশে, ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। ১৯৫১ সালে তিনি স্নাতকে দ্বিতীয় শ্রেনীতে চতুর্থ স্থান অর্জন করে স্নাতকোত্তর শ্রেণীতে (এম.এ) ভর্তি হন।

ইতোমধ্যে ঢাকাসহ সারাদেশ মাতৃভাষা বাংলার রাষ্ট্রভাষা দাবিতে উত্তাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর কেন্দ্র। আবুল বরকত কেবল এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে নন, একজন বাংলাভাষী মানুষ হিসেবে এ আন্দোলনে আলোড়িত হয়ে ওঠেন। এ চেতনা থেকেই আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হয়ে নিয়মিত মিছিল-মিটিং ও লিফলেট-পোস্টার-দেওয়াল লিখনে অংশ নেন তিনি। এরই অংশ হিসেবে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্র“য়ারী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের সামনে আমতলায় সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদ কর্তৃক আয়োজিত সমাবেশে যোগদান করেন তিনি। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্রজনতার শ্লোগানে শ্লোগানে কেঁপে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যা¤পাস।

শুরু হয় পুলিশের সঙ্গে ছাত্র-জনতার সংঘর্ষ। সংঘর্ষের প্রথম পর্যায় থেকেই পুলিশ ছাত্রদের ব্যারিকেড ভেঙ্গে হোস্টেল চত্বরে ঢুকতে চেষ্টা করে। কিন্তু ছাত্রদের শক্ত প্রতিরোধের কারনে তারা ব্যর্থ হলেও বেলা ৩ টার দিকে হোস্টেল চত্বরে ঢুকতে সক্ষম হয়। শুরু হয় নির্বিচার গুলিবর্ষণ। এ সময় আবুল বরকত তাঁর এক বন্ধুকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসলে হঠাৎ ঘাতক পুলিশের একটি বুলেট তাঁর তলপেট বিদ্ধ করে।

সঙ্গে সঙ্গে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন, রক্তের ধারায় ভিজে যায় পরনের নীল হাফ শার্ট, খাকি প্যান্ট, স্যান্ডেল আর মাটি। গুলির ভয়কে উপেক্ষা করে কয়েকজন ছুটে আবুল বরকতকে কাঁধে তুলে ঢাকা মেডিকেলের জরুরী বিভাগে নিয়ে যান। উপস্থিত ডাক্তাররা আবুল বরকতকে বাঁচাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাতে থাকেন। কিন্তু অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের জন্য সকলের চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে ২১ ফেব্র“য়ারী রাত ৮ টায় আবুল বরকত শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। অন্যদিকে, ছাত্ররা মাইকে পরের দিন শহীদদের জানাজা অনুষ্ঠিত হওয়ার ঘোষণা দিলে সরকারি পুলিশ ও সেনাবাহিনী রাতেই মেডিকেলের মর্গ থেকে লাশ গুম করা শুরু করে।

এ সময় শহীদ আবুল বরকতের মামা পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা আব্দুল মালেক এবং আরেক আরেক আত্মীয় এস.এম.জি. বিভাগের কর্মকর্তা আবুল কাসেমের আন্তরিক প্রচেষ্টায় তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। এ রাতেই কড়া পুলিশ প্রহরায় আজিমপুর পুরাতন গোরস্থানে শহীদ আবুল বরকতকে সমাহিত করা হয়। ২০০০ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার শহীদ আবুল বরকতকে মরনোত্তর ২১শে পদক প্রদান করেন। ভাষাশহীদ শফিউর রহমান (১৯১৮- ১৯৫২) ১৯১৮ সালের ২৪ জানুয়ারি কোননগর, হুগলী, চব্বিশ পরগণা, পশ্চিমবঙ্গে শফিউর রহমান জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মৌলবী মাহবুবুর রহমান দেশবিভাগ পরবর্তী সময়ে ঢাকার পোস্ট এন্ড টেলিগ্রাফ অফিসের সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পড়াশুনা শেষ করে শফিউর রহমান কলকাতার গভর্ণমেন্ট কমার্শিয়াল কলেজে ভর্তি হন। এখান থেকে আই.কম. পাস করে চব্বিশ পরগনা সিভিল সাপ্লাই অফিসে অ্যাকাউনটেন্ট হিসেবে চাকরি শুরু করেন। ১৯৪৭ সালে তিনি পরিবারের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ঢাকায় চলে আসেন। এরপর তিনি বি.এ. ক্লাসে ভর্তি হন এবং ঢাকা হাইকোর্টে হিসাবরক্ষণ শাখায় চাকরি গ্রহণ করেন। ঢাকায় আসার পূর্বে ১৯৪৫ সালে তিনি আকিলা খাতুনের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।

১৯৪৯ সালে জন্ম নেয় তাঁদের প্রথম সন্তান শাহনাজের। দ্বিতীয় সন্তান শফিকুর রহমান জন্ম নেয় তাঁর পিতার মৃত্যুর পর, ১৯৫২ সালের মে মাসে। প্রতিদিনের মতো ২২ ফেব্র“য়ারী শফিউর রহমান সকাল দশটায় সাইকেল নিয়ে অফিসে রওনা হন। সকাল সাড়ে দশটার দিকে রাথখোলা, নবাবপুর রোডে ২১শে ফেব্র“য়ারীতে নিহত ভাষা শহীদের স্মরণে জন সমাবেশ, গণমিছিল ও বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবিতে বিক্ষোভ শুরু হলে শফিউর রহমান এতে অংশগ্রহণ করেন। পুুলিশ এক পর্যায়ে বিক্ষোভরত জনতার উপর বেপরোয়া গুলিবর্ষণ করতে থাকলে তিনি খোশমহল রেষ্টুরেন্টের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতরভাবে আহত হন।

ঘটনাস্থল থেকে সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। কিন্তু প্রচুর রক্তক্ষরণে অস্ত্রোপচার সফল না হওয়ায় এদিন সন্ধ্যা সাতটায় শফিউর রহমান হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এরইমধ্যে পাকিস্তান সরকারের পুলিশ ও সেনাবাহিনী হাসপাতালে ঢুকে তাদের গুলিতে নিহত কয়েকজনের লাশ গুম করে ফেলে। এ সময় মিটফোর্ড হাসপাতালের ছাত্র মাহবুবুর রহমানের নেতৃত্বে কয়েকজন ছাত্র শহীদ শফিউর রহমানের লাশ ঢাকা মেডিকেলের স্টেরিলাইজ ডিপার্টম্যান্টে লুকিয়ে রাখেন। পাক-সরকারের ভয়ে ৩ দিন লুকিয়ে রাখার পর ঢাকা হাইকোর্ট গ্রন্থাগারের গ্রন্থাকারিক কামালউদ্দিন ঢাকার তৎকালীন এস.ডি.ও.-র নিকট থেকে অনুমতি নিয়ে মেডিকেল কলেজ থেকে লাশ বের করে এনে ২৪ ফেব্র“য়ারী রাত বারোটায় আজিমপুর গোরস্থানে দাফন করা হয়।

শহীদের স্ত্রীর জমানো একশত টাকা দিয়ে কবরের জায়গা কেনা হয়। সংরক্ষণ করা হয় শফিউর রহমানের রক্তমাখা শার্ট, কোট ও জুতা। বর্তমানে এগুলো বাংলাদেশ জাতীয় যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। অমর শহীদ শফিউর রহমানকে বাংলাদেশ সরকার ২০০০ সালে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করেন। ভাষাশহীদ আবদুস সালাম (১৯২৫- ১৯৫২) ১৯২৫ সালের ২৭ নভেম্বর ফেনী দাগনভুঁইঞা উপজেলার লক্ষণপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আবদুস সালাম।

পিতা মো. ফাজিল মিয়া প্রান্তিক কৃষক, মাতা দৌলতের নেছা গৃহিণী। ইচ্ছে ছিল পড়াশুনা করে বড় চাকরী করবেন। ভর্তি হন মাতুভূঞা করিম উল¬াহ উচ্চ বিদ্যালয়ে এবং এরপর ১৯৪২ সালে আতার্তুক উচ্চ বিদ্যালয়ে। কিন্তু পারিবারিক অস্বচ্ছলতার কারণে সালামের ম্যাট্টিক ফাইনাল পরীক্ষা দেয়া হয়নি। নিত্য অভাব-অনটন তাঁকে রোজগারের জেঠাতো ভাইয়ের হাত ধরে ঢাকায় নিয়ে আসে।

অনেক চেষ্টায় মিলে যায় মতিঝিল ডাইরেক্টার অব ইন্ডাষ্ট্রিজ এ পিয়নের চাকুরি। বসবাস করেন ৩৬ বি, নীলক্ষেত ব্যারাকে। বায়ান্নোর শুরু থেকেই ঢাকাশহর ভাষা আন্দোলনের কর্মসূচীতে উত্তাল হয়ে ওঠে। ২৭ বছর বয়সী টগবগে যুবক সালামের হৃদয়ও মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার অঙ্গীকারে কেঁপে ওঠে। চলমান আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ২১শে ফেব্রয়ারি হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রাঙ্গনে সমবেত হলে আবদুস সালাম তাতে যোগ দেন।

বেলা ৩ টার দিকে পুলিশ ছাত্র-জনতার মিছিলে নির্বিচার গুলি বর্ষণ করলে রফিক, বরকত, জব্বার প্রমুখের সঙ্গে সালামও গুলিবিদ্ধ হন। পেটে গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। টেলিগ্রামে খবর পেয়ে ফেনী থেকে মেডিকেলে ছুটে আসেন সালামের বাবা ফাজিল মিয়া, জ্যাঠাতো ভাই হাবিব ও প্রতিবেশী মকবুল আহমদ। বাবার উপস্থিতিতে হাসপাতালেই ২৫ ফেব্র“য়ারী বেলা সাড়ে ১১ টায় আবদুস সালাম মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। ২৬ ফেব্র“য়ারি বিকাল ৪টার দিকে মৃতদেহ ঢাকাস্থ আজিমপুর গোরস্থানে সমাহিত করা হয়।

পরবর্তীতে পাকসরকারের কারণে তাঁর কবরের চিহ্ন সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি। একইসঙ্গে উলে¬খ্য যে ১৯৯৯ সাল পযন্ত ভাষা শহীদ আবদুস সালামের কোন ছবি কোথাও সংরক্ষিত ছিলনা। ভাস্কর রাসার উদ্দ্যেগে শিল্পী সাহজাহান আহমেদ বিকাশের মাধ্যমে শহীদ সালামের পরিবারের সদস্যদের বিবরণ অনুযায়ী তৈরী করা হয় তাঁর বর্তমানে ব্যবহৃত ছবিটি। ২০০০ সালে বাংলাদেশ সরকার ভাষাশহীদ আবদুস সালামকে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করেন। একই বছরে ফেনী জেলার একমাত্র স্টেডিয়াম ভাষাশহীদ সালামের নামে নামকরণ হয়।

শহীদ সালামের জন্মস্থান লক্ষ্মনপুর গ্রামের নাম পরিবর্তন করে সরকারিভাবে সালামনগর হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। পাশাপাশি একটি স্মৃতি গ্রন্থাগার ও জাদুঘর নির্মান প্রতিষ্ঠা করা হয়। উল্লিখিত ভাষাশহীদদের সঙ্গে মাতৃভাষার জন্য প্রাণ হারায় রাজমিস্ত্রী হাবিবুর রহমানের ৯ বছর বয়সী শিশুপুত্র অহিউল্লাহ। পুলিশ তাঁর মৃতদেহ গুম করে ফেলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের সন্নিকটে পাওয়া যায় অজ্ঞাত-পরিচয় এক বালকের মৃতদেহ।

২২ ফেব্র“য়ারি ভাষাশহীদদের স্মরণে আয়োজিত শোকমিছিলে অংশ নিয়ে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান ২৬ বছর বয়সী রিক্সাশ্রমিক আব্দুল আউয়াল। বাংলাসহ পৃথিবীর সকল ভাষাভাষী মানুষের হৃদয়ে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার্থে শহীদগণ চিরস্মরণীয় আছেন। তাঁরা অমর অক্ষয় চিরঞ্জীব। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।