আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যৌনতা ভেদ আর নায়িকার মেদ

ডার্টি পিকচার করার জন্য ওজন বাড়িয়েছিলেন অভিনেত্রী বিদ্যা বালান। ২০১১ সালে মুক্তি পাওয়া প্রশংসিত এই মুভিটাতে বালান অভিনয় করেন সিল্ক স্মিতার রোলে। মুভিতে যদিও তার নাম থাকে রেশমা। স্মিতা দক্ষিণ ভারতীয় অভিনেত্রী, বিতর্কিত কেননা তিনি করতেন সফট পর্নো। তার সবচেয়ে আলোচিত মুভি ভান্দিচক্রম।

আত্মহত্যা করেন তিনি ১৯৯৬ সালে। ওজন বাড়িয়ে বালান কিছু ইরোটিক দৃশ্যে দেখা দেন। তার মধ্যে আছে কিছু গানের দৃশ্যায়ন। মুভিটা কেমন হোল বা বালান কেমন অভিনয় করলেন সেটা এস্থলে আমাদের আলোচনার বিষয় নয়। আমরা বিচার করার চেষ্টা করবো আশির দশকের একজন অভিনেত্রী হিশেবে পর্দায় দেখা দেবার জন্য বিদ্যা বালান-কে কেন ওজন বাড়াতে হয়েছিল? অন্যভাবে বলা যায়, সিল্ক স্মিতা কেন ওজনদার বা কিঞ্চিত মেদবহুল ছিলেন অধুনা নায়িকাদের চেয়ে? সিল্ক স্মিতা (১৯৬০-১৯৯৬) সিনেমায় যারা অভিনয় করতে আসেন, তাদের ক্ষেত্রে আমরা বলি, অমুকে সিনেমায় 'নেমেছে'।

পরিচলক বা যে ব্যাবসায়ী পুঁজি খাটান, তাদের ক্ষেত্রে 'নামা' বলা হয় না। অভিনেতা বা অভিনেত্রীদের বেলায় এই 'নামা' সামাজিকভাবে নামা নয়? আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি তাদের পেশাকে খুব একটা মর্যাদা দেয় না, বরং একটা তাচ্ছিল্য বা হেয় করার ব্যাপার থাকে। পুরুষরাই যেখানে 'নামেন', সেখানে নারীদের অবস্থা যে আরও মারাত্মক, সে কথা বোঝা সহজ। আরও একটা উদাহরণ নিয়ে আলোচনা করি। আরও অনেক কিছুর মতোই ইউরোপিয়ান থিয়েটার আমাদের দেশে আসে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির হাত ধরে।

ঠাকুরদের পয়সা ছিল, সবচেয়ে বড় কথা রুচি ছিল। কিন্তু ঠাকুর বাড়ির হাত ধরে যে থিয়েটার আসে, তা একান্তই শহুরে বাবুদের জন্য, গাঁয়ের চাষা বা জোলার নয়। তাদের 'থ্যাটার' হোল যাত্রা, এই যাত্রা আমাদের আপনার জিনিস, এর জন্য ইউরোপিয়ানদের দ্বারস্থ হতে হয়নি আমাদের। এইসব যাত্রাপালা আয়োজনের জন্য গরীব কৃষকের ভরসা ছিল গ্রামের ধনী মানুষগুলো-জমিদার বা তালুকদার-এরা। এরা শহর থেকে যাত্রার দল আনতেন।

প্রথমদিকে এইসব পালায় নারী চরিত্রগুলো করতেন পুরুষরাই। পরবর্তীতে নারীরা আসা শুরু করলেন। গাঁয়ের যাত্রা এবং বাবুদের শহুরে 'থ্যাটার'-দু'টোতেই। তবে প্রথমদিকে আমাদের শো-বিজনেসে যেসব নারীরা আসতেন, তারা একটি বিশেষ পরিমন্ডল থেকে আসতেন। এরা বেশিরভাগ সময় হতেন বারবনিতা।

বড় একটা উদাহরন হলেন দাসী বিনোদিনী (১৮৬২-১৯৪১)। নটী শব্দটি নটের স্ত্রী-বাচক। কিন্তু এখনো আমাদের বিভিন্ন স্থানীয় ভাষায় নটী বলতে সরাসরি দেহপশারিনী বোঝায়। কালে কালে ধারনা পাল্টায়। একসময় আমাদের বাবু কালচারে যেমন পুরুষদের ভুঁড়ি থাকাটাকে অবশ্যম্ভাবী ভাবা হতো, তবে সে আলোচনা অন্যত্র।

শিক্ষা এবং সময়ের সাথে আমাদের নারীরাও অনেক এগিয়ে গেছেন। কিন্তু নারী তো ততটুকুই আগায় যতটা পুরুষের পছন্দ। সিনেমায় নারী তাই যৌনতার প্রতীক হয়েই বর্তমান থাকে। সোফিয়া লরেন, জন্ম ১৯৩৪ পূব আর পশ্চিমের সিনেমায় নারীচিত্র রূপায়নে অবশ্য বিপুল প্রভেদ। সিনেমায় নারীকে কীভাবে প্রেজেন্ট করা হচ্ছে তা বিচার করে ঐ সমাজের যৌনতার মানদণ্ড কী তা বোঝা যেতে পারে।

সিনেমায় নারী পৃথুলা নাকি তার সরু কোমর, তার শরীরের কী দেখানো হচ্ছে, তার পোশাক-পরিচ্ছদ, পেশা, খাদ্য কী ইত্যাদি ঐ সমাজের পুরুষ মন এবং নারীর অবস্থান বোঝার একটা ভালো টুল হতে পারে। কেননা সিনেমা একটা পণ্য, তাকে বিক্রীত হতে হয়। কাজেই তার চাহিদা থাকতে হবে। দর্শক কী চাচ্ছে তা মাথায় রাখতে হবেই। প্রাচ্য বা পাশ্চাত্যের সিনেমার নারী চরিত্রের একটা বড় পার্থক্য খালি চোখেই দৃশ্যমান হয়।

পশ্চিমা নায়িকারা সাধারণত স্লিম হন। মেরিলিন মনরো-গ্রেটা গারবো-সোফিয়া লরেন থেকে শুরু করে নাওমি ওয়াটস বা নিকোল কিডম্যান বা ক্যাথেরিন জেটা জোনস-আমরা একই ব্যাপার খেয়াল করি। এমনকি অপ্রধান নারী চরিত্রগুলোও তাই। স্থূলকায়া হিশেবে নারীকে দেখানো হয় শুধুমাত্র হাস্য-রসিকতা করার জন্য। পশ্চিমা সমাজ কি তাহলে স্লিম, চোয়াল ভাঙ্গা নারী পছন্দ করে? ক্ষুধা বা অভাব কম, তাই খাদ্য প্রাচ্যের তুলনায় বেশি।

আর তাই মোটা হয়ে পড়ার প্রবণতা বেশী। তাই কি নারীকে পাতলা হিশেবে দেখতে চাওয়া? সমাজ কি এটা ভবিষ্যতের খাদ্যাভাবের কথা চিন্তায় রেখে প্রতিরোধক হিশেবে এটা করছে? নাকি নারী পুরুষের ওপর নির্ভরশীল, পুরুষতন্ত্র এটা দেখতে চায়, আর এটা বেশি স্পষ্ট হয় যদি নারী হয় আন্ডারওয়েট? শো-বিজনেসের এই আন্ডারওয়েট রোল মডেলেরা আধুনিক মেয়েদেরকে নিজেদের মতোই অ্যানোরেক্সিক করে তুলছে। প্রাচ্য অনেক বেশি রক্ষনশীল তাই সিনেমার নারীর স্থূলতা হয়তো সবসময় বোঝা নাও যেতে পারে। যেমন ইরান। শক্তিশালী সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি থাকার পরও অবগুণ্ঠনের কারনে সেখানে এমনিতেই নারী আড়ালে থাকে।

দুরপ্রাচ্যের দেশগুলোর মঙ্গলয়েড বাসিন্দারা এমনিতেই তেমন চর্বিযুক্ত হন না। অতএব আকিরা কুরোশওয়ার সিনেমার নারীদের ক্ষেত্রে এ কথা বোধহয় স্পষ্ট হয় না। আফ্রিকান ইতিহাস দীর্ঘদিনের শ্বেত শাসনের অর্থাৎ ইউরোপিয়ান সাম্রাজ্যবাদ ও সেই সূত্রে পুঁজির। আফ্রিকানদের জন্য নির্মিত আফ্রিকান দ্বারা নির্মিত ফিল্ম সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব স্বত্ত্বেও ঝুঁকি নিয়ে একথা বলা যায় যে, সেখানেও নারীর মেদ আর সমাজের পুঁজি-প্রভাব পরস্পর বিপ্রতীপ কোনে দাঁড়িয়ে। শোলে-তে হেলেন দক্ষিণ এশিয়ার সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে শক্তিশালী ঘাঁটি মুম্বাই।

ভারতের অনেক প্রদেশেই সিনেমা তৈরি হয়, প্রতিবেশী দেশগুলোতেও হয়। কিন্তু সমুদ্রবন্দর থাকা এবং আরও নানা কারনে বলিউড পশ্চিমের বেশি অনুগামী। অর্থাৎ, পশ্চিমের সিনেমার চারিত্রিক গুণ সবার আগে ধরা পড়ে বলিউডি হিন্দি ফিল্মগুলোতে। তবুও দেখি দুইজন প্রধান নারী চরিত্র থাকার পরও 'শোলে'-তে (১৯৭৬) যৌনাবেদন প্রকাশে তুলনামূলক স্থূলকায়া হেলেন-কে আনতে হয়। দক্ষিণ ভারতে শক্তিশালী ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি আছে।

তামিল-তেলেগু-মালয়ালাম ভাষায় সিনেমার সংখ্যা অনেক। দক্ষিণ ভারতীয় অঞ্চলের সিনেমাগুলোর দিকে তাকালেও আমরা মেদবহুল নায়িকা দেখবো। খেয়াল রাখতে হবে, দক্ষিণ ভারতে পুঁজির আধিপত্য দেরিতে হয়েছে, অন্তত পশ্চিম ভারতের চেয়ে। নগরায়নের গতিও তাই একই। সত্যজিত রায় বা শ্যাম বেনেগাল বা তারেক মাসুদের দর্শক শিক্ষিত শহুরে।

এদের তৈরি সিনেমা দেখতে হোলে দর্শককেও কিছুটা শিক্ষিত হতে হয়। তাই এদের সিনেমা হয়তো শিক্ষিত দর্শকের আশা-আকাঙ্খা-বাস্তবতার প্রতিফলন হতে পারে কিন্তু জনরুচির মানদন্ড নয়। জনরুচি প্রতিফলিত হয় 'বেদের মেয়ে জোসনায়'। শহুরে বাবুরা শিল্পী মমতাজের গান শোনে না। আশ্চর্যজনকভাবে গরীবের শিল্পী মমতাজও স্থূল আকারের! সত্যম শিবম সুন্দরম (১৯৭৮), বাড়ছে বক্ষ সচেতনতা আমাদের নিম্নবর্গের সমাজের যৌন রূপায়ন এমন কেন? কেন তারা তাদের নায়িকাদের মোটাতাজা দেখতে চায়? আমাদের নৌকার মাঝি দেবীর কাছে আশ্বাস চায়, যেন 'তার সন্তান থাকে দুধে ভাতে'।

সোনা-চাঁদি চায় না সে, শুধু চায় তার আদরের ধন যেন অন্নকষ্ট না পায়। অন্নকষ্ট বড় কষ্ট, মাঝি জানে। তাই কি আমাদের পল্লীর শ্রমজীবীরা নিজেদের যৌন প্রতিমা গড়ে তাকে অধিক পুষ্ট বা মেদবহুল করে? তাই কি নায়িকা ময়ূরী বলেন যে, তার দর্শকেরা তাকে ওইরূপেই (মেদবহুল) দেখতে চান?এই উদ্ধৃতি স্মৃতি থেকে তুলে দেওয়া। উৎস জানানোর সুযোগ আপাতত নেই, কারন ময়ূরী আরবান মধ্যবিত্ত শিক্ষিত দর্শকের নায়িকা নন, কাজেই তার বক্তব্য কেউ মূল্যবান মনে করে সংরক্ষণ করেছেন-এমন হওয়ার সুযোগ কম। কারিনা কাপুর, সাইজ জিরো? নব্বই দশকের শুরু থেকে দুটো টেকনোলজি মানুষে মানুষে যোগাযোগ বাড়িয়েছে।

একটা হোল কেবল টেলিভিশন আর একটা ইন্টারনেট। পূর্ব-পশ্চিমের দূস্তর তফাত কমা শুরু করে। শহরে এ দুটো সুলভ। টেকনোলজির কল্যাণে মানুষের পরিশ্রম কমতে থাকে। বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় ওবেসিটি এবং তার সাথে হৃদরোগ ও ডায়াবেটিস।

অতিরিক্ত মেদ ঝরানোর জন্য জিম 'করার' প্রবণতা বাড়ে। সিনেমার নায়িকারা হতে থাকেন স্লিম ট্রিম। টিভি অভিনেত্রীরাও তাই। আবার নারী যে সমাজে তার ক্ষমতা ধীরে ধীরে বাড়াচ্ছে, তা বুঝতে পারি যখন দেখি নায়কেরা সিক্স-প্যাক বানাচ্ছে। এখন বক্ষদেশ স্ফীত করছেন নায়িকারা কৃত্রিম উপায়ে।

কিন্তু পল্লীর শ্রমজীবীর তো মেদ থাকে না আর শরীরও থাকে পেটা-পরিশ্রমের দরুণ। তার নায়িকা কেন স্লিম হবে? আর সেতো জানেই না কৃত্রিম বক্ষের ব্যাপারে। আমাদের গ্রামগঞ্জ থেকে যে সিনেমা হলগুলো উঠে যাচ্ছে আর তার বদলে শহুরে কায়দায় যে মাল্টিপ্লেক্সগুলো গড়ে উঠছে, তার থেকে আমরা এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি, গাঁয়ের চাষার আশা-আকাঙ্খা বর্তমানের সিনেমা পূরন করতে পারছে না। সিনেমা বোধহয় এখন বানানোই হচ্ছে শহুরে মধ্যবিত্তদের জন্য। বিদ্যা সিনহা সাহা মীম, স্লিম শহুরে নায়িকা? গ্রামের লোকের যাত্রা অশ্লীলতার অজুহাতে প্রায়শই শিক্ষিত ভদ্রমহল বন্ধ করে দিচ্ছে।

এদের টিভিও নেই, সিনেমাও নেই। এদের মনের ক্ষিদে তবে মেটে কীভাবে? রাজশাহী ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৫ বার

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।