আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সরকারকে পঙ্গু করে দেয়ার উদ্ভট খায়েশ

আমি নতুন কিছু লিখবো বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া সরকারকে পঙ্গু করে দেবার ঘোষণা দিয়েছেন। চাঁদপুরের জনসভায় তিনি বলেছেন, ‘এই ব্যর্থ সরকার টেনে-টেনে খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে চলছে। আমরা তাদের ফেলতে চাই না; দেখতে চাই, কতোটুকু খুঁড়িয়ে চলতে পারে। আমরা তাদের ল্যাংড়া-লুলা বানিয়ে ছেড়ে দিতে চাই। ’ দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে দাবি করে এর জন্য সরকারকে পুরোপুরি দায়ী করেছেন তিনি।

বলেছেনÑ ‘গত তিন বছরের সরকার ১২ হাজার মানুষকে হত্যা করেছে। মানুষ তাদের কাছে পেয়েছে শুধু লাশ আর লাশ। তবুও তাদের রক্তের স্বাদ মেটেনি। খুনি সরকারের হাত জনগণের রক্তে রঞ্জিত। ’ এরপরই তিনি বলেন, ‘তাই বারবার না মরে আবারো জেগে উঠুন।

এই সরকারের পতন না হলে দেশে শান্তি আসবে না। ’ আমরা পেছন ফিরে তাকালে অনেক কিছুই দেখবো। ২০০১ সালের নির্বাচনের পরপরই প্রধান বিরোধী দলকে নির্লজ্জভাবে কোণটাসা করার প্রবণতা তো শুরু করেছিল জামাত-জাতীয়তাবাদী সরকারই। নির্বাচনের পরই সংখ্যালঘু নির্যাতন, ধর্ষণ, দখল, আওয়ামী নেতাকর্মীদের জঘন্য হয়রানির কথা তো দেশবাসী এখনো ভুলে যাননি। দুই-তৃতীয়াংশ মেজরিটির অপব্যবহার করে জোট সরকার সে ত্রাস তো নিজেরাই সৃষ্টি করেছিল।

ক্রমশ প্রশাসন দখল, হাওয়া ভবনের ছায়া সরকার গঠনের মাধ্যমে ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছিল। মানুষের কাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের সম্মুখীন করেছিল দিনে দিনে। এর পরের ঘটনাগুলো অনেকেরই জানা। শাহ কিবরিয়ার মতো বরেণ্য রাজনীতিককে হত্যা করা হয়েছিল। দেশে একযোগে বোমা হামলা করা হয়েছিল।

২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা ছিল ইতিহাসের নির্মমতম ঘটনা। একটি জাতিসত্তার প্রতি একজন ব্যক্তি কিংবা একটি দল কতোটা অনুগত তা নির্ভর করে তার মৌলিক আচরণ প্রকাশের ওপর। আচরণটিও দুরকম হতে পারে। একটি লোক দেখানো, অন্যটি আত্মিক। যারা মনেপ্রাণে কোনো জাতিসত্তাকে স্বীকার করে এবং ভালোবাসে তাদের দেশপ্রেম নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকে না।

প্রশ্ন ওঠে তাদের দেশপ্রেমের প্রতি, যারা মুখে গণতন্ত্রের কথা বলে কিন্তু ভেতরে ভেতরে সুযোগ খুঁজে জাতিসত্তাকে ধ্বংস করে দেয়ার। মূলত এদের শ্রেণী চরিত্রটি হচ্ছেÑ আত্মপ্রতারক। তারা একটি দেশে অবস্থান করেও ব্যস্ত থাকে সে দেশের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্রে। তারা রাষ্ট্র এবং জনগণের পিঠে ছুরি মেরে নিজেদের কায়েমি রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়। বাংলাদেশে একাত্তরের পরাজিত শক্তিরা এখন তেমনভাবেই সম্মিলিতভাবে বিএনপির কাঁধে ভর করে পার পেতে চাইছে।

বেগম জিয়া আজ দখলের কথা বলছেন। ২০০১-২০০৬ সালে তার দলের সমর্থকরা কী হীন কাজ করেননি! দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জেনারেল জিয়া, খালেদা জিয়াসহ বিএনপির বেশ কিছু সিনিয়র নেতার নামসর্বস্ব সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে স্কুল, মাদ্রাসা, এতিমখানা, স্বস্থ্য কমপ্লেক্স প্রভৃতির জন্য খাস জমি দখল করে নেয়া হয়েছিল। ঐ সময়ের সরকার সেসব অবৈধ দখলকারীদের উচ্ছেদ করেনি। সরকার উচ্ছেদ করছিল বীর মুক্তিযোদ্ধা সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফের স্ত্রী-পরিবারকে সরকার কর্তৃক বরাদ্দ বাসা থেকে। তারা উচ্ছেদ করতে চেয়েছে, জঙ্গিবাদীদের হাতে আক্রান্ত এবং পরে প্রয়াত বুদ্ধিজীবী ড. হুমায়ুন আজাদের স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে সরকারি বাসা থেকে।

স্বাধীন বাংলাদেশে বীর মুক্তিযোদ্ধা, খ্যাতিমান বুদ্ধিজীবীর পরিবারবর্গ এভাবেই পরিকল্পিত রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার হয়েছেন বেগম জিয়ার শাসনামলে। বাংলাদেশের মানুষ সেসব ঘটনা তো ভুলে যাননি। ভুলে যেতে পারেন না। আমাদের মনে আছে বাংলাদেশের ইতিহাসে ভয়ঙ্কর, ধৃত দুই শীর্ষ জঙ্গি শায়খ রহমান এবং বাংলাভাইকে মুখোমুখি করা হলে তারা পরস্পরকে বলেছিল, আমরা বিশ্বাসঘাতকতার শিকার। এই বিশ্বাসঘাতক কারা? কারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল তাদের সঙ্গে? এই সত্যগুলো বেরিয়ে এলেই রাষ্ট্রের প্রতি বিশ্বাসঘাতকদের চিহ্নিত করা সহজ হতো।

কারণ যারা এসব জঙ্গিকে দিয়ে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটিকে ধ্বংস করার পাঁয়তারা করেছিল এবং কিছুটা হলেও সার্থকও হয়েছে এরাই স্বাধীনতার, রাষ্ট্রের প্রধান শত্রু। এসব শত্রুদের চিহ্নিত করার প্রক্রিয়া এবং মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এদেরকে ‘রাষ্ট্রের শত্রু’ বলার হিম্মত দেশের সুশীল সমাজের কতোটা আছে সে বিষয়ে আমি কিছু প্রশ্ন তুলতে চাই। খালেদা জিয়ার শাসনামলে দুধরনের ভোগবাদী গ্রুপ ছিল। এরা এখনো আছে। একটি হচ্ছে তাৎক্ষণিক ভোগবাদী।

আর অন্যটি হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি ভোগবাদী। বিএনপির যারা চঁাঁদাবাজি, টেন্ডার টানাটানি করে দুপয়সা কামানোর ধান্দা করেছে কিংবা আগামীতেও করবে এরা হচ্ছে তাৎক্ষণিক ভোগবাদী। আর মৌলবাদী যারা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় এগিয়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে এরা হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি সুদূরপ্রসারী ভোগবাদী। বেগম খালেদা জিয়াই এই দেশকে পঙ্গু করার অন্যতম রূপকার। চাঁদপুরের জনসভায় তার মুখ দিয়ে অকপটে সেই সত্যই বেরিয়ে এসেছে।

ভাবতে অবাক লাগে এই জঙ্গি ভোগবাদী শক্তির বিরুদ্ধে দেশের মানুষ যথেষ্ট সোচ্চার হচ্ছেন না। যতোটুকু সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন ছিল। সরকারও জঙ্গিবাদের হোতাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়নি। বাংলাদেশে খালেদা জিয়া পালিত পেটোয়া বাহিনী কিভাবে সাংবাদিকদের আক্রমণ করেছিল তা আমরা ভুলে যাইনি। চট্টগ্রামে জাতীয়তাবাদী পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন আলী আকবর।

যিনি একসময় ছাত্রদলের নেতা ছিলেন। তিনি হুঙ্কার দিয়ে বলেছিলেন, এরা সাবের হোসেনের লোক। এদেরকে পেটাও। সঙ্গে সঙ্গেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তার বাহিনী। পিস্তল উঁচিয়ে হত্যা করার হুমকিও দিয়েছিল তারা।

এসব সংবাদ বিভিন্ন দৈনিকে ছাপা হয়েছিল। একটি দৈনিক ক্যাপশনে লিখেছিল ‘এই পুলিশ কর্মকর্তাকে চিনে রাখুন। ’ হ্যাঁ, দুঃখজনক হলেও সত্য এসব পুলিশ কর্মকর্তাকে চিনে রাখার, শনাক্ত করে রাখার প্রয়োজন ছিল বৈকি। কোহিনুর মিয়া, মাসুদ মিয়া, সার্জেন্ট আনোয়ার কিংবা আলী আকবর মিয়ারা কি বাংলাদেশ নামক ভূখ-টিকে তাদের নিজস্ব ‘তালুক’ মনে করছিলেন সে সময়? তারা এতো শক্তি পেয়েছিলেন কোত্থেকে। সাবের হোসেন চৌধুরী ক্রিকেট বোর্ডে ছিলেন বলে রাজনৈতিক জিঘাংসা চরিতার্থ করতে, সাংবাদিকদের এভাবে প্রহার করতে হবে? জোট সরকার কি তাদের বাহিনীকে এসব এসাইনমেন্ট দিয়ে মাঠে নামিয়েছিল? এসব ঘটনা বেগম খালেদা জিয়া ভুলে গেছেন? বেগম জিয়ার শাসনামলে, দেশের সবকটি জাতীয় দৈনিকের ফটো সাংবাদিক চট্টগ্রামে সরকারি পেটোয়া বাহিনীর নির্মমতার শিকার হয়েছিলেন।

দেশের অগ্রজ ফটো সাংবাদিক আলহাজ জহিরুল হক। সেই প্রবীণ সাংবাদিককে কিল-ঘুষি মারার যে দৃশ্যটি পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল, তা ছিল ইতিহাসের কলঙ্কময় ঘটনা। আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল একাত্তর সালের কথা। সেই পাক খানসেনাদের প্রেতাত্মার কথা। পুলিশ কর্মকর্তা আলী আকবর দানবীয় কায়দায় যে আক্রমণ চালিয়েছিলেন, তা করতে একটিবারও চারদলীয় জোট সরকারকে ভাবায়নি? এভাবেই দানব সমাজে বসবাসে নিপতিত হয়েছিল গোটা জাতি।

একই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন প্রবীণ ফটো সাংবাদিক আলহাজ জহিরুল হকও। সেসব দিনগুলোর কথা খালেদা জিয়া ভুলে গেছেন। এখন তার ক্ষমতা দরকার। এজন্য তিনি সরকারকে পঙ্গু বানাতে চান। অথচ তার সময়ে এই দেশের কোমর ভেঙে দেবার চেষ্টা করা হয়েছিল।

মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছিল বলেই এই দেশ ভবনওয়ালাদের খপ্পর থেকে রক্ষা পেয়েছিল। বেগম খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত দুঃখবোধ, গোটা জাতির জন্য কালোশক্তির ছায়া হতে পারে না। রাজনীতিতে মার্জিত ভাষা সবসময়ই আলোর দরজা খুলে দেয়। সরকারকে পঙ্গু করার মধ্য দিয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের দুরভিসন্ধি মেনে নেবে না এই দেশের মানুষ। কারণ এই দেশ থেকে শহীদের রক্তবিন্দুর উষ্ণতা এখনো মিলিয়ে যায়নি।

কোনোদিন যাবেও না। ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১২ ফকির ইলিয়াস : কবি ও সাংবাদিক। View this link ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.