আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার শৈশব, কৈশোর আর তারপরের লাগামহীন দিনগুলি - ৭

"আমারে ফিরায়ে লহো অয়ি বসুন্ধরে, কোলের সন্তানে তব কোলের ভিতরে"-শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ক্লাস এইটে পড়ার সময় ছোট চাচার কাবিন করানো হলো। মেয়ে বিক্রাম্পুরের প্রত্যান্ত এক গ্রামের এক সরকারি রিটায়ার্ড চাকরিজীবীর মেয়ে। ছোট চাচা কিছুতেই বিয়েতে রাজি না। আমার বাবা ও অন্য দুই চাচা দাদার ইচ্ছেতে মেয়ে না দেখেই বিয়েতে রাজি হয়েছে। কিন্তু ছোট চাচা কিছুতেই রাজি হয় না।

আর তার যেই পরিমান প্রেমিকা ছিল সেইটা না বলাই ভালো। যাইহোক, দাদা হুমকি দিলেন চাচ্চু বিয়ে না করলে তিনি আত্মহত্যা করবেন, দাদিও সাথে সাথে সূর মিলালেন। সুতরাং আর যায় কই? ছোট চাচাকে ধরে নিয়ে কাবিন করিয়ে দেয়া হলো সেই মেয়ের সাথে। ছোট চাচা বাসায় ফেরার পথে কাঁদো কাঁদো হয়ে বললেন,” ভাতিজ (আমাকে ভাতিজ বলেই ডাকেন), তোর দাদা-দাদী এইটা কি করলো রে!“ মনে মনে বললাম, চাচ্চু তুমি এতগুলা প্রেম করছো, তাই তোমার শাস্তি হিসেবে এই গ্রাম্য মেয়ে। সুখে থাকো।

যাইহোক, ছোট চাচ্চুর কান্না দেখে সেদিন সান্তনা দিতে ইচ্ছে করলেও দিতে পারলাম না। ভেতর থেকে হাসি চাপা রাখতেও কষ্ট হচ্ছিল। কিছুদিন পরে বিয়ের অনুষ্ঠান। ছোট চাচ্চু খুঁত ধরতে লাগলেন শ্বশুর বাড়ির। আর তার কথা কেউ কানেই তুললো না।

ছোট চাচা মিন মিন করে কথা বলতেন বলে সবাই আদর করে তাকে “বরকি” ডাকতো। বিয়ে ঢাকাতে হলেও বিয়ের পরে কিছুদিনের জন্যে তাকে পাঠিয়ে দেয়া হলো শ্বশুর বাড়িতে। আমার বার্ষিক পরীক্ষা থাকায় আমি যেতে পারলাম না। আব্বু ব্যাবসা দেখাশোনা করে খুব কম সময় দিতেন আমাদের। মাঝে মাঝে পড়া ধরতেন।

তখন এমন বিরক্ত লাগতো বলার বাইরে। আব্বু আমাদের গায়ে হাত তুলতেন বছরে একবার। এটা ছিল রুটিন করা। বছরে একবার বিনাদোষে কিংবা লঘুদোষে বেদম দিয়ে সারাবছর সেই কথা স্মরণ করিয়ে দিতেন। আর আমার আম্মু নিরহ টাইপের মহিলা।

ঘুমাতে তিনি সবথেকে বেশী সাচ্ছন্দবোধ করতেন। আর আমাদের চার ভাইবোনের উদ্দেশ্য হলো কিভাবে তাকে জ্বালাতন করা যায়। এই যেমন আম্মু ঘুমাচ্ছে দুপুর বেলায়, আমি টিফিনে বাসায় এসে আম্মুর উপরে ঝাপ দিয়ে চমকে দিতাম। আম্মু হকচকিয়ে দেখতেন আমি, তখন চোখ গরম করতেন আর আমি নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে মজা নিতাম। টিফিনে বাসায় এসে একদিকে ভাত মুখে দিতাম আর অন্যদিকে ক্যাপ্টেন প্ল্যানেট কিংবা ক্যাসপার দেখতাম।

নবম শ্রেনিতে লক্ষ করলাম ক্লাসের ব্ল্যাকবোর্ডে স্যারের লেখা দেখতে পাই না। চোখ সংকুচিত করলে একটু একটু দেখা যায়। আবার কোন বন্ধুর চশমা চোখে দিলে সব স্পস্ট দেখতে পাই আর শুভ্রর – ৪.২৫ চশমা চোখে দিলে মাথা ঘুরে পড়ে যাই। বুঝলাম আমি অন্ধদের কাতারে চলে যাচ্ছি। মনে মনে ভীষণ খুশি আমি চশমা পড়বো।

ডাক্তার দেখিয়ে একটা সোনালি ফ্রেমের চশমা অর্ডার করে আসা হলো। চশমা চোখে দিয়ে দেখলাম আমার দুনিয়া পুরাই ফকফকা। কিন্তু সমস্যা হলো সোনালি রঙয়ের চশমা মেয়েরা পড়ে। তাই চশমা পরে ভাব নেয়ার চেয়ে লজ্জা পাইলাম বেশী। কিছুদিন পরে ইচ্ছে করে চশমার একটা গ্লাস ভেঙ্গে আব্বুর হাতে দিলাম।

নতুন ফ্রেম নিজে পছন্দ করলাম। হাফ রিমের ফ্রেম। এর পর থেকে দুইমাস থেকে তিনমাস পর পর দেখা যেত আমার চশমা ভাঙ্গে। দেখা যায় আমি চশমা পরে ঘুমিয়ে গেছি, সকালে দেখি চশমা ভাঙ্গা। আবার দেখা যায় সকালে মুখ ধয়ার সময় চশমা পেছনের পকেটে রাখছি, ফ্রেস হয়ে যখন বসছি তখন কট করে শব্দ হয়।

বুঝলাম যে চশমা গেছে। আবার দেখা যায় চশমা টেবিলে রাখা হয়েছে, সকালে দেখি ছোটভাই চশমার জায়গায় চশমা রাখছে কিন্তু গ্লাস দুইটা নাই। মাঝে মাঝে চশমা হারিয়ে ফেলতাম। সারাবাড়ি খুঁজে দেখা যেত আমি চশমা চোখে দিয়েই চশমা খুঁজতেছি। মাঝে মাঝে এক্সট্রা চশমা দিয়ে চশমা খোঁজা হতো।

আমি এখনো ঘুমালে স্বপ্ন দেখিনা মানে স্বপ্ন আমার মনে থাকে না। মাঝে মাঝে মনে হয় চশমা পড়ে ঘুমালে হয়ত স্বপ্ন দেখা যাবে। তাছারা চশমা না পরে আমি কোন কিছু খেতে পারি না। কেমন যেন পানসে লাগে। ক্লাস নাইনে উঠে যখন বই কিনলাম তখন আমার হাসি পাচ্ছিল।

একই বই দুই বছর পড়তে হবে। আমার বাসায় যে টিচার ছিলেন তিনিই আমাকে সায়েন্সের বিষয়গুলো পড়াতেন। আমার ইচ্ছে ছিল টেকনোলজি নিয়ে দেশের বাইরে পড়াশোনা করা। তাই সায়েন্স নিলাম। আর সায়েন্সের পড়া খুব মজার ছিল আমার কাছে।

বায়োলজিতে সবথেকে ভালো দখল ছিল আমার। ক্লাস নাইনে ইংরেজি পড়া শুরু করলাম কুরবান আলী স্যারের কাছে। শেষে স্যার আমাদের চারজনের একটা ব্যাচ ঢুকিয়ে দিলেন মেয়েদের ব্যাচের সাথে। মেয়েদের সাথে ক্লাস করা সে কি লজ্জার। আমি তখনো মেয়েদের দেখলে ভীষণ লজ্জা পাই।

কোন মেয়ে আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করলে কি বলবো ভেবে না পেয়ে চেহারা এমন অসহায়ের মত দেখায় যে কেউ তখন আমাকে দেখলে ভাববে সেই মেয়ে বোধহয় আমার কিডনি দুইটাই নিয়ে নিতে চেয়েছে। যাইহোক, মেয়েদের সাথে ক্লাস করতে যেয়ে লজ্জায় লাল হয়ে বসে থাকতাম। স্যার পড়া ধরলে মিটিমিটি হাসতাম, স্যার ধমক দিলে পড়া শুরু করতাম। আর বজ্জাত মেয়েগুলা আমাকে আর সোহেলকে বেশী টিজ করতো। সোহেল ছিল আমাদের মাঝে সুন্দরী আর স্মার্ট।

অত্যাধিক সুন্দর হওয়ায় সোহেলকে আমরা “আপা সোহেল” কিংবা “সুন্দরী সোহেল” আবার কখনো” লেডিস সোহেল” বলে ডাকতাম। স্কুলে আমাদের থেকে একহাত লম্বা আর স্মার্ট হওয়াতে সোহেলের ভালই জনপ্রিয়তা ছিল মেয়েদের মাঝে। আর সোহেল হারামি সেই ফায়দা নিত, আমরা পাহারা দিতাম। আমার ছোট বোন একই স্কুলে পড়তো। দশম শ্রেনীতে উঠে আমার শারিরিক বৃদ্ধি হলো।

তখন আমি আমার প্রতি স্কুলের মেয়েদের কুদৃষ্টি টের পাইলাম। আমার বোন স্কুল থেকে এসে বলতো,”ভাইয়া ক্লাস টেনের এমন এক মেয়ে আমাকে আদর করে, তোমার কথা জানতে চায়। “ মেয়েদের কাছে থেকে সে ভালই ফায়দা নিত আমার উছিলায়। আর ক্লাস টেনে তখন আমার লজ্জা ভাংতে শুরু করেছে। টুকটাক মেয়েদের সাথে কথা বলতে ভালো লাগতো।

পরে বসে বসে ভাবতাম কি কি কথা বলেছি। আর একটা সমস্যা আমার ছিল যে সুন্দরী মেয়ে দেখলে প্রেমে পড়ে যেতাম। এই বদ অভ্যাসটা এখনো আছে। মাঝে কিছুদিন সিরিয়াস একটা প্রেম করেছিলাম তখন অবশ্য এমন হয় নাই। আমাদের স্কুলের ফার্স্ট গার্ল ছিল ইমা নামের একটি মেয়ে।

বায়েজিদ (আগের পর্বে বলেছি ওর সম্পর্কে, বর্তমানে আমেরিকাতে আছে) খুব পছন্দ করতো ইমাকে। মাঝে মাঝে দেখতাম বায়েজিদ সাহস করে ইমার সাথে কথা বলছে। ইমা যে টিচারের বাসায় প্রাইভেট পড়তো বায়েজিদ সেই টিচারের কাছে পড়তে শুরু করলো। আর ইমার পেছনে আমাদের ক্লাসের সায়েন্স কমার্স আর আর্টসের ছেলেরা পুরাই ক্রাশড। আমি আর নয়ন ইমার প্রেমিকদের একটা টপচার্ট করার গুরুদায়িত্ব নিলাম, যেখানে বায়েজিদের নাম সবার উপরে দেয়া হলো।

দশ জনের নাম সাজাতে যেয়ে দেখা গেলো ইমার জন্য আরও অনেক বেশী চাহনেওয়ালা আছে। যাইহোক, দুইটা ঘটনা বলি, আমাদের বিদায় অনুষ্ঠানের দিন আমি বন্ধুদের ছবি ধারন করছিলাম। বায়েজিদ ক্যামেরা নিয়ে গেলো ইমার ছবি তুলবে বলে। আমি আরও কয়েকজন ফ্রেন্ডকে নিয়ে গেলাম ঘটনা কি দেখাইতে। যেয়ে দেখি ইমা ফুলে বেলুন হয়ে বাতাসে উড়তেছে আর বায়েজিদ আলপিন হাতে ঘুরতেছে সেই বেলুনের হাওয়া কমানর জন্যে।

যাইহোক, অনেক বাঁধা পেরিয়ে শেষে যেয়ে কয়েকটা ছবি তোলা হলো। আমি সেই ছবি প্রিন্ট করে এনে দেখি ইমার ছবি আসছে মুখে আচল দেয়া। একটা ছবিও ঠিক মত আসে নাই। পুরা দুইমাস ঘুরাইয়া বায়েজিদের কাছে ছবি দিলাম। সেই আচলে ঢাকা ছবি দেখে বায়েজিদের কি আনন্দ! আর আমি বুঝে নিলাম প্রেম অন্ধ।

আমরা তখন এস এস সি এক্সাম শেষ করে প্রাকটিক্যাল পরীক্ষা দিচ্ছি। ছেলেদের এবং মেয়েদের পরীক্ষা একই ক্লাসে। ছেলেদের সেই কি আনন্দ, কিন্তু আমার সেই দিকে খেয়াল নেই। কারন আমি তখন সম্পূর্ণ নারী বিদ্বেষী। কালনাগীনেরা একে একে আমার বন্ধুদের বধ করছিল আর আমি চেষ্টা করতাম তাদের ফিরিয়ে আনতে।

মেয়েদের অনেকে ইশারা করলেও আমি অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখতাম। বন্ধুরা আমাকে নিয়ে হতাশ। তারা আমার জন্যে অনেকেই মেয়ে দেখা শুরু করলো, মেয়ের হয়ে আরজু করতে লাগলো। কিন্তু আমি ডিসিশনে অনড়। আমি প্রেম করবো না।

যাইহোক, শেষ প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষার দিন বায়েজিদ বললো ইমার সাথে নাকি ওর খুব ভালো ভাব হয়ে গেছে। আমি তো কিছুতেই বিশ্বাস করি না। বায়েজিদ কোন উপায় না দেখে বললো যে,” দেইখো আমি ওরে ক্লাসে কি করি, তাইলেই তো বুঝবা। “ আমি উৎসুক হয়ে ক্লাসে ঢুকলাম। আমি ঠিক ইমার পেছনের বেঞ্চে বসা।

বায়েজিদ ক্লাসে ঢুকে ইমার গালে আদর দিতে যেয়ে একটু জোরে থাপ্পর দিয়ে ফেললো। ক্লাসের সবাই হা করে তাকিয়ে আছে। ইমা গালে হাত দিয়ে কান্নাকাটি করে অস্থির। বায়েজিদ আবুলের মত ঝারি খাইতেছে ইমার। আর আমি পেছন থেকে মজা নিতেছি আর বলতেছি,” আহা বায়েজিদ, এই অবলা মেয়েটারে কি করলা?” একটু পরে দেখি ইমার আম্মা ক্লাসে ঢুকে ইমাকে সান্তনা না দিয়া আমাকে আর বায়েজিদকে সান্তনা দিতেছে।

(পর্বভিত্তিক ভাবে চলবে) এই পর্বে কৈশর অধ্যায়ের সমাপ্তি, পরের পোষ্টগুলোতে আমার প্রেমবেলা এবং তারপরের দিনগুলির কথা থাকবে। আমার শৈশব, কৈশোর আর তারপরের লাগামহীন দিনগুলি - ৬  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।