আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ইয়ংওয়ান গার্মেন্টসের শ্রমিক বিদ্রোহ প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ থেকে

নিজের ভাবনা অন্যকে জানাতে ভালো লাগে। (লেখাটা ইয়ংওয়ান গার্সেন্টসের শ্রমিক আন্দোলন নিয়ে লেখেছিলাম, শ্র্রমিক আওয়াজ নামক একটা পত্রিকার জন্য। তারা চরম বিকৃতিভাবে ছেপেছিল, তাই মুল লেখাটা অনেক দিন পর উদ্ধার করতে পেরে নতুন করে ব্লগে ছাপলাম---লেখক) তুষের আগুনের মতো জ্বলতে থাকা গার্মেন্টস শ্রমিকদের ক্ষোভ- বিক্ষোভগুলো কখনও-কখনও বিস্ফোরণমুখর হয়ে উঠে! এই বিস্ফোরণের বহু নমুনা আমরা দেখেছি মিড়িয়াতে। কিন্তু পরম সৌভাগ্য হলো ২০১০ সালের ১২ ও ১৩ ডিসেম্বর তারিখ ঘটে যাওয়া চট্টগ্রামের ই,পি,জেডের ইয়ংওয়ান গার্মেন্টসের শ্রমিক আন্দোলন প্রত্য করার। সমস্ত গণ আন্দোলনের মতই এই আন্দোলন সর্ম্পকে সরকারের ভাষ্য: ‘কতিপয় ষড়যন্ত্রকারির উস্কানি।

তাদের দাবিমতে, এই ষড়যন্ত্রকারিরা বহিরাগত ও যুদ্ধাপরাদের বিচারকে বাধাগ্রস্ত করতে চায়। যদিও সরকারের ভাষ্যের সেই ষড়যন্ত্রকারিদের আমরা বেশিরভাগ সময় মূর্তরূপে দেখি না- কিন্তু এই শ্রমিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে আমরা দেখলাম। এই ষড়যন্ত্রকারিরা কারা? নব্বই-এর স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলনের ছাত্রনেতা মোশরাফা মিশু, শ্রমিক নেতা মাহাবুবুর রহমান ইসমাইল, আর মন্টু ঘোষ তথা এদেশের বাম প্রগতিশীল শক্তি - যারা এদেশের খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষের রাজনীতি করে থাকেন; শাসকশ্রেণীর বুর্জোয়া রাজনৈতিক দল - যারা এদেশের ধনিকশ্রণির মুনাফার পাহারাদার হিসেবে মেহনতি মানুষের সাথে নিয়মিতই ধাপ্পাবাজি করে যাচ্ছে-এই বহিরাগত তত্ত্বটাও হচ্ছে এই ধরণের ধাপ্পাবাজিরই একটা অংশ। যখন এদেশের সমস্ত বুর্জোয়া প্রচার যন্ত্রগুলো ঘটনার প্রকৃত কারণ উৎঘাটনের ন্যূনতম দায়িত্ব বোধের পরিচয় না দিয়ে, সরকারের ভাষ্যকেই প্রচার করে মালিকশ্রেণির শোষণের পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে। বুর্জোয়া মিড়িয়া ও সরকারের ভাষ্যকে আমরা চরম মিথ্যচার বলে দাবি করছি; সেখানে প্রকৃত সত্যের জন্য আমাদের কাছে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীর কাছেই যেতে হবে, এমনই এক প্রত্যক্ষদর্শী শিউলি বেগম, বয়স আনুমানিক আটত্রিশ, বিগত নয় বছর ধরে ইয়ংওয়ান গার্মেন্টসে সুইং অপারেটর হিসেবে কাজ করছেন, ১২ তারিখের শ্রমিক অসন্তোষের প্রত্যক্ষদর্শী এই শিউলি বেগমের মুখজবানি থেকে যা জানতে পারি, ‘স্যাররা আমাগোরে হেই তিনমাস আগে থেইক্য কইতাছে, তোমরা ধৈর্য্য ধরো তোমাগো বেতন বাড়ামু, প্রেতেক মাসের চার তারিখের মধ্যে আমাগো বেতন দেয়, অথচ এ-মাসে বেতন দিছে আট তারিখ; বেতন হাতে পাইয়্যাতো তাজ্জব বইন্য গেলাম, আমার মূল বেতন আছিলে ৪৮০০ টাকা হের লগে পাইতাম ৩৮০টাকা গাড়ি ভাড়া , ১০০টাকা বোনাস আর জিনিস পত্রের দাম ভাড়ায় প্রেতেক মাসে ৫০০টাকা।

পরে কমাই দিত ২৫০ টাকা, এই হিসাবে আমি মাস শেষে পাইতাম সাড়ে সাত হাজার টাকার উপরে, অথচ এ মাসে বেতন পাওয়ার পর আমার হাতে আইলো সাড়ে ছয় হাজার টাকা। হু, আমার বেতন ভাড়াইছে! আগে পাইতাম ৪৮০০+৩৮০+২৫০+১০০ মোট ৫৫৩০টাকা অহন সব হিসাব বাদ। আমার বেতন হইছে ৫১০০টাকা। হিসাব থেইক্য ৪৩০টাকা হাওয়া। ’ এই হচ্ছে ইয়ংওয়ান গার্মেন্টেস-এর বেতন বৃদ্ধির নমুনা! এবার আসা যাক শ্রমিক অসন্তোষের কথায়, সুহৃয় পাঠক, এক্ষেত্রে শ্রমিকবন্ধুর অনুরোধেই তার নাম উল্লেখ না করে প্রত্যদর্শীর বিবরণ দিচ্ছি, ‘প্রথমে সু ফ্যাক্টরির ছেলে-মেয়েরাই প্রতিবাদ করে কারখানা থেকে বেরিয়ে আসে, তাদের বেরিয়ে আসতে দেখে সঙ্গে যোগ দেয় কিছু গার্মেন্টস কারখানার ছেলে-মেয়ে - এই বেরিয়ে আসা দলের একজন মেয়ে মুখোমুখি হয়ে যায় ম্যানেজার হারুন প্রকাশ জল্লাদ হারুনের (শ্রমিকরা এই ম্যানাজারকে আড়ালে জল্লাদ বলেই সম্বোধন করে)।

হারুন মেয়েটাকে চড় মেরে কাজের জায়গায় পাঠিয়ে দেয়, এই চড়েই ম্যানেজার ক্ষান্ত হলো না, ছুটে এসেই মেয়েটার গালে দ্বিতীয় চড় বসাল ম্যানেজার হারুন! এবার মেয়েটা প্রতিবাদ করে বললো, ‘সু ফ্যাক্টরির মেয়েদের মত আমরাও তো বেতন কম পাইছি - ওরা প্রতিবাদ করলে আমরা করবো না কেন? এই শ্রমিকের প্রশ্নের প্রতি-উত্তরে তৃতীয় চড়টি দিতে যাচ্ছিল জল্লাদ হারুন; এবার হাত ধরে ফেলে মেয়েটার এক পুরুষ সহকর্মি! এই প্রতিবাদ আর সহ্য হলো না জল্লাদ হারুনের, সঙ্গে-সঙ্গেই অগ্নি মূর্তি ধারণ করে এই দুই শ্রমিকসহ মোট আট জন শ্রমিককে আলোচনার কথা বলে ডেকে নিয়ে গেল কারখানার পাঁচ তলার অফিস কক্ষে অন্যরা ততণে কাজে, মনোযোগী হয়ে গেছে - এভাবেই ঘন্টা দু’য়েক অতিক্রম হয়ে গেছে। এর মাঝেই অফিসে নিয়ে যাওয়া শ্রমিকের মধ্যে থেকে এক নারী শ্রমিকের মোবাইল ফোন এলো, মোবাইলে তার আকুতি, ‘আমাদের সবাইকে মেরে শেষ করে দিচ্ছে তোমরা কে কোথায় আছ আমাদেরকে বাঁচাও। মুহূর্তের মধ্যে এই কণ্ঠস্বর ছড়িয়ে পড়লো সমস্ত শ্রমিকদের মাঝে। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা ছুটে গেল পঞ্চম তলায়, অফিস করে দিকে - আমাদের সামনে আবিষ্কার হলো রক্তাক্ত সহকর্মি! তখনো নির্লিপ্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে বড় স্যার শাহিন, নিজেদের আর আমরা সামলাতে পারলাম না, সবাই মিলে বড় স্যারকে দিলাম আচ্ছা করে দোলাই! তারপর শ্রমিকরা নেমে আসল রাস্তায়। ” এই দুই প্রত্যদর্শীর ভাষ্য আর বুর্জোয়া প্রচার মাধ্যেমের তথ্য ও সরকারের ভাষ্যের মধ্যে পার্থক্য আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়েই ধরা দিচ্ছে - যে শ্রমিক অসন্তোষের কারণে শ্রমিক নেতা কমরেড মোশরাফা মিশুকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে সেই ইয়ংওয়ান গ্রুপের আন্দোলনকারি শ্রমিকদের কারো সাথে মোশরাফা মিশুর যোগাযোগ আছে বলে মনে হলো না।

আমাদের আন্দোলনের নিরিখ বিশেষণ করে মনে হলো মোশরাফা মিশুর সাথে শ্রমিকদের যোগাযোগ থাকলে বরং মালিকদেরই মঙ্গল হতো! কারণ রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত শ্রমিকদের আন্দোলন কখনো মেশিন ভাঙ্গার আন্দোলন হয় না- দেশের খ্যাতিমান অর্থনিতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ তাঁর এক গবেষণায় দেখিয়েছেন, স্বাধীনতার পর হতে এখন পর্যন্ত দেশে যে শ্রমিক আন্দোলন হয়েছে এর কোনটাই মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলন নয়, বরং মজুরি রার আন্দোলন; পাকিস্তানি উপনিবেশিক শাসন কালে একজন শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি দিয়ে যেখানে পাঁচ মণ চাল পাওয়া যেত সেখানে স্বাধীন বাংলাদেশের একজন শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি দিয়ে এক মণ চাল পাওয়াও দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের প্রধান বৈদেশিক মুদ্রার যোগানদাতা গার্মেন্টস শ্রমিকদের পিঠ আজ দেয়ালে টেকে গেছে! যে আন্দোলন শ্রমিকশ্রেণির রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্বে হতে পারতো, সে আন্দোলনগুলো হচ্ছে স্বর্তঃস্ফুর্তভাবে! শ্রমিকরা নিজ অস্তিত্বের স্বার্থেই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ছে - তো, এখন বহিরাগত তত্ত্ব নিয়ে কিঞ্চিত কথা বলা যায়, এটাও সেই পুরানো বাহাস, যেটা শাষকশ্রেণি এদেশের নানা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সময় প্রয়োগ করে! চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যখন বেতন-ফি বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে, তখন সেই আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে আমরা অনেকেই রাজপথে নেমেছিলাম - আমাদের ভাই, বন্ধু, সন্তানদের শিক্ষার অধিকার নিয়ে আমরা যারা রাজপথে নেমেছিলাম, শাসকশ্রেণির ভাষাই সেই আমরাই ছিলাম বহিরাগত - অথচ যে সাম্রাজ্যবাদী মহাজনি সংস্থা আই,এম, এফ ওয়াল্ড ব্যাংকের সুপারিশে এদেশের লক্ষ-লক্ষ শিক্ষার্থীর জীবন অনিশ্চয়তার মুখে টেলে দিচ্ছে তারা এদেশের শাসকশ্রেণীর বড়ই অন্দরের মানুষ! অবশ্যই এটা এমন কোন বিস্ময়কর ব্যাপার নয়! সাম্রাজ্যবাদের কাছে আত্মবিকৃত শাসকশ্রেণির কাছে দেশের মানুষের থেকে তো বিদেশি বেনিয়ারাই অধিক আপন হবারই কথা - অনুরূপভাবে আমরা চট্টগ্রামের ইয়ংওয়ান গ্রুপের শ্রমিক আন্দোলনের সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রির মুখে শুনেছি লুঙ্গিপড়া বহিরাগত মানুষের কথা, যারা শ্রমিকদের সাথে মিশে পুলিশকে উদ্দেশ্য করে পাথর ছুড়েছেন! মন্ত্রিমহোদয়ের প্রশ্ন, ‘শ্রমিকরা কী লুঙ্গি পড়ে কাজে যায়?’ বিষয়টা প্রথম দিকে আমাকেও কিঞ্চিত ভাবিয়ে ছিল - পরে খবর নিয়ে জানতে পারলাম, ওই লুঙ্গি পড়া মানুষগুলো ছিল, ই,পি,জেড অঞ্চলের সাধারণ মানুষ যারা তাৎক্ষণিকভাবে এই শ্রমিক আন্দোলন-এর সাথে সংহতি জানিয়ে রাজপথে নেমেছিল! মাননীয় মন্ত্রি বোধ করি ভুলে গেছেন, পৃথিবীর তাবত মেহনতি মানুষের পরষ্পরের স্বার্থ অভিন্ন! তা ছাড়া এদেশের বাইশ লক্ষ গার্মেন্টস শ্রমিকের দেড়কোটি পরিবার ! এই পরিবারগুলো সবসময় সহকর্মি, ভাই, ভগ্নি কিংবা সন্তানকে আগুনে পুড়ে মরতে দেখে অশ্রুপাত করবে এমন আশা করা ঠিক নয়, এই অশ্রু যে কোন সময় অগ্নিতে রূপ নিতে পারে! এটাই হলো ইতিহাসের অভিজ্ঞতা; আর একেই বলে শ্রেণিসংগ্রাম! শ্রমিক আন্দোলনের চতুর্থ দিন ই, পি, জেড সহ ইয়ংওয়ান গ্রুপের স্বাভাবিক কাজ-কর্ম শুরু হয়ে গেছে। শ্রমিকরা যার-যার কাজে যোগ দিয়েছে । সেই শিউলি বেগমের ভাষ্যমতে, সব শ্রমিকেই ছত্রভঙ্গ, এর মধ্যে ফ্যাক্টরিতে দু’বার পুলিশ রেড দিয়ে মোট আটজন শ্রমিককে ধরে নিয়ে গেছে। যাদের নিয়ে গেছে তাদের কোথায় নিয়ে গেছে এ-টুকু পর্যন্ত কোন সহকর্মি জানে না! সব শ্রমিকই কাজে যাচ্ছে ভয়ে-ভয়ে।

কেউ কারো মুখের দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছে না। মনে হতে পারে এই আন্দোলন এখানেই বুঝি শেষ, কিন্তু বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। আমার রোজকার আড্ডার উদ্দেশ্যই বাসা থেকে বেরিয়েছি - পথেই দেখা হলো চার শ্রমিক বন্ধুর সাথে। এই শ্রমিকরা ই, পি, জেডে নয়, চট্টগ্রামের মুনচুরাবাদের এক দেশিয় মালিকানাদিন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন। আমাকে দেখেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে, ‘জসিম ভাই, আমাদেরকে অমুক নেতার ঠিকানা দিতে পারবেন?’ আমি বিস্ময় কণ্ঠে, ‘তার নাম তোমরা পেলে কোথায়?’ - পত্রিকায় দেখেছি ।

- তো ওনার ঠিকানা দিলে? - জসিম ভাই আমাদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে, আন্দোলন ছাড়া অন্য কোন উপায় নাই, বেতন কিছু বাড়িয়েছে ঠিকই, সেই সাথে পরিশ্রমটাও বেড়ে গেছে দ্বিগুণ। আগে যে কাজ একশ জন শ্রমিক করতো সে কাজ এখন পঞ্চাশ জনকে দিয়ে করাচ্ছে! সেই সাথে কথায় কথায় খিস্তিখেউড় আর গায়ে হাত তোলা তো আছেই। শ্রমিক বন্ধুদের কথা শুনার সঙ্গে-সঙ্গে মনে পড়ে গেল কংস বধের সেই অমর বাণী, ‘তোমারে বধিবে যে গো-কূলে বাড়িছে সে। ’ ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৫ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।