আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সে, আমি; আমরা ও আমাদের সম্পর্ক

যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে. সম্পর্কে সে আমার খালাতো বোন। আমার ছোট খালার সবার ছোট মেয়ে। আমার খালাদের (আম্মা সেঝো, ৪ বোন আম্মারা) মধ্যে এই খালা সবার ছোট। ছোট বলেই কি না জানি না, এই খালার প্রতি আমার অসম্ভব শ্রদ্ধাবোধ। আম্মার পরেই যাকে খুব সম্মান করি উনি হলেন আমার এই খালা।

উনি খুব মিশুক প্রকৃতির মানুষ। প্রচন্ড হাসিখুশি এবং গল্প / আড্ডা করতে উনার জুড়ি নেই। উনার সামনে গল্প করতে মিনিট দশেক বসলে কেউ না হেসে পারবে না। তার একেকটা কথার মাঝে এত হাস্যরস লুকিয়ে থাকে যাতে তাঁর সামনে কেউ থাকলে হাসতে বাধ্য সে। তাই সব আসরের মধ্যমণি আমার এই খালা।

আমার প্রিয় মানুষদের মধ্যে উনি একজন। ধরি, আমার খালাতো বোনের নাম “অহনা” । এখনও মনে পরে সেই ছোটবেলা থেকেই তার সাথে আমার সম্পর্কটা বেশ মজবুত ছিল। সে শুধু আমার বোন যে তা নয়। একাধারে সে আমার খুব ভাল একজন বন্ধুও ছিল।

এমন কি আমার বড় ভাই বোনদের থেকে তাকে আমি বেশি পচ্ছন্দ করতাম। তার সাথে সব কথা শেয়ার করা যেত। সেও তার মনের সব কথা আমাকে অকপটে বলে দিত। সে কোন সমস্যায় জড়ালে আমার কাছে আসতো বলতে। বলতে পারেন তার সাথে আমি বেশ ফ্রী ছিলাম।

অহনা খুব বোকা, ভীতু স্বভাবের ছিল। কেউ ক্যামেরা নিয়ে তার সামনে ছবি তুলতে দাঁড়ালে কেদে দিত। তখন তাকে থামানো অনেক কষ্টকর ছিল। খাওয়া দাওয়া কম করার কারণে তাকে আমরা সবাই আদর করে ডাকতাম “কাঠি” । এতে সে খুব ক্ষেপে যেত।

মনে পরে সে যখন ইন্টার মিডিয়েট দেবে তখন অবধি তাকে এই নাম ধরেই ডাকতাম। তার বাবা মানে আমার ছোট খালু ছিলেন ঢাকা। ঢাকার কাকরাইলে উনাকে তার পেশার কারণে থাকতে হত। সেখানে তিনি একাই থাকতেন। আর তার পরিবার থাকতো জয়দেবপুর, গাজিপুরে।

মাঝে মাঝে তিনি গাজিপুর যেতেন। এই খালু যখন মারা যান তখন খুবই কষ্ট পেয়েছিলাম। আমার প্রিয় মানুষগুলোর মধ্যে যে তিনিও আছেন। আমাকে অসম্ভব ভালবাসতেন। সে যাই হোক, মনে পরে যখন স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হত তখন স্কুল ছুটি থাকতো ১ মাসের বেশি।

সেই ১ মাসের জন্য আমরা চলে যেতাম নানু বাড়ি। আমি, আম্মা, ছোট খালা, আর অহনা। নানু আমার জন্মের আগেই মারা গিয়েছিলেন। অসাধারণ কেটেছে আমার সেই মধুর দিনগুলো। মামাতো ভাই বোন, অহনা, আমি সবাই মিলে অনেক মজা করে সময় কাটিয়েছি।

কুয়াশা মাখা শীতের সকালে উঠে বাদাম কুড়াতে যাওয়া কিংবা হাল্কা বাতাসে ঘোড়াঘুড়ি করা, কিংবা দূরে খেজুর গাছের রস নিয়ে যাওয়া লোকটার কাছ থেকে খানিক রস চেয়ে খাওয়া, খালি পায়ে ঘাসের উপর দিয়ে হাটা সেসব এখনও চোখের সামনে ভেসে উঠে। সারাদিন ছুটোছুটি করে, পিকনিক করে, কিংবা বোমবাস্টিং খেলে, পুকুরে মাছ ধরা দেখে সময় কাটতো। রাত নামলে হারিকেনের হাল্কা আলোয় চোর পুলিশ খেলার কথা মনে হলে এখনো অনেক মজা পাই। নানার বাড়িটা দোচালা হওয়াতে আমরা ঘুমাতাম উপরে। মাটিতে তোশক বিছিয়ে ঢালাও ভাবে ঘুমাতাম আমরা।

বয়স যত বাড়তে থাকলো ততই অহনার সাথে আমার সখ্যতা বাড়তে লাগলো। আমাদের বাসায় আসলে কিংবা আমরা তাদের বাসায় গেলে অনেক ভাল লাগতো। সে আমার থেকে ১ বছরের ছোট ছিল। তাই আমাকে সে ভাইয়া না ডেকে নাম ধরে ডাকতো। এই নিয়ে আমার ছোট খালা ওকে বকা দিত।

কিন্তু সে কিছুতেই আমাকে ভাইয়া বলে ডাকতো না। ওরা যখন ঢাকা চলে এসেছিল তখন প্রতি ঈদেই তার বাসায় যাওয়া হত। অহনার সাথে কাটানো প্রতিটা সময় আমার কাছে ছিল অনেক মুল্যবান। অহনা যখন ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে তখন থেকেই তাকে বিয়ে দেয়ার জন্য তার পরিবার উঠেপড়ে লেগেছিল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না।

আমি এই কারণে তীব্র প্রতিবাদ করেছিলাম। কেন এত তারাতারি বিয়ে দিতে হবে অহনাকে? ওর তো বয়সই হয় নি বিয়ের। বিয়ে করলে পড়াশোনা করবে কিভাবে? কিন্তু অহনার পরিবার রক্ষণশীল হওয়াতে আমার কোন কথাতেই কোন কাজ হয় নি। বিয়ের পরেও পড়াশোনা করা যাবে এটা ছিল উনাদের যুক্তি। সময় থেমে থাকে না।

আসতে আসতে আমরা বড় হতে লাগলাম। অহনা তার অসুস্থতার কারণে ইন্টার পরীক্ষা দিতে পারলো না। পরের বছর দিতে হল তাকে। ছোটবেলা থেকেই সে খুব অসুস্থ থাকতো। তাই তাকে নিয়ে সবাই অনেক চিন্তা করতো।

আমি যখন ইউনিভার্সিটিতে তখন অহনা সবে ইন্টার পাশ করে ডিগ্রীতে ভর্তি হয়েছে। আগেই বলেছি ছোটবেলা থেকে তার বিয়ের প্রস্তাব আসছিল। অনেক দেখে শুনে তার পরিবার একটা ছেলে পছন্দ করলো। সবারই পছন্দ হল ছেলে। কিন্তু অহনার কেন জানি এতে মত ছিল না, তারপর ও সে মত দিল।

এ ছাড়া আর কোন উপায় তার ছিল না। যেহেতু তার পরিবার চাপ দিচ্ছিল। সেই বিকেলের কথা আমার এখনও মনে আছে যেদিন সে আর তার মা আমাদের বাসায় এসেছিল ছেলের ব্যপারে আমার আব্বার সাথে কথা বলতে। অহনাকে একা পেয়ে আমি সেদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম - আমিঃ কি রে! খবর কি? অহনাঃ এই তো। ছেলে দেখে গিয়েছে।

আমিঃ জানি। তা কেমন লাগলো? অহনাঃ আছে আর কি, সেই রকম না। আমিঃ কেন, ভাল লাগে নাই? অহনাঃ না, আমার ভাল লাগে না। আমিঃ (রাগত স্বরে) তাহলে তোমার কারে ভাল লাগে? এতজন দেখলা কাউকে তো দেখি তোমার ভাল লাগে না! অহনাঃ (নিরবতা) আমিঃ তাহলে কি আমারে ভাল লাগে? কেমন ছেলে তোর পছন্দ? অহনাঃ (আমার দিকে তাকিয়ে) তোমার কি মনে হয়? আমিঃ দেখ, তুই যদি আমার সম্পর্কে বোন না হতিস, তাহলে তোকেই আমি বিয়ে করতাম। কাউকে দরকার হত না তাহলে।

আর তোকে অপছন্দ করার মত কিছু নেই। তুই অনেক শান্ত, ভদ্র একটা মেয়ে। আমি যেরকম চাই। কিন্তু আমার পরিবার আর তোমার পরিবার কেউ এরকম পরিবারের মধ্যে বিয়ে মেনে নিবেন না। তাই সেটা সম্ভব না।

আর আমিও চাই না। অহনাঃ হ্যা, জানি। সেই ছেলের সাথে তার বিয়ের কথা পাঁকা হয়েছিল। যথারীতি বিয়ের তারিখ ও ঠিক হয়েছিল। আমরা সবাই অনেক খুশি হয়েছিলাম তার বিয়ের ব্যপারে।

কারণ অনেক কষ্টের বিনিময়ে এরকম একটা ভাল পাত্র আমার খালু পেয়েছিলেন। তার গায়ে হলুদের স্টেজ সাজানো, বাজার, বাসা ডিজাইন করা, ছবি তোলা, বাসর ঘর সাজানো, গেইট ধরা, রান্নাবারা তদারকি করা, বিয়ে বাড়িতে গেস্টের আপ্যায়ণ, তদারকির কাজ ইত্যাদি সবকিছুতেই আমার উপস্থিতি ছিল সবসময়। এমন কি অহনার সাথে তার শ্বশুর বাড়িতে আমি আর আমার মামাতো ২ ভাই বোন গিয়েছিলাম। শেষ বিদায় দিয়ে যখন বাসায় আসলাম তখন নিজের অজান্তেই চোখ দিয়ে ২ ফোটা পানি গড়িয়ে পরেছিল। হয়তো এটা আমার প্রিয় বোনের, বন্ধুর বিদায়ের কারণেই।

বর্তমান সে ফুটফুটে এক কন্যা সন্তানের জননী। বিঃদ্রঃ অনেক তো গল্প লিখেছি। এইবার নিজের জীবন থেকে নেয়া সত্য ঘটনা লিখলাম। জানি, অনেক আগাছালো হয়েছে লেখাটা। আরো অনেক কিছু লেখা যেতো কিন্তু লিখলাম না।

এতে বড় হয়ে যেত অনেক। সংক্ষেপে লিখেছি যতটুকু পারা যায়। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।