আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাঙালি কৌমের কেলি কল্লোলিত কর কলাবতী/জানতো না যা বাৎসায়ন, আর যত আর্যের যুবতী

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ সাম্প্রতিক সময়ের মতো প্রাচীন কালেও বাংলার ওপর ভারতীয় আর্যদের আগ্রাসন অব্যাহত ছিল। তবে সে আগ্রসনের বৈশিষ্ট্য যতটা না ছিল সামরিক, তার চেয়েও বেশি ছিল ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক। তবে সে আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে প্রাচীন বাংলায় প্রবল বিরোধীতাও হয়েছিল।

আর্য আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তুমুল রুখে দাঁড়িয়েছিল বাঙালি কৌমের গর্বে গবির্ত বাঙালি । ভারতীয় আর্য আগ্রাসন আজও অব্যাহত। বাংলাদেশের কবি-সাহিত্যকগণ আজও এই আধিপত্যবাদের উপযুক্ত জবাবই দিয়ে চলেছেন। প্রাচীন বাংলার কৌম বাঙালি ছিল নির্জন-সবুজ গ্রামীণ প্রকৃতিতে লালিত। তার নিবাস ছিল, কবি রফিক আজাদ এর ভাষায়,‘সীমাবদ্ধ জলে, সীমিত সবুজে’।

অপরূপা প্রকৃতির মূখর আঙ্গিনায় নিজেকে নিয়েই তার আত্মমগ্ন দিনগুলি কাটছিল। তার চৌহদ্দি ছিল মাটির ঘর, নিকানো উঠান এবং ধান-আখ আর হলুদ সর্ষের ফসলের মাঠ; খালে-বিলে আর নদীতে মাছ আর বনভূমিতে পশুপাখি শিকার করে কাটত তার নিষাদজীবন । তাকে ঘিরে ছিল কৌমের সহজ সরল তাম্রবর্ণের মানুষ, আর তার অন্তরে ছিল ‘মনের মানুষ’। সে ভিতরে ভিতরে পরমের অস্বিত্ব টের পায়, দুঃখ-দুর্বিপাকে তার কাছে প্রার্থনা করে, নতজানু হয়; তাকে সুখদুঃখের সঙ্গী ভাবে। এই নিয়েই ছিল নির্জনতাপ্রিয় বঙ্গবাসীর মাতৃতান্ত্রিক নিষাদসমাজ।

জবা ফুল, বেলপাতা দিয়ে মাতৃদেবীর পুজা করত ওরা। কৌমের চিন্তাশীল নরনারী নারী কে পর্যবেক্ষণ করে, বিচিত্র বৈশিষ্ট্যের নারীকেই মর্তে পরমের প্রতীক বলে ভাবে । এভাবে কৌমসমাজে তান্ত্রিক ধ্যানধারণা ডালপালা মেলে। তন্ত্র হল প্রকৃতির অন্তরালের পরম সত্তাকে উপলব্দি করবার নিগূঢ় মার্গ বা পথ! বাঙালি চিরকালই এমনই থাকতে চেয়েছিল। পূর্ণিমা রাতে নির্জন জ্যোস্নার উঠানে বসে অস্ট্রিকভাষী নিষাদবুড়োর কাছে শুনতে চেয়েছিল আশ্চর্য সব রূপকথা, যে রূপকথা আজও বেঁচে আছে মধ্যযুগের ‌'মঙ্গলকাব্যে' ।

হয়তো রূপকথা শোনার সময় নিকটস্থ বনভূমি থেকে ভেসে আসত মাদলের ধিতাং ধিতাং বোল। ওই বনভূমিতে অরণ্যবাসী নিষাদেরা বোঙ্গা দেবতার মূর্তি ঘিরে নৃত্যগীতে মেতে উঠেছে যে! এই বোঙ্গা দেবতার নাম থেকেই বঙ্গ শব্দটির উৎপত্তি বলে কারও কারও ধারণা। এ প্রসঙ্গে কাবেদুল ইসলাম লিখেছেন,‘সম্ভবত অস্ট্রিক ভাষার দেবতাবোধক ‘বোঙ্গা’ শব্দ থেকে তাঁর ভক্ত অর্থে বঙ্গ শব্দের উদ্ভবের কথা অনুমান করা যেতে পারে। ( প্রাচীন বাংলার জনপদ ও জনজাতি গোষ্ঠী; পৃষ্ঠা,১৮) ...সে যা হোক। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্তের মৌতাতে অবগান করে কী সুখেই না কাটছিল প্রাচীন বঙ্গবাসীর দিনগুলি ! হায়! আত্মমগ্ন বাঙালি কৌমের এমন নিস্তরঙ্গ সুখের দিন আর রইল না।

পশ্চিম থেকে ঘনিয়ে এল আতঙ্কজনক কালো মেঘ। ভারতবর্ষে লোহার আবিস্কার হয় খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ অব্দে । এরও প্রায় সাতশ বছর আগে আর্যরা যাযাবর জীবন ত্যাগ করে ভারতবর্ষের পশ্চিমাঞ্চলে বসতি স্থাপন করতে থাকে। এই বসতিস্থাপনের প্রক্রিয়ায় আর্যরা ভারতবর্ষের আদি অধিবাসী দ্রাবিড়দের ধ্বংস করে ফেলছিল। ড. আর এম দেবনাথ লিখেছেন, ‘এ সংঘর্ষের পরিচয় বেদের পাতায় পাতায় পাওয়া যায়।

দেখা যায় আর্যরা তাদের দেবতা ইন্দ্রের কাছে মহেঞ্জোদারো নগরী ধ্বংস করার জন্য বারবার প্রার্থনা করছে। ’ ( সিন্ধু থেকে হিন্দু; পৃষ্ঠা, ৬২)। ওই মহেঞ্জোদারো নগরীটি দ্রাবিড়রা নির্মাণ করেছিল। উন্নত হরপ্পা সভ্যতার নির্মাতা তারাই। হরপ্পা সভ্যতা যে মিশর ও সুমেরিয় সভ্যতার চেয়ে উন্নত ছিল-ইতিহাসবিদগণ একবাক্যে স্বীকার করেছেন ।

হরপ্পার মানুষ সে যুগে সুতি কাপড়ের ব্যবহার জানত। তাছাড়া হরপ্পার জনগন, অর্থাৎ দ্রাবিড় জনগোষ্ঠী অনেক বেশি পরিকল্পিত এবং স্বাস্থসম্মত ভাবে নগর গড়তে সমর্থ হয়েছিলেন। প্রশস্ত এবং আলোবাতাস পূর্ণ ঘরবাড়িতে বাস করত। এরকম বাড়িঘর মিশর বা মেসোপটেমিয়ায় ছিল না। স্নানাগার তৈরি, ড্রেন ব্যবস্থা, পরিকল্পিত রাস্তা, পয়ঃনিস্কাশনের ব্যবস্থা এসব ক্ষেত্রে হরপ্পাবাসী অসাধারণ দক্ষতা প্রদর্শন করেছে।

অথচ আর্যরা দাবিড়দের দস্যু, দাস এবং অসুর বলে অবহিত করেছে! আর্যরা দ্রাবিড় সভ্যতা ধ্বংস করে বাঙালি কৌম ধ্বংস করতে পূর্বদিকে অগ্রসর হতে থাকে । সেই খ্রিস্টপূর্ব যুগে প্রাচীন বাংলার পশ্চিমাঞ্চল ঘন বনভূমিতে আচ্ছাদিত ছিল। প্রাচীন বঙ্গবাসী সে বনভূমি অতিক্রম করে কখনোই পশ্চিমে যায়নি। কেন? আপন কৌমজীবনে সন্তুষ্ঠ ছিল সে। সে পুজা (পুজা শব্দটি অষ্ট্রিক ভাষার শব্দ) করত, তীর্থে-তীর্থে ঘুরে বেড়াত।

প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপনই ছিল তার ধর্ম। এ ছাড়া ১৯৩৪ সালে লেখা জীবনানন্দের একটি কবিতার দুটি চরণ বিষয়টি বুঝতে সাহায্য করে - ‘অশ্বত্থের পাতাগুলো পড়ে আছে ম্লান শাদা ধুলোর ভিতর/ এ পথ ছেড়ে দিয়ে এ-জীবন কোনোখানে গেল নাকো তাই। ’ (রূপসী বাংলা) ... নিজস্ব কৌমজীবনে সমাচ্ছন্ন প্রাচীন বঙ্গবাসীর আত্মার স্বরূপটি উপলব্দি করা গেল। খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ অব্দে লোহা আবিস্কার হওয়ার পর ধারালো অস্ত্র নির্মিত হতে লাগল। তাতে ঘন বনভূমি কেটে সাফ করে বৈদিক আর্যদের পক্ষে পূর্বমুখী অভিপ্রয়াণ সহজ হয়েছিল।

তারা দলে দলে প্রাচীন বাংলায় আসতে লাগল । তৎকালীন সময়ে বাংলার জনসংখ্যা ছিল কম। লোকালয়ের বাইরে বসতি স্থাপনের জন্য প্রচুর জায়গা খালি ছিল । দীর্ঘকাল অবধি আর্য সম্প্রসারণ সীমাবদ্ধ ছিল করতোয়া নদী পশ্চিমপাড়েই। 'করতোয়া' নামটি বাংলায় আর্য প্রভাবের ফল।

কর (হাত) এবং তোয়া (জল)। শিব যখন পার্বতীকে বিয়ে করেন তখন শিবের হাতের জল থেকেই করতোয়ার উৎপত্তি! দিনাজপুরের ‘পুনর্ভবা’ নদীর নামটিও উত্তর বাংলায় আর্যস্মৃতির সাক্ষ বহন করছে। এসব প্রভাব হয়তো মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু আর্যরা সঙ্গে করে এনেছিল পশুবলির ধারণা। অথচ কৌমবাঙালি জবা ফুল, বেলপাতা দিয়ে মাতৃদেবী পুজা করত । আমি আগে একবার বলেছি যে পুজা শব্দটি অষ্ট্রিক ভাষার শব্দ।

তারা তীর্থে-তীর্থে ঘুরে বেড়াত। প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপনই ছিল তার ধর্ম। সে পশুবলি মেনে নেবে কীভাবে! তাছাড়া আর্যরা মানববিরোধী এক সংকীর্ণ ধারণায় আচ্ছন্ন ছিল- তা হল: ‘বর্ণাশ্রম প্রথা’; যা সাম্যবাদী বাঙালির তো মেনে নেওয়ার কথা নয়। কেননা তার জীবন ছিল শ্রেণিহীন কৌমজীবন। সে যাই হোক।

করতোয়ার পূর্বপাড়ের প্রাচীন বঙ্গবাসী আর্য অভিপ্রয়াণ রুখে দিয়েছিল! তার নজীর রয়েছে কবি আল মাহমুদ-এর ‘সোনালি কাবিন’ কবিতায়। অতীতে যাদের ভয়ে বিভেদের বৈদিক আগুন/ করতোয়া পার হয়ে এক কঞ্চি এগোতো না আর ... বলিপ্রথা এবং মানববিরোধী বর্ণাশ্রম প্রথা ছাড়াও আর্যরা সঙ্গে এনেছিল এক গ্রন্থ। সে গ্রন্থের নাম বেদ। প্রাচীন মানবসমাজের ধ্যানধারণা ধারণ করে বলে আমরা ওই গ্রন্থকে সম্মান করি, শ্রদ্ধা করি। তবে প্রাচীন কৌমবাংলায় মানুষ মানবরচিত গ্রন্থের বড় একটা ধার ধারত না ।

ওদের কাছে বিচিত্র রসায়নে সৃষ্ট মানুষ আর বিস্ময়কর প্রকৃতিই ছিল একমাত্র গ্রন্থ। একারণেই প্রাচীন কৌম বাংলার মানুষ মানুষরচিত গ্রন্থ পাঠ করে তৃপ্ত হত না। বেদের ওপর ওদের বিতৃষ্ণাই ছিল বলা যায়। দীর্ঘ কাল পরে বাঙালির আধ্যাত্মিক গুরু লালনের একটি গানেও বেদের প্রতি বিতৃষ্ণার কথা প্রতিফলিত হয়েছে- আত্মারূপে কর্তা হরি, মনে নিষ্টা হলে মিলবে তারি ঠিকানা। বেদ-বেদান্ত পড়বি যত বেড়বি তত লখনা (সন্দেহ) আর্যরা প্রাচীন বাংলায় বেদ নিয়ে এসেছিল বটে, তবে বিস্ময়কর হলেও সত্য যে - বেদে বঙ্গের নাম উল্লিখিত হয়নি! অবশ্য এটি কোনও গুরুতর অভিযোগের বিষয় নয়।

বেদের যুগে খুব সম্ভবত বৈদিক আর্যদের কাছে ‘বঙ্গ’ অপরিচিত ছিল। বেদ এর খন্ড চারটি। ঋগ্বেদ, সামবেদ, যজুর্বেদ এবং অথর্ববেদ। এই অথর্ববেদ -এ অবশ্য অঙ্গ দেশের নাম রয়েছে। ‘ঐতরেয় আরণ্যক’-এ সর্বপ্রথম ‘বঙ্গ’-র উল্লেখ করা হয়েছিল।

‘ঐতরেয় আরণ্যক’ টি ঐতরেয় মুনি প্রণীত। এটির রচনাকাল আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতক। তবে সে উল্লেখ সুখকর নয় বরং অপমানজনক। সেরকমই তো হওয়ার কথা। ‘ঐতরেয় আরণ্যক’-এর বঙ্গবিষয়ক শ্লোকটি এরকম: ‘ইমাঃ প্রজা স্তিস্রো অত্যায়মায়ং স্তানীমানি বয়াংসি।

বঙ্গাবগধাশ্বের পাদান্যন্যা অর্কমভিতো বিবিস্র ইতি। (২/১/১) অর্থাৎ, বঙ্গদেশবাসিগণ, বগধবাসিগণ এবং চের জনপদবাসিগণ, এই ত্রিবিধ প্রজাই কি দূর্বলতা, কি দুরাহার ও বহু অপত্যতায় কাক, চেটক ও পারাবাত সদৃশ! ‘ঐতরেয় আরণ্যক’ রচনাকালে বৈদিক আর্যরা বগধ (মগধ?), চের এবং বঙ্গবাসিকে ‘পাখির মতো অস্ফূটভাষী অথবা যাযাবর’ মনে করত। অথচ যে ভাষায় রচিত হয়েছে মানবসভ্যতার সমৃদ্ধতম দার্শনিকসংগীত, যে ভাষায় কাব্য রচনা করে সুর্যপ্রতিম এক বাঙালি কবি বিশ্বের স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছেন, যে ভাষার সম্মান রক্ষার্থে প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন একঝাঁক বাঙালি তরুণ, একুশ শতকে যে ভাষাটি মধুরতম ভাষা হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পেয়েছে, যে ভাষার শিশুতোষ ছড়ার ধ্বনিমাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে ফরাসিরা সযত্নে বইয়ে স্থান দিয়েছে । সুতরাং ঐতরেয় মুনির রচনায় সে ভাষার প্রতি ঈর্ষা এবং অবজ্ঞা প্রকাশ পেয়েছিল-এটা বোঝাই যায়। ঐতরেয় মুনির পর বঙ্গ সম্বন্ধে তাচ্ছিল্যপূর্ণ মন্তব্য করেন আর্য ঋষি বৌধায়ন।

ইনি ‘কল্পসূত্র’ লিখেছিলেন। তারই অর্ন্তগত ‘ধর্মসূত্র’- এ বৌধায়ণ লিখেছিলেন: ‘ যিনি বঙ্গ, কলিঙ্গ ও প্রাণৃন (!) দেশ ভ্রমন করিবেন, তাহাকে পুনস্তোম বা সর্বপৃষ্ঠা ইষ্টি করিতে হয়। ’ অর্থাৎ বঙ্গে যে যাবে তাকে প্রায়শ্চিত্য করতে হবে। এ প্রসঙ্গে গবেষক কাবেদুল ইসলাম লিখেছেন: ‘মূলত আত্মগর্বী আর্যদের রচিত এই সব গ্রন্থনিচয়ে পারতপক্ষে ‘বঙ্গ’ এর নাম এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে, আর কোথাও একান্ত বাধ্য হয়ে উচ্চারিত হলেও তা নেওয়া হয়েছে নিতান্ত অবজ্ঞা ও ঘৃণা ভরে। ’ (প্রাচীন বাংলার জনপদ ও জনজাতি গোষ্ঠী ।

পৃষ্ঠা,২৪ ) বৈদিক আর্যরা বঙ্গের উদ্ভব সম্বন্ধে উদ্ভট এক গল্প প্রচার করেছে। দীর্ঘতমা নামে এক ঋষি ছিল। সে ছিল অন্ধ এবং চরিত্রহীন। আর্য নারীরা তাকে ঘৃনা ভরে পরিত্যাগ করেছিল। দীর্ঘতমা ঋষি তারপর গঙ্গার জলে ভেসে যাচ্ছিল (!) ... তখন বলি নামে এক অনার্য (অনার্য শব্দটি লক্ষ করুন) রাজা তাকে উদ্ধার করে এবং প্রাসাদে নিয়ে যায়।

বলি রাজার স্ত্রীর নাম সুদেষ্ণা। এরপর বলি রাজা নাকি সুদেষ্ণার সঙ্গে যৌনসঙ্গমের জন্য দীর্ঘতমা ঋষিকে প্ররোচিত করে (!)। এর ফলে সুদেষ্ণার গর্ভে এবং দীর্ঘতমার ঔরসে পাঁচটি সন্তান জন্ম হয়। এদের নাম: অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুন্ড্র এবং সূক্ষ্ম। বলিরাজ এদের পাঁচটি রাজ্য দেন।

এদের নামানুসারে রাজ্যের নাম হয় অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুন্ড্র এবং সূক্ষ্ম। এই বিষয়ে মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান মন্তব্য করেছেন, ‘ব্রাত্যজনের চরিত্রহননের জন্য এটি একটা চিত্তাকর্ষক ব্রাহ্মণ্য-প্রচার’। (গঙ্গাঋদ্ধি থেকে বাংলাদেশ। পৃষ্ঠা, ১২) আর্য ব্রাহ্মণরা ক্রোধের বশে কৌমবাংলার এক মেধাবী চিন্তাবিদের রচনা ধ্বংস করে ফেলেছিল । সেই চিন্তাবিদের নাম কপিল।

যশোরের কপোতাক্ষ নদের পাড়ে কুপিলমুনি নামে একটি গ্রাম আছে, সেখাইে সেই খ্রিস্টপূর্ব যুগে কপিলের জন্ম। কপিল উত্তর ভারতে গিয়ে তাঁর দর্শন প্রচার করেন। কপিলের দর্শনের নাম সাংখ্য দর্শন ; যে সাংখ্য দর্শনের মূল হল প্রকৃতিপুরুষতত্ত্ব। কপিলের মতবাদ নিরেশ্বরবাদী এবং বেদ বিরোধী হওয়ায় মূল রচনা বৈদিক ব্রাহ্মণরা ধ্বংস করে ফেলেছে। তথাপি আজও বাঙালি কবির কবিতায় বেঁচে আছেন কপিল।

কবি আল মাহমুদ লিখেছেন- সে -কোন গোত্রের মন্ত্রে বলো বধূ তোমাকে বরণ করে এই ঘরে তুলি? আমার তো কপিলে বিশ্বাস, প্রেম কবে নিয়েছিল ধর্ম কিংবা সংঘের শরণ? (সোনালি কাবিন) ‘ আমার তো কপিলে বিশ্বাস’ বলতে আল মাহমুদ কপিলপ্রবর্তিত স্বাধীন মতবাদের প্রতিই ইঙ্গিত করছেন। ওই চরণ কটি প্রমান করে কপিল প্রাচীন বাংলার জন্মে গ্রহন করেছিলেন। এবং বাঙালি কবি আজও আজও তাঁকে নিয়ে কবিতা লিখেন। অন্যদিকে উত্তরভারত সাংখ্য দর্শনের স্থ’ল ব্যাখ্যা করে মাত্র! মধ্যযুগের বাংলার বজ্রযানী সাধকগণ কপিলের প্রকৃতিপুরুষ তত্ত্বটিকে আরও বিকশিত করেছিলেন। বুদ্ধের সময়ে অড়াড় এবং কলাম নামে কপিল-এর দুজন শিষ্য ছিলেন।

বুদ্ধ কপিলবস্তুর (কপিলবস্তু শব্দের অর্থ, যেখানে কপিল বাস করেন। কপিল শেষ জীবনে হিমালয়ের পাদদেশে চলে গিয়েছিলেন) রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করার পর সাংখ্য দার্শনিক অড়াড় এবং কলাম -এর শিষ্যত্ব গ্রহন করেছিলেন। তার পরের ইতিহাস আমরা জানি। অহিংসার দীপশিখা জ্বালিয়ে প্রাচীন ভারত আলো করেছিলেন মহামতি বুদ্ধ। অথচ পরবর্তীতে কট্টর ব্রাহ্মণ্যবাদ বুদ্ধকে ভারতবর্ষ থেকে উচ্ছেদ করে।

তখন বাংলাই বুদ্ধের মানবিক ধর্মটিকে বুকে টেনে পরম যত্বে আশ্রয় দিয়েছিল। ইতিহাসের পাতায় সেকথা লেখা রয়েছে। বুদ্ধ যেমন প্রথম জীবনে কপিলপ্রবর্তিত সাংখ্য দর্শনে আচ্ছন্ন হয়েছিলেন, ঠিক সে রকমই সাংখ্য দর্শনের প্রকৃতিপুরুষতত্ত্বটি ধারণ করে আছে বাংলার বাউল দর্শন । ‘মায়েরে ভজিলে হয় তার বাপের ঠিকানা’- লালনের এই জনপ্রিয় নারীবাদী গানটিতে তারই ইঙ্গিত রয়েছে- পুরুষ পরওয়ারদিগার অঙ্গে ছিল প্রকৃতি তার। প্রকৃতি প্রকৃতি সংসার সৃষ্টি সবজনা।

যে লালন আজ অনিবার্যভাবেই বাঙালির অর্ন্তজগতের গুরু হিসেবে অধিষ্ঠিত হয়েছেন, সেই লালনের জীবনীভিত্তিক ‘মনের মানুষ’ চলচ্চিত্রটি ভারতবর্ষের সরকার রাষ্ট্রীয় পুরস্কারে সম্মানিত করতে দ্বিধা করেনি। এরপরও সীমান্তে ভারত সরকার বাংলাদেশিদের রক্ত ঝরাতে দ্বিধা করে না। সামান্য অজুহাতে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষিরা বাংলাদেশিদের নগ্ন করে লাঠিপেঠা করে নয়তো গুলি করে হত্যা করে। এ কেমন দ্বৈত আচরণ? ভারত সরকার বাংলাদেশের আধ্যাত্মিক গুরুকে সম্মান জানানোর পরও কেন সীমান্তে রক্তপাত ঘটানোর নির্দেশ দেয়? অবশ্য এরকম পরস্পরবিরোধীতা অতীতেও দেখা গিয়েছে। অতীতে বৈদিক আর্যরা বাংলার কঠোর সমালোচনা করলেও কোনও কোনও লেখক বাংলার মাহাত্ম স্বীকার করে নিয়েছিলেন ।

যেমন বাংলার বস্ত্রশিল্পের প্রশংসা করে কৌটিল্য তাঁর ‘অর্থশাস্ত্রে’ লিখেছেন- ‘বাঙ্গকং শ্বেতং স্নিগ্ধং দুকূলং। পৌন্ড্রকং শ্যামং মনি স্নিগ্ধং। । ’ (২/১১/১৭) এর মানে বঙ্গ দেশের তৈরি দুকূল (রেশমী কাপড়) স্নিগ্ধ এবং মসৃণ। ঐতরেয় মুনি, বৌধায়ন প্রমূখ সংকীর্ণচেতা আর্য লেখকগণ বাংলার সমালোচনায় মূখর হলেও দেখা যাচ্ছে কৌটিল্যের ন্যায় মেধাবী পন্ডিত বাংলার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।

এ কেমন দ্বৈত আচরণ? কৌটিল্যই কামশাস্ত্রের রচয়িতা বাৎসায়ন কিনা সে বিষয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে। সে যাই হোক। বাৎসায়ন এর কামশাস্ত্র একটি অনবদ্য গ্রন্থ হিসেবে আজ বিশ্বে স্বীকৃতি লাভ করেছে । যৌনতা মানুষের জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক। যৌনজীবনের পরিপূর্ণতায় এ গ্রন্থ সহায়ক এবং কার্যকরী বটে, তবে আমি আগেই বলেছি-প্রাচীন কৌমবাংলার মানুষ কাছে মানবরচিত গ্রন্থের বড় একটা ধার ধারত না ।

ওদের কাছে বিচিত্র রসায়নে সৃষ্ট মানুষ আর বিস্ময়কর প্রকৃতিই ছিল একমাত্র গ্রন্থ। একারণেই প্রাচীন কৌম বাংলার মানুষ মানুষরচিত গ্রন্থ পাঠ করে তৃপ্ত হত না। হোক সে কামশাস্ত্র, বেদ কি অর্থশাস্ত্র। সেসব স্মরণ করেই কবি আল মাহমুদ লিখছেন- বাঙালি কৌমের কেলি কল্লোলিত কর কলাবতী/জানতো না যা বাৎসায়ন, আর যত আর্যের যুবতী (সোনালি কাবিন) বৈদিক যৌনশিক্ষা ব্যতীতই যে প্রাচীন বাংলার মেয়েরা কামকলায় অধিক পারদর্শী ছিল- কবির এ প্রবল আর্যবিরোধী বক্তব্য আমাদের দারুণ ভাবে শিহরিত করে। কাজেই সীমান্তে মানুষ হত্যার প্রতিবাদে আজ যে ভারতীয় পণ্যবর্জনের কথা উঠছে এবং ভারতীয় দূতাবাসের সামনে মানববন্ধনের যে উদ্যেগ নেওয়া হয়েছে, ভারতবিরোধী এইসব ন্যায়সঙ্গত প্রতিবাদ-প্রতিরোধ নতুন কিছু নয়, বরং আজ থেকে হাজার বছর আগেই প্রাচীন বাংলায় আর্যভারতের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ হয়েছিল ... তথ্যসূত্র: আল মাহমুদ ; শ্রেষ্ট কবিতা শ্রীযোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত; বিক্রমপুরের ইতিহাস আবদুল মমিন চৌধুরী; প্রাচীন বাংলার ইতিহাস ও সংস্কৃতি কাবেদুল ইসলাম; প্রাচীন বাংলার জনপদ ও জনজাতি গোষ্ঠী এ কে এম শাহনাওয়াজ; বাংলার সংস্কৃতি ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.