আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কমিটমেন্টের বেড়াজাল ভেঙ্গে সংবেদনশীল লেখকদের স্বপক্ষে এক মর্মবেদনা (শেষ কিস্তি)

সুখ চাহি নাই মহারাজ—জয়! জয় চেয়েছিনু, জয়ী আমি আজ। ক্ষুদ্র সুখে ভরে নাকো ক্ষত্রিয়ের ক্ষুধা কুরুপতি! দীপ্তজ্বালা অগ্নিঢালা সুধা জয়রস, ঈর্ষাসিন্ধুমন্থনসঞ্জাত,সদ্য করিয়াছি পান—সুখী নহি তাত, অদ্য আমি জয়ী। প্রথম কিস্তি এখানে হুমায়ূন আহমেদের লেখকগুন হুমায়ূন আহমেদ তৎকালীন সাপ্তাহিক বিচিত্রা পত্রিকাকে এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। ওখানে তিনি সেই অঙ্গীকারবদ্ধতার প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। তাঁর উত্তরে একথা স্পষ্ট যে এই উত্তর তাঁর আগেও জানা ছিল।

কিন্তু তিনি একটা পাথরের সাথে লড়াই করার আগে একটু প্রস্তুতি নিতে অনুকূল পরিবেশ তৈরী করে সে লড়াইয়ে নামতে চেয়েছেন। তিনি আগে তাঁর কাজ দেখিয়ে তারপর মুখ খোলার কৌশল নিয়েছেন। তার আগে তাঁর প্রতি ছুঁড়ে দেওয়া প্রশ্নে তিনি উত্তর না দিয়ে লেখায় মনোনিবেশ করেছেন। তাঁর লেখা জনপ্রিয় হতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে আমরাও সচকিত হয়ে লক্ষ্য করেছি হুমায়ূন আহমেদকে আমরা ‘প্রগতিশীল’ লেখক বলতে যা বুঝায়, সেভাবে ভাবতে পারছি না।

আরও লক্ষ্য করার বিষয় হলো, তাঁর সমালোচক বা প্রশংসাকারী সকলেই তাঁর এক বিশেষ গুনের দিকে ইঙ্গিত দিচ্ছেন। বাংলাদেশের ‘প্রগতিশীল’দের প্রতিনিধি শান্তনু কায়সার তাঁর কড়া সমালোচক। তিনি হুমায়ূন সম্পর্কে বলছেন, “তিনি (বরং) সুখপাঠ্য, কিছুটা সরল আর স্বাদু কাহিনী ও গদ্যের প্রতি বিশ্বস্ত থেকেছেন। ” তাঁর অন্যান্য গুনমুগ্ধ প্রশংসাকারীরা বলছেন, "তাঁর গল্প বলার সম্মোহনী ক্ষমতা, চরিত্র সৃষ্টির দক্ষতার" জন্য তাঁর লেখা তাদের ভালো লাগে। আর একজন বলছেন, “তাঁর লেখা ইচ্ছা করলেই সহজ ভাবে গ্রহণ করা যায় আবার যারা তলিয়ে দেখতে ভালবাসেন, তাদের জন্য যথেষ্ঠ চিন্তার খোরাক একই লেখায় থাকে।

” এছাড়া প্রায় প্রত্যেকেই তাঁর লেখার ‘হিউমার’-এর কথা বলেছেন। অর্থাৎ প্রত্যেকেই লেখক হিসেবে তাঁর মৌলিক গুনাবলীর দিক থেকেই তাঁর প্রশংসা করেছেন। এর সাথে আরও যোগ করে বলা যায়, তাঁর বিশেষ গুন হলো সব চরিত্রই তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ- ‘দারোয়ান’, ‘পাখাল’ থেকে শুরু করে প্রত্যেকেই। কেউই নাটকের একক মূল চরিত্র নয় যে কেবল তাকে চিত্রায়িত করে বিশেষ ভাবে তুলে ধরার প্রয়োজনটুকুর জন্যই অন্য চরিত্রের সৃষ্টি করতে হবে। এ কারণেই প্রতিটি চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলতে তাঁর প্রয়োজন পরে ডিটেইল্‌ড ওয়ার্কের খুঁটিনাটি, সব কিছু বিস্তারিত বর্ণনার।

আর এখানেই লেখকের বাস্তবের প্রতি সততা, সংবেদনশীল মননের ক্রিয়া ধরা পড়েছে। লেখক প্রকৃতই লেখক হয়ে উঠেছেন। কারণ এক সংবেদনশীল মনন ক্রিয়া ছাড়া এধরনের খুঁটিনাটি চরিত্র দাঁড় করানো অসম্ভব। অতএব আমরা এক মৃতপ্রায় সাংস্কৃতিক নগরীতে খুঁজে পেয়েছি একজন সংবেদনশীল লেখককে, ‘প্রগতিশীল’ হওয়ার কোন চেষ্টা যাঁর নেই। তাই হুমায়ূন আহমেদ আমাদের আগ্রহের বিষয়, জনপ্রিয়তা যাঁর প্রাথমিক প্রাপ্য।

হুমায়ূন আহমেদের প্রতিউত্তর এই জনপ্রিয়তায় প্রতিষ্ঠা লাভের পর হুমায়ূন আহমেদ পত্রিকায় মুখোমুখি লড়াইয়ে নেমেছিলেন। লেখক হিসেবে হুমায়ূন আহমেদের এক বিশাল গুন আর যোগ্যতা হলো নিজের বিশ্বাস, উপলব্ধিতে সততা রেখে কথা বলা। হুমায়ূন আহমেদ তাঁর এই গুনের উপর ভর করেই দাঁড়িয়েছেন। কমিউনিস্টদের অঙ্গীকারের উত্তর না দিতে পেরে মৌলিক সত্ত্বা হারানো লেখক হয়ে মৃতপ্রায় যারা, তাদের আবার উঠে দাঁড়ানোর জন্য এর তাৎপর্য সুগভীর। বিচিত্রাকে সাক্ষাৎকারে রাজনৈতিক অঙ্গীকারের প্রসঙ্গে উত্তর দিয়েছেন তিনি।

বলেছেন, “এটা লেখক থেকে লেখকে ভিন্ন হতে পারে। ” অর্থাৎ সকলকে সমান বা কোন বিশেষ মাত্রায় রাজনৈতিক অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে- তা তিনি মানেননি। ফলে স্বভাবতঃই আবার প্রশ্ন এসেছে, একেবারেই অঙ্গীকারহীন লেখক হতে কেউ পারেন কি না? প্রশ্ন এবার অনেক সরাসরি। এখানেই তাঁর সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ উত্তর। বলেছেন, “সবচেয়ে বিচিত্র জিনিষ মানুষের মন।

ওটাকে যদি লেখক ভালোভাবে জানতে পারেন, আমি মনে করি সেটাই তাঁর কৃতিত্ব। ” তাঁর এ কথার গভীর অর্থ করলে দাঁড়ায়- রাজনৈতিক অঙ্গীকারের প্রকাশটা মনগড়া ইতিহাস বিবর্তনের কাঠামোয় মালমশলা দিয়ে উপন্যাসের মাঝে ইতিহাস লেখার নায়ক চরিত্র তৈরী করার মাধ্যমে ঘটে না। মানুষের মন বড় বিচিত্র। এই বিচিত্র মন অনেক কিছু পারে। অনেক তার ক্ষমতা।

মনের ক্ষমতা ও তার বিকশিত হতে পারার কথা মনে রেখে লেখক এর সৃষ্টিশীল প্রকাশ ঘটাতে পারেন। এর মাধ্যমে প্রচ্ছন্নে আরও উন্নত পর্যায়ের রাজনৈতিক অঙ্গীকারের প্রকাশ ঘটাতে পারেন তিনি। অর্থাৎ লেখক মনের যোগ্য কারবারী হতে পারেন, যার ভিতর দিয়ে তাঁর অঙ্গীকার প্রকাশিত হয়ে উঠবে। এরপর আরও স্পষ্ট করে তিনি বলছেন, অঙ্গীকারের নামে লেখক সত্ত্বা ম্লান করে দিয়ে ‘ঐতিহাসিক’, ‘রাজনীতিবিদ’, ‘অর্থনীতিবিদ’ বা ‘সমাজ সংস্কারক’ হওয়াটা লেখকের কাজ নয়। অন্য এক স্থানে তিনি কারও লেখা পড়ে কিছু শেখার প্রসঙ্গে বলছেন, “আমি যদি ইতিহাস শিখতে চাই মূল ইতিহাসের বই পড়বো, ফিলসফি শিখতে চাইলেও সেভাবে।

” অর্থাৎ উপন্যাসিককে উপন্যাসিক হতে হবে। উপন্যাস লিখতে গিয়ে ইতিহাস লেখা চলবে না। এমন দৃঢ় আর বলিষ্ঠভাবে প্রগতিশীল লেখকের ধারনার বিরুদ্ধে হূমায়ূন আহমেদের স্পষ্ট বিরোধিতা প্রগতিশীল লেখক ধারনার খোপ থেকে বের হবার ক্ষেত্রে এক তাৎপর্যপূর্ণ প্রচেষ্টা। অতএব দেখা যাচ্ছে, হুমায়ূন আহমেদ এক নতুন ধারার দাবীদার লেখক। তিনি খুব ভালো করেই জানেন অঙ্গীকারবদ্ধ হবার প্রশ্নের জবাব বা এর অর্থ কী।

এই প্রশ্নের উত্তর তাঁর সবসময় তৈরীই ছিল, কিন্তু তিনি প্রতিকূল এই সমাজে এটা প্রকাশের একটা সহায়ক পরিবেশ খুঁজছিলেন। তাঁর জনপ্রিয়তা যখন তুঙ্গে উঠেছে তখনই তিনি তাঁর বিশ্বাসের কথাগুলো দৃঢ়তার সাথে প্রকাশ করেছেন। তাঁর এই কৌশল সংবেদনশীল লেখকদের এ সমাজে টিকে থাকার জায়গা করে নেবার জন্য কী পরিমাণ প্রতিকূল অবস্থায়, অঙ্গীকারবদ্ধতার নামে এক পাথুরে পরিস্থিতি আর সময়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে প্রতিষ্ঠা পাবার সংগ্রাম করছে, এরই এক ক্ষতিকর নমুনা। তাঁর এই সংগ্রামের আরও কিছু নমুনা, তাঁর “লেখার গভীরতা নেই”, এটা কিভাবে তিনি উপলব্ধি করেছেন- সেই ফাঁকা কথার সরস বর্ণনা দিয়েছেন বিচিত্রার সাক্ষাৎকারে। অঙ্গীকার প্রকাশঃ মনকে জানার কৃতিত্ব অঙ্গীকারবদ্ধতার প্রশ্নে হুমায়ূন আহমেদ মুখোমুখি হয়েছেন ‘মন’ সংক্রান্ত মন্তব্য দিয়ে।

এ মন্তব্য আরও এক কারণে তাৎপর্যপূর্ণঃ ‘কমিউনিস্টদের’ প্রভাবে আমরা ‘প্রগতিশীল’রা ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম মনের বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া, মনের বৈচিত্রপূর্ণ অসামান্য সৃষ্টশীল প্রকাশের প্রতি মনযোগ দেয়া আমাদের জন্য ক্ষতিকর। ওটা নাকি ভাববাদীতা! ‘বস্তুবাদী’ হতে গেলে ‘মন’ নিয়ে এসব বাড়াবাড়ি ভালো নয়। ওতে বস্তুবাদীতা ম্লান হয়ে বিভ্রান্তিকর হয়ে পড়ে। এ বক্তব্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ হচ্ছে ‘বস্তুবাদী’তার বিরুদ্ধে মনকে দাঁড় করানো। এতে আমরা বাংলাদেশের ‘বস্তুবাদী’ প্রগতিশীলদের ইতরোচিত (ভালগার) বস্তুবাদী অবস্থান সম্পর্কে বুঝতে পারি।

এই ধারা মানুষের সকল সমস্যাকে অন্ত্রের সমস্যার অধিক ভাবতে পারে না এবং চেতনা ও নান্দনিক বৃত্তিকে এক হিসাবে অস্বীকার করে। কবি শামসুর রাহমানের পক্ষে কবিতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে মিজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকায় শামসুর রাহমান সংখ্যায় এই ‘প্রগতিবাদী’ ধারার রাজনীতিকে এভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তো দেখা যাচ্ছে হুমায়ূন আহমেদও প্রয়াত শামসুর রাহমানের মতো এই রাজনৈতিক ধারার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়েছিলেন। তিনি ভালগার বস্তুবাদীদের অঙ্গীকারবদ্ধতার উত্তর দিয়েছেন মানুষের মন, তার গতি প্রকৃতি ও একে লেখকের বুঝতে পারার উপর গুরুত্বারোপ ক’রে। এর বিরুদ্ধে বিষ উদ্গার করে শান্তনু কায়সার সাপ্তাহিক খবরের কাগজে লিখেছিলেন, “মানুষের মন জ্যোৎস্না বা সৌন্দর্য্যের, ফুলের উপর তিনি বেশী গুরুত্ব আরোপ করেন, বাস্তবের চেয়ে স্বপ্ন তাঁর বেশী মনযোগ ও প্রশ্রয় পায়।

” শান্তনু কায়সারের দোকানদারী বস্তুবাদীতা স্বপ্নকে খুবই ঘৃণ্য মনে করে। এরা বুঝতে অক্ষম স্বপ্ন কী। বাস্তবের সাথে স্বপ্নের সম্পর্ক বা যোগসূত্রটা কোথায়। কার্ল মার্কসের বস্তুবাদ কখনই মন বা স্বপ্নকে অবস্তুবাদী কোন বিষয় হিসেবে দেখেনি। স্বপ্ন নিষ্ঠুর নির্মম অমানবিক বাস্তবতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্বরূপ, কষ্ট বেদনা লাঘবের এক মাধ্যম, যেখানে সকলেই মানবিক।

একে অস্বীকার করা মানে অমান্যকারীদের কষ্ট বেদনাকে সংবেদনে অনুভব না করে তার মানবিক হয়ে উঠার আকাঙ্খা আকুতিকে পায়ে দলা। সব লেখককেই তাই স্বপ্ন কল্পনাকে আশ্রয় করেই মানুষের মৌলিক মানবিক আকাঙ্খা মানবিক দুনিয়া গড়ার আকুতিকে প্রকাশ্যে আনতে হয়্য আর এভাবেই অসম অমানবিক বাস্তবতার বিরুদ্ধে তার অবস্থান ব্যক্ত হয়। সেজন্য স্বপ্নে কি দেখাচ্ছে সেটা নয়, বরং কি দেখাতে চাচ্ছে, কিসের প্রকাশ, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। সেই ম্যাসেজ আমরা পাচ্ছি কি না এটাই স্বপ্নের তাৎপর্য। হুমায়ূন আহমেদ মধ্যবিত্তের লেখক নন একথা আজ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে যে হুমায়ূন আহমেদ মধ্যবিত্তের লেখক।

এমনকি লেখাকে নিয়েও এ ধারনায় তিনি এতো প্রভাবিত হয়েছেন যে দশচক্রে পড়লে ভগবানও যেভাবে ভূত ব’লে শেষে নিজেকে মেনে নেন, লেখক নিজেও এটা সেভাবে মেনে নিয়েছেন। মধ্যবিত্তের লেখক আমরা কাদের বলতে দেখি? দু’টো অর্থে আমরা বলতে দেখি। একঃ মধ্যবিত্তের জীবনকে বিষয় বানিয়ে যিনি তাঁর রচনায় পাত্র-পাত্রীর সুখ-দুঃখের কথা লিখে চলেন। দুইঃ মধ্যবিত্তের সংকীর্ণ জীবন বোধ দিয়ে যিনি তাঁর রচনা রচয়িত করেন। বিষয়ের দিক থেকে বিবেচনায় নিলে “অয়োময়” সিরিজ নাটক যে মধ্যবিত্তের জীবন কাহিনী নয়, তা নিশ্চয়ই আমরা সকলেই মানবো।

'বহুব্রীহি', 'এইসব দিনরাত্রি' বা তাঁর প্রথম উপন্যাস 'শঙ্খনীল কারাগার' বিষয়ের দিক থেকে মনে হতে পারে মধ্যবিত্তের জীবন হিসাবে আদর্শ উদাহরণ। আর অয়োময়ও কি মধ্যবিত্তের সংকীর্ণ জীবন বোধ থেকে লেখা? এটার উত্তরেও হ্যাঁ বলতে আমরা পারছি না। এর দুই গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র মির্জা সাহেব ও কাশেমের মধ্যে এমন কোন জীবনবোধ আমরা দেখি না। এছাড়া অন্যান্য চরিত্রগুলোর কোনটাতেই তা আমরা পাই না। সাধারণভাবে আমরা যেগুলো পাই তা হলো হিউমার আর তাদের মনের ভালো আর মন্দের দিকগুলোর এক দ্বন্দ্বমূলক সমাহার।

কাজেই এদিক থেকেও অয়োময়কে মধ্যবিত্তের নাটক বলা যাচ্ছে না। এই দুই বিচার পদ্ধতিতে অয়োময়কে কোন পদবাচ্যেই চিহ্নিত করা যায় না। তাহলে আমরা যে তাঁকে ‘স্বপ্নের সওদাগর’ বলেছি এবং হুমায়ূন আহমেদ তাই মেনে নিয়েছেন, তার কি হবে? পুরো ব্যাপারটাকেই আসলে আমরা এবার একটু ভিন্ন চোখে দেখি। হুমায়ূন আহমেদের প্রতিটি রচনায় মূল বিষয় হলো মানুষের মন। মনের বিচিত্র গতি-প্রকৃতি, সৃষ্টি আর সংবেদনশীলতা, অসংখ্য তার প্রকাশ।

এই মন কখনও হয় মধ্যবিত্তের, কখনও জমিদারের, পাগলের, লাঠিয়ালের, পাখালের- যে কোন কারও। মোটের উপর বিষয় হলো মন। অয়োময় নাটকের শুরুতে আমরা দেখেছিলাম মির্জা সাহেবের মাথার যন্ত্রণা। মির্জা সাহেব ছিলেন প্রাকৃতিক বন্ধনে আবদ্ধ এক সামাজিক বৈষয়িক পরিস্থিতির প্রকাশ। তিনি জমিদার।

জমিদার-প্রজা-জমি মিলে একাকার বৈষয়িক পরিস্থিতির প্রকাশ তিনি। আমাদের অনেকের মধ্যে এমন একটা ধারনা কাজ করে যে জমিদার প্রজার সম্পর্কে জমিদারের নিষ্ঠুর নির্মম অমানবিক আচরণ বোধ হয় নৈর্ব্যক্তিক না, অর্থাৎ ব্যক্তি ইচ্ছা নিরপেক্ষ নয়। জমিদারের এই আচরণ ইচ্ছা নিরপেক্ষ নয়। জমিদারের এই আচরণ যে জমিদার হিসাবে তার ইচ্ছা নিরপেক্ষ অর্থাৎ তাকে করতেই হবে- এটা আমরা অনেকেই ধরতে পারি না। মনে করি যে জমিদার ইচ্ছা করলেই এ আচরণ বদলাতে পারেন।

অথচ এক বিশাল নৈর্ব্যক্তিক প্রাকৃতিকতার কাছে প্রজা-জমিদার উভয়ই বন্দী হয়ে আছে, তা তলিয়ে দেখতে আমরা এখনও শিখিনি। এছাড়া আমরা মনেও রাখি না যে, এই উৎপাদন সম্পর্ক পূর্ণ বিকশিত হয়ে না উঠার আগে পর্যন্ত ইতিহাসের এই পর্যায়টা ব্যক্তি ইচ্ছা নিরপেক্ষ ভাবে নির্মম ও রক্তাক্ত হতে বাধ্য। এই জমিদার তাই তার জমিদারী ভ্যানিটি রক্ষা করতে গিয়ে প্রজাকে বস্তায় ঢুকিয়ে ভয় দেখাবে, এটাই স্বাভাবিক। হুমায়ূন আহমেদ এই বাস্তবতাকেই কেবল স্বীকার করে ছবি এঁকেছেন তা নয়, বরং তিনি একই সাথে এই জমিদারের মাথায় এক অব্যক্ত নিরাময়হীন যন্ত্রণা চাপিয়ে দিয়েছেন। মনে রাখা দরকার, এই যন্ত্রণা নিরাময়হীন।

আমিন ডাক্তার এই অসুখ নিরাময় করতে পারেনি। কারণ এই জমিদার শেষ বিচারে হলেও মানুষ। জমিদারি নির্মম আচরণের সাথে তার মননের একটা অমীমাংসেয় সংঘাত থাকতে বাধ্য। সেই সংঘাতের প্রতীক মির্জা সাহেবের মাথার অব্যক্ত যন্ত্রণা। অতএব নৈর্ব্যক্তিক এই রোগও হবে নিরাময়হীন।

একে কেবল জীবনে ধারন করে কষ্টে কষ্টে সয়ে এই বৈষয়িক পরিস্থিতি আর সময় পেরিয়েই এর হাত থেকে মুক্তি পেতে হবে। অথচ জমিদারের ঘৃণিত চরিত্র দেখতে আর দেখাতেই আমরা অভ্যস্ত হয়ে আছি। জমিদারকে ঘৃণিত চরিত্র হিসাবে উপস্থাপনের চেয়ে জমিদারের জীবন আর তার রক্তমাংসের মানবিক জীবন-সংঘাত উপস্থাপন অনেক বেশী অগ্রসর চেতনা আর ইতিহাসবোধ সম্পন্ন এক বহিঃপ্রকাশ। আমরা ‘প্রগতিশীলরা’ নতুন অগ্রসর প্রকাশ ভঙ্গীতে অভ্যস্ত নই। আমরা যান্ত্রিক ভালগার বস্তুবাদীতায় মুখ থুবরে পড়ে থাকা দেখতে শিখেছি।

জমিদারকে তার বৈষয়িক পরিস্থিতি সহ উপস্থাপন করতে গিয়ে কিছুটা সহানুভূতি সে পেয়ে গেল, তা সত্ত্বেও কাশেম প্রজা হিসেবে আমাদের সহানুভূতি পাওয়া থেকে কিন্তু বঞ্চিত হয় না। জমিদার ও প্রজা একই বৈষয়িক নৈর্ব্যক্তিক পরিস্থিতির শিকার। ফলাফলে জমিদার মাথার যন্ত্রণা নিয়ে জীবন যাপনের কষ্ট ভোগ করছে আর প্রজা কাশেম ছেলেমেয়ে নিয়ে গান রচনা ক’রে আর গেয়ে এক মানবিক পরিস্থিতি তৈরী করে বেঁচে থাকার অর্থ খুঁজছে। এমনকি জমিদারের যে লাঠিয়াল, যাকে আবেগশূণ্য ভাবে ঠান্ডা মাথায় জমিদারের হুকুমে মানুষ খুন করতে হয়, সেও এসে আশ্রয় খোঁজে কাশেমের গানের জগতে। সে গান গায়, “আকাশ ভাইঙ্গা জোছনা পড়ে আমার ঘরে জোছনা কই” ইত্যাদি।

এভাবে এই চরিত্রগুলোও সহানুভূতিশীল হয়ে উঠেছে। নাট্যকার সেলিম আল দীন ‘অয়োময়’ সম্পর্কে মন্তব্যে বলেছিলেন, জমিদারদের অত্যাচার ইতিহাসের তুলনায় কিছুই আসেনি অয়োময় নাটকে। এতদিন ধরে জমিদারদের কাহিনী দেখানোয় তিনি উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন। ইতরোচিত বস্তুবাদী চিন্তার দোষ থেকে সেলিম আল দীনও মুক্ত ছিলেন না, তা এতে স্পষ্ট হয়েছে। কাশেম জমিদার হবার পর সাবিহা তার দ্বিতীয় স্ত্রী।

সাবিহা আর কাশেম- এভাবে এই নতুন প্রেক্ষিতে দুই চরিত্রকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে জমিদার হিসাবে এবং পুরুষ হিসাবে তাঁর স্ত্রীর পুরনো প্রেমিক সোলায়মান তার জমিদারিতে এসে ঘুরে বেড়িয়ে তার ভ্যানিটিতে ঘা দেবে- এটা সে মেনে নেয় নি। সে সোলায়মানকে গ্রামছাড়া করেছে। আবার বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে সোলায়মান যখন রাস্তায় পড়ে কাতর, তখন তাকে নিজেই সে বাড়িতে তুলে এনে আশ্রয় দিতে চেয়েছে। আবার সোলায়মানের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী সাবিহার কষ্ট তার নিজেরও কষ্ট ব’লে মনে করেছে। শোক ভুলে যেতে সহায়তা করার জন্য সাবিহাকে সহায়তা দিতে আগ্রহী হয়ে ঈর্ষাকাতর প্রথম স্ত্রীকেও কাসেম সহানুভূতিশীল হতে বলেছে।

মনের কষ্ট বুঝতে পারে এমন সংবেদনশীল স্বামী আবার স্ত্রীর প্রতি সহানুভূতিশীল হতে গিয়ে স্ত্রীর প্রেমিকের প্রতিও কোথাও যেন দূর্বলতা অনুভব করে। এটা এক মীমাংসাহীন জটিলতা। সাবিহা, কাসেম, সোলায়মান প্রত্যেকেই এই বৈষয়িক পরিস্থিতির হাতে বন্দী। কিন্তু তবু এক মানবিক পরিবেশ তৈরী হয়েছে সেখানে। এভাবে পুরো অয়োময় থেকে অসংখ্য ঘটনা তুলে আনলে তাতে মানবিক পরিবেশের আঁচ পাওয়া যায়।

সে প্রচেষ্টা না করে সারসংক্ষেপ করে বললে দাঁড়াচ্ছে, হুমায়ূ্ন আহমেদ মনের কারবারী লেখক, মধ্যবিত্তের লেখক নন। অলোচনার এই পর্যায়ে এসে তাই দেখা যাচ্ছে তাঁর অন্যান্য নাটকে উপন্যাসে, যেগুলোর জন্য তাঁকে মধ্যবিত্তের লেখক বলা হয়েছে, তা যথেষ্ঠ ভেবে বলা হয়নি। এমনকি হুমায়ূন আহমেদের নিজেরও এই প্রশ্নে সায় দেয়াটা কতটা মনের কথা আর কতটা ‘প্রগতিশীলদের’ প্রতি তাঁর অভিমানের কথা- তা ভেবে দেখা প্রয়োজন। ‘শঙ্খনীল কারাগার’, ‘বহুব্রীহি’ বা ‘এইসব দিনরাত্রি’ মধ্যবিত্তের জীবনকে ঘিরে লেখা হলেও আসলে এখানেও হুমায়ূন আহমেদের বিষয় ‘মন’। হতে পারে এই ‘মন’ মধ্যবিত্তের জীবনকে ঘিরে আবর্তিত।

আমরা সকলে যারা তাঁকে মধ্যবিত্তের স্বপ্নের সওদাগর বলেছি, আলোচনার এই প্রান্তে দাঁড়িয়ে তাঁদেরকে ‘বিষয়টা’ পূনর্বিবেচনা করতে বলি। ‘নিজের জন্য লিখি’ হুমায়ূন আহমেদের বিচিত্রায় সাক্ষাৎকারের শিরোনাম ছিলো “নিজের আনন্দের জন্য লিখি”। আমরা ‘প্রগতিবাদীরা’ যে ধরনের উত্তর শুনতে আগ্রহী বা অভ্যস্ত, এই উত্তর তেমন নয়। আমরা হয়তো শুনতাম ‘ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগনের জন্য লিখি’ বা আরেকটু এগিয়ে ‘মেহনতী জনগনের জন্য লিখি’ অথবা ‘সামাজিক দায়বদ্ধতার জন্য লিখি’- এইসব। অথচ হুমায়ূন আহমেদ বললেন কী না তিনি নিজের জন্য লিখেন! পাঠকের আনন্দটা গুরুত্বপূর্ণ বোধ হলেও নিজের আনন্দটাই তাঁর কাছে প্রধান।

এমন সগর্ব ঘোষনা আমরা লেখকদের কাছে শুনতে অভ্যস্ত নই। হুমায়ূন আহমেদের এই উপলব্ধির দু’টো দিক আছে। এক, লেখকের নিজের লেখার উপর নিজের সন্তোষ লাভ যে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তা তিনিই দৃঢ়তার সাথে প্রথম তুলে ধরলেন। নিজের ভিতরের “আমি”কে এভাবে টের পাওয়া এবং সদর্পে ঘোষনা দিয়ে বলা আসলে স্বাধীন একটা মন জেগে উঠে বিকশিত হবারই এক প্রাথমিক ঘোষনা। সমাজে ব্যক্তির উত্থানের ও বিকাশের একটা লক্ষণ টের পাওয়া যায় এতে।

প্রকৃতির আর রক্তের সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ “আমরা” থেকে যখন “আমি”তে উন্নিত হই, তখন আমরা সকলে ‘জনগনের জন্য লিখি’- এ কথার আড়ালে আমাদের প্রাকৃতিক আর রক্তসম্পর্কের বন্ধন আর লুকানো যায় না। হুমায়ূন আহমেদের দ্বিতীয় উপলব্ধিতে দেখা যায় তিনি গুরুত্ব দিতে চেয়েছিলেন লেখকের নিজের আনন্দের দিকটিকে। তবে পাঠকের আনন্দের দিকটাকে উপেক্ষা করে নয়। তাই তাঁর মন্তব্য “আমি তো লেখা শেষ করে ট্রাঙ্কে ভরে রাখি না, প্রকাশের তাগিদ বোধ করি। ” অথবা অন্যত্র বলেছেন, “আমার সময়ে আমি আমার লেখাগুলো পাঠকদের পড়াতে পেরেছি এটাই আমার সবচেয়ে বড় তৃপ্তি।

” ফলে দেখা যাচ্ছে পাঠকের সাথে তাঁর সম্পর্ক সম্বন্ধে তিনি স্পষ্ট। তিনি আসলে বলতে চেয়েছেন যে তিনি একই সাথে নিজের জন্যও লেখেন, সকলের জন্যও লেখেন। তবু আমাদের অনভ্যস্ত কান ও চিন্তা “নিজের জন্য লিখি” শুনে একে অসচেতন স্বতঃস্ফূর্ততা ব’লে চিহ্নিত করে ফেলতে পারে। সাপ্তাহিক বিচিত্রা কি সেই সময় একে এভাবেই চিহ্নিত করে “নিজের জন্য লিখি” কথাটাকে শিরোনাম বানিয়েছিল? ভেবে দেখা দরকার। অঙ্গীকারবদ্ধতা দাবীকারীদের প্রতি কমিটমেন্ট বা অঙ্গীকারবদ্ধতার নামে লেখকের সংবেদনশীল প্রাণকে সংহার করে আমরা যে ক্ষতি করেছি তা কাটিয়ে উঠার সুযোগ হিসাবে হুমায়ূন আহমেদকে যদি আমরা মূল্যায়ন না করতে পারি, তবে আমাদের কপালে আরও দুর্ভোগ আছে নিঃসন্দেহে।

স্থবিরপ্রায় সৃষ্টিহীন উত্থানরহিত মৃতপ্রায় সাংস্কৃতিক নগরীতে আমরা আবার প্রাণময়তা প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে অন্ততঃ একটা সম্ভাবনা হিসাবে উত্থিত হুমায়ূন আহমেদকে উপেক্ষা করার পরিণতি আমাদের কারো জন্য শুভ হবে না। একে লালন করা আমাদের কর্তব্য। মনে রাখা দরকার, রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার বোঝায় ভারাক্রান্ত সংবেদনশীলতাত্যাগী লেখকের চাইতে সংবেদনশীল লেখক-সাহিত্যিক অনেক সম্ভাবনাময়। এই সংবেদনশীল লেখক যদি সামাজিক দায়বদ্ধতাবোধহীন হন, তবু সে ক্ষতি সহনীয়। 'প্রগতিশীলদের' বিচারে হুমায়ূন আহমেদ যদি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ লেখক না-ও হন, তবু তিনি উপেক্ষার পাত্র হতে পারেন না।

কারণ তিনি সংবেদনশীল। প্রতিশ্রুতিবদ্ধতার নামে সৃষ্টিশীল মননচর্চার বিরুদ্ধে যে পাথর আমরা গড়েছি, তাকে ভাঙ্গার সাহস ও সুযোগ হুমায়ূন আহমেদের মতো আর কারও সহসা না-ও হতে পারে। আজকের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল তৈরীতে এর গৌরব অগৌরব সহ সবকিছুর ভাগীদার ‘কমিউনিস্টরা’। একে পরিশীলিত করে গৌরবের ভাগ আরো বৃদ্ধি করতে কিছু করার এটাই উপযুক্ত সময়। ‘প্রতিশ্রুতিবদ্ধতা’র বিরুদ্ধে হুমায়ূন আহমেদের উত্থানের সংগ্রামকে মর্মে অনুভব করে এ থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা কি আমাদের ‘প্রগতিশীলতা’কে প্রশ্ন করে একে পূনর্মূল্যায়ন করার মধ্য দিয়ে লেখক-সাহিত্যিকদের মনন চর্চার এক অনুকূল পরিবেশ গড়ে তুলতে পারি না? @ এই রচনাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।