আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শিল্পী সাহিত্যিকের উপর সোসাল কমিটমেন্টের মুগুর



১. ব্যক্তির সামাজিক দায়বদ্ধতা বা সোসাল কমিটমেন্ট নিয়ে তর্ক-বিতর্ক বহু পুরানো। বিশেষত আমাদের এই ভুভাগে সত্তর-আশির দশক জুড়ে কমিউনিষ্ট চিন্তার আধিপত্যের যুগে এই ভাবনার একটা রমরমা সময় গিয়েছে। সোসাল কমিটমেন্ট বিষয়টা যে জানে না বা জেনেও কেউ যদি মানতে রাজি না হত তাঁর দুর্দশার সীমা ছিল না। এছাড়া এর উপরে যারা ছিল সংস্কৃতিতে সাহিত্য, শিল্পকলার জগতের সৃষ্টিশীল কাজের দুনিয়ার লোক এদের দুর্দশা ছিল আরও বেশী। সোসাল কমিটমেন্টের মুগুড় মেরে এমন কত সম্ভবনা যে স্রেফ খুন করা হয়েছে তার সীমা-পরিসীমা নাই।

নানান কারণে নিজ দোষে বা গুণে আজ সমাজে সোসাল কমিটমেন্টে নামে ভাবনার আধিপত্য ফিকে হয়ে গেছে, যেটাকে বলে চিন্তার সোসাল হেজিমনি তা আর নাই। এর একটা সুবিধা ভোগ করেছে আমাদের নতুন প্রজন্ম। আবার সোসাল কমিটমেন্টের তর্ক মুখোমুখি হতে হয় নাই বলে তর্কটাই আদতে কী ছিল তা অনেকের জানা হয় নাই। এই পরিস্হিতিতে তরুণ ব্লগার হাসান মাহবুবের "প্লাস্টিকের ফুল আর খেলনা একতারার গল্প" নামে লেখা একটি গল্প Click This Link পড়ছেন ব্লগার স্তব্ধতা; পরে প্রতিক্রিয়ার মন্তব্য ও নিজেই এপ্রসঙ্গে Click This Link পোষ্ট লিখেছেন। স্তব্ধতার এই পোষ্ট সুত্রে হাসান মাহবুবের লেখাটা পড়া হয়ে গেল; আগে পড়ি নাই।

দিন তারিখ লক্ষ্য করলাম ০৮ ই অক্টোবর, ২০০৯ অর্থাৎ ৭ মাস আগে হাসান এটা লিখেছিল যদিও, আর আমার চোখে পড়ল এখন। হাসান মাহবুব সম্পর্কে আমার একটা ধারণা শেয়ার করি: সাধারণভাবে বললে, ভাল একটা অস্হিরতা ওর মধ্যে আছে বলে মনে হয়, আস্হার সাথে অনেক কিছু করে কিন্তু অলক্ষ্যে একটা আস্হার অভাব যেন তাঁকে বারবার কোথায় আটকে ফেলে। ও যা করতে চাই এর স্বপক্ষে একটা শক্ত সামাজিক আনুকুল্য ও পাঠক সাপোর্ট না পাবার অসুন্তুষ্টি যেন ওকে তাড়া করে বেড়ায়। ভাল হত যদি ওর বিশ্বাসমত ওকে আমরা বাইরের সকলে একটা জায়গা করে দিতে পারতাম, ও লতিয়ে লতিয়ে কিন্তু নিজের ক্ষমতা দেখিয়ে নিজের একটা জায়গা করে নিতে পারত। নানান কারণে যেমন দুনিয়ার কাম্য অনেক কিছুই ঘটে না তেমনি এটাও ঘটেনি।

আমার এই ধারণা একান্তই আমার, হাসান বা যে কেউ এটা অবলীলায় উপেক্ষা করতে পারে। কোন ক্ষতি নাই। তবে সত্য বা মিথ্যা আমার এই ধারণার কারণেই হাসানের লেখা নিয়ে আমি কখনও কিছু লিখি নাই বলেই আমার মনে হয়েছে। কথার পিঠে কথা হিসাবে তাহলে প্রশ্ন উঠে এখন কেন লিখছি? কারণ ব্লগার স্তব্ধতা এর পোষ্ট; হাসানের মুল লেখায় উনার কমেন্ট আর এই পোষ্ট "শিল্প বা শিল্পীর দায়বদ্ধতা" নিয়ে তোলা প্রশ্ন আমার অনেকদিনে থেকে বেছে রাখা লেখার এক প্রসঙ্গকে খুচিয়ে তুলেছে। "শিল্পের দায়বদ্ধতা", "শিল্পীর দায়বদ্ধতা" অথবা "সামাজিক দায়বদ্ধতা" - এইসব কথাগুলো নিয়ে বিগত আশির দশক থেকে আমিও "স্তব্ধতা" মত করে ভাবতাম।

দায়বদ্ধতার মুগুর হাতে নিয়ে ঘোরতরভাবে একে সঠিক বলে বয়সের দোষে মারমুখো তর্কে ধাবিত হতাম, বিপক্ষের কোন কথা মাটিতে পড়তে দিতাম না, সে সময়। এখন সম্ভবত বয়সে পেকেছি, জানা ও নিশ্চিত মনে করা ধারণাগুলোকে ঠান্ডা মাথায় পুনঃ পুনঃ পরীক্ষায় ফেলে যাচাই করার মত অভ্যাস রপ্ত করেছি; এসবের দরকার ও লাভালাভ বুঝতেও পারি। সম্ভবত সেজন্য বুঝি "দায়বদ্ধতা" বিষয়ক ধারণাগুলো আবার উল্টপাল্টে দেখার, অন্তত রিফাইন করে বুঝার দরকার ও স্কোপ আছে; এবং তা আমার দরকারী কাজ হয়ে অপেক্ষা করছে। "সামাজিক দায়বদ্ধতা" বা "শিল্পীর দায়বদ্ধতা" প্রসঙ্গ নিয়ে আর ছড়িয়ে কথা তুলব এখন। আর সেই ফাঁকে এবিষয়ে স্তব্ধতা ও হাসানের মন্তব্য প্রাসঙ্গিক করে তুলব।

২. মানুষকে আমরা ক্রমশ ব্যক্তি হয়ে উঠতে দেখি বটে, বুঝতেও পারি; মানি এটা বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি হয়ে উঠার সময়ও বটে কিন্তু, আমাদের ভুলে যাওয়া চলে না - সমাজের মধ্যেই ব্যক্তি হবার কসরৎ আমাদের চলে তবু পরস্পর আমরা পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত থেকেই যাই। হয়ত, সেই সম্পর্কটা এবার এক নতুন জানালা খুলে দেয় তবু তা শেষাবধি সম্পর্কিত তো অবশ্যই; লেনদেনে, ভোগে উৎপাদনে ঘোরতর আরও জটিল জড়াজড়িতে। ফলে মানুষ মানেই সামাজিক মানুষ - মুল এই কথাটা একচিলতেও হেলে না। এই সারকথাটা টিকে যায়। সামাজিক মানুষ একএকটা আলাদা ব্যক্তি বলে একটা আপতিক ভ্রম তৈরি হলেও ঐ ব্যক্তির সামাজিক দায়, নিজের সমাজের কাছে নিজের দায় হয়ে থেকেই যায়।

বিচ্ছিন্ন ব্যক্তির উল্টোপিঠে ঐ ব্যক্তির সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা উঠে এখান থেকেই। সামাজিক দায় মানে সমষ্টির স্বার্থের পক্ষে এক আনুগত্য প্রকাশের প্রয়োজনীয়তা অনুভব ও সে বিষয়ক ব্যক্তির কর্তব্য। এতদূর পর্যন্ত যা বললাম সেটা ব্যক্তির সামাজিক দিক একটা আছে এটা যারা ধরতে, বুঝতে পারেন তাঁরা মানবেন। স্তব্ধতার সাথেও এই কথা পর্যন্ত আমার কোন অমিল দেখি না। কিন্তু ব্যক্তি যদি বলে আমি সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা কী জিনিষ বুঝি না, মানতেও চাই না।

অথবা, আরও আগ বাড়িয়ে কেউ বলল, আমি বুঝি কিন্তু মানব না, মানতে বহুত কষ্ট তাই মানতে পারব না, মাফ করেন। অথবা বলল, এসব ভারি ভারি কথা ফ্যালায় রাখেন, এগুলো আনপ্রাকটিক্যাল। বিরক্ত কইরেন না। তাহলে আমরা যারা বুঝি বলে দাবী করি তারা কী করব? বিশেষ করে যারা ক্রিয়েটিভ দুনিয়ার লোক, বাস্তব দুনিয়া ও মানুষকে গভীর পর্যবেক্ষণে দেখেন, সেসব অভিজ্ঞতা নিয়ে গল্প কবিতা লেখেন, ছবি আঁকেন, ছবি বানানোর নানা কাজ করেন এদের প্রতিই-বা আমরা কী এটিচ্যুড মনোভাব নিব? আমরা কী হাতে একটা করে মুগুর নিয়ে সবাইকে "সামাজিক দায়বদ্ধতা" বা "শিল্পীর দায়বদ্ধতা" বুঝাতে বসব? এদের সবার নাকের ডগায় একটা করে "দায়বদ্ধতার" নোটিশ ঝুলিয়ে দিব? তাদের লেখক, শৈল্পিক বা প্রাত্যহিক কাজে সামাজিক দায়বদ্ধতা নাই বলে কঠোর সমালোচনা, ক্রিটিকের ঝড় তুলব? সব উদোম করে দিতে পেরেছি বলে বাহবা চাইব? এর উত্তর আমি এখানে কীভাবে দিব - তা বলতে গিয়ে অনেকের থেকে সম্ভবত ভাবনার তফাৎও হতে পারে; তাতে পাঠকের মনোযোগ চাইব। আগে বলেছি সামাজিক দায়বদ্ধতা দিক আমাদের আছে, আমরা বুঝতে পারি, মানি কিন্তু সে কর্তব্য অমান্য করার জন্য কাউকে মুগুর হাতে নিয়ে তাড়া করে দোষারোপ করা, সমালোচনা করা, শিখানোর চেষ্টা বা সর্বোপরি বাধ্য করা - আমার কাছে ঠিক বা কাজের কাজ মনে হয় না।

এটা পথ নয়। কারও এপথে হাঁটা উচিত বলে মনে হয় না। কেন? কারণ, ঘটনার ভিন্ন একটা দিক আছে। যেমন ধরেন, বলছি বটে এটা সামাজিক দায়বদ্ধতা, সমাজের কাছে ব্যক্তির দায় অনুভব করা ইত্যাদি। কিন্তু ভেবে দেখলে আমরা বুঝব শেষ বিচারে কেউ যদি কোন দায়বোধ করে সেটা আসলে করে সমাজের কাছে না, বরং নিজের কাছে।

আরও স্পষ্ট করে বললে, এটা নিজের সাথে নিজের দায়বোধ, বোঝাপড়া; সেটা আবার কোথায়, কতটুকু সেটাও নিজের কাছে নিজেই দায়বোধ ও প্রতিজ্ঞা করার বিষয়; বাইরের কোন পুলিশ বা মুগুরের কাজ বা বিষয় এটা নয়। ফলে আমাদের বাইরের কারও কোন মুগুর মারার ভুমিকাই এখানে নাই। তাহলে কথা দাঁড়ালো, সামাজিক দায়বদ্ধতা জিনিষটা আসলে কাউকে নিজের সাথে নিজের বোঝাপড়া করতে দেয়া ও ফলশ্রুতিতে তাঁর একটা দায়বোধ করা অথবা না করার বিষয়। মুগুর, শাসনের কোন জায়গা এখানে নাই। এছাড়া, সমাজ বলে বিমূর্ত, মূর্ত আকারে যা দেখা যায় না এমন কিছু খাড়া করার দরকারই নাই।

কারণ, প্রত্যেক ব্যক্তির ভিতরে সমানভাবে এবং একইসাথে সমাজও আছে, অর্থাৎ সামাজিক সত্বা আছে। অতএব তা বাইরে খুঁজার দরকার নাই, বরং ভিতরেই টের পাবার ব্যাপার সেটা। ফলে মুগুর দিয়ে এখানে কী হবে? ওর কাজই বা কী? ৩. প্রসঙ্গ কথা এখানে শেষ করতে পারতাম হয়ত; আমার মুলকথা এখানে শেষও বটে। কিন্তু প্রসঙ্গটা এখানে স্তব্ধতা তুলেছেন সাহিত্য বা লেখালেখি লেখকের দিক থেকে। ফলে আরও একটা সতর্কতার দিক আছে।

দায়বদ্ধতা প্রসঙ্গে আমার উপরের কথার মানে কী এমন যে, আমার দায়বদ্ধতার ব্যাখ্যা অনুযায়ী যে লেখকের নিজের সাথে নিজের বোঝাপড়া, দায়বোধ ঘটেনি - সে আসলে লেখকই না অথবা চাই কী আমরা উনাকে লেখক বলে মানতে অস্বীকার করব? একটা হীনদৃষ্টিতে তাকে দেখব, বিচারে বসব? এই প্রসঙ্গে গল্প লেখক হাসান এখানে স্তব্ধতার তোলা প্রশ্নের উত্তরে উপরে মন্তব্যে কিছু স্পষ্ট কথা জানিয়েছেন তা তুলে আনছি: "সামাজিক দায়বদ্ধতার সাথে আপোষ করলে শিল্পীস্বত্তা ক্ষতিগ্রস্থ হবার সম্ভাবনা থাকে। ..........লিখে সমাজ উদ্ধার করব? ওভাবে ভাবিনি এখনও। বা ভাবার পর্যায়ে যাইনি। অতটা দায়িত্ববোধ আমার ঘাড়ে এখনও চাপেনি। " আমার অবস্হান হাসানের পক্ষে দাঁড়াবে।

আমি হাসানের কথা পছন্দ করেছি। তবে, লেখকসত্ত্বার হাসান আর সমাজের ব্যক্তি হাসানের মধ্যে একটা তফাৎ তৈরি করব এখানে। এটা হাসান বলে নয়, সব সাহিত্যকার লেখকের বেলায়ই আমি করব, করা জরুরী। ব্যক্তি হাসান - এই সত্ত্বার বেলায় হাসান নিজের সাথে নিজের বোঝাপড়া, দায়বোধ কোথায় কতটুকু ঘটাবে বা ঘটাবেনা - সেটা দায়বদ্ধতা বিষয়ে আমার উপরের ধারণা ও বিচার আমি এখানেও বহাল রাখব। যদিও সেটা এখানে গৌণ বিষয়।

কিন্তু হাসান যেখানে লেখকসত্ত্বায়, গল্প লিখতে বসা লেখক হাসান - এর বিচার করতে গিয়ে নতুন কিছু বাড়তি কথা, বাড়তি দিক যোগ করব। হাসান বলছে, "সামাজিক দায়বদ্ধতার সাথে আপোষ করলে শিল্পীস্বত্তা ক্ষতিগ্রস্থ হবার সম্ভাবনা থাকে" - এটাই গুরুত্ত্বপূর্ণ মুল কথা। কেন? সামাজিক দায়বদ্ধতা যেটাকে আমি ব্যাখ্যা করেছি নিজের সাথে নিজের বোঝাপড়া ও তৎজাত নিজের কাছে নিজের দায়বোধ, উপলব্দি - এসব কথাগুলো আসলে নিজের একধরণের তাত্ত্বিক বা নীতিগত সংকল্প ও প্রতিজ্ঞা। তাহলে এর ব্যবহারিক দিক কী, কেমন হবে? বিশেষত আমি যদি চিত্রকর বা গল্প বলার কোন লোক অর্থাৎ লেখক হই? নীচে আমার উদাহরণে লেখকের নামটা ধরা যাক হাসান মাহবুব, আমাদের ব্লগার, লেখক হাসান মাহবুব নয়। কেবল নামটা নিলাম যাতে একটা যে কোন লেখক সম্পর্কে ভাব আসে।

সমাজে বহু ধরণের রাজনৈতিক চিন্তা তৈরি হয় হবে, ভাঙা গড়ার সংঘাতের ভিতর দিয়ে সেগুলো এগিয়ে চলবে। রাজনৈতিক চিন্তা, ভাব, দর্শনের সেসব কারবারের মধ্যে কোনটা প্রভাবশালী, কোনটা ক্ষীণ, কোনটা অপুষ্ট অবিকশিত ইত্যাদি নানান রূপ, আকারে বিরাজ করবে। আমাদের হাসান সেসবের কোন একটা প্রতিনিধি, পছন্দ করে। ওদিকে ধরা যাক সামাজিক দায়বদ্ধতা বা কমিটমেন্টের দায়-কর্তব্য সম্পর্কেও নিজের প্রতিজ্ঞা সংকল্পে সে বুক উচু সটান ফয়সালা সেরে আসা ব্যক্তি। এখন লিখতে বসে হাসান কী ভুমিকা অবস্হান নিবে? সে কী তাঁর পছন্দের রাজনৈতিক চিন্তা, ভাব, দর্শনের প্রচারক, ক্যাম্পেনার হয়ে যাবে? নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতাগুলোর ভিতর দিয়ে গভীর পর্যবেক্ষণ শক্তি আর কোন ঘটনাকে বিভিন্ন দিক থেকে উল্টেপাল্টে ভাববার, কল্পনা করার ক্ষমতা অর্জন - এগুলো কোন লেখকের মৌলিক প্রয়োজনীয় গুণাবলী বলে আমার ধারণা।

এসব করতে গিয়ে কোন ঘটনায় লেখকের রাজনৈতিক বিশ্বাসের সীমার বাইরের কোন ঘটনা যদি সে কুড়িয়ে পায় তবে সে কী করবে? এড়িয়ে যাবে? ঘটনাকে মনে গ্রেফতার করে রাখবে না? দেখি নাই মনে করে গুরুত্ত্বহীন বলে উপেক্ষা করবে? তাঁর পরিশীলিত রাজনৈতিক বিশ্বাসের বাইরে কোন সত্য থাকতে পারে না বলে নিজেকে প্রবোধ দিবে? অর্থাৎ এককথায়, লেখকের তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাস ও সোসাল কমিটমেন্টের অধীনে তাঁর চিন্তা করার ক্ষমতা, লেখকস্বত্ত্বাকে অধীনস্ত করবে কী না? এর উত্তর একদম সোজা; লেখক করতে পারেন তবে সেক্ষেত্রে সেটা পরিণত হবে একটা "কমিটেড পার্টি সাহিত্য"; যার খাস মানে হলো কোন চিন্তার প্রচারকের ভুমিকায় অবতীর্ণ হওয়া। এর সাথে তুলনায়, চিন্তার অফুরন্ত অসীম সম্ভবনাকে যে জারী রাখে, দুয়ার খুলে রাখে এমন লেখক সে আর নয়। চিন্তাকে বারবার পরীক্ষায় ফেলে প্রতি মুহুর্তে রিফ্রেস সতেজ করার দায়িত্ত্ব যে বোধ করে না বা নেয়নি, এমন কাজ হবে সেটা। সে অর্থে, লেখকসত্ত্বা ওখানে মৃত, নিজেকে মৃত ঘোষণা করা সেটা। কোন পার্টির বা কোন চিন্তার প্রচার ক্যাম্পেনে যাবার দরকার থাকতে পারে এবং তা সদর্থকভাবেই থাকে।

এই ভাল প্রচারককে লেখক সংজ্ঞা থেকে বাইরে রেখে কথাটা বলেছি। ব্লগার বাস্তব হাসান মাহবুবের "সামাজিক দায়বদ্ধতার সাথে আপোষ করলে শিল্পীস্বত্তা ক্ষতিগ্রস্থ হবার সম্ভাবনা থাকে" - এই বাক্যটাকে আমি এজায়গা থেকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেছি। এই অর্থে আমি "শিল্পীস্বত্তাকে ক্ষতিগ্রস্থ" না করার, ওকে মৃত না বানানোর পক্ষে, আমি হাসানের কথা পছন্দ করেছি। তবে হাসান পরে যেটা লিখেছে, "....লিখে সমাজ উদ্ধার করব? ওভাবে ভাবিনি এখনও। বা ভাবার পর্যায়ে যাইনি।

অতটা দায়িত্ববোধ আমার ঘাড়ে এখনও চাপেনি। " - এটা তাঁর আগের কথার স্বপক্ষে ওকে আরও পোক্ত করে এমন কোন কথা হয়নি। বরং লেখকসত্ত্বার পক্ষে থাকলে আর সামাজিক "দায়িত্ববোধ" এর পক্ষে সম্ভবত থাকা সম্ভব নয় এমন ইঙ্গিত সে করেছে। এটা একটা ভুল ধারণা এবং কোন লেখকের জন্য অদরকারী ধারণাও বটে। যেমন, কেউ যদি বলেন, আমি আমার লেখকসত্ত্বার মধ্যে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে চাই।

সোসাল কমিটমেন্ট বা নিজের সাথে নিজের প্রতিজ্ঞার বিষয়ে আমার সীমাবদ্ধতা আছে ফলে সেদিকে যেতে চাইনা, ভাবি না। একথা জন্য তাঁর উপর কমিটমেন্টের মুগুর ধরার কোন মানে হয় না সেটা আগেই বলেছি। কিন্তু কেউ যদি বলে, আমি লেখক, লেখকসত্ত্বা রক্ষার জন্য সোসাল কমিটমেন্ট বা নিজের সাথে নিজের প্রতিজ্ঞার বিষয় আমার থাকতে নাই। তবে এটা হবে একটা অপ্রয়োজনীয় জাষ্টিফিকেশন এবং তা বেঠিকও বটে। সোসাল কমিটমেন্ট বা নিজের সাথে নিজের প্রতিজ্ঞার বিষয় না থাকলে কোন লেখককে বাইরের কেউ মুগুর ধরতে পারে না ফলে জাষ্টিফিকেশনটাই অপ্রয়োজনীয়।

আবার, সোসাল কমিটমেন্ট বা নিজের সাথে নিজের প্রতিজ্ঞা থাকার সাথে লেখকসত্ত্বা বিরোধাত্মক - এমন ধরণার কোন ভিত্তি নাই। তবে হাসান যেটা ধরে নিয়ে একটা ইঙ্গিত রেখেছে ওর মুল পয়েন্ট হল, লেখকের তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাস ও সোসাল কমিটমেন্টের অধীনে তাঁর চিন্তা করার ক্ষমতা বা লেখকস্বত্ত্বাকে অধীনস্ত না করলেই হলো। ফলে নিজের সাথে নিজের প্রতিজ্ঞাবদ্ধতাও (যদি সে করতে চায়) সে থাকতে পারে আবার লিজের লেখকসত্ত্বায় লেখককেও বাঁচিয়ে রাখতে পারে। ফলে হাসান , লেখকসত্ত্বা বজায় রাখতে পারে আবার একইসাথে যদি চায় নিজের সাথে নিজের প্রতিজ্ঞাও রাখতে পারে। এবং গুরুত্ত্বপূর্ণ হলো কোন কমিটমেন্টের মুগুর হাসানের উপর কেউ ধরতে পারে না।

৪. যারা কমিটমেন্ট, পার্টি সাহিত্য বিষয়ে ১৯০৫ সালের লেনিনের এক লেখা প্রসঙ্গের ভিতরে আরও ঢুকতে চান আগ্রহী সেসব পাঠকের কেবল একটা খেই ধরিয়ে দেবার জন্য এই পয়েন্ট। অন্যদের জন্য এটা জরুরী নয়। তাদের এখানে এসে এসব পুরানো কমিউনিষ্ট তর্ক ঢুকে পড়ে বিরক্তবোধ করার দরকার নাই। লেনিন পার্টি সাহিত্যের পক্ষে ছিলেন; সমাজে সাহিত্য চর্চা হতে হবে পার্টির চিন্তাভাবনা অধীনে থেকে - লেনিনের বরাতে এমন একটা দাবী কমিউনিষ্টদের মধ্যে ছিল। এর জের এখনও অনেকে বহন করেন।

সামাজিক দায়বদ্ধতার কথাটাকেও এদের কেউ কেউ তুলেন এখানে দাঁড়িয়ে। কোন পাঠক আগ্রহী হলে মন্তব্য জবাবে সেসব কথা তুলা যেতে পারে। এখানে তুললাম না।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।