আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ধোঁয়াটে নেশার আখ্যান

'গড়গড়ার মা-লো, তোর গড়গড়াটা কই! হালের গরু বাঘে খেয়েছে পিঁপড়ে টানে মই'। ছেলেবেলায় পড়া ছড়াটা এখনও অনেকেরই মুখস্থ। কিন্তু কতজন ভেবে দেখেছেন ছড়ায় বলা ‘গড়গড়া’-র কথা? কোন সে ছেলে যার নাম ‘গড়গড়া’? আসলে নাম তো হয়েছে ছেলের নেশা থেকে। অবস্থা সম্পন্ন চাষি ক্ষেত উপচে পড়া ফসল দেখে নিশ্চিন্তে গড়গড়া বা হুঁকোয় দম টানে। পরিচিত এই দৃশ্য থেকে গ্রামের ছেলেরা ঠাট্টা করে তার নাম রাখে ‘গড়গড়া’।

গ্রামের মানুষের মধ্যে এখনও সেই থেলো হুঁকোয় তামাক খাওয়ার চল রয়েছে। নারকেলের খোলের সঙ্গে আড়াআড়ি নলের আগায় তামাক রাখার ছোট পাত্র আর তার ওপর পোড়ামাটির খুদে মালসায় টিকলি জ্বালানোর ব্যবস্থা। নারকেল মালার অন্য এক দিকে অপেক্ষাকৃত খাটো নল জুড়ে দেয়া। টিকলির আগুনে তামাক তেতে উঠলে তার নিচের নল বেয়ে ধোঁওয়া নামে। সে ধোঁওয়া নারকেলের খোলের ভেতরে থাকা জলে পরিশুদ্ধ হয়।

ছোট নলের মুখে ঠোঁট চেপে টানতে হয় সেই পরিশুদ্ধ ধোঁয়া ! হুঁকো নিয়ে আধুনিক ভারতের ‌'স্বামী' বিবেকানন্দের শৈশবের এক গল্প অনেকেরই জানা। তার বাবার কাছে নিত্যই যাতায়াত ছিল নানা সম্প্রদায়ভুক্ত ও বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মক্কেলের। জাতি-ধর্মের বিচারে এঁদের প্রত্যেকের জন্য আলাদা হুঁকোর ব্যবস্থা ছিল। বালক নরেন্দ্রনাথ একদিন প্রত্যেকটা হুঁকোয় টান মেরে পরীক্ষা করে দেখতে চেয়েছিলেন, অন্য জাতের মানুষের হুঁকো ব্যবহার করলে জাত-কুল বিসর্জন যায় কি না ! =>কলকাতার দেউলটির বাড়িতে রাখা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের গড়গড়া। গ্রাম্য জীবনে হুঁকোর চল প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে।

ইউরোপীয় ঐতিহাসিকরা প্রচার করেন, তামাক আবিষ্কৃত হয়েছিল আমেরিকায়। নৃতত্ব কিন্তু সে দাবি সমর্থন করে না। উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রাচীন সেমা নাগা উপজাতীয়রা যে দেশি হুঁকোয় তামাক খান তার নাম ‘তসুনকুবা’। তিন টুকরো বাঁশ দিয়ে তৈরি এই ধূমপান যন্ত্রের মধ্যমণি বাঁশের চোঙ বা খোল। এতে জল থাকে।

তার সঙ্গে লাগানো থাকে একটা নল আর ওপরের তামাকপাত্র। উল্লেখ্য, পর্তুগিজরা ভারতে জাহাজ ভেড়াবার কয়েক হাজার বছর আগে থেকেই এই অঞ্চলে ধূমপানের অভ্যাস চালু ছিল। ভারতীয় আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে ধূমপানের উপকারিতা সম্পর্কে বৈদ্যরাজ চরক বলেছেন, ‘স্নাত্বা ভুক্তা সমুল্লিখ্য ক্ষুত্বা দন্তান বিঘৃষ্য চ। নাবনাঞ্জুন নিদ্রান্তে চাত্মবান ধুমপো ভবেৎ। ।

' অর্থাৎ, স্নানের পর, ভোজনের পর, বমি হলে, হাঁচি হলে দাঁত ধুয়ে নস্যি দিয়ে শির বিরেচনান্তে, ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে ধূমপান করবে। অমোঘবাণীটি গাঁজা-গুলি বলে মনে হলেও,একটা কথা বলা দরকার,চরক সমন্ধে কিংবদন্তি বলে-সেই যুগে ভারতবর্ষে তিনিই নাকি সম্পুর্ন ১০০% খাদহীন তরল স্বর্ণ বানানোর কৌশল আবিষ্কার করেছিলেন! সে যাই হোক,হুঁকো সাধারণের ব্যবহার্য। কিন্তু গড়গড়া বা আলবোলা আভিজাত্যের প্রতীক। ইতিহাস বলছে,অবিভক্ত বাংলার ধনী সমাজে প্রথম গড়গড়ার চল হয় আকবরি আমলে। এর আগেই অবশ্য পারস্য ও মধ্যপ্রাচ্যে প্রবল জনপ্রিয়তা লাভ করে ধূমপানের এই রীতি।

পারস্যে গড়গড়ার নাম ‘গলিয়াঁ’। মিশর ও মধ্যপ্রাচ্যে তার পরিচিতি ‘সিসা’ নামে। আবার,তুর্কিরা ডাকে ‘নারগিলে'। পণ্ডিতরা বলেন, প্রাচীন কালে ব্যবহৃত নারকেল মালার হুঁকোর চল ছিল এই অঞ্চলেও। সংস্কৃতে নারকেল-কে বলা হয় নারিকেল।

তার থেকেই পরবর্তীকালে ‘নারগিলে’ নামের উৎপত্তি। মুঘল বাদশা আকবরের দরবারে এর আবির্ভাব পারস্যজাত হাকিম আবুল ফথ্ গিলানির সৌজন্যে । কথিত আছে, এর আগে ভারতবর্ষের মানুষ ধূমপান করতো ছিলিমের সাহায্যে। মুঘল মন্ত্রী-আমলাদের মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত ধূমপানের প্রভাব লক্ষ্য করে গিলানি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। শেষে ধোঁয়া পরিশুদ্ধ করতে তিনিই প্রথম জলের মধ্যে দিয়ে ধোঁওয়া চালান করার কৌশল আবিষ্কার করেন।

নন্-স্মোকার বাদশার মনোরঞ্জনের জন্য জলভরা পাত্রে তামাকের ধোঁওয়া নল দিয়ে প্রবেশ করিয়ে তা শুদ্ধ ও ঠান্ডা করার কায়দা চালু করেন গিলানি। জলের মধ্যে দিয়ে ধোঁওয়া চলাচলের সময় যে শব্দ তৈরি হয়, তা থেকেই এর নাম হয় ‘আলবোলা’, ‘গুড়গুড়া’ বা গড়গড়া। গোটা বিশ্বে হুঁকো বা হুক্কার নাম ছড়িয়ে দেওয়ার কৃতিত্ব অবশ্যই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে কলকাতায় পা-দেওয়া ইংরেজ কেরানিদের অবসর যাপনের অন্যতম উপাদান হয়ে ওঠে এই ধোঁওয়া যন্ত্র। ১৭৭৫ সালে শহরে পা রাখার পর হুঁকোর সঙ্গে প্রথম মোলাকাত হয় উইলিয়াম হিকির।

এর উল্লেখ মেলে তার রেখায়। হিকি জানিয়েছেন, 'আমার জন্য উঁচু মানের একটি সুন্দর হুক্কা সাজানো হল। কিন্তু চেষ্টা করেও তার স্বাদের তারিফ করতে পারলাম না। বাধ্য হয়ে জানতে চাইলাম, এটা কি না খেলেই নয়? গম্ভীর ভাবে পারিষদ জানালেন, উপায় নেই। সমাজে কেতাদুরস্ত হতে গেলে ধূমপান আবশ্যিক।

এখানে প্রায় সকলেই হুক্কা ব্যবহার করে। অনেকেরই মত, নৈশাহার না জুটলে পরোয়া নেই, কিন্তু তারপর ধূমপানের বন্দোবস্ত না থাকলে সব মাটি। ' কোম্পানির আমলে চাকর-বাকরের বহর ছিল দেখার মতো। সেকালে হুঁকোর দেখভাল করার দায়িত্ব বর্তাত হুঁকোবরদারের ওপর। দুপুরবেলা খাওয়া সেরে গড়গড়ায় টান দিতে দিতে বিশ্রাম নিতেন সাগরপারের যুবক কেরানি বা রাইটার।

এদিকে সাহেবের লাঞ্চ শেষ হওয়ার আগেই গড়গড়ায় তামাক সাজতে বসত নফর। আর সে তামাক সাজানো ছিল এক এলাহি কান্ড। গোড়ার দিকে গড়গড়ার মুখে আগুন জ্বালাতে ব্যবহৃত হত কাঠকয়লা। ১৮৭২-৭৩ সাল নাগাদ মানিকতলার মুসলমান কারিগররা কাঠকয়লার গুঁড়োর সঙ্গে নানা উপকরণ মিশিয়ে বাজারে ‘টিকলি’-র প্রচলন করেন। স্থানীয়রা তার নাম দিলেন 'কালো বাতাসা'।

শুরুতে হিন্দুরা জাত হারানোর ভয়ে না ছুঁলেও ক্রমেই সমাজে তার ব্যবহার বাড়তে থাকে। শেষে কট্টর হিন্দু বাবুরাও বৈঠকখানাতে আলবোলায় অগ্নি সংযোগ করতে মুসলমানদের টিকলির সাহায্য নিতেন। ততদিনে অবশ্য দস্তুরমতো শৌখিন হয়ে উঠেছে ধূমপানের আয়োজন। জমিদার প্রথার উৎপত্তির সঙ্গে সঙ্গে বাংলার সাবেক হুঁকোর জায়গা দখল করে বনেদি গড়গড়া। নারকেলের মালার বদলে ব্যবহার হতে শুরু করে কাচ বা পিতলের জলদানি।

ধনীরা অবশ্য রূপোর পাত্রে গোলাপজলে শোধিত তামাকের ধোঁওয়া সোনার নল দিয়ে টানতেন। বাবু সমাজে ফরাস, ঝাড়বাতি, আতরের সঙ্গেই অনায়াস সহাবস্থান ছিল গড়গড়ার। সত্যজিৎ রায়ের ‘জলসাঘর’ ছবিতে গড়গড়ায় টান দিতে দেখা গিয়েছিল জমিদাররূপী ছবি বিশ্বাসকে। ‘সন্যাসী রাজা’ ছবির গানের দৃশ্যেও রাজার ভূমিকায় উত্তমকুমারের বৈঠকখানায় দেখা গিয়েছে আলবোলা। আর ঢালিউডে 'চাঁপা ডাঙ্গার বউ' যারা দেখেছেন তাদের অনেকেরই মনেই দাগ কেটেছে,এটিএম শামসুজ্জামানের ধোঁয়া ছাড়ার কৌশলটি।

গ্রাম্য কৃষক বা হাটুরে কাজের ফাঁকে বা পথচলার মাঝে বিশ্রাম নিতে যে হুঁকো ব্যবহার করেন, তার তামাক স্বাভাবিক ভাবেই নিম্ন মানের। দামও কম। কিন্তু বিত্তবানের গড়গড়া সাজতে প্রয়োজন হয় খানদানি তামাকের। গুলশানের দুটি দোকান ছাড়া ঢাকায় মিঠে তামাকের আদি মজুতদার নেই বললেই চলে। মাঝে-মধ্যে নিউমার্কেটের কিছু দোকানে মিলে থাকে।

প্রধানত দু' ধরনের তামাকের চলন রয়েছে এদেশে। ‘অম্বরী’ বা ‘অম্বুরী’ তামাকের দাম সবচেয়ে বেশি। আদিকালে মিশর-পারস্য-তুরস্কের শৌখিন রইসদের পছন্দ এই তামাক সুবাসিত করতে ব্যবহার করা হত এক জাতের তিমির পেটে জমা হওয়া প্রাকৃতিক সুগন্ধী। সে দিন ফুরিয়েছে বহুকাল। এখন অম্বুরী তামাকে গন্ধ আনতে দামি আতর বা মশলা ব্যবহার করাই প্রথা।

জনপ্রিয় ফ্লেভার মোটামুটি ৪ রকম- শমামা, কেওড়া, হেনা এবং কস্তূরী। অম্বুরী তামাকের দাম প্রতি তোলায় ১ হাজার টাকা থেকে শুরু। অম্বুরীর চেয়ে ‘বালাখানা’ তামাকের দাম তুলনামূলক কম। এর সুগন্ধ তৈরি হয় লবঙ্গ, এলাচ, জাফরান বা নানারকম ফলের সাহায্যে। সস্তার বালাখানা মিলবে তোলা প্রতি ৮০ থেকে ২০০ টাকার মধ্যে।

তবে সুপারফাইন বালাখানার দামও ২ হাজার টাকা তোলা। গড়গড়ায় ব্যবহার্য তামাককে বলা হয় 'খামিরা তাম্বাকু'। কলা, আম, বেল, টোপাকুল অথবা আনারসের মতো ফলের নরম শাঁসের সঙ্গে জারিত হয় তামাক পাতা। ১৫-৩০ দিন মাটির মালসা বা সিমেন্টের চৌবাচ্চায় পচতে দেওয়া হয় সেই মিশ্রণ। এরপর তা শুকিয়ে আনা হয় বাজারে।

অবিভক্ত বাংলার সাবেক কলকাতায় বনেদি ক্লাবগুলিতে একদা প্রচলন ছিল গড়গড়া সেবনের। এমনকি লাটভবনেও দাপটে রাজত্ব করেছে হুক্কা। ১৮৩৯ সালে ব্রিটিশ শাসিত ভারতের প্রধান সেনাপতির স্ত্রী লেডি ন্যুজেন্টের লেখনীতে সে বিবরণ পাওয়া যায়। সে যুগে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রকাশ্যে ধূমপানের রেওয়াজ চালু ছিল। শৌখিন হুঁকোখোররা অনেকেই তাঁদের নিজস্ব হুঁকোবরদারদের নিয়ে চলাফেরা করতেন।

আত্মীয়-বন্ধুর বাড়ি নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গেলেও সঙ্গে থাকত পেয়ারের তামাক সেজে দেওয়ার চাকর। আধুনিক যুগে হুক্কা বারের প্রচলন হয়েছে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল ছাড়াও বিশ্বের বহু শহরেই। খোদ ঢাকাতেই ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে অনেক হুঁকো বার। নবীন প্রজন্মের কাছে গড়গড়ায় তামাক সেবনের অভিজ্ঞতা পৌঁছে দিতে সম্ভবত ২০০৬ সালে এই হুঁকোর ঠেকের আত্মপ্রকাশ। গড়গড়ায় বিভিন্ন ফল-ফুলের গন্ধমাখা, মধুমিশ্রিত তামাক সেবন করার আরও বেশ কিছু আড্ডা পরবর্তী কালে গজিয়ে ওঠে শহরের নানা প্রান্তে।

সিগারেটের মতো যখন-তখন ফস করে জ্বেলে নেওয়ার বাতিক আলবোলা-প্রেমীদের ধাতে সয় না। ধীরে-সুস্থে আরাম করে বসে গড়গড়ার নলে মৃদু-মন্দ টান দেওয়াই দস্তুর। রসিকজনেরা বলেন, এতে শরীর ও মন, দুটোই ঠান্ডা হয়। আর কে না জানে,পেঁয়াজ ও কালিজিরা খাওয়া বাঙ্গালীর মাথা ঠান্ডা রাখতে ঈশ্বরকে কতই না কষ্ট করতে হয় ! তাই হয়তো,ভেবেচিন্তে ধরাধমে হুঁকো পাঠিয়ে ঈশ্বর চেয়েছেন তার সময় বাঁচাতে ! ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১২ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।